গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ২৮

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ২৮
লেখনীতে জেনিফা চৌধুরী

চোখের সামনে বাবা-মায়ের সাদা কাপড় জড়ানো লা’শ কোনো সন্তানের পক্ষে’ই সহ্য করার ক্ষমতা নেই। ফাইজা’র গগন কাঁপানো চিৎকারে সবার হৃদয় কেঁপে উঠছে বার বার। ফাইজার সামনেই ফারদিন এক কোনে চুপিসারে দাড়িয়ে আছে। ওর বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সহ্য করতে পারছেনা ফাইজার চোখের পানি। এই আহাজারি’র শব্দে ফারদিন নিস্তব্দ, নিশ্চুপ হয়ে আছে। কি করে স্বান্তনা দিব সদ্য বাবা-মা হারা মেয়ে’টাকে? কোনো ভাষা কি আছে? তনুজা ফাইজা’কে বুকে আগলে রেখে চোখের পানি ফেলছে। সায়মা খানম একটু দূরে বসে আছে। মেয়ে’টাকে স্বান্তনা দেওয়ার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন সে? ফাইজা’র গলা ভেঙে গেছে চেঁচিয়ে কান্নার ফলে। কিছুক্ষন পরেই দাফন করা হবে হাসনাত সাহেব আর নাদিয়া বেগম’কে।

–সবাই চিরকাল বেঁচে থাকেনা মা। এত’টা ভেঙে পড়িস না। আমি আছি তো। আমি তোর মা না বল? আমি তোকে আগলে রাখব। তুই আর কান্না করিস না মা। তুই অসুস্থ হয়ে যাবি….
তনুজা কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলে উঠলো। ফারদিন টলমল চোখে তাঁকিয়ে আছে ফাইজা’র দিকে এক নজরে। তনুজার কথা শুনে ফাইজা চিৎকার করে বললো…….
–এইসব কিছু আমার জন্য হয়েছে। আমি আমার বাবা-মা’কে মে’রে ফেলেছি। আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আমার ও ম’রে যাওয়া উচিত…..
বলেই তনুজার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে একেক’টা জিনিস সব ফেলে দিলো। পা’গলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলো” আমার ম’রে যাওয়া উচিত”। ফাইজা’কে থামানোর যথেষ্ট চেষ্টা করছে তনুজা আর আরজা। আরজা খবর শুনে’ই ছুটে এসেছে। জেহের বাইরে খাটিয়ার সামনে বসে আছে। ফাইজা’র পাগলামি গুলো নিশ্চুপ হয়ে টলমল চোখে দেখছে ফারদিন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

টেবিলে থাকা একটা বড় ফ্লাওয়ার ভাজ নিয়ে নিজের মাথায় আঘাত করার জন্য প্রস্তুত হতে’ই ফারদিন গিয়ে ধরে ফেললো। ফাইজা ফারদিনের দিকে অশ্রভর্তি চোখে অসহায় চাহনী’তে দিতে’ই ফারদিন ফাইজা’কে শক্ত করে বুকে চেপে ধরলো। ফারদিনের স্পর্শে ফাইজা আরো বেশি কান্নায় ভেঙে পড়লো। আরজা ও দাড়িয়ে মুখ চেপে কান্না করতে করতে বাইরে চলে এলো। তনুজা ফারদিন’কে ইশারা করতে’ই ফারদিন বুঝতে পারলো। তাই, চোখের ইশারায় যেতে বলে নিজে ফাইজা’কে শান্ত করতে বলে উঠলো…..

—আমি আছি তো। কেনো এত’টা ভেঙে পড়ছো। আজ থেকে তুমি আর আমি দুজনেই এতিম। আমরা দুজনেই সমান। আল্লাহ কি সবাই’কে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখবে। একদিন আগে পরে সবাই’কে তার কাছে যেতে হবে। এখন তুমি এত’টা ভেঙে পড়ছে তোমার বাবা-মা দুজনে কষ্ট পাবে। তারা তো দেখছে তোমাকে?
ফারদিনের স্বান্তবা বানী শুনে ফাইজা ফারদিন’কে আরো বেশি আকড়ে ধরে বললো…..
–আমি পারব না। বিশ্বাস করুন আমার দম আটকে যাচ্ছে। আমি ম’রে যাব। আমি থাকতে পারব না….
ফারদিন আর উওর না দিয়ে চুপ করে রইলো। সাথে সাথে ওর দুচোখ বেয়ে অশ্রু ফোটা গড়িয়ে পড়লো।

