চন্দ্রাস্ত পর্ব ২
ফারহানা কবীর মানাল
হাবিব বাসের সিটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। হঠাৎই তার কিছু ভালো লাগছে না। মন খারাপ হয়ে আছে। পাশের সিটে তার কলিগ বাদশা বসা। চোখে-মুখে উৎফুল্ল ভাব। বাদশা বলল, “কতদিন বাদে বাড়ি থেকে দূরে কোথাও যাচ্ছি। রোজ রোজ এক সংসারে যেন অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম।”
“এ কথা বলছেন কেন? যতদূর জানি– পরিবার নিয়ে আপনি বেশ সুখে আছেন। বউকে ছাড়া কোথাও যান না। এখানেও আসতে চাননি। অফিসের বেশিরভাগ সময় তার সাথে কথাবার্তা বলেন।”
বাদশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিচু গলায় বলল, “সবই লোক দেখানো। আমার পরিবারে সত্যিকারের সুখ-শান্তি নেই। আপনাদের ভাবী প্রতিদিন রাতে না খেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করে। আমায় জিজ্ঞেস না করে কোন কাজ করে না। বাপের বাড়িতে গিয়ে একটা রাতও থাকে না। অথচ আমরা দু’জনই জানি এসব লোক দেখানো। এ কাজের উৎস ভালোবাসা নয়।”
“সংসারের সবকিছু লোক দেখানো হতে পারে? সবই কি মিথ্যা হয়?”
“অবশ্যই হয়। এই যেমন ধরুন- আমি যে মহিলার সাথে এক বিছানায় ঘুমাই। মাঝরাতে যার গায়ের ওপর হাত তুলে দিই। সে আমায় এক বিন্দু পরিমাণ বিশ্বাস করে না। আমি ঘুমিয়ে পড়ার পরপরই আমার মোবাইল হাতে নিয়ে সবকিছু চেক করে। ঘরে ঢোকার পর শার্টের গন্ধ নিয়ে দেখে তাতে মেয়েদের পারফিউমের ঘ্রাণ আসছে কি-না।”
হাবিব হাসল। সরু গলায় বলল, “প্রিয় মানুষের ভাগ কাউকে দেওয়া যায় না। সে আপনাকে ভালোবাসে বিধায়ই এমন করে। হারানোর ভয় পায়।”
“হারানোর ভয় থাকা ভালো। তবে সন্দেহ করা কতটা ঠিক তা বলতে পারব না। পরিস্থিতি এমন যে যে-কোন সময়ে আমার স্ত্রী আমাকে খু’নও করতে পারে।”
হাবিব নড়েচড়ে বসল। চিকন গলায় বলল, “আপনার শেষ কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।”
“অতিরিক্ত যে কোন কিছুই মানুষের জন্য ভালো না। সে আমায় এতটাই সন্দেহ করে যে সন্দেহের বশে খু’ন করতেও দ্বিধা করবে না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ওহ আচ্ছা। এসব আপনার ভুল ধারণা। এমন হবে কেন?”
বাদশা কিছু বলার আগেই তার মোবাইলটা বেজে উঠল। সে কল রিসিভ করে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাসের জানালা দিয়ে চারপাশে দেখে জায়গার নাম বলছে। হাবিব কি বলবে বুঝতে পারল না। খেয়াল করল- ভদ্রলোকের চোখ-মুখ থেকে উৎফুল্ল ভাব সরে গিয়ে বিরক্তি ছাপ ফুটে উঠেছে। অথচ কথা বলছে খুব হেসে হেসে। সে ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। দুপুরের রান্না চাপানো হয়নি। সকালে সামান্য কিছু নাস্তা তৈরি হয়েছিল। তা সকালেই শেষ। শরিফা বেগম বললেন, “শরীর ভালো আছে তোমার? নাকি হাবিব যেতে না যেতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছ?”
নববী শাশুড়ির কথায় মুখ তুলে তাকালো। নরম গলায় বলল, “শরীর ঠিক আছে আম্মা। দুপুুরের জন্য কি রান্না করব?”
“তোমার শশুর গতকাল বাজার থেকে চিতল মাছ কিনে এনেছিল। মাছের দু-পদ রান্না করো। সাথে ডাল ভাজি যা ভালো লাগে তাই করো।”
নববী বিছানা ছেড়ে নামল। মাথা ঘোমটা কপাল পর্যন্ত টেনে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। ফ্রিজ থেকে মাছ করে পানিতে ভিজিয়ে রাখল। নাইমা বলল, “কি রাঁধবে?”
“মাছ আর ডাল। কেন তোমার কিছু লাগবে?”
