গুলবাহার গল্পের লিংক || লেখা:ইলমা বেহরোজ

গুলবাহার পর্ব ১
লেখা:ইলমা বেহরোজ

জেসমিন বেগম সোফায় বসে চোখের পানি ফেলছেন।আজ তিন মাস যাবৎ গুলবাহার খুব বেশি বিগড়ে গেছে।অবাধ্যতা বেড়েছে বহুগণ। তবু ও জেসমিন বেগম অপেক্ষায় আছেন,একদিন তার মেয়ে সব বুঝবে।
জেসমিন বেগম বিধবা হোন যখন গুলবাহারের দুই বছর।গুলবাহারের দাদা-দাদী নেই।চাচা-ফুফিও নেই।বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে ছিলেন গুলবাহারের বাবা।গুলবাহারও তার মা-বাবার একমাত্র মেয়ে।তবে এখন শুধু মায়ের একমাত্র মেয়ে।স্বামী মারা যাওয়ার পর জেসমিন বেগম তার শিক্ষাকে কাজে লাগাতে সিলেট অগ্রগামী স্কুলে শিক্ষাকতা শুরু করেন।স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়িটাই এখন মা-মেয়ের শেষ সম্বল।
একটা কাজের মেয়ে রাখেন ছোট গুলবাহারকে দেখে রাখার জন্য।সকাল ৮টা-২টা পর্যন্ত তিনি স্কুলে থাকেন।বাসায় এসেই গুলবাহারকে গোসল করানো খাওয়ানো সব সম্পন্ন করেন।আবার বিকেলে বাসায় কয়টা স্টুডেন্ট আসতো প্রাইভেট পড়তে।এইভাবেই হাজার ব্যস্ততায়,আদর-যত্ন করে বড় করেন গুলবাহারকে।

——–‘আম্মু…..আম্মু……আম্মু?বয়রা হয়ে গেছো নাকি??শুনতে পাচ্ছোনা ডাকছি যে?’
জেসমিন বেগম চোখের পানি মুছে দৌড়ে আসেন মেয়ের রুমে।এতক্ষণ কাঁদছিলেন কথাটি লুকিয়ে,তিনি হেসে বলেন,
——-‘সরি মামনি রাগ করোনা।একটু চোখ লেগে গেছিলো।’
গুলবাহার কপাল কুঁচকে তাকায়।বিরক্তি নিয়ে বলে,
——–‘এতোটা কেয়ারলেস কেমনে হয় একজন শিক্ষিকা?মেয়ের বন্ধু-বান্ধব এসেছে বাসায়।ওদের খেয়াল না রেখে ঘুম আসে কোনো মায়ের?’
মনের ব্যাথা লুকিয়ে তিনি হাসিটা দীর্ঘ করে বলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

——‘আমিতো আসছিলাম ই। তুমিই তো তাড়িয়ে দিয়েছিলে মামনি।’
গুলবাহার মায়ের বকবকানি একদমই নিতে পারেনা।ইচ্ছে হয় অনেকগুলা কথা শুনিয়ে দিতে।কিন্তু রুমে অনেক ফ্রেন্ড আছে,তাই নিজেকে কন্ট্রোল করে বললো,
——–‘ওদের নাস্তার ব্যবস্থা কি করলা?’
——-‘সুমি রাঁধছিলো।এতক্ষণে হয়তো শেষ রান্না।জাস্ট দুই মিনিট।আমি নিয়ে আসছি।’
জেসমিন বেগম বেরিয়ে যান।গুলবাহারের মাথার রগ কাঁপছে রাগে।সুমিকে দিয়ে রান্না সে একদম পছন্দ করেনা।ফ্রেন্ডদের দিকে হেসে তাকায়।বলে,

——–‘তোরা আড্ডা দে।আমি আসছি।’
জেসমিন বেগম রান্নাঘরে আসেন।খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে সুমিকে বলেন,
—–‘কিরে কতটুকু? ‘
——‘জ্বি খালাম্মা শেষ।’
——‘দেখিস উনিশ-বিশ যেনো না হয়।মেয়ের বকা শোনাইস না।’
——‘আপনি মা হইয়া মেয়েরে এতো ডরান ক্যান খালাম্মা?’
জেসমিন বেগম হাসলো।বললো,
——‘তুই বুঝবিনা।’
রান্নাঘরে গুলবাহারের আগমন।কপট রাগ নিয়ে মা’কে বললো,

