গুলবাহার পর্ব ২

গুলবাহার পর্ব ২
লেখা:ইলমা বেহরোজ

গুলবাহার ঘুমিয়েছে অনেক্ষণ।জেসমিন বেগম মেয়ের রুমে আসেন।মেয়ের মুখপানে তাকিয়ে ভাবেন,
——‘দেখতে সেই আগের মতোই কতোটা মায়াবী। মনটা এমন তেতো হলে কেনোরে মামনি?বুঝো না তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই।’
কাঁথা বুক অব্দি টেনে দিয়ে, আসার সময় মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দেন।
জেসমিন বেগম রুমে এসে দরজাটা বন্ধ করে আলমারি থেকে মেয়ের ছোটবেলার জামা-কাপড় গুলা নিয়ে কাঁদেন।আহা!কতোই না পাগল ছিলো গুলবাহার মায়ের জন্য।মাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝতোনা।একদিন জেসমিন বেগম অভিমান করে বলেছিলেন, গুলবাহার না পড়লে তিনি চলে যাবেন আল্লাহর কাছে।তাই গুলবাহার কি কান্নাটাই না করেছে।সারাদিন পড়েছে।তিনি খুব মিস করেন সেই দিনগুলো।আফসোস করেন,

——–‘যদি ফেরা যেতো সেই সুন্দর দিন গুলিতে।’
জেসমিন বেগমের শরীরটা ভালোনা।হার্টে প্রবলেম, ডায়বেটিস।কিন্তু ঔষধ এনে খান না।খাবেই বা কীভাবে?শিক্ষকতা করে কি আর অঢেলা টাকা পাওয়া যায়?মেয়েকে প্রত্যেকদিন টাকা দিতে হয়।কম টাকা দিয়ে হয় না, অনেক দিতে হয়।পার্টিতে যাবে জামা দরকার।বিয়েতে যাবে জামা দরকার।বন্ধু-বান্ধবদের ট্রিট দিবে টাকা দরকার।কিন্তু ইদানীং টাকার অংকটা বেড়ে গেছে।তিনি ভেতরে ভেতরে ভয় পান,মেয়ে তাঁর নেশায় আসক্ত হচ্ছেনা তো?আবার টানা না দিলেও মেয়ের ব্ল্যাকমেইল হাজারটা।নিজের ক্ষতি করার ভয় দেখায়।আদর-শাসন কিছুই কাজ করছেনা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ছুটি শেষের আর দু’দিন আছে।তারপরই স্কুল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন জেসমিন বেগম।বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে মেয়েকে নিয়ে ঘুরার।সাহস করে মেয়ের রুমে আসেন।গুলবাহার ফোনের সামনে বসে কথা বলছিলো।সম্ভবত লাইভে এসেছে ফেসবুকে।এই মুহূর্তে ডাকাডাকি করলে রেগে কি করে বসে।তাই আর ডাকেন নি।রুমে এসে বসেন।টিভি ছাড়েন।কিন্তু না ভালো লাগে না টিভি।অসুস্থতা বাড়ছে দিন দিন।ঔষধ না খাওয়ার কুফল।বুকটা মাঝে মাঝে ব্যাথা করে।ডায়বেটিসও বেড়েছে বোধহয়। এমতাবস্থায় একজন সঙ্গী দরকার।কিন্তু কে হবে সঙ্গী?মেয়ে ছাড়া তো কেউ নেই!সুমিকে ডাকেন,

———‘সুমিই?’
দুয়েক মিনিটের মাথায় সুমি আসে।
——-‘জ্বি খালাম্মা?’
——-‘তুই বিয়ে করছিস কবে?’
সুমি হকচকিয়ে তাকায়।বললো,
——‘এজন্য ডাকছেন?’
জেসমিন বেগম হাসলো। আধাশোয়া হয়ে বসেন।তারপর বলেন,
——‘আয় একটু গল্প করি।’
——‘থালা-বাসন গুলা…..
——‘ওসব পরে করিস এখন আয়। বস এখানটায়।’
সুমি বিছানায় জেসমিনের পাশে বসে।জেসমিন হেসে বললো,
——‘বয়স কতো হলো?’
——‘ওইতো ১৭ বছর।’
জেসমিন বেগম জোরে হেসে উঠে বললো,
——‘দুই বছর আগে যখন আমার বাড়িতে প্রথম আসলি, তখনও বলেছিলি ১৭।তোর কি বড় হতে ইচ্ছে হয়না?’
—–‘না খালাম্মা আমার সতেরোই বয়স।’
জেসমিন বেগম আর কথা বাড়ান নি।শুধু হাসেন।গুলবাহার বের হচ্ছিলো।জেসমিন বেগম ডাকেন,