“না ভাবী। আমার কিছু লাগবে না। ঘরে বসে বই পড়ছিলাম। দেখলাম তুুমি রান্নাঘরের দিকে আসছ তাই আসলাম। যদি কোন সাহায্য লাগে।”
“কিছু লাগবে না নাইমা। তুমি গিয়ে পড়তে বসো।”
“অনেক পড়েছি। সকাল থেকে বই নিয়ে বসে আছি। এখন আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। বেশি পড়লে পরে আবার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। তখন আমার বিয়ে হবে না।”
নববী শব্দ করে হাসল। বলল, “বেশি পড়লে মাথা খারাপ হয়ে যায় নাকি?”
“হ্যাঁ তো। ম্যাম বলেছে- এক ছেলে ছিল। ম্যামের শিক্ষার্থী। সে সারাদিন বই পড়ত। ঘর থেকে বের হতো না। এরপর আস্তে আস্তে মাথা খারাপ হয়ে যায়।”
“পরে সে ছেলের আর বিয়ে হয়নি, তাই না?”
“হয়নি না আবার! দুটো বিয়ে হয়েছে। প্রথমে বাড়ি থেকে দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছিল। সে বউ পছন্দ হয় না বিধায় অন্য একজনের বউকে নিয়ে পালিয়েছে। সাথে একটা বাচ্চাও ফ্রি পেয়েছে।”
“তাহলে তো ভালো। তুমিও পড়াশোনা করে পা’গ’ল হও। তোমারও দু’টো বিয়ে হবে। ভাগ্য ভালো থাকলে বাচ্চাও ফ্রি-তে পেতে পারো।
তারা দু-জনেই শব্দ করে হাসছে। নাইমা নাক সিটকিয়ে বলল, “ইসস! আমার রুচি অমন পঁচে যাইনি। বিবাহিত ছেলেদের সাথে কে প্রেম করে? যাদের চরিত্রে সমস্যা আছে তারা করে। বউ আছে জানার পরও আমি কেন তার সাথে কথা বলতে যাব? দেশে কি ছেলের অভাব পড়ছে নাকি?”
নববী স্বস্তির হাসি হাসল। নাইমা আগ বাড়িয়ে এসে তার হাতের কাজ কেড়ে নিয়ে বলল, “আমাকে একটু কাজ শিখতে দাও। কাজ না পারলে কেন বিয়ের পর আবার এই বাড়িতে ফেরত দিয়ে গেল। তখন খুব ভালো হবে বুঝি?”
নববী কিছু বলল না। সে জানে নাইমা যখন বলছে তখন সে এই কাজ করবেই করবে। সে অন্তঃসত্ত্বা হবার পর থেকেই মেয়েটা তার কাজে সাহায্য করে। নিষেধ করলেও শোনে না৷ আগেও অবশ্য টুকটাক সাহায্য করত তবে এই ক’দিন একটুু বেশিই খেয়াল রাখছে। অন্যের সুবিধা অসুবিধা বুঝতে পারা সত্যিকার মানুষের একটা গুণাবলী। সবার ভেতর থাকে না।
শরিফা বেগম সদর দরজার সামনে বসে কাজ করছেন। দু’টো মরিচ গাছ লাগিয়েছিলেন, তা ঢলে পড়ে গেছে। লাঠি দিয়ে সেই গাছ দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। তখনই মিলি তার সামনে এসে দাঁড়ালো। রোহান তার হাত ধরে আছে। শরিফা বেগম বললেন, “একি! নানা ভাই তুমি? এখানে এসে খুব ভালো কাজ করেছ মিলি। কতদিন নানা ভাইয়ের সাথে দেখা হয় না। ইসস! মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।”
মিলি বলল, “আসতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু যা কিছু হলো তারপর আর কেমন করে আসি?”
“সেকি কথা? যা হয়েছে তাতে তোমার তো কোন দোষ নেই। ভাগ্য ছিল হয়েছে। এখানে তুুমি কি করবে বলো?”
“তবুও লোকজন ভালো চোখে দেখবে না। যার সূত্রে আত্মীয়তা সেই যখন নেই। তখন আর কিভাবে আসি বলেন?”
“একজনের অপরাধ কি অন্য একজনের কাঁধে চাপানো যায়? বাইরে দাঁড়িয়ে থেকো না। ঘরে আসো। নানা ভাই, কই দেখি।”
তিনি রোহানের দিকে এগিয়ে গেলেন। রোহান সরে গিয়ে মিলির পেছনে লুকালো। মিলি বলল, “আন্টি, রোহান অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না। কারো সাথে কথা বলে না।”
শরিফা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, “ভেতরে এসো। রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। তোমার বাড়ির সবাই কেমন আছে? বেয়ানের শরীর ভালো?”
