কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৩

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৩
মিসরাতুল রহমান চৈতী

দেখতে দেখতে দুটো দিন কেটে গেলো রাতুল বাসায় এসেছে সেইদিন রাতেই। চারোদিকে রোজার পবিত্র মিষ্টি সুভাস বইছে। এই মাসটা সংযমের মাস,, আত্মাকে পবিত্র করার মাস।
জানালা থেকে চোখ সরিয়ে চৈতী চোখ রাখলো বিছানাতে, রাতুল ঘুমাচ্ছে। ফোঁস করে শ্বাস নিলো চৈতী। পৃথিবীর সবচেয়ে পাপিষ্ঠ পুরুষের সাথে তার ভাগ্য জুড়ে গেছে। সে চায় এই সম্পর্কটা মেনে নিতে, কিন্তু তার মস্তিষ্ক যেন আগুনের দাবানলের মতো দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে, যখন সে ভাবে যে রাতুলের হাতে অনেক নারীর স্পর্শ রয়েছে। সেই হাতটা কিভাবে মেনে নিবে?

চৈতী কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। রাতুলের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে অজস্র প্রশ্নের ভিড় জমে যায়। একদিকে তার আবেগ, অন্যদিকে রাতুলের অতীত— দুইয়ে মিলে তার মনকে অস্থির করে তোলে। তার কষ্টটা যেন আরও বেড়ে যায় যখন সে ভাবে, রাতুলের জীবন কতটা জটিল এবং কষ্টকর ছিল।
কিন্তু কেন? কেন সে এই অতীতের বোঝা তার ওপর নিতে চায়? কেন সে তার মনকে এই কঠিন পথ বেছে নিতে বাধ্য করছে?
তখনই রাতুল হঠাৎ করে গভীর নিঃশ্বাস নিলো, যেন কিছু অনুভব করে। চৈতী তাড়াতাড়ি মাথা নিচু করে, যেন তার চোখে আর কিছু না পড়ে। রাতুল কিছুটা এলোমেলো ভাবে চোখ খুললো, তার দৃষ্টি কিছুক্ষণ অস্পষ্ট ছিল, তারপর ধীরে ধীরে চৈতীর দিকে তাকালো।
রাতুল রাশভারি কণ্ঠে ডাক দিলো—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“চৈতী!”
চৈতী ধীর পায়ে এগিয়ে এসে রাতুলের সামনে দাঁড়ালো। তার কণ্ঠ ছিল শান্ত, কিন্তু চোখে স্পষ্ট এক দ্বিধা—
“কিছু লাগবে আপনার?”
রাতুল কিছুক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো, তারপর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো—
“না কি এত ভাবছিলে?”
চৈতী সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো, “কিছু না।”
রাতুল হালকা হাসলো, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে লুকিয়ে ছিল তীব্র অনুভূতির ছোঁয়া।
“আমি জানি তুমি কী ভাবছিলে, চৈতী। আমাকে ভালোবাসতে হবে না… তুমি না হয় আমাকে তোমার ঘৃণার মধ্যে রেখো।”

চৈতীর চোখের মণি কাঁপলো। গভীর শ্বাস নিয়ে বললো—
“আমি আপনাকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু আমার অবচেতন মনটা আমার মস্তিষ্কের কাছে হেরে যাচ্ছে। ভাবতে অবাক লাগে, পৃথিবীর সবচেয়ে পাপিষ্ঠ পুরুষ আমার স্বামী! আমাকে ছোঁয়ার আগে আপনি ছুঁয়েছেন হাজারও নারীকে! আপনার স্পর্শই বা আমি কীভাবে মেনে নেব, এমপি রাতুল? আপনার ছোঁয়া আমাকে অপবিত্র করে দেয়।”
রাতুল গভীর দৃষ্টিতে তাকালো চৈতীর দিকে। তার ফর্সা নাক লাল হয়ে আছে, আর চোখ দুটো যেন রক্তজবা—যেন এক তীব্র ঝড়ের আগমন বার্তা দিচ্ছে।
ফোঁস করে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাতুল বললো—

“সমস্যা কোথায়, চৈতী? তোমার স্পর্শ দিয়েই না হয় মুছে দিও আমার গা থেকে সকল অযাচিত নারী স্পর্শের চিহ্ন! ভুল মানুষ মাত্রেই হয়, আমিও করেছি। কিন্তু সেই ভুলের শাস্তি হিসেবে তুমি আমাকে কী দেবে?”
চৈতীর ঠোঁট কেঁপে উঠলো, গলা ধরে আসলো, তবু স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো—
“যদি বলি, বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী?”
রাতুল তখনো স্থির চোখে তাকিয়ে। ঠান্ডা কণ্ঠে উত্তর দিলো—
“তাহলে আমি বলবো—তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি পাপিষ্ঠ হতে রাজি। আমার কলঙ্কিত হাত দিয়ে আমি তোমার অঙ্গ ছুঁয়ে নেবো।”
চৈতী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।
তার চোখে কিছুটা ভয়, কিছুটা বিস্ময়।
অপরূপ এক ধীর ভঙ্গিতে বললো—
“আমাকে কলুষিত করতে চান?”
রাতুল একটু এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো—

“না, তুমি আমার হৃদয়ে ফোঁটা এক পবিত্র ফুল, যার সুবাস আমি আতরের মতো মাখি। আর সেই পবিত্র ফুলকে অপবিত্র করার দুঃসাহস আমার নেই। তবে হ্যাঁ, আমৃত্যু তোমাকে আমার সাথে থাকতে হবে।”
চৈতী এক পলক তাকিয়ে রইলো রাতুলের চোখে। দুজনের মাঝখানে নীরবতার এক সেতু তৈরি হলো।
নীরবতা, যা একে অপরের মনের গভীরে প্রবেশ করতে বাধ্য করে…
চারদিকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। দুপুর কখন গড়িয়ে আসরের ওয়াক্ত হয়ে গেল, চৈতী বুঝতেই পারেনি।
রাতুল ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো—
“ছোট মস্তিষ্কে এত চাপ নিতে হবে না। ভালো না বেসেও তো অনেকেই সংসার করে যায়, তুমি না হয় সেটাই করবে।”

তার ঠান্ডা কণ্ঠে উপহাসের ছোঁয়া ছিল। তারপর এক মুহূর্ত চৈতীর দিকে তাকিয়ে বললো—
“আজানের সময় হয়ে গেছে, আমি নামাজে যাচ্ছি। তুমিও নামাজটা আদায় করে নিয়ো। পারলে জায়নামাজে বসে মোনাজাতে বলে দিও, যেন তোমার পাপিষ্ঠ স্বামীর মৃত্যুটা তোমার কোলে হয়!”
রাতুলের এমন কথা শুনে চৈতীর বুক কেঁপে উঠলো। যেন মুহূর্তেই তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেল। বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে।
রাতুল ভাবলেশহীন মুখে উঠে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ পর বের হয়ে দেখলো, চৈতী তখনো একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১২

কোনো কথা না বলে আলমারি খুলে একটি সাদা পাঞ্জাবি বের করলো রাতুল। পাঞ্জাবি পরে মাথায় টুপি দিলো, তারপর আতর মাখতে মাখতে বললো—
“যাও, নামাজ পড়ে নিয়ো। আমি আসছি।”
বলেই লম্বা কদমে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো রাতুল…

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ১৪