প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৪

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৪
Writer Mahfuza Akter

“তরী মেয়েটা অনেক ইনোসেন্ট। দেখলেই বোঝা যায় যে, নিষ্পাপ একটা মেয়ে। ওকে তুমি এভাবে ধোঁকা দিচ্ছো! মেয়েটা জানলে সহ্য করতে পারবে তো!”
কথাটা শুনেই সৌহার্দ্যের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। সে ক্রোধান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে। ড. আরমান যেন সৌহার্দ্যের রাগী মুখশ্রী দেখে বেশ আনন্দ পাচ্ছেন। তাঁর ব্যাঙ্গাত্মক হাসিতে মিশে থাকা পৈশাচিক আনন্দটুকু সৌহার্দ্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু সে কিছু বলছে না। তার তো বলার মতো কিছুই নেই!

ড. আরমান টেবিলে থাকে পেপারওয়েটটা দক্ষ হাতে ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন,
“আমি আগেই বলেছিলাম তোমাকে, এইসব প্রেম-ভালোবাসা বলতে কিছু নেই। যেটাকে মানুষ প্রেম-ভালোবাসা-মায়া বলে, এগুলো শুধুই ফেসিন্যেশান। আসলে লাইফে ফেইম এন্ড প্রোস্পারিটি-ই সব।”
সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আপনি এসব আমাকে কেন বলছেন? এগুলো আমি ভালো করেই জানি।”
ড. আরমান সশব্দে হাসলেন। তার খিটখিটে হাসির শব্দে সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকালো। ড. আরমান হাসতে হাসতেই বললেন,

“তুমি শুধু এসব জানোই না! তুমি তো আমার থেকেও দুই কাঠি ওপরে। আমি ভাবতেও পারিনি তুমি নিজেকে এতোটা ভালোবাসো। স্বার্থপরতায় তো তুমি আমাকেও পেছনে ফেলে দিলে! ইট’স রিয়েলি আমেইজিং টু ওয়ার্ক উইদ ইউ, ইজে’ন্ট ইট?”
“আপনি এখানে আমাকে বিদ্রুপ করতে এসেছেন?”

“নো! নো! নট এট অল!! আমি তো তোমায় এখানে ওয়েলকাম করতে এলাম। কালকে রিসার্চ সেন্টারেও সবাইকে তোমার গুণগান শোনাবো। আজ তাহলে আসি।”
ড. আরমান হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন। সৌহার্দ্য অনুভূতিহীন চোখে তাঁর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে সে পরবর্তী পদক্ষেপের ছক আঁকছে। কিন্তু আপাতত এপয়েন্টমেন্ট-গুলো ক্লিয়ার করা জরুরি। তাই পিয়নকে কল দিলো।

ভোর হতে না হতেই আহমেদ ভবনের সামনে গাড়ি এসে থামলো। আফনাদ হক ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, গাড়িটা সৌহার্দ্য পাঠিয়েছে। মধু আর মালিহা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। মালিহা ব্যাকুল হয়ে কারো সাথে কোনো কথাবার্তা না বলেই দ্রুত গাড়িতে উঠে বসলো। মধু অবাক হলেও কিছু বললো না। সে বুঝে উঠতে পারে না, মালিহা কেন তরীর প্রতি এতোটা দূর্বল! অরুণী তো তার নিজের মেয়ে! তবুও অরুনীর জন্য এতো টান হয়তো মালিহার মনে নেই, যতটা তরীর জন্য আছে। এদিকে তরীর মা মোহনার তো কোনো হেলদোল-ই নেই! মধু হাজার ভেবেও কোনো আগামাথা খুঁজে পায় না। প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে মধু সবাইকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।

গাড়িটা ধোঁয়া উড়িয়ে যখন তাদের দৃষ্টিসীমা পেরিয়ে যেতে লাগলো, তখন রায়হান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“যাক! সুজাতা এখন বাড়ি ফিরলেও তেমন চিন্তা করার কিছু নেই। মালিহা বাড়িতে থাকলে ভয়ে ভয়ে থাকতে হতো আমায়।”
আফনাদ হক কিছুটা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,

“মালিহা ভাবী তো আগে এমন ছিলেন না! তোমার কি মনে হচ্ছে না যে, তিনি দিন দিন অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে যাচ্ছেন? ওনার রাগ আর আক্রোশ দেখলে মনে হয় না যে, উনি রেগে গেলে নিজের মধ্যে থাকেন! মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত উনি।”

“এখন কী আর করার! তরীকে দেখলে যদি একটু শান্ত হয়!”
আফনা বেগম বিড়বিড় করে বললেন,
“যার স্বামী-সন্তান থাইকাও নাই, সে মানসিকভাবে কেমনে সুস্থ থাকবো!”

