চন্দ্রাস্ত পর্ব ৩

চন্দ্রাস্ত পর্ব ৩
ফারহানা কবীর মানাল

সন্ধ্যা নেমে গেছে। চারদিকে আবছা অন্ধকার। থেমে থেমে অল্প অল্প ঠান্ডা বাতাস বইছে। তার কিছু জানালা গলে ঘরের ভেতর ঢুকছে। মিলি খাট থেকে নেমে জানালা আটকে দিলো। পর্দা টেনে দিতে দিতে বলল, “জানি না কেন এসব করছি। তবে এর সবটাই তাকে পাবার জন্য। সমাজ কেন আমায় স্বীকৃতি দিতে চায় না তা জানতে চাই না। বুঝতে চাই না। আমার শুধু তাকে চাই।” সে চওড়া হাসল। ঠিক তখনই নাইমা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে বলল, “ভেতরে আসব?”
“জিজ্ঞেস করছ কেন? আমার ঘরে ঢোকার জন্য তোমার অনুমতি নিতে হবে না। যখন খুশি চলে আসবে।”
নাইমা শক্ত মুখে বলল, “কারো ঘরে ঢোকার আগে অনুমতি নেওয়া এক ধরনের ভদ্রতা। অবশ্য এটা সবার জানা থাকে না।”
“তুমি সবসময় আমার সাথে এমন করে কথা বলো কেন? মনে হয় যেন আমি তোমার খুব বড় কোন ক্ষতি করে ফেলেছি।”

“আপনি কেন আমার ক্ষতি করতে যাবেন? কিছুই করেননি।”
“সবসময় খেয়াল করি- কথার মধ্যে ঝাঁঝ মিশিয়ে রাখো। এখানে আসায় অখুশি হয়েছ?”
“তেমনটা হলেও কিছু যায় আসবে না। আপনি আমাকে খুশি করার জন্য ফেরত চলে যাবেন না। বাদ দেন। আপনার জন্য শুকনো খাবার নিয়ে এসেছিলাম। এই নিন।”
মিলি এগিয়ে এসে বক্স দু’টো হাতে নিলো। সরু গলায় বলল, “কি আছে এতে?”
“একটায় বাদাম, কিশমিশ আর খেজুর অন্যটায় চানাচুর। খিদে পেলে খাবেন। মা দিয়ে পাঠালো।”
“সত্যিই আন্টি আমাকে অনেক ভালোবাসে। একদম নিজের মেয়ের মত জানে।”
নাইমা বিড়বিড় করে বলল, “একটু বেশিই ভালোবাসে। এতকিছু জানার পরও এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছে। কেন নিজেরা কেউ একজন গিয়ে কি রোহানকে নিয়ে আসা যেত না? অসহ্য!”
মিলি তার কথা স্পষ্ট বুঝতে পারল না। ভ্রু কুঁচকে বলল, “কিছু বললে?”
“কিছু না। আপনি বিশ্রাম নিন। আমাকে যেতে হবে। পড়তে বসতে হবে।”
সে আর কিছু বলল না। বক্স খুলে একটা খেজুর মুখে পুরে দিলো। এখন যে যা-ই বলুক, নিজেকে শান্ত রাখতে হবে। নয়তো উদ্দেশ্যে সফল হওয়া যাবে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাতে খাবার সময় মহিউদ্দিন সাহেব রোহানকে নিজের কোলের কাছে বসালেন। পাতের মাছ তরকারি রোহানের পাতে তুলে দিয়ে বললেন, “ভালো করে খাও। রান্না মজা হয়েছে?”
রোহান ডান দিকে মাথা কাত করল। বলল, “খুব মজা হয়েছে।”
তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। নাইমা বলল, “ভাইয়া বাড়িতে নেই। যতদিন না আসে আমি ভাবীর সাথে ঘুমাব।”
শরিফা বেগম বললেন, “কেন? নববী একা ঘুমুতে পারবে না?”
“পারবে না কেন? তবুও আমি ঘুমাতে চাই। ভাইয়া বারবার করে বলে গেছে।”
“তোর ইচ্ছে। তবে রাতে যেন আবার বিছানায় উঠে বসে থাকিস না। তুই তো কারোর সাথে ঘুমুতে পারিস না।”
নাইমা হাসল। মিলি বলল, “নাইমার সমস্যা থাকলে আমি নববীর সাথে বেড শেয়ার করতে পারি। কি নববী? তোমার কোন আপত্তি নেই তো?”