ছেলেরা তো সবার মতো শব্দ করে কাঁদতে পারেনা। চাইলেও কাঁদতে পারেনা। জেহের ড্রয়িং রুমে বসে বসে বোনের আহাজারির শব্দ শুনছিলো। কিন্তু ভেতরে যাওয়ার সাহস হচ্ছেনা। কি বলে বোন’কে স্বান্তনা দিবে সে? ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে নিঃ শব্দে চোখের পানি ফেলছিলো। আরজা ড্রয়িং রুমে পা দিয়ে জেহের’কে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো জেহেরের দিকে। জেহেরের পাশে বসে ওর কাঁধে সাহস করে হাত রেখে বললো…..
–আপনি এত’টা ভেঙে পড়লে ফাইজুর কি হবে ভাইয়া? প্লিজ নিজেকে শক্ত করুন। এখন আপনি ছাড়া আর কে আছে ওর?
স্বান্তনা বানী পেয়ে জেহের নিজেকে সামলাতে পারলো না। হুট করে আরজা’কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আরজা খানিকক্ষণ চমকে গেলেও নিজেকে সামলে জেহের পিঠে রাখলো।

নাদিয়া বেগম আর হাসনাত সাহেব’কে জানাযার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। তাই ফাইজা’কে শেষ বারের মতো তাদের সামনে নিয়ে আসলো ফারদিন। সাদা কাফনের থেকে নাদিয়া বেগমের মুখ’টা খুলে দিতে’ই ফাইজা চিৎকার করে খাটিয়ার সামনে লুটিয়ে পড়লো। খাটিয়া ধরে জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো….
–মা ও মা একবার উঠো না মা। আমি থাকতে পারব না তোমাকে ছাড়া। আমাকেও নিয়ে যাও তোমার সাথে…..
বলেই পাশে রাখা হাসনাত সাহেবের খাটিয়া ধরে বললো….
–বাবা তুমি না বলে ছিলে তুমি আমাকে ছেড়ে কোনো দিন যাবে না। তাহলে এইভাবে এখন নিশ্চুপে সুয়ে আছো কেনো? উঠো না বাবা।
বলেই পাগলের মতো কাদতে লাগলো। জেহের ফারদিনের পাশে দাড়িয়ে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। উপস্থিত স্কবার চোখ অশ্রুসিক্ত। জেহের বোনের পাগলের মতো অবস্থা দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বোন’কে জড়িয়ে ধরলো। ভাইয়ের ভরসা পেয়ে ফাইজা গগন বিদায়ক চিৎকার করে উঠলো।

–ভাই আমি আর তুই একা হয়ে গেলাম। আমরা কি নিয়ে বাঁঁচব ভাইয়া। আমাকেও মে’রে ফেল তুই। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া। বুক ফেটে যাচ্ছে। গলা ছিড়ে যাচ্ছে। নিশ্বাস ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে। আমাকে মে’রে ফেল প্লিজ। আমি থাকতে পারব না….
জেহের সহ্য করতে না পেরে নিজেও শব্দ করে এইবার কেঁদে দিলো। দুই পাশে দুইটা খাটিয়া রাখা তার মাঝে বসে দুই ভাই বোন বিলাপ করে যাচ্ছে। দৃশ্য’টা সহ্য করার মতো না।

দাফন শেষ হতে’ই ফারদিন আর জেহের এক সাথে রুমে প্রবেশ করলো। ফাইজা সেন্সলেস হয়ে আছে। ওর দুই পাশে বসে আছে আরজা আর তনুজা আর সায়মা খানম। ফাইজা’কে এই অবস্থায় দেখে ফারদিন আর জেহের দুজনেই দৌড়ে গেলো ওর সামনে। দুজনেই এক সাথে অস্থির হয়ে প্রশ্ন করে বসলো…
–ওর কি হয়েছে? কি হয়েছে?
তনুজা ঠান্ডা মাথায় উওর দিলো…..
–খাটিয়া নিয়ে যাওয়ার পর চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সেন্সলেস হয়ে গেছে। শরীর ভীষন দূর্বল তাই স্যালাইন দিতে হবে। তোমরা ব্যবস্থা করো তাড়াতাড়ি…..

ফারদিনের জান বেড়িয়ে যাচ্ছে ফাইজার মুখের দিকে তাঁকিয়ে। মেয়ে’টা আর কত কষ্ট সহ্য করবে? ফারদিন এখনো জানেনা ফাইজার বাবা-মাকে পরিকল্পনা করে হ’ত্যা করা হয়েছে। ফাইজা’কে কিছুক্ষনের মধ্যে স্যালাইন দেওয়া হলো। সারাদিন সবার উপরে ধকল গিয়েছে বিধায় ফারদিন’কে ফাইজার কাছে রেখে সবাই একটু অন্য রুমে গিয়েছে। জেহের’ বোনের অবস্থা দেখে পাগল পাগল হয়ে গেছে। সদ্য বাবা-মাকে হারিয়ে এভাবেই ভেঙে পড়েছে৷ বোনের মুখ চেয়ে নিজেকে শান্ত রেখেছিলো এতক্ষন৷ এখন সেই বোনের এই অবস্থা মেনে নিতে পারছেনা। জেহের কে জোর করেই তনুজা অন্য রুমে নিয়ে গেছে।

