কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৬

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৬
মিসরাতুল রহমান চৈতী

চৈতীর মাথাটা যেন ভারী হয়ে আছে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাতেই বুঝতে পারল, সে একটা নরম বিছানায় শুয়ে আছে। ঘরের চারপাশে হালকা নীলচে আলো ছড়িয়ে আছে, জানালার পর্দা অল্প দুলছে, যেন কোনো অদৃশ্য বাতাস খেলা করছে সেখানে।
সে উঠে বসতে গেল, কিন্তু শরীরটা এতটাই দুর্বল যে এক মুহূর্তের জন্য মাথা ঘুরে গেল। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো রাতুল একটা সোফায় পা এর উপর পা তুলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
রাতুল বাঁকা হেসে চৈতীর কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসতেই চৈতী সড়ে গেলো।
চৈতীকে সড়ে যেতে দেখে রাতুলও ওর দিকে এগিয়ে গেলো। চৈতী আরেকটু সড়তেই একদম আধশোয়া হয়ে গেলো। রাতুলও চৈতীর উপর আধশোয়া হয়ে গেলো।
চৈতীর নিঃশ্বাস একদম বন্ধ হয়ে আসছিল। রাতুলের মুখটা খুব কাছে, এতটাই যে ওর গরম নিঃশ্বাস চৈতীর গালে স্পষ্ট লাগছে। চৈতী আতঙ্কে দু’হাত দিয়ে ওকে ঠেলে সরাতে চাইল, কিন্তু রাতুলের শক্তি এতটাই বেশি যে সেটা যেন একদম অসম্ভব।

“কি হলো? এত ভয় পাচ্ছো কেন?” রাতুলের কণ্ঠস্বরে ছিল শয়তানি খেলা।
চৈতী চোখ বন্ধ করে ফেলল, ঠোঁট শক্ত করে কামড়ে ধরল, যেন কোনোভাবেই দুর্বলতা প্রকাশ না পায়।
রাতুল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল, “তুমি যতই পালানোর চেষ্টা করো, জান, আমি কিন্তু ছাড়ছি না।” আজকের রাতে তুই আমার হয়ে যা চৈতী।
চৈতীর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। ওর দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
“রাতুল, প্লিজ…!” কণ্ঠে অসহায়তা ঝরে পড়ল।
রাতুলের ঠোঁটের কোণে সেই বাঁকা হাসিটা আরও গভীর হলো। ও চৈতীর মুখের খুব কাছে ঝুঁকে এল, কিন্তু ঠিক তখনই— চৈতী রাতুলের কলার টা চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললো আমার থেকে দূরে থাকবেন চরিত্রহীন পুরুষ।
রাতুলের মুখটা মুহূর্তেই থমকে গেল। চৈতীর চোখে এক অদ্ভুত আগুন জ্বলছিল। ওর গলা শক্ত, অথচ কাঁপছিল না একটুও।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চৈতী বলে উঠলো,,, আপনার বুকে ছুড়ি চাালাতে আমার হাত একটু ও কাম্পিত হবেনা।
রাতুল চৈতীর দিকে আরেকটু ঝুঁকে ওর গালে নাক ঘষতে ঘষতে বললো,, বেশ তো মেরে ফেল আমায় তোর হাতে নিজেকে দিলাম সঁপে একবার না একশত বার তোর হাতে মরতে রাজি।
চৈতীর পুরো শরীরটা শিউরে উঠল। আতঙ্ক, রাগ আর ঘৃণা একসাথে জমাট বেঁধে ওর রক্তে আগুন ধরিয়ে দিল। রাতুলের নিঃশ্বাস ওর গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এবার চৈতী আর কাঁপছে না।
ওর হাত নিশপিশ করে উঠল। এক ঝটকায় বালিশের নিচে রাখা ছোট্ট ছুরিটা বের করল চৈতী। তীক্ষ্ণ ধাতব ঝলক দেখে রাতুলের ঠোঁটের বাঁকা হাসিটা আরও গভীর হলো।
“ওহ! সত্যি বলেছিলি, তাই না?” রাতুলের কণ্ঠে মজা, “তাহলে চল, দেখি তো তোর হাত কাঁপে কিনা!”
চৈতীর চোখে বিদ্যুৎ চমকালো। এক মুহূর্ত দেরি না করে ও ছুরির ফলাটা রাতুলের বুকের একদম মাঝখানে চেপে ধরল।