নববী না সূচক মাথা দোলালো। নাইমা বলল, “আমার আপত্তি আছে।”
শরিফা বেগম বিস্মিত গলায় বললেন, “তোর আবার আপত্তি কিসের?”
“এ বাবা! আপত্তি থাকবে না? মিলি আপু কতদিন বাদে আমাদের বাড়িতে এসেছে। মেহমান মানুষ। তাকে অসুস্থ রোগীর সেবাযত্ন করতে দেওয়া যায় নাকি? তাছাড়া আপু তো বলল- রোহান তাকে ছাড়া থাকতে পারে না। রাতে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়।”
শরিফা বেগম বললেন, “তা-ও তুই ঠিক বলেছিস। মিলি তোমার ওসব ঝামেলায় গিয়ে কাজ নেই। নাইমা ঘুমুতে চাচ্ছে, ও-ই ঘুমাক।”

মিলি একটু মিইয়ে গেল। তবে কাউকে বুঝতে দিলো না। ঠোঁটে চওড়া হাসি ধরে রাখল। খাওয়া শেষ করে সে খুব দ্রুতই উঠে পড়ল। বলল, “আন্টি, আমার খাওয়া শেষ। ঘরে যাচ্ছি। পরে এসে রোহানকে নিয়ে যাব।”
শরিফা বেগম বললেন, “ ঠিক আছে। যাও, আমি পরে গিয়ে রোহানকে। দিয়ে আসব। মিলি উঠে যাবার পর মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, “বিয়ের উপযুক্ত মেয়েকে এভাবে বাড়িতে রাখা ঠিক না। লোকে নানান কথা বলবে।”
শরিফা বেগম বললেন, “কে কি বলবে? রোহানের ফুফু, রোহানকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে। এখানে কার কি বলার থাকতে পারে? তাছাড়া বলাই তো আছে- পা’পকে ঘৃণা করো, পা’পীকে নয়। সেখানে একজনের দোষ অন্য একজনের কাঁধে দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত? তাছাড়া হাবিব এখন বাড়িতে নেই।”
মহিউদ্দিন সাহেব কথার জবাব দিলেন না। বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এই মহিলার আগে থেকেই বড় মেয়ে আর তার শশুরবাড়ির প্রতি দূর্বলতা আছে। এতকিছুর পরও সে দূর্বলতা ফিকে হয়ে যায়নি দেখে তিনি খুবই বিস্মিত হলেন।
রাত দশটা নাগাদ হাবিব কল দিলো। নববী কল রিসিভ করে বলল, “কোথায় ছিলে? কল রিসিভ করছিলে না কেন?”
হাবিব লম্বা হাই তুলে বলল, “হোটেলে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তোমাকে টেক্সট পাঠিয়েছিলাম। পড়ে দেখনি?”

