কৃষ্ণবেণী গল্পের লিংক || নন্দিনী নীলা

কৃষ্ণবেণী পর্ব ১
নন্দিনী নীলা

“বুবু দুলা ভাইয়ের মাথায় চুল আমাগো সাধাকালা মোরগের নাগাল। চাচি ক‌ইল দুলাভাই বুইড়া ব্যাটা। তোমার থিকা ১০ বছরের বড়‌। বুবু তোমারে ওই ফর্সা বুইড়া ব্যাটার লগে বিয়া দিল ক্যান আব্বায়?”

বলে বকুল নিজের বুবুর দিকে তাকিয়ে র‌ইল উওরের আশায়। কিন্তু লাল শাড়ি পড়া কনে সাজের মেয়েটি কোন উওর দিতে পারল না। পাথরের ন্যায় বসে আছে। ছলছল চক্ষু মেলে একবার ছোট বোনের দিকে চাইল।
বকুল বোনের চোখে অশ্রু দেখে ধীর গলায় বলল,,” বুবু তুমি কানতাছ?”
আমি চোখ মুছে বললাম,” আম্মা ক‌ই?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আম্মা তো রানধন ঘরে তোমার লিগা খাওন আনতাছে। একটু পরে তোমারে ল‌ইয়া যাইব গা শহরে। ক‌ইল আম্মায়। বুবু আমি তোমার লিগা মেলা কষ্ট পামু একা থাকতে। তুমি আবার কবে আইবা?”
আমি বকুল রে জরিয়ে ধরে বললাম,” আমি ও তোরে খুব মিস করমু রে বকুল। শহরের ওই বন্ধ দালান কোঠায় আমি কেমনে থাকমু? আব্বা আম্মায় আমারে ওতো দূরে ক্যান বিয়া দিল।তোগো রে দেখতে ও পারমু না।”

” বুবু তুমি কাইন্দো না। আজ তোমারে মেলা সুন্দর লাগতাছে কাইন্দা নষ্ট ক‌ইরো না।”
আমি কাঁদতেছি। বললেই কি কান্না থামানোর যায়? বকুল বোনকে ছাড়িয়ে চলে গেল। এখানে থাকলে বুবু আরো বেশি কাঁদবে। তার থেকে আড়ালে থাকাই ভালো।

আলেয়া বেগম মুরগির গোশত দিয়ে ভাত নিয়ে আসল মেয়ের কাছে। মেয়ের পাশে কেউ নাই সবাই
বরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিয়ে পড়ানো হয়েছে ব‌র আর ব‌উকে একসাথে আর বসানো হয়নি। মেয়েটা তার এখানে বসে আছে। সকাল থেকে কিচ্ছু টি খায়নি। রাগ করে মেয়ে তার সাথে কথা পর্যন্ত বলে না। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে মেয়ের পাশে বসে বলে,” মা কয়টা খাইয়া নে। আমি নিজের হাতে তোরে খাওয়ায় দিমু।”

ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের পানে তাকিয়ে বললাম,,”বড়লোক বাড়িতে বিয়ে দিয়া পাঠাইতাছো ভালো-মন্দ খাবার জন্য‌। ভালো থাকার জন্য। তোমগো এই গরিবের ঘরে আর খাব কেন? আমি এহন বড়লোক বাড়ির বউ। তোমাগো এই সব খাওন আমার মুখে রসবো না। নিয়া যাও এগুলা আমার সামনে থিকা।”

“রাগ করিস না মা। তোর ভালোর লিগাই সব করছি। পোলার একটু বয়স কিন্তু খুব বেশি না। আর পোলা মাইনষের একটু বয়স বেশি থাকেই। কি সুন্দর পোলা তুই তো দেখলি না রাগ ক‌ইরা। যাকগে সারাদিন না খাইয়া রইছিস এখন কয়টা খা আমার হাতে। আবার কবে এই সুযোগ পামু। চ‌‌ইলাই তো যাবি যাওয়ার আগে আমার অন্তরে একটু শান্তি দিয়া যা। এইভাবে রাগ কইরা গেলে আমি যে শান্তি পামু না।”