——-‘গুলবাহার?’
গুলবাহার বিরক্ত হয়।কিন্তু প্রকাশ করেনি।দাঁড়ায় দরজার সামনে।জেসমিন বেগম উঠে এসে অনুরোধ গলায় বললো,
——–‘কই যাচ্ছো মামনি?আমার সাথে আজ একটু ঘুরবে? যা খেতে চাইবে দেবো।’
কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে মায়ের দিকে তাকায় গুলবাহার। আর্তনাদ করে বলে,
——‘কি বলছো? তোমার সাথে আমার ঘুরার বয়স? এখন বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঘুরবো।আর কই যাচ্ছি সেটা বলা যাবেনা।ব্যক্তিগত অনেক ব্যপার আছে।’
জেসমিনের উত্তরের আশায় না থেকে গুলবাহার বেরিয়ে যায়।
টুনি রাগ নিয়ে বলে,
——-‘আপনি ভালা মানুষ।আমার আম্মা হইলে জুতা দিয়া বাইড়াইতো।”
জেসমিন বেগম বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলেন,
——‘কখনো মারিনি মেয়েটারে।এক-দুবার মারছি দেখস নাই কি হইছে।থাক না ও ওর মতো।একদিন ঠিক বুঝবে।’

স্কুল খোলা হয়েছে দু’দিন জেসমিন বেগম স্কুলে যান না।স্কুলের প্রধান আবু হানিফ স্যারের কল আসে।জেসমিন বেগম রিসিভড করেন,
—–‘আসসালামু আলাইকুম। ‘
——‘ওয়ালাইকুম আসসালাম ম্যাডাম।আপনি স্কুলে আসছেন না কেনো?’
——‘জ্বি শরীরটা ভালো না।’
—–‘কবে নাগাদ আসতে পারবেন?’
——‘আগামীকাল দেখি আসবো।’
—–‘আচ্ছা ম্যাডাম।আপনার সাথে একটা কথা ছিলো?’
—–‘জ্বি বলুন।’
——‘আমার বোনের ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজছে।আপনি আর আপনার মেয়েকে তো আমি চিনি।আপনি যেমন বুদ্ধিমতী আপনার মেয়েও।দুই বছর আপনার মেয়েকে দেখিনা।কিন্তু এর আগে তো দেখেছি,যথেষ্ট সুন্দরী।আপনার মেয়ের জন্য আমার বোনের ছেলে উপযুক্ত মনে হলো।আমার ভাগনে কিন্তু কর্মঠ।’
জেসমিন বেগম অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।মেয়ের বিয়ের কথা ভাবেন নি।কিন্তু এখন ভাবতে হচ্ছে।মেয়ে যেভাবে বিগড়ে যাচ্ছে।যদি স্বামী – সংসার পেয়ে ঠিক হয়।তিনি উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞাস করেন,

——‘ছেলের ফ্যামিলি মেম্বার কতজন?’
—–‘মা আর ছেলে।ছেলের বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।তাই তো বলছি আপনাকে।’
জেসমিন বেগম খুশি হোন।বলেন,
——‘ছেলে কি করে?’
——‘অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়া শেষ করে।দেশে জব করছে আপাতত।ছয় মাস পর চলে যাবে।
জেসমিন বেগমের মুখটা খুশিতে ভরে উঠে।
——‘আচ্ছা আপনি আমাকে কাল ছবি দেখিয়েন।’
—–‘আচ্ছা ম্যাডাম।আজ রাখি।’
—–‘জ্বি।আল্লাহ হাফেজ।’
এরপরদিন ছেলের ছবি দেখেন জেসমিন বেগম। খুব পছন্দ হয়।নাম ইফতেখার ফুয়াদ।ছবিটা নিয়ে আসেন মেয়েকে দেখাতে।

দিনটা শুক্রবার,
শরীর মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে জেসমিন বেগমের। টুনি আসেনি।কল করে জানিয়ে দিছে, আজ আসবেনা। অসুস্থ নাকি খুব।জেসমিন বেগম মাথা ধরা নিয়ে মেয়ের জন্য নুডলস পরিবেশন করেছেন।
—–‘আম্মু পেটের ক্ষুধায় মরে যাচ্ছি।আমার নাস্তা কই?’
জেসমিন বেগম রান্নাঘর থেকে উত্তর দেন,
—–‘আসছি মামনি।’
গুলবাহারের সামনে নুডলসের বাটি রাখেন তিনি।গুলবাহার ফোনে মগ্ন।জেসমিন বেগম বললো,
—–‘অনেক্ষণ হয়েছে উঠেছো।খেয়ে নাও।’
গুলবাহার ফোন থেকে চোখ না সরিয়েই বলে,
—–‘আচ্ছা যাও এখন।’
জেসমিন বেগম সাবধানে বলেন,