“দেখেছি। সেজন্যই খানিকটা চিন্তামুক্ত থাকতে পেরেছি। রাতে খাওয়া হয়েছে?”
“না এখনও খেতে যাইনি। একটু পর যাব। নতুন জায়গা, বাকি দু’জন ঘুরতে বেরিয়েছে।”
নাইমা খাটে হেলান দিয়ে বই পড়ছিল। সে হাতের ইশারায় মোবাইল চাইল। নববী বলল, “নাইমা তোমার সাথে কথা বলবে।”
“নাইমা তোমার সাথে ঘুমাবে?”
“হুম। আমি একা থাকতে পারতাম কিন্তু সে রাজি হলো না।”
“ঠিক আছে। ওকে ফোনটা দাও।”
নববী নাইমার দিকে মোবাইলটা এগিয়ে ধরল। নাইমা বলল, “ভাইয়া, ঠিকভাবে পৌঁছে গেছ?”
“হুম ঠিক ভাবে এসেছি। সমস্যা হয়নি।”
“তোমায় একটা কথা জানানোর আছে। গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো তাই বলছি।”
“কি কথা? বাড়িতে কোন ঝামেলা হয়নি তো?”
“না, এখনও কিছু হয়নি। তবে মিলি আপু এসেছে। রোহানকে সাথে নিয়ে এসেছে। রাতে থাকছে। কিছুদিন থাকবে বলেছে।”
“হঠাৎ মিলি বাড়িতে আসবে কেন?”
“বলেছে- রোহান আসতে চেয়েছিল তাই। তবে আমার কাছে ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না। ওই মেয়ের মতিগতি সুবিধা না।”

“আমার মনে হয় তুই একটু বেশিই ভাবছিস। তবুও নজরে নজরে রাখ। কিছু হলে সাথে সাথে জানাবি।”
নাইমা মোবাইল ফেরত দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। সে ভাই ভাবীর কথা শুনতে চায় না। তারা দু-জন দীর্ঘ সময় কথা বলল। বিশেষ কিছু নয়। সাধারণ অর্থহীন কথাবার্তা। কথা বলার জন্যই কথা বলা। তবে তাদের কথা বলতে ভালো লাগছিল। বাদশা দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুকল। নরম গলায় বলল, “হাবিব ভাই, খেতে আসেন। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে। আবার সকালে উঠতে হবে।”

হাবিব নববীকে বিদায় জানিয়ে বলল, “আসছি। তবে আপনার চোখ-মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? সজীব ভাই কোথায়?”
“সজীব ভাই নিচে অপেক্ষা করছে।” তার গলার স্বর একটু অন্যরকম শোনালো। হাবিব বলল, “আপনার কি কিছু হয়েছে? দেখে মনে হচ্ছে দুশ্চিন্তায় আছেন।”
বাদশা দু-হাত দিয়ে মুখ মুছে ফেলল। বলল, “আমার জীবনের একমাত্র সমস্যা আমার স্ত্রী। তাকে কোন কিছু বোঝানো যায় না ভাই। তার ভাষ্যমতে আমি হোটেলে মেয়ে নিয়ে এসেছি। তাকে সারাক্ষণ ভিডিও কলে রাখতে হচ্ছে।”
“বউকে ভিডিও কলে রাখবেন। এতে বিরক্ত হবার কি আছে?”

“উদ্দেশ্য এবং কথার কারণে পরিস্থিতি পাল্টে যায় ভাই। সে যদি বলত- তোমার না দেখে থাকতে পারছি না, ভালো লাগছে না। তাহলে কোন সমস্যা ছিল না। সারারাত কথা বলতেও বিরক্তি আসত না। সে বলছে- নিশ্চয়ই তুমি কোন মেয়ের সাথে আছ। ভিডিও কল দাও আমি দেখব তুমি কোথায়। এমন করলে কার ভালো লাগে বলুন?”
হাবিব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। একজন পুরুষের জীবনে সবথেকে বড় পাওয়া হচ্ছে একজন নেককার স্ত্রী। যে তাকে বুঝবে৷ ভালোবাসবে। খাবার সময়ও হাবিব খেয়াল করল বাদশাকে তার বউ কল দিচ্ছে। সে মোবাইল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আশপাশ দেখাচ্ছে। সজীব বলল, “হাবিব ভাই, বাদশা ভাই কেমন ভেড়া দেখেছেন? কোথায় আছে সেটাও বউকে ভিডিও কলে দেখাচ্ছে। এমন পুরুষ হয়ে জীবনে কোন লাভ নেই।”
হাবিব ভ্রু কুঁচকে বলল, “কেমন পুরুষ হয়ে লাভ আছে?”

“মেয়ে মানুষকে দাসীর মতো