“ভালো আছে। তবে খুব দুশ্চিন্তা করে। যা কিছু হয়েছে তার জন্য মা খুুব লজ্জিত। আমাকেও এখানে আসতে দিতে চায় না।”
“কি আর করার! সবই আমাদের দূর্ভাগ্য।”
তিনি মিলিকে নিয়ে ঘরে ঢুুকে গেলেন। মিলির চোখে-মুখে বিজয়ের হাসি। অবশেষে পরিকল্পনা সফল হয়েছে। মা’কে বললে কিছুতেই এখানে আসতে দিত না। তাই বান্ধবীর সাথে মেসে থাকার কথা বলেছে। বুদ্ধি করে বেরোবার সময় রোহানকেও সাথে নেয়নি। আগেই মানিক মিয়াকে বলে রেখেছিল। তিনি রোহানকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। রোহানও বেশ কয়েকবার নানাবাড়ির কথা বলেছে তাই মানিক মিয়া তেমন কোন বাঁধা দেননি। মা বাবা হারা ছেলেটা যদি নানাবাড়ি এসে একটু ভালো থাকে তাতে এমন কি দোষ হবে? কেউ কিছু বললেই বা কি? মানুষ শুধু কথা শোনায়, কষ্টের ভাগ নিতে আসে না।
মিলি গেস্ট রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। রোহানকে খাটে বসতে বলে বাথরুমে ঢুকে গেল। হাত-মুখ এসে বলল, “রোহান, কিছু খাবে?”
রোহান মাথা দুলিয়ে বলল, “খুব খিদে পেয়েছে। খাবো।”
মিলি বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। নাইমা তাকে দেখে বলে উঠল, “এই বাড়িতে কি মনে করে?
মিলি শান্ত গলায় বলল, “রোহান ওর নানা নানিকে দেখার জন্য বায়না করছিল। তাই নিয়ে এসেছি। কেন তোমার সমস্যা আছে?”
নাইমা হাসল। কিছু বলল না। মিলি বলল, “রোহানের খুব ক্ষুধা লেগেছে। ঘরে খাওয়ার মত কিছু থাকলে দাও।”
নববী পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, “দুই মিনিট, আমি নুডলস রান্না করে দিচ্ছি।”
মিলি তার দিকে তাকিয়ে হাসল। নাইমার দিকে একটু ঝুঁকে বলল, “বাকিরা কোথায়?”
“আব্বা কোথায় গিয়েছে বলতে পারব না। তবে ভাইয়া অফিসের কাছে বাইরে গেছে। এক সপ্তাহ সেখানেই থাকবে।”
“ওহ আচ্ছা! জার্নি করে এসেছি। সামান্য ক্লান্ত লাগছে। আমি ঘরে যাচ্ছি। নুডলস রান্না হয়ে গেলে একটু দিয়ে যাবে প্লিজ।”
নাইমা কিছু বলল না। অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। মিলি বেরিয়ে যাবার পরপরই শরিফা বেগম রান্নাঘরে ঢুকলেন। বললেন, “মাছের দু-পদ রান্না হয়ে গেছে।”
নববী বলল, “না মা। ডাল আর একটা পদ রান্না শেষ। রোহানের জন্য নুডলস রান্না করে বাকিটাও করে ফেলব।”
“সমস্যা নেই। নুডলস রান্না করে গোসলে যাও। কতদিন বাদে নানা ভাই এ বাড়িতে এসেছে। আমি ফ্রিজ থেকে মুরগির গোশত বের করে রান্না করে রাখব।”
“ঠিক আছে আম্মা।”
নাইমা মা’য়ের দিকে একটু সরে গেল। কিন্তু কিছু বলল না। নববী রান্না শেষ করে নিজের ঘরে ঢুকল। বালিশের পাশে রাখা মোবাইলটা হাতে নিয়ে হাবিবকে কল দিলো। একবার রিং হতেই হাবিব কল রিসিভ করল। ক্লান্ত গলায় বলল, “কি অবস্থা? শরীর ঠিক আছে?”
নববী বলল, “আমার শরীর ঠিক আছে। তুমি কোথায়? বলেছিলাম পৌঁছে কল দেবে।”
“এখনও বাসে বসে আছি। পথ শেষ হয়নি।”
“দুপুরে কোথায় খাবে? বেলা হয়ে গেছে।”
“বাস থেকে নেমে হোটেলে খেয়ে নেব। চিন্তা করো না।”
চন্দ্রাস্ত পর্ব ১
তারা দু-জনে বেশ কিছু সময় নিজেদের কথাবার্তা চালিয়ে গেল। নববীর মনে হলো রোহান আর মিলি আসার ব্যাপারটা হাবিবকে জানাবে। কিন্তু পরে কি মনে করে আর বলল না।