মধ্য রাত ফাইজা’র সেন্স আসতে’ই চোখ খুলে তাঁকা’তেই দেখলো ফারদিন নিচে বসে ওর এক হাতে আকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। অন্য হাতে স্যালাইন চলছে। ফারদিন’কে দেখে’ই কেনো যেনো ওর শরীর রাগে জ্বলে উঠলো। হাত’টা জোর করে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই ফারদিন জেগে উঠলো। ফাইজা’কে সজাগ দেখে লাফিয়ে দাড়িয়ে পড়ে অস্থির কন্ঠে বললো….
–তোমার কষ্ট হচ্ছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? পানি খাবে? কি হয়েছে?
ফাইজা ফারদিনের অস্থির কন্ঠ শুনে লাফিয়ে উঠলো। এক টানে স্যালাইন’টাকে খুলে ফেললো। এতে অবশ্য ওর হাত দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করলো। ফাইজার কান্ডে ফারদিন অবাক হয়ে তাঁকিয়ে আছে। রক্ত বের হতে দেখে ভয় পেয়ে ফাইজার হাত’টা ধরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো….

–কি করছো কি? রক্ত বের হচ্ছে তো? পাগল হয়ে গেছো তুমি?
ফারদিনের কথায় ফাইজা এইবার ও’কে ধাক্কা মে’রে দূরে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বললো….
–আমার কাছে আসবেন না একদকম। আপনার জন্য আজ আমি বাবা-মা হারা। তাদের মৃ’ত্যুর জন্য শুধু মাত্র আপনি দায়ী। চলে যান আপনি চোখের সামনে থেকে। নয়তো আমি কি করব নিজেও জানিনা। চলে যান বলছি…..
কথাগুলো শুনেই ফারদিন যেনো আকাশ থেকে পড়লো। ওর মাথা ঘুরে গেলো মুহূর্তে’ই। কি বলছে মেয়ে’টা এইসব? ফারদিন অবাক স্বরে বলে উঠলো….
–কিসব বলছো তুমি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? দেখো এটা একটা এক্সিডেন্ট। আর এক্সিডেন্টের উপর আমাদের কারোর হাত থাকেনা। প্লিজ নিজেকে সামলে নাও……
ফাইজা এইবার দ্বিগুন রাগ নিয়ে চারদিকে কিছু খুঁজতে লাগলো। টেবিলের উপর ফোন’টা দেখে ছুটে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ’টা বের করে ফারদিনের হাতে ফোন ধরিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..

–দেখুন। আমার বাবা-মা’কে খুন করা হয়েছে। কে করেছে আশা করি আপনাকে বুঝাতে হবেনা। আপনাকে ভালোবাসা আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল। আমার ভুলের জন্য আমার বাবা-মা’কে জীবন দিতে হলো। চলে যান আপনি…….
ওদের চেচামেচি’তে সবাই তড়িঘড়ি করে ছুটে এলো। তনুজা এসেই ফাইজা’কে ধরে প্রশ্ন করলো…..
–চেঁচাচ্ছিস কেনো? শরীর খারাপ করবে? একি হাত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে কেনো? কি করেছিস তুই…..
ফাইজা উওর না দিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। আর ফারদিনের দিকে রাগী চাহনী দিয়ে আছে। ফারদিন ফোন’হাতে নিস্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে। ফাইজা পুর্নরায় চেঁচিয়ে উঠার আগেই ফারদিন বড় পা ফেলে রুমের বাইরে চলে গেলো। সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এখানে কি হচ্ছে তারা কিছুই বুঝছেনা। ফারদিন চলে যেতে’ই ফাইজা তনুজা’কে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো। আর সবাই প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে ওর দিকে চেয়ে রইলো।

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ২৭

ফারদিন নিচে নেমে এসে’ই ফোন’টা আছাড় মে’রে ভেঙে ফেললো। রাগে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো…..
–আমি এত’টা বোকা কি করে হতে পারলাম? তিথী ভয়ংকর জেনেও কেনো চুপ করে বসে রইলাম সময়ের অপেক্ষায়। আজ আমার জন্য’ই ফাইজা’র এই অবস্থা? সত্যি তো আমি দায়ী এইসবের জন্য। এখন কি করব আমি….
বলেই চুল খামচে ধরলো দুই হাতে। রাগে দাতে দাত চেপে বলে উঠলো…..
–যার জন্য আজ তুমি এতিম হলে? যার জন্য আজ তোমার এই অবস্থা। তাকে এত’টা ভয়ংকর মৃ’ত্যু দিব যে কেউ কল্পনা ও করতে পারছেনা। ইটস মাই প্রমিস………

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ২৯