আমি কথা বলল না। দলা পাকিয়ে কান্না আসছে। কাদলাম ও না মায়ের দিকে থেকে মুখ ঘুরিয়ে বসে র‌ইলাম। আলেয়া বেগম মেয়েকে অনেক কিছু বলেও রাগ ভাঙাতে পারল না। মুখে আঁচল চেপে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। আম্মা যাইতেই সেদিকে তাকিয়ে চোখের জল ছেড়ে দিলাম।

বিদায়ের ঘন্টা বেজে উঠল। আনন্দ ভরা জায়গাটা মুহূর্তে কান্নায় পুলকিত হয়ে উঠল। আলেয়া বেগম রুমে বসেই কাঁদছে। মেয়েটা রাগ করে না খেয়েই চলে যাচ্ছে। তার যে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আজ দরিদ্র বলেই ১৬ বছরের মেয়েটাকে বিয়ে দিতে হলো। কি করবে? আরেকজন ও যে বড় হয়ে উঠেছে তাকেও তো বিয়ে দিতে হবে। আজ কালের দিনে যৌতুক ছাড়া মেয়ে বিয়েই দেওয়া যায় না। আমাদের যে অবস্থা তিন বেলা ডাল ভাত খেতে পারি না। নাজেহাল অবস্থা আমাদের।‌আবার যৌতুক দিয়ে মেয়ে কী করে বিয়ে দেব?

এজন্যই তো এমন সু-পাত্র পেয়ে কোন দিকে না তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে বিয়ে দিতে হলো। ছেলে শহরের বিরাট বড়লোক। তারে আবার টিভিতে ও দেখায়। এতো বড়লোক পরিবার থেকে মেয়ের বিয়ের কাম আসছে বলে প্রথমে আমরা সন্দেহ করি। কিন্তু লোভে পরে বিয়ে দিলাম।

ছেলের লগে কথা ক‌ইয়া ও খারাপ মনে হয়নি। ধনী হ‌লেও কি ভাল তার ব্যবহার। মাইয়া আমার রাজ কপালি এজন্য ত এমন ঘরে বিয়া দেবার পারলাম। টাকা পয়সার অভাব নাই আর আমাদের মেয়েকে একদম নিজে খরচ পাতি দিয়ে নিলো। কিচ্ছু টি লাগল না। এই সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়?

মেয়েটা বুঝেই না। তার এক কথা তুমি আমায় বিয়া দেবা দাও কিন্তু আমারে এতো দূরে ওই শহরে বিয়া দিও না। আমি তোমাগো ছাইড়া ওতো দূরে থাকতে পারমু না। কিন্তু কাছে বলতে কি সেই আমাগো মতো ঘরে বিয়া দিয়া মেয়েরে দুঃখের সাগরে ভাসামু নাকি। মেয়ে দূরে থাক কিন্তু ভালো থাক এটাই তো চাওয়ার আমাগো।

বকুল বোনকে জাপ্টে ধরে কাঁদছে। কনের বাবা এগিয়ে এসে মেয়ের হাত জামাইয়ের হাতে দিলো।
বলল,” বাবা আমার মেয়েটারে দেইখা রাইখো। ছোট মানুষ তো বুঝে না সব কিছু একটু বুঝিয়া নিও। গ্রামের মানুষ আমরা শহরে চলতে পারি না। তারে সব শিখাইয়া নিও।”

তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,” মা সাবধানে থাকিস।”
বরের কানে কেউ ফিসফিস করে তখন বলল,,” জায়ান অন্তত এবার বের হ‌। অসহ্য লাগছে এসব ন্যাকামি। আমাদের লেট হয়ে যাচ্ছে।”
জায়ান তার সদ্য বিবাহ করা স্ত্রীর হাত শক্ত করে ধরে বলল,” আসছি।”