——-‘ব্রেড পাকোড়া,স্যান্ডউইচ কতোটা বাজে ভাবে সুমি বানায় জানোনা তুমি? তবুও ওরে কেন এই দায়িত্ব দিছো?’
——-‘আমি শিখিয়ে দিছি মামনি।সত্যি মজা হয়েছে খেয়ে দেখ।’
——-‘তবুও,বাসায়ই তো থাকো এখন।গ্রীষ্মের বন্ধ স্কুল।নিজে রাঁধলে কি এমন হতো?’
সুমি ফোড়ন কাটলো।
——‘খালাম্মার শরীরডা ভালা না আফা।আপনি তো খোঁজ রাখেন না।ডাক্তার কইছে আগুনের কাছে কম থাকতে।’
গুলবাহার সুমিকে ধমক দেয়।তারপর মা’র দিকে রেগে একবার তাকিয়ে চলে যায়।সুমি ঠোঁট বাঁকায়।জেসমিন বেগমকে বলে,
——‘খালাম্মা মেয়েরে শাসন কইরেন।নইলে দেখবেন আর হাতের মুঠোয় নাই।আপনার মাইয়ারে আমার একটুও ভালা লাগেনা।খালি আপনের লাইগা কাম করতে আই।’
জেসমিন বেগম হেসে ব্রেড পাকোড়া বড় চ্যাপ্টা প্লেটে নেয়।আর বলে,

——‘এমন করে বলিস না।আমার তো মেয়ে।আমি ছাড়া ওর কে আছে? আর ওরে ছাড়া আমারই বা কে আছে?’
——‘আপনের কেউ না থাকতে পারে।কিন্তু আপনার মাইয়ার অনেক পোলা বন্ধু আছে।ডাইনির মতো কতকগুলা মেয়ে বান্ধবি আছে।’
——‘চুপ কর।জলদি সবকিছু সাজিয়ে দে।বাচ্চাগুলো অনেক্ষণ হয়েছে আসছে।’
গুলবাহারের রুমে একটা মিউজিক বক্স আছে।মায়ের আলমারি থেকে টাকা চুরি করে সে কিনেছে।নিশা গুলবাহারকে বললো,
——-‘গান দে একটা।একটু নাচি সবাই।বরিং হয়ে যাচ্ছি।’
গুলবাহার একটু নিভে।মিউজিকের আওয়াজ জেসমিন বেগমকে অসুস্থ করে দেয়।তাই সে বললো,
——‘ফোনে গান দিচ্ছি ওয়েট।’
নিশা আক্ষেপ নিয়ে বললো,
——‘দূর, ভাবলাম সবাই একসাথে হয়েছি।একটু গান বাজিয়ে নাচবো।আনন্দ করবো।’
গুলবাহারের মত পালটে যায়।নিশার হাত ধরে বলে,

——–‘উম!বেইবি,মন খারাপ করছিস কেনো?ওয়েট মিউজিক বক্স অন করছি।’
নিশা,ইকরা,রিনি,জুনায়েদ,রাফিসহ বাকি ছেলেগুলি উল্লাসিত হয়ে বললো, হিপ হিপ হুররে।
জেসমিন বেগম আর সুমি ব্রেড পাকোড়া, স্যান্ডউইচ, কোক, পানি দিয়ে চলে যায়।কিন্তু খাওয়ার তালে নেই গুলবাহারের ফ্রেন্ডমহল।তাঁরা নাচের তালে।জেসমিন বেগম রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেন।তিনি একদম নিতে পারেন না এতো আওয়াজ।মাথা ধরে আসে।কিন্তু কিছু করার নেই।মেয়েকে মানা করা যায়না এখন কিছুতে।এইতো এক মাস আগে,
প্রথম গুলবাহার ছেলে ফ্রেন্ড নিয়ে আসে বাসায়।তা নজরে পড়ে এলাকার মানুষের।আবার মিউজিক বক্স চলছিলো উচ্চআওয়াজে।জেসমিন বেগম বাড়ি ফিরছিলেন তখন শফিকের বাবা জেসমিন বেগমকে আটকিয়ে বলেন,
——-‘আপনি মেয়েদের স্কুলের একজন গুণী শিক্ষিকা।মেয়েদের শিক্ষা দেন।আর সেখানে,নিজের মেয়ে এসব কি জামা-কাপড় পরে? আজ আবার দেখলাম এক ঝাঁক ছেলেকে নিয়ে বাসায় ঢুকতে।’
শুনে জেসমিন বেগম আহত হোন।এর মাঝে আরেকজন এসে বললো,
——‘যে নিজের মেয়েকে ভালো শিক্ষা দিতে পারেনি।সে অন্য মেয়েদের কীভাবে দিবে ভাই?’
জেসমিন বেগমের বুক ভারী হয়ে আসে।এমন কথা কখনো শুনতে হবে ভাবেন নি।স্তব্ধ হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন।তারপর হেসে বলেন,

