প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩২

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩২
Writer Mahfuza Akter

ভোরের আলো ফুটতেই আহমেদ ভবনের সামনে দু’টো সাদা গাড়ি থামলো। গাড়ি দু’টোর উপরিভাগে এখনো বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। হয়তো রাতভর ভারী বর্ষণে গাড়ি চালিয়ে গ্রামে এসেছেন তারা। দুই গাড়ি থেকে একে একে রায়হান সাহেব এবং আফনাদ সাহেব বেরিয়ে এলেন। রায়হান সাহেবে মুখভঙ্গি গম্ভীর ও থমথমে। তিনি আসলে রেগে আছেন নাকি চিন্তায় আছেন, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অন্যদিকে আফনাদ সাহেব মুখভর্তি চিন্তার ছাপ, দৃষ্টিতে ব্যাকুলতা। তারা দু’জনে আহমেদ ভবনে প্রবেশ করার সময় আফনাদ কিছুটা আশা নিয়ে রায়হান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,

“সৌহার্দ্যের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছিস? কোথায় আছে ওরা দু’জন? কিছু কি জানা গেল?”
রায়হান সাহেব অতিশয় বিরক্তিমিশ্রিত মুখভঙ্গি করে বললেন,
“কিভাবে যোগাযোগ করবো? আমার ছেলে আমার নাম্বার সব জায়গা থেকে ব্লক করে রেখেছে। কোনো ছেলে কোনোদিন নিজের বাবাকে ব্লক করতে পারে? কত বড় বেয়াদব, অপদার্থ আর বেপরোয়া হলে কেউ এরকম কাজ করতে পারে আমি ভেবে পাচ্ছি না!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ব্যাপারটা হাস্যকর। অন্য সময় হলে আফনাদ হেসে হেসে পেটে খিল ধরিয়ে ফেলতেন। কিন্তু এখন তাঁর হাসি পাচ্ছে না। তরীর চিন্তায় ধরণীর কোনো কিছুই তাঁকে স্বস্তি দিচ্ছে না। এদিকে রায়হান সাহেবের মেজাজ চরম মাত্রায় বিগড়ে আছে। সৌহার্দ্যকে সে যতই কল-মেসেজ করছে, কিছুই সেন্ড হচ্ছে না। তাঁর দু’টো নাম্বার ব্লক করেছে। আফনাদের নাম্বার তো দূরের কথা, কোনো অপরিচিত নাম্বারের কলও ধরছে না। ছেলেকে নিয়ে রায়হান সাহেবের চিন্তা নেই। সৌহার্দ্য যেখানে খুশি যাক, তাঁর সেটা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু তরীকে নিয়ে চলে যাওয়ায় তিনি বিপাকে পড়েছেন। মেয়েটাকে নিয়ে কই গায়েব হয়েছে ছেলেটা কে জানে?

রায়হান ও আফনাদ সাহেব ভেতরে প্রবেশ করতেই আফনা বেগম লাঠি ভর দিয়ে এগিয়ে এলেন। তিনি যেন এতোক্ষণ অপেক্ষায় ছিলেন তাঁদের। মাকে দেখে রায়হান সাহেব প্রশ্ন করলেন,
“কীভাবে কী হলো, মা? এক রাতের মধ্যে এতো বড় ঘটনা ঘটে গেল আর তোমরা কেউ টেরও পেলে না?”
আফনা বেগম মুখ বি’কৃত করে বললেন,

“তোর বউ কাউকে টের পেতে দিলে তো টের পাবো! আমি ভাবতেও পারি নাই বড় বৌমা এতো জঘন্য একটা কাজ করতে পারবে! এখন বল, ওদের দুজনের কোনো খোঁজ পেয়েছিস?”
রায়হান সাহেব হতাশ হয়ে বললেন,

“এখন পর্যন্ত পাইনি। প্রহরের সাথেও যোগাযোগ করতে পারছি না। হয়তো সৌহার্দ্য ওকে নিষেধ করে দিয়েছে। আর তোমার নাতি কি কম চালাক নাকি? বিদেশের মাটিতে আট বছর থেকে এসেছে। এসেই গাড়ি কিনেছে, এপার্টমেন্টও কিনেছে থাকার জন্য শুনেছি। এখন ওখানেই আছে খুব সম্ভবত।”
আফনাদ হক আফনা বেগমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“চাচী মা, মালিহা ভাবী কোথায়? উনি কি ঠিক আছেন?”
“ডাক্তার ডাকিয়ে ঘুমের ইন*জেক*শন আর স্যালাইন দিতে হইছে। সামলানো যাচ্ছিলো না কোনো মতেই। এখনো ঘুমাইতেছে, মধু পাহারা দিতাছে।”