“এক ইঞ্চি ভেতরে চালালেই আপনার হৃদপিণ্ড ফুটো হয়ে যাবে,” চৈতীর গলা তেতো হয়ে উঠল। “এবার বল, মরতে রাজি আছিস?”
রাতুল নিঃশ্বাস নিল ধীরে ধীরে। একটুও ভয় পায়নি ও। বরং চোখের তারায় উন্মাদ একটা ঝলক খেলে গেল।
“তুই কি জানিস, তুই এখন আমার চোখে কতোটা সুন্দর লাগছিস?”
চৈতীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। এক ধাক্কায় ও রাতুলকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল।
রাতুল নিজেকে সামলে নিয়ে ঠোঁটে এক চতুর হাসি আনল। চোখে মুগ্ধতার ঝলক, তবে তাতে শয়তানি মেশানো। ধীর কণ্ঠে বলল,

“হাহ! আমারই বিলাই আমাকেই মেঁও বলছে? ইন্টারেস্টিং… আই এম ইমপ্রেসড, চৈতী!”
রাতুল ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে চৈতীর চিবুকটা তুলে ধরল। ওর চোখে আর আগের সেই শয়তানি ঝলকটা ছিল না, বরং সেখানে একটা গভীর কাতরতা, একটা অপরাধবোধের ছায়া ফুটে উঠেছে।
নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল ওর। চৈতীর চোখে চোখ রেখে একদম নরম গলায় বলল, “শুনেছি, হাজার পাপীরাও যদি মন থেকে তওবা করে, আল্লাহ তাদের মাফ করে দেন। আজ তোর চোখে যে ঘৃণা দেখতে পাচ্ছি, জানিস, সে ঘৃণা আর একদিন থাকবে না। একসময় ওই চোখে শুধু ভালোবাসা থাকবে, যা আমি তোর কাছে কখনও আশা করিনি, — সেই ভালোবাসা একদিন আমার হবে।”
রাতুল গভীর শ্বাস নিল, যেন ভেতরের সমস্ত কথা একসঙ্গে বলে ফেলতে চায়। তারপর নরম, অথচ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,

**”আমি তো শুধু একজন সাধারণ মানুষ, কোনো ফেরেশতা নই, চৈতী। মানুষ মাত্রই ভুল করে, আমিও করেছি। জন্ম থেকে কেউ নিষ্পাপ থাকে না, সময়ের সাথে আমরা শিখি, বুঝতে শিখি। কিন্তু আমি সেই সুযোগ পাইনি। ছোটবেলা থেকেই মায়ের স্নেহ পাইনি, বাবা-চাচাদের কঠোর শাসনে বড় হয়েছি। তারা আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে শক্ত হতে হয়, কীভাবে অন্যকে কাবু করতে হয়, কীভাবে ভয় দেখাতে হয়… কিন্তু কখনও শেখায়নি যে, মেয়েরা শুধু শরীর নয়— তারা মানুষ, তাদেরও অনুভূতি আছে, ব্যথা আছে, মন আছে, সম্মান আছে।
আমি জানি, আমি হয়তো অনেক ভুল করেছি, অনেক অন্যায় করেছি… কিন্তু চৈতী, যদি মানুষ তার ভুল বুঝতে পারে, যদি সত্যিই পরিবর্তন চায়, তাহলে কি সে আর সুযোগ পেতে পারে না?”**
রাতুলের কণ্ঠে যেন একটা অদ্ভুত আবেগের কম্পন ছিল, যা চৈতীর হৃদয় পর্যন্ত ছুঁয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য ওর মনেও যেন দোটানা জেগে উঠল—এই মানুষটা কি সত্যিই বদলাতে চায়? নাকি এও একটা অভিনয়?
রাতুল ধীরে ধীরে উল্টে ফিরে গভীর শ্বাস নিল, যেন ভেতরের সমস্ত অস্থিরতা সামলে নিচ্ছে। তারপর নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

**”শোনো, চৈতী… কিছু বলার দরকার নেই। তুমি শুধু চুপচাপ এখানে বসে থাকো। আমি ডিনার নিয়ে আসছি, তুমি খেয়ে নিও, তারপর ঘুমিয়ে পড়ো। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি— যতদিন না তুমি নিজে অনুমতি দেবে, ততদিন আমি তোমাকে স্পর্শ করবো না।
তুমি জানো, চৈতী? আমার হৃদয়টা অর্ধপচন ধরা একটা মরুভূমির মতো, যেখানে ভালোবাসা কখনো প্রস্ফুটিত হয়নি, যেখানে কোমলতা কখনো আশ্রয় নেয়নি। কিন্তু তুমি… তুমি যেন সেই মরুভূমিতে ফুটে ওঠা এক সতেজ, নিষ্পাপ চম্পার ফুল। এমন এক ফুল, যার সুগন্ধ আমার হৃদয়ের সমস্ত অন্ধকার দূর করবে, যার স্পর্শ আমার কলুষিত আত্মাকে পবিত্র করে তুলবে।
তুমি আমার জন্য শুধু একটা মানুষ নও, চৈতী… তুমি আমার বেঁচে থাকার কারণ। আমার হৃদয়ের প্রথম এবং শেষ পবিত্র অনুভূতি।”**

