মনে পড়ে তোমায় সন্ধ্যে বেলায় শেষ পর্ব 

মনে পড়ে তোমায় সন্ধ্যে বেলায় শেষ পর্ব 
নুজাইফা নূন

-“উৎস ফারুক চৌধুরীর সাথে মিটিং শেষ করে নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে থাকে। তাদের আলাপচারিতার মধ্যে নাতাশা সেখানে এসে উপস্থিত হয়। নাতাশা কে দেখে ফারুক চৌধুরী বললো,
-” কিছু বলবে মামনী?”
-” আচ্ছা পাপা মম সবসময় ম্যামের সাথে এতো খারাপ ব্যবহার কেন করে বলো তো? ম্যাম কতো ভালো একটা মেয়ে। অথচ মম সবসময় ম্যাম কে বাজে কথা বলে।”

-” কেন মা ? কি হয়েছে??”
-” ম্যাম বারবার বলেছে সে আজকে পড়াতে আসতে পারবে না। কিন্তু মম এটা কিছুতেই মানতে রাজি নন। একদিন না পড়লে কি এমন ক্ষতি হতো বলো তো পাপা?হয়তো ম্যাম অসুস্থ্য। এজন্যই তিনি আসতে চাইছেন না‌।”
-” তুমি বরং আদ্রিকে কল দিয়ে বলে দাও যে আজকে তার পড়াতে আসতে হবে না।পাপা না করে দিয়েছে।”
-” আদ্রি নামটা শোনা মাত্রই চমকে উঠে উৎস।উৎস গল্পে গল্পে ফারুক চৌধুরী কে বললো,
-” এই আদ্রি টা কে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” আদ্রিকা খন্দকার। নাতাশার হোম টিউটর।খুব‌ই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। অনেক সহজ, সরল ভদ্র মেয়েটা। পার্সোনাল ভাবে তাকে আমার খুবই ভালো লাগে। কিন্তু আমার ওয়াইফ কেন জানি মেয়েটাকে পছন্দ করেন না।”
-” ফারুক চৌধুরীর কথা শুনে উৎসের বুঝতে বাকি রইলো না তিনি ঠিক কার কথা বলছেন ‌।উৎস তবু ও শিওর হ‌ওয়ার জন্য বললো,

-” আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি একটা কথা বলতে পারি?”
-” অবশ্যই।”
-” এই আদ্রির কোনো ছবি হবে ? না মানে আমি একজন আদ্রি কে চিনি।সেই আদ্রি আর এই আদ্রি একজন কিনা সেটাই দেখবো ।”

-” উৎসের কথা শোনা মাত্রই নাতাশা তার ফোন থেকে আদ্রির একটা ছবি বের করে উৎসের হাতে দিলো।ছবিটা দেখা মাত্রই উৎসের হার্ট বিট বেড়ে গেলো। তার হাত কাঁপতে শুরু করলো।উৎস মনে মনে বললো, এটাই তো আমার সন্ধ্যে কন্যা।তার মানে সেদিন সন্ধ্যে বেলায় আমি আদ্রি কে দেখেছিলাম।আদি কে নয়।আদি আমাকে মিথ্যা বলেছে ।ঠকিয়েছে আমাকে।আর আমি কিনা আদ্রি কে ভুল বুঝলাম। আমি কিভাবে আমার ভালোবাসা কে চিনতে পারলাম না?এখন আমি আদ্রির মুখোমুখি কিভাবে দাঁড়াবো? আমার এই ভুলের জন্য আমি কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।”

-“আদ্রি নাতাশা কে পড়ানোর জন্য তাদের বাড়ি এসে ড্রয়িং রুমে উৎস কে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।সে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই উৎস এসে আদ্রি কে জড়িয়ে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় আদ্রি‌।আদ্রি মনে করে উৎস হয়তো তাকে আদিতা ভেবে জড়িয়ে ধরেছে। এজন্যই সে উৎসের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,