——‘বাচ্চা মেয়ে।বুঝে কম।আমি ও’কে বুঝাবো।’
অনেকটা রাগ নিয়ে তিনি বাসায় ঢুকেন।কলিং বেল চাপতেই সুমি এসে দরজা খুলে দেয়।তিনি ভ্যানিটিব্যাগ সোফায় রেখে মেয়ের রুমে আসেন।রাগ নিয়ে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসিয়ে দেন মেয়ের গালে।গুলবাহার স্তব্ধ হয়ে যায়।তিনি রাগ নিয়ে বলেন,
——-‘আমি তোমায় এই শিক্ষা দিয়েছি গুলবাহার?নৈতিকতা শিখাইনি তোমায়?এভাবে সমাজের চোখে আমাকে নিচু করে তুমি কি পাচ্ছো?’
গুলবাহার আহত চোখে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে।চোখ লাল হয়ে এসেছে।রুমে উপস্থিত সব ফ্রেন্ডরা বেরিয়ে যায়।জেসমিন বেগম চলে আসেন নিজের রুমে।উনার খুব কষ্ট হচ্ছে।এই প্রথম তিনি মেয়েকে মেরেছেন।একটা মাত্র মেয়ে।যা’কে নিয়ে তাঁর দুনিয়া।আজ সেই মেয়ের গালে হাত তুলতে তিনি বাধ্য হয়েছেন।চোখের চশমাটা খুলে তিনি গোসলে ঢুকেন।গোসল থেকে বেরিয়ে মেয়ের রুমে আসেন।দেখেন দরজা লাগানো।দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি।হয়তো মেয়ে তাঁর কাঁদছে শুয়ে। তিনি ড্রয়িংরুমে আসেন।সুমিকে ডেকে বলেন,

——-‘কি রে সুমি? খেয়েছিস? তোর আফামনি খেয়েছে?’
——‘হ খালাম্মা আমি খাইছি।আফা খায় নাই।’
——‘ডেকে নিয়ে আয়।’
—–‘আচ্ছা খালাম্মা।’
সুমি একটু পর এসে বলে,
—–‘আফা সাড়া দেয়না।’
——-‘রাগ করছে।আজ ছেড়ে দে।রাগ কমুক।’
রাত আট টা হয়ে যায়।দুপুর থেকে দরজা লাগানো।জেসমিন বেগম অনেকবার ডেকেছেন সাড়া পান নি।গুলবাহার নিজের ক্ষতি করার মতো মেয়ে নয়।রক্ত সে খুব ভয় পায়।যখন এতক্ষণ হয়ে গেলো সাড়া নেই।তখন তিনি ভয় পেয়ে যান।বাইরে থেকে দুজন পুরুষকে ডেকে এনে দরজা ভাঙ্গান।দেখেন,হাত রক্তাক্ত গুলবাহারের।পাশে ব্লেড। বিছানায় ফ্লোরে পড়ে আছে।আত্মা কেঁপে উঠে জেসমিন বেগমের।প্রতিবেশী দুজন গুলবাহারকে হাসপাতাল নিয়ে আসে।ডাক্তার বলে,
——-‘রগে ব্লেড লাগেনি।তাই মেয়েটা বেঁচে আছে।আর ঘুমের ঔষধ খেয়েছে যার জন্য এতক্ষণ ঘুমিয়েছে।’
সেদিন জেসমিন বেগমের চেনা-জানা দুনিয়াটা অচেনা হয়ে যায়।এতো শান্ত-ভীতু-মেধাবী মেয়েটা এমন কীভাবে হলো?এতোটা বিগড়ে কীভাবে গেলো? ভার্সিটিতে ভর্তির পর থেকেই মেয়েটার মধ্যে চেঞ্জ আসে।আস্তে আস্তে এই পর্যায়ে!সঙ্গদোষে লোহা ভাসে!কথাটির সত্য প্রমাণ ‘গুলবাহার’।