মহিলাটি জায়ানের এক বন্ধু ছিল। তিনি চলে গেলেন। জায়ান ভীড় ঠেলে গাড়ি কাছে এসে হাতটা ছেড়ে দিল। আমি কাঁদতেছি তখনো।
জায়ান গাড়িতে উঠে বসেছে বিরক্ত লাগছে ওর। আমাকে আমার ননদ উর্মি গাড়িতে বসিয়ে দিল উনার পাশে। তারপর উর্মি ও বসল। আমি পরলাম মাঝখানে।

গাড়ি চলতে শুরু করল। সাতটা বাজে। ঢাকা পৌঁছাতে চার ঘন্টা লাগবে। এসি চলছে জায়ান গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।
আমি মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি।

আমার পাশে বসে আছে আমার সদ্য বিবাহ করা স্বামী যাকে এখন অব্দি আমি দেখেনি। লোকটা বয়স্ক সবাই বলেছে লোকটা আমার বাবার বয়সী। অন্ধকারে এখন তাকালেও দেখা যাবে না। গাড়ির ভেতরে অন্ধকার। আমি একবার নিজের বামপাশে তাকালাম একটা মেয়ে। মুখ দেখা যাচ্ছে না।

আর একবার বাম পাশে তাকালাম এটা আমার স্বামী। তার মুখ বুঝা যাচ্ছে না আমি ঢোক গিললাম। অজানা কারনেই আমার বুক ঢিপঢিপ করছে। ভয় করছে লোকটাকে। এই লোকটার সাথে নাকি আমায় থাকতে হবে। এই এতো সব অচেনা মানুষের সাথে আমি থাকব কি করে। গলা শুকিয়ে আসছে আমার।

তার গলার কাছে একটু আলো পরেছে যা এসেছে ড্রাইভারের সিট থেকে তাতে শেরোয়ানির কলার দেখা গেল তাতে স্বর্ণের একটা মোটা চেইন দেখতে পেলাম। উনি হঠাৎ নিজের হাতটা উঁচু করল সেই আলোয় উনার ফর্সা পুরুষালী হাত দেখলাম যাতে কালো মোটা দামী ঘড়ি চিকচিক করে উঠল।

এই লোকটা যে বিরাট বড়লোক তা তার সাজ পোশাক ই বলে দিচ্ছে। এজন্যই তো আব্বা আমায় বিয়া দিছে এই টাকা পয়সার লোভে প‌ইরা‌। শুনছি বিয়েতে নাকি অনেক টাকা দিছিল আয়োজন খরচ পাতি করার জন্য।

সারাদিন না খেয়ে থাকার ফলে আমার হঠাৎ করেই সব কিছু বের হয়ে আসতে চাইল পেট মোচড় দিয়ে। আমি মুখে হাত দিয়ে হাঁসফাঁস করছি। আমার পাশে বসে থাকা আমার স্বামী নামক ব্যক্তি হয়ত আমার সমস্যা ধরে ফেলল চট করেই। তিনি আমার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,” হোয়াটস হ্যাপেন্ড?”

আমি কথা বলতে পারছি না মুখে হাত দিয়ে উম উম করে যাচ্ছি।কথা বললেই সব উনার উপরেই উগড়িয়ে দেব। আর উনি ইংরেজি তে কি জানি বলল আমি বুঝলাম না। বুঝব কি করে আমি তো লেখাপড়া করিনি।
উনি সামনে বলে লাইট অন করলেন। আর গাড়িও থামাতে বললেন।

আমি মুখ চেপে মাথা নিচু করে আছি। গাড়ি থামতেই উনি দ্রুত নেমে গেল। আমি নামতে পারলাম না। মাথা এগিয়ে গাড়ির বাইরে মাথা এলিয়ে উগড়িয়ে দিলাম বমি। উনি আমাকে নামাতে চাইছিলেন কিন্তু আমি তার আগেই বমি করে দিছি দেখে লাফিয়ে সরে গেছে। হয়তো বা আমার কান্ডে নাক ও ছিটকেছে।