-” আপনি আবারো ভুল করছেন উৎস।আমি আদিতা না।আদ্রি।”
-” আমি জানি তুমি আদ্রি‌।সাথে এটাও জানি তুমিই আমার সন্ধ্যে কন্যা।যার সাথে এক সন্ধ্যে বেলায় এই চোধুরী ভিলায় আমার দেখা হয়েছিলো।”
-” এসব আপনি কি বলছেন উৎস? ”

-” তুমি যে আমার সন্ধ্যে কন্যা, এটা তুমি জানার পরেও এতো বড় একটা সত্যি আমার থেকে কেনো লুকিয়ে গেলে আদ্রি ? কেনো আমাকে তিলে তিলে পুড়িয়ে মা’র’লে ? বুঝতে পেরেছি।আমি তোমাকে না চিনে কষ্ট দিয়েছিলাম। এজন্যই তুমি আমার উপর প্রতিশোধ নিলে তাই না?”

-” আদ্রি ঠিক কি উত্তর দিবে জানা নেই তার।সে তো নিজেও জানতো না সেই উৎসের সন্ধ্যে কন্যা।উৎস যে মেয়েটা কে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে সেই মেয়েটা আদি নয় , বরং সে নিজেই।আদ্রি কি বলবে বুঝতে না পেরে বললো, আমি নিজেও জানতাম না আমিই আপনার সন্ধ্যে কন্যা।আদি আমাকে বলেছিলো আদির সাথে ও কোনো এক সন্ধ্যে বেলায় আপনার দেখা হয়েছিল। এজন্যই আপনি আদি কে সন্ধ্যে কন্যা বলে ডাকেন।”

-” জানো আদ্রি আমি না অনেক বোকা।তোমার বোন টা আমাকে কতো সহজে বোকা বানিয়েছে।তোমার সাথে যখন আমার দেখা তখনি তোমার মায়াবী চোখের মায়ায় পড়ে যাই আমি। কিন্তু তোমার নাম , পরিচয় কিছুই জানা ছিলো না আমার।আমি পরের দিন আবারো সেই জায়গায় ছুটে আসি।যেখানে তোমার আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ‌। ঠিক তখনি আমি তোমার মতো কালো বোরকা পরা একটা মেয়েকে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখি।

দারোয়ান আঙ্কেল এর কাছ থেকে জানতে পারি মেয়েটার নাম আদিতা। ব্যাস আমি সেদিন ই তোমাদের বাড়ি তে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাই। কিন্তু প্রথম থেকেই আদি কে নিয়ে আমার মনে সন্দেহ জেগেছিলো।আবার এটাও মনে হচ্ছিলো, হয়তো সবটা আমার মনের ভুল। তবে আজ বুঝতে পারছি আমি সঠিক ছিলাম‌।আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি।তোমাকে অপমান, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছি‌‌।আমি খাঁটি সোনা চিনতে ভুল করেছিলাম ‌।আমি জানি আমি যা করেছি।সেটা ক্ষমার অযোগ্য। তবুও বলছি পারলে আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও বলেই উৎস আদ্রির পা জড়িয়ে ধরলো।আদ্রি তৎক্ষণাৎ নিজের পা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

-” ছিঃ ছিঃ এসব আপনি কি করছেন উৎস? আপনি মানুন বা না মানুন আমি আপনাকে আমার স্বামী হিসেবে মনে প্রাণে বিশ্বাস করি‌।আপনার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই আমার।আপনি আমার সাথে যা যা খারাপ করেছেন,সেসব না হয় আমাকে একটু ভালোবেসে উষুল করে দিবেন।”
-” উৎস তৎক্ষণাৎ আদ্রি কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, তোমাকে আর কোনো কষ্ট দিবো না আমি।আজ থেকে তোমার সুখের দিন শুরু হলো।কথা দিচ্ছি আমি বেঁচে থাকতে তোমার চোখে পানি আসতে দিবো না। নতুন করে সবটা শুরু করবো আমরা।দেখো আমরা অনেক ভালো থাকবো।অনেক।”

-” ভাইয়া তুমি রোজ সন্ধ্যে বেলায় এখানে এসে চোখের পানি কেন ফেলো বলো তো? যা হবার হয়ে গিয়েছে। তুমি হাজার চোখের পানি ফেললে , কান্না করলেও যে চলে গিয়েছে ‌।সে আর ফিরে আসবে না ভাইয়া। তুমি কেনো বুঝতে চাইছো না ভাবিমণি আমাদের মাঝে নেই।আজ‌ থেকে পাঁচ বছর আগেই সে মা’রা গিয়েছে। তুমি কি ভুলে গিয়েছো সেই দিন টার কথা?”