দুপুর থেকে রাত দশটা অব্দি বন্ধু-বান্ধব বাসায় ছিলো।যখন চলে যায়,জেসমিন বেগম হাসিমুখে বিদায় দেন।গুলবাহার গেইট অব্দি এগিয়ে দিতে আসে।নিশা হাত নাড়িয়ে বললো,
——–‘গুল্লাবাহার বেইবি বাই।’
জুনায়েদ নিশার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
——-‘গুল্লাবাহার না।গুলবাহার হবে।’
নিশা তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
———‘গুলবাহার কোনো নাম হলো? এত বড় নাম।বুড়ি মহিলাদের মতো।মগা নাম!’
গুলবাহারের মনটা তিক্ত হয়ে যায়।তবুও ঠোঁটে হাসি রেখে বললো,
——‘বাই। ‘
গুলবাহার বাসায় ঢুকে দেখে ড্রয়িংরুমে মা বসে আছে।ক্লান্ত শরীর সোফায় হেলিয়ে দিয়ে বললো,
——‘গুলবাহার নামটা না রাখলেও পারতে আম্মু।কাউকে বলা যায় না এই নাম।শিক্ষিত হওয়া স্বত্তেও এমন নাম কেমনে রাখলে?’
জেসমিন বেগম উত্তরে কিছু বলেন নি।চোখে ভেসে উঠে যখন গুলবাহার ক্লাস থ্রি তে পড়তো।স্কুল থেকে বেরিয়েই মা’কে গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,

—–‘আম্মু থ্যাঙ্কিউ।’
——‘ওমা।আমার মামনিটা আজ এতো খুশি কেনো??আর থ্যাংকস?ব্যাপার কি?হুম?
—–‘তুমি আমার বেস্ট মা।আমার এত্তো সুন্দর নাম রেখেছো এজন্য থ্যাঙ্কিউ।
——‘তাই?তা কে বললো আমার মামনির নামটা অনেক সুন্দর?’
—–‘বাংলা মিস বলেছে আমার নামটা নাকি অনেক সুন্দর।সবার চেয়ে সুন্দর।আরো বলেছে, এই নামটা যে রেখেছে সে নাকি আরো সুন্দর। আমি কি বলেছি জানো মা?’
—–কি?
—–‘বলেছি আমার আম্মু দুনিয়ার সবার চেয়ে সবচেয়ে সুন্দরী।তাই আমার আম্মু আমাকে এত্তো সুন্দর নাম দিয়েছে।’
সেদিন জেসমিন বেগম গুলবাহারকে জাপটে ধরেছিলেন খুশিতে।
——-‘এই নামটা চেঞ্জ করে ফেলবো আমি।’
জেসমিন বেগমের ভাবনার সুতো কাটে।বলেন,

——-‘হুম করো।’
——‘একটা ফ্ল্যাট কিনো আম্মু।এই বাড়ি ভালো লাগেনা।’
——‘এতো টাকা কই পাবো রে মামনি?’
গুলবাহার বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।রুমে যেতে যেতে বললো,
——‘আফসোস হয়।কেনো যে কোনো ধনীর ঘরে আমার জন্ম হলোনা।’
জেসমিন বেগমের চোখ জলে ভরে উঠে।মেয়ে হয়তো জানেনা,উনার বুকটা চুরমার হয়ে যায়।যখন গুলবাহার অন্য বাবা-মায়ের সাথে নিজের বাবা-মা’কে তুলনা করে।

গুলবাহার পর্ব ২