“আর সুজাতা ভাবী?”
আফনা বেগম বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“সে তো দোর দিছে কাল থেইকা! বাইর হইবার নাম নাই।”
আফনাদ হক অবাক হয়ে বললেন,
“সে কী! রায়হান, দরজা খোলার ব্যবস্থা করা উচিত।”
রায়হান সাহেব নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে বললো,

“আজাদকে নিয়ে গিয়ে দরজা ভাঙাও। আপাতত ওকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে না।”
আফনা বেগম চেয়ারে বসে বিড়বিড় করতে করতে বললো,
“ওর জন্য আমার নাতিটা বাড়ি ছাইড়া চইলা গেল মাঝরাতে। আমগো চাঁদ-টারেও নিয়া গেলো রে! আজাদ কইতাছিল, সৌহার্দ্য নাকি আর কোনোদিনও ফিরবো না বইলা গেছে। মরার আগে নাতিটারে আর দেখতে পাবো কি না কে জানে! ”

সকালে ডক্টর আরমানকে নিয়ে প্রশ্ন করার পর থেকে সৌহার্দ্য খেয়াল করেছে, তরী তার সাথে তেমন কথা বলছে না। নাস্তার সময়ও সৌহার্দ্যের কথার বিপরীতে শুধু মাথা নাড়িয়েছে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগছে তার। খাওয়া শেষে তরীকে ওষুধ খাওয়ানোর সময় সৌহার্দ্য প্রশ্ন করলো,
“এখন কি সুস্থ লাগছে তোমার?”

তরী ওপর-নিচে মাথা নাড়িয়ে ওষুধ খেতেই সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কথা বলছো না কেন তুমি আমার সাথে?”
তরী অবুঝের মতো তাকালো। সৌহার্দ্য কি তার আচরণে রেগে যাচ্ছে? সে কী বলবে বা করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সৌহার্দ্য তরীর এমন চাহনি দেখে বললো,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করেছি, তুমি বলতে চাইলে বলবে, না বলতে চাইলে বলবে না! আমি তো তোমায় বলার জন্য ফোর্স করিনি! তুমি এজন্য কথা বলা-ই বন্ধ করে দিয়েছো। আশ্চর্য!”

তরী মুখ কালো করে তাকালো আর নিচু গলায় বললো,
“সেরকম কিছু না।”
সৌহার্দ্য অতিষ্ঠ হয়ে দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“যেরকম-ই হোক! আমার সাথে কখনো কথা বলা বন্ধ করবে না। আমি কথা বলা বন্ধ করলেও তুমি করবে না। তুমি ছাড়া কিন্তু এই মুহুর্তে আমার আর কেউ নেই। তোমার জন্য সব ছেড়েছি, কারণ তোমায় ছাড়তে পারবো না।”
তরী ছলছলে চোখে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। তার চোখ কখন অশ্রুপূর্ণ হয়ে গেছে, সে জানে না। সৌহার্দ্য তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,

“কান্না করার মতো কিছু বলেছি আমি?”
তরী দু’পাশে মাথা নাড়ালো। সৌহার্দ্য ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,
“তাহলে কাঁদছো কেন?”
তরী ওড়না দিয়ে নাক ঘষতে ঘষতে বললো,
“জানি না। এমনিতেই কান্না পাচ্ছে।”
সৌহার্দ্য হেসে দিলো তরীর এমন কথায়। তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
“থাক! কাঁদে না, ছোট্ট বউ।”

তরী চোখ মুছে ভালোভাবে তাকিয়ে বললো,
“এটা কেমন নাম হলো?”
“অনেক সুন্দর নাম।”
সৌহার্দ্য বসা থেকে উঠে আলমারি থেকে কাপড় বের করতে করতে বললো,
“রেডি হয়ে নাও। আমি হসপিটাল জয়েন করবো আজ থেকে। তাই তোমায় একটা কোচিং-এ ভর্তি করিয়ে দিবো।”
তরী মুখ গোমড়া করে বললো,