বমি করে আমি লজ্জা মাথা উঁচু করতে পারছি না। ভয়ে আঁতকে নিজের জায়গায় বসে আছি শাড়ির কুচি মুঠো করে। তখন আমার ননদ কে ঠেলে উনি তার পাশে বসল। আমি জানালার কাছে বসে আছি এখন। লজ্জায় আমি আর কারো দিকে তাকালাম না। নিচু হয়ে বসে আছি। পেট ব্যাথা করছে।‌ খালি পেটে এতো দূরে কীভাবে যাব?

আমি অজ্ঞানের মতো পরে আছি। তখন পাশে বসা আমার ননদ উর্মি বলল,” ভাবি তোমার কি খুব খারাপ লাগছে? সামনে ফার্মেসি পেলে ওষুধ নেব। ততক্ষন পর্যন্ত ঠিক থাকো প্লিজ। তোমার যে গাড়িতে সমস্যা হয় আগে বললে একটা ব্যবস্থা করা যেত।”

” আমার খুব খিদে পেয়েছে আপু । সকাল থেকে আমি না খাওয়া।” লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই দিলাম খিদের কথা।
উর্মি চমকানো চোখে তাকাল। এবং কিছু চিন্তা করে বলল,,” ভাবি এখনো ত মেইন রোডেই আসিনি। কোন হোটেল পেলেই খাবারের ব্যবস্থা করে দেব। এখন খাবার কোথা থেকে দেব। এইভাবে না খেয়ে আসে কেউ।”

আমি আর কথা বলতে পারলাম না লজ্জায়।
উর্মি সামনে থেকে পলি এনে আমার হাতে দিয়েছে। আবার যদি বমি পায় এজন্য। গাড়ির জানালা ও খোলা। আমি আরো দুইবার বমি করলাম। মনে হয়েছে পেটের নারি ভুরি বেরিয়ে আসবে। পেট খালি এ ছাড়া আর কিবা আসতে পারে?
দের ঘন্টা পর গাড়ি থামল। আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো উর্মি ও আমার দেবর। আমি আর স্বামী নামক ব্যক্তি টাকে দেখিনি আসতে।

হোটেলে থেকে আমাকে ভাত গরুর গোস্ত ডাল ও মাছ ভাজা দিয়েছে আমি খিদের জ্বালায় গপাগপ খেতাম। কিন্তু পারলাম না। গলা ছুলে গেছে খেতে কষ্ট হচ্ছে। তাও তরকারি কম নিয়ে শুধু ভাত গিলেছি পেটের খিদায়।

গাড়িতে এসে আমাকে পানি ও ওষুধ দিয়েছে উর্মি। খেয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলাম। সমস্ত অপরিচিত মানুষদের সাথে যাচ্ছি। এনারা হয়তো প্রথমদিনেই আমাকে দেখে নাক ছিটকাচ্ছে। লাইট আবার নিভিয়ে দিয়েছে অন্ধকার এসে ভীড় করেছে গাড়িটাতে। আমি আমার ননদ কে দেখেছি মারাত্মক সুন্দর তিনি। তারপরণে ছিল লেহেঙ্গা কি সুন্দর করে সাজছে। আমি ছলছল চোখে তাকিয়ে ভাবছিলাম।

উর্মি আবার বলল,” ভাবি এখন ভালো লাগছে?”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। আমার স্বামী কেন একবার ও আমার খোঁজ নিল না?

বুইড়া ব্যাটা বিয়ে করেছি সেও এখন আমাকে অবজ্ঞা করছে। চোখ দিয়ে গলগলিয়ে পানি পরতে লাগল। আমি ফুঁপিয়ে আবার কেঁদে উঠলাম।
তখনি গম্ভীর গলায় স্বামী নামক ব্যক্তির আওয়াজ শুনে থমকে উঠলাম।

কৃষ্ণবেণী পর্ব ২