—–‘মামনি একটা কথা বলি?’
গুলবাহার ফোনে কিছু একটা করছে।মায়ের কথায় বিঘ্ন ঘটছে।কপট রাগ নিয়ে তাকায়।বলে,
—–‘কি কথা?’
জেসমিন বেগম মেয়ের দুই হাত ধরে অনুরোধ নিয়ে বলেন,
—–‘মামনি তোমার কাছে আর কখনো কিছু চাইবোনা আজ একটা জিনিষ চাই??প্লীজ আম্মু ফিরিয়ে দিওনা!’
গুলবাহার হকচকিয়ে উঠলো।বললো,
——‘কি?
—–‘একটা ছেলে দেখছি তোমার জন্য।খুব ভালো ছেলে।খোঁজ নিয়েছি।দেখতেও সুন্দর।’
গুলবাহার চেঁচিয়ে উঠলো,
——‘কিহহহ?’
জেসমিন বেগম ছলছল চোখে তাকান।গুলবাহার একটু নিভলো।বললো,
——‘ছেলে করে কি?
—–‘অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়া শেষ করে।জব করছে।ছয় মাস পর আবার চলে যাবে।মা-বউ নিয়ে।’
গুলবাহার মনে মনে খুশি হয়।ছেলের তাহলে টাকা আছে অনেক।টাকা ছাড়া দুনিয়া চলে নাকি?
গুলবাহার রয়ে সয়ে বললো,
——‘আচ্ছা দেখো।’
জেসমিন বেগম অবাক হোন।সেই সাথে খুশিও।

বিকেলে বুকের যন্ত্রনাটা বেড়ে যায় হাজারগুণ। বিছানায় কাঁতরাতে থাকেন জেসমিন বেগম।বাসায় সুমি নাই যে,একটু পানি চাইবে।
গুলবাহার বের হয়ে যাচ্ছিলো আজ তাঁর বেস্ট ফ্রেন্ড নিশার জন্মদিন।তাঁর কাছে আজ শ্রেষ্ঠ দিন।
জেসমিন বেগম উঠে দাড়াঁনোর শক্তি পাচ্ছেন না।জোর করে হাসি ফুটিয়ে ঠোঁটে গুলবাহারকে ডেকে বলেন,
——-‘মামনি এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও?
গুলবাহার বিরক্ত হলেও।এক গ্লাস পানি এনে দেয়।জেসমিন বেগম বলেন,
——‘মা একটু আমার কাছে থাকবি?’
গুলবাহার ফোঁস করে উঠে বললো,

——‘আমি এক জায়গায় যাচ্ছি দেখতে পাচ্ছোনা?আজ ইম্পোরটেন্ট একটা দিন। ইচ্ছে করে কেন এমন করছো?’ একদমে কথাগুলো বলে গুলবাহার বেরিয়ে যায়।
জেসমিন বেগম চোখের জল লুকিয়ে হাসেন।বলেন,
——-‘আল্লাহ,মেয়েটাকে হেদায়েত করো।সঠিক পথ দেখিয়ো।’
তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসে পানি খায়।ফোনটা হাতে নিয়ে,হানিফ স্যারকে কল করেন,
——–‘হ্যালো? ‘
——-‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।একটা কথা ছিলো?’
——-‘জ্বি বলুন?’
——-‘আগামী বুধবার ছেলেকে নিয়ে আমার বাসায় আসবেন।’
——‘আলহামদুলিল্লাহ। আমি জানাচ্ছি ওদের।’
——‘ধন্যবাদ। ‘
শুয়ে থাকতে ভালো লাগছেনা,জেসমিন বেগম বেরিয়ে আসেন বাইরে।ছাদে অনেক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন।অস্থির লাগছে খুব।পাশের ছাদে একজন বৃদ্ধা বসে ছিলেন।জেসমিন বেগম কথা বলার জন্য ডাকেন,

গুলবাহার পর্ব ১

——‘চাচী কেমন আছেন?’
বৃদ্ধা রোদ পোহাচ্ছিলেন।কারো ডাক শুনে চোখের চশমাটা ঠিক করে তাকান।জেসমিন বেগমকে দেখে বলেন,
——জেসমিন না?’
—–‘জ্বি চাচী।’
অনেক্ষণ কথা হয় দুজনের মাঝে।কথার মাঝে জেসমিন বেগমের মাথাটা ঘুরিয়ে উঠে। তিনি ছাদের মেঝেতে বসে পড়েন।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আচমকা লুটিয়ে পড়েন।বৃদ্ধা আৎকে উঠে।গলায় যতটুকু জোর আছে, সবটুকু দিয়ে ছেলেকে ডাকেন।

এরপরদিন দুপুর দুইটা অব্দি জেসমিন বেগমের লাশ নিয়ে গুলবাহারের জন্য অপেক্ষা করেছে প্রতিবেশীরা।কিন্তু গুলবাহারের আশার নাম নেই।বাধ্য হয়ে জেসমিন বেগমকে দাফন করা হয়।
গুলবাহার নিশার বার্থডে উপলক্ষে আনন্দ-ফূর্তির জন্য ফ্রেন্ডদের সাথে অতিরিক্ত মাদক সেবন করেছে। রাত থেকে নিশার বাসায় মরার মতো ঘুমাচ্ছে সে।

গুলবাহার শেষ পর্ব