রাতুলের কণ্ঠে ছিল অদ্ভুত এক আকুতি, যা কেবল কথার মধ্যে আটকে ছিল না— ওর চোখেও সেই সত্য ফুটে উঠেছিল। যেন এই প্রথম সে কারও জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসার তীব্রতা অনুভব করছিল।
চৈতী কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল, রাতুলের কথাগুলো তার মনের মধ্যে গভীরভাবে গিয়ে গেঁথে যাচ্ছিল। এক অদ্ভুত অনুভূতি তার বুকের ভেতর সঞ্চালিত হতে লাগল—যে অনুভূতি সে আগে কখনো অনুভব করেনি। এক ধরনের শূন্যতা, এক ধরনের অতৃপ্তি, যে ক্ষুধা কখনো কোনো খাবারে মিটে না, বরং ভালোবাসার স্পর্শে পূর্ণ হয়।
রাতুল উঠে গিয়ে ডিনার নিয়ে এসে সামনে রাখল, কিন্তু চৈতী কিছুই বলল না। রাতুল আবার এক পা এগিয়ে এসে আদর মিশ্রিত কন্ঠে বললো,, তুমি না খেলে আমিও একটা দানা পানি মুখে তুলবো না চৈতী।
তুমি যখন রাজি হবে, তখন আমি খাবো।”

চৈতী হালকা চুপ করে থেকে, তারপর ডিনারের দিকে তাকাল। তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রতিটি কথায় যেন একে অপরকে প্রতিধ্বনিত করছে—রাতুলের কথা, তার অনুভূতি, এবং নিজের অন্তর্নিহিত কষ্ট।
চৈতী একটু মাথা নাড়ে, যেন এক ধরনের অবহেলা আর সংশয়ের মিশ্রণ। রাতুল তার দিকে এক পলক তাকিয়ে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়িয়ে, মুচকি হাসে। তারপর কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে যায়, খাবার আনতে।
কিছুক্ষণ পর দরজা খোলার শব্দ হলো। রাতুল ফিরে এলো, হাতে খাবারের ট্রে।
রাতুল ধীর পায়ে চৈতীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ট্রেটা টেবিলে রেখে একপাশে বসে পড়ল। তার চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি, কিন্তু ভেতরে যেন একটা অপেক্ষা কাজ করছে—চৈতী খাবে কি না।
চৈতী মাথা নিচু করে বসে ছিল, চোখ খাবারের দিকে গেলেও সে কিছুতেই হাত বাড়াচ্ছিল না। যেন মনে মনে একটা দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে।

রাতুল হাত বাড়িয়ে একটা রুটি ছিঁড়ে নিয়ে নিজের প্লেটে রাখল, কিন্তু খাওয়ার আগে থেমে গেল। তার কণ্ঠে আস্তে আস্তে এক চাপা মায়া ঝরে পড়ল, “চৈতী, জানো? আমি এই প্রথম কারো সাথে বসে খেতে চাইছি, কারো জন্য অপেক্ষা করতে চাইছি।”
চৈতী চমকে তাকাল, কিন্তু কোনো কথা বলল না।
রাতুল নরম গলায় আবার বলল, “আমি জোর করব না, তোমার ইচ্ছা। শুধু এটুকু বলতে চাই, তুমি না খেলে আমিও খাব না।”

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৫

চৈতী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিঃশ্বাস ফেলল। রাতুলের চোখে সেই একরোখা জেদ, কিন্তু আজ তাতে হিংস্রতা নেই, আছে কেবল এক ধরনের শূন্যতা—যেন সে সত্যিই অপেক্ষা করতে রাজি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর চৈতী ধীরে ধীরে প্লেটের দিকে হাত বাড়াল। ছোট্ট এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে নিল।
রাতুলের ঠোঁটে একটা ছোট্ট হাসি ফুটে উঠল। সে কিছু না বলে নিজের প্লেট থেকে খাওয়া শুরু করল।
এই নিস্তব্ধ মুহূর্তের মাঝেই যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল ভেঙে গেল দু’জনের মাঝে…

কোন গোপনে মন ভেসেছে পর্ব ৭