তরী কোচিং শেষে বিকেলের দিকে একা একা-ই বাড়ি ফিরলো। সৌহার্দ্য চিনিয়ে দেওয়ার পর তরী এখন নিজেই রিকশা নিয়ে চলে আসতে পারে। ফ্ল্যাটের সামনে এসে দরজার লকে চাবি ঘোরাতে গিয়ে অবাক হলো সে। দরজা ভেতর থেকে আটকানো। কিন্তু এই মুহুর্তে কে বাড়িতে থাকবে? সৌহার্দ্য তাড়াতাড়ি ফিরলে তো তাকে সাথে নিয়েই ফিরতো। ভয়ে ভয়ে সে কলিং বেল বাজালো। সাথে সাথেই দরজা খুলে গেল। ভেতরে তাকিয়ে তরীর চক্ষু চড়কগাছ! হতভম্ব হয়ে বললো,

“মধু!! তুই!!”
মধু কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরলো তরীকে। তরী এখনও অবাকতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। বিস্মিত চোখে তাকিয়েই বললো,
“তুই কীভাবে এখানে এলি? একাই এসেছিস?”
মধু নাক টানতে টানতে বললো,
“ভাইয়া গাড়ি পাঠিয়েছিল। ছোট-মাও এসেছে।”

মালিহার আগমনের কথা শুনে তরী দ্রুত ভেতরে এসে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। মধু হেসে বললো,
“এখানে নেই। ঐ কর্ণারের রুমে ঘুমাচ্ছে। দুপুরে কোনোমতে খাইয়ে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি।”
তরীর চোখ পানিতে টলমল করে উঠলো। মালিহার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার শিয়রের কাছে বসলো সে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মালিহার ফ্যাকাসে মুখটা দেখতে লাগলো। সেই পুরোনো মা-মা গন্ধটা নাকে লাগছে। তরী আনন্দে চোখ বুজে ফেললো।

রাতে সৌহার্দ্য যখন বাসায় ফিরলো, মালিহা তখনও ঘুম থেকে উঠেনি। মধু সৌহার্দ্যকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো। মধুর চোখের পানিতে সৌহার্দ্যের শার্ট ভিজে যাচ্ছে দেখে সৌহার্দ্য হেসে উঠে বললো,
“এই তুই এতো ছিচকাঁদুনে কবে থেকে হলি? তোকে তো আমি সারাক্ষণ বাঁদড়ামো করতে দেখি। কান্নাকাটি তো তোকে করতেই দেখি না!”
মধু চোখ মুছতে মুছতে বললো,

“তো তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসবে, আর আমি কাঁদবো না? আমি তো ভেবেছি তোমাকে আর কখনো দেখতেই পাবো না আমি!”
সৌহার্দ্য মধুর নাক টেনে বললো,
“এখন তো দেখতেই পাচ্ছিস! এখন কান্নাকাটি থামিয়ে যা ছোট-মাকে ঘুম থেকে তোল। রাতের খাবার খাবো একসাথে।”

সৌহার্দ্য ঘরে এসে দেখলো, তরী মনযোগী ভঙ্গিতে পড়ার টেবিল গোছাচ্ছে। সৌহার্দ্য হালকা কাশি দিয়ে নিজের আগমন জানালো। তরী সৌহার্দ্যকে দেখে চমৎকারভাবে হেসে বললো,
“আপনি চলে এসেছেন? এতো তাড়াতাড়ি!!”
সৌহার্দ্য তরীর হাসি দেখে কিছুটা অবাক হলো। এতো দিনে এই প্রথম তরীকে প্রাণখুলে হাসতে দেখলো সে। অবাকতা আড়াল করার চেষ্টা করে বললো,

“হু। মধু আর ছোট-মা এসেছে, তাই একটু তাড়াতাড়ি ফিরলাম।”
বলেই সৌহার্দ্য ফ্রেশ হতে চলে গেল। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সৌহার্দ্য টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
“তোমার পড়াশোনা ঠিক মতো চলছে, চাঁদ?”
“হ্যাঁ। একটু পিছিয়ে পড়েছি যদিও! তবে আমি পুষিয়ে নেবো।”
সৌহার্দ্য ইতস্তত করে বললো,

“হুম! আমার মনে হয়, আমি এই রুমে থাকলে তোমার পড়াশোনায় সমস্যা হবে।”
তরী কথাটার মানে বুঝতে না পেরে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে ঘনঘন পলক ফেলতে ফেলতে বললো,
“মানে?”
“মানে হচ্ছে তোমার পড়াশোনা থাকে আর আমার রিসার্চের কাজ থাকে। আমার মনে হয় আমাদের আলাদা রুমে থাকা উচিত।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৩

সৌহার্দ্য কথাটা বলে তরীর দিকে না আর তাকালো না। ধুপধাপ পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তরী হতবিহ্বল চোখে সৌহার্দ্যের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৪(২)