“কোচিং-এর কী দরকার? আপনি মাঝে মাঝে একটু সময় দিলেই হবে!”
সৌহার্দ্য তরীর জন্য কাপড় বের করে বললো,
“মাঝে মাঝে দেওয়ার মতো সময়ও পাবো না আমি। হসপিটাল, চেম্বার আর রিসার্চ সব একসাথে শুরু হবে কাল থেকে। রাতেও লেইট হতে পারে আমার ফিরতে।”
তরী চোখ বড়বড় করে বললো,
“হ্যাঁ? সত্যি? আমি একা একা কীভাবে থাকবো?”
সৌহার্দ্য হেসে বললো,

“চিন্তা কোরো না! দুই-একদিনের মধ্যে মধুকে এখানে আনানোর ব্যবস্থা করছি। ছোট-মাও চলে আসবে খুব সম্ভবত। এখন রেডি হয়ে এসো দ্রুত। নয়টার আগে পৌঁছাতে হবে আমায়!”

প্রতি ডিপার্টমেন্টে সকালের ক্লাস শুরু হয় সাড়ে আটটা থেকে। মুগ্ধ সকাল সাতটা থেকে মেডিক্যাল কলেজের গেইটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকেই আসছে, কিন্তু অরুণীর কোনো দেখা নেই। হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ভোরে। কিন্তু গেইটের গার্ডকে দেখে উল্টো ঘুরে চলে এসেছে। লোকটা প্রায়ই তাকে গার্লস হোস্টেলের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখায় কেমন সন্দিগ্ধ চোখে তাকায় যেন!

এর মধ্যে অরুণীকে দশ-বারো বার কলও করে ফেলেছে মুগ্ধ। কল কানেক্ট হচ্ছে, কিন্তু অরুণী রিসিভ করছে না। মুগ্ধ হতাশ হয়ে মুখ গোমড়া করে গেইটের পাশে থাকা ঘাসের ওপর বসে পড়লো। দুই গালে হাত রেখে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো, অরুণী এখনো আসেনি।
“এখানে এভাবে বসে আছো কেন?”

পেছন থেকে আকাঙ্ক্ষিত কন্ঠ শুনে মুগ্ধ চমকে পেছন ফিরে তাকালো। অরুণী চোখ ছোট ছোট করে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ তড়িঘড়ি করে গাল থেকে হাত সরিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো,
“আপনি? আপনি ঐ দিক থেকে কেন আসছেন? আমি আপনার জন্য সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি!”
অরুণী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

“আমার জন্য কেন অপেক্ষা করছিলে? আর এতো কল কেন করেছো আমার নাম্বারে?”
মুগ্ধ কিছুটা ভড়কালো। অরুণীর সাথে দেখা করার জন্য এতোক্ষণ উদভ্রান্তের মতো অপেক্ষা করছিল, কিন্তু এখন দেখা হওয়ার পর কোথা থেকে কী বলা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। আমতা আমতা করে বললো,
“আমি আসলে…….”
অরুণী মুগ্ধর পেছনে তাকিয়ে বললো,

“ঐটা তোমার বাবা গাড়ি না? তোমার দিকেই আসছে!”
মুগ্ধর চোখ কপালে উঠে গেল, “ওহ মাই গড! কোথায়?”
মুগ্ধ পেছনে তাকিয়ে দেখলো, সত্যিই ঐটা তার বাবার-ই গাড়ি। কিন্তু ডক্টর শাহরিয়ার এখনো গাড়ির ভেতর থেকে তাকে দেখেনি। মুগ্ধ তাই তাড়াতাড়ি করে অরুণীর হাত ধরে ছুটে মাঠের দিকে চলে গেল।
অরুণী বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললো,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পুনরাগমনী পর্ব

“আরেহ্! কোথায় যাচ্ছো? হাত ছাড়ো। তোমার সাহস কী করে হলো আমার হাত ধরার?”
মুগ্ধ অরুণীর হাত আরো শক্ত করে ধরে বললো,
“সাহস কম বলেই বাবাকে দেখে পালাচ্ছি। কিন্তু আপনার হাত ছাড়া যাবে না। আপনার সাথে অনেক কথা আছে আমার, সিনিয়র আপু।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৩