-” সে দিনটার কথা আমি চাইলেও ভুলতে পারি না উপমা।সেদিন ই আমি জানতে পেরেছিলাম আদ্রিই আমার সন্ধ্যে কন্যা।আমরা নতুন করে বাঁচার অঙ্গীকার করেছিলাম।বিয়ের পর প্রথম বার কিছু সময় দুজন একান্তে কাটিয়েছিলাম।দুজনে মিলে আড্ডা , খাওয়া দাওয়া,শপিং শেষ করে গাড়িতে বসার পর দেখি আমার পকেটে ফোন নেই।আমার ফোন ভুলে কোনো দোকানে রেখে চলে এসেছিলাম।আমি আদ্রি কে গাড়িতে বসিয়ে রেখে আবারো শপিং মলে গিয়েছিলাম।

মলের বেশ খানিকটা দূরে আমার গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম।আমি মল থেকে বের হতেই দেখি দেখি রাস্তায় আনুমানিক চার বছরের একটা বাচ্চা ছেলে কান্না করছে‌। আর দূর হতে একটা ব্রেকফেল করা মালবাহী গাড়ি বাচ্চাটার দিকে ধেয়ে আসছে।আদ্রি হয়তো সেটা দেখেই বাচ্চা ছেলে টাকে বাঁচাতে গিয়েছিলো। কিন্তু মেয়েটা তাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ টায় দিয়ে দিলো।

আদ্রি ছেলেটা কে কোলে নিয়ে দৌড় দিতে গেলেই বোরকার সাথে বেঁধে রাস্তায় পড়ে যায়।যার ফলস্বরূপ বাচ্চা ছেলে টা দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে।ভাগ্যক্রমে ছেলেটা বেঁচে গেলেও বেঁচে ফেরে নি আমার সন্ধ্যে কন্যা।আমি চিৎকার করে দৌড়ে এসে ও কিছু করতে পারি নি। চোখের সামনে মালবাহী গাড়ি টা আমার সন্ধ্যে কন্যার কোমল দেহ পিষে দিয়ে চলে যায়।আমি দৌড়ে গিয়ে আদ্রির মাথাটা আমার কোলের উপর রাখতেই আদ্রি কাঁপা কাঁপা স্বরে বলেছিলো,

-” আমাকে একবার ভালোবাসি বলবেন উৎস?আমি ভালোবাসি বলে আদ্রির কপালে চুমু দিতেই আদ্রি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।বিশ্বাস কর উপমা আমি যদি জানতাম আদ্রি কে ভালোবাসি কথাটা বললেই আদ্রি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে‌।তাহলে আমি কখনোই আদ্রি কে ভালোবাসি কথাটা বলতাম না।”
-” যা হবার হয়েছে ভাইয়া।এখন সেসব ভেবে কোনো লাভ নেই। তুমি বাসায় চলো তো।সবাই তোমার জন্য টেনশন করছে।”

মনে পড়ে তোমায় সন্ধ্যে বেলায় পর্ব ১২

-” তুই যা। আমি আমার সন্ধ্যে বেলা টা আমার সন্ধ্যে কন্যার সাথে কাটাতে চাই।”
-” উপমা জানে হাজার বার বললেও উৎস এখন বাসায় ফিরবে না। পাঁচ বছর যাবৎ তার বাসার সবাই এটা দেখে আসছে। উৎস রোজ সন্ধ্যে বেলায় আদ্রির কবরের পাশে বসে থাকে‌। নিজের মতো করেই বকবক করে।কখনো বা উচ্চস্বরে হেসে উঠে।কখনো বা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।তার মুখে সবসময় একটা কথায় আওড়াতে শোনা যায় #মনে_পড়ে_তোমায়_সন্ধ্যে_বেলায় ।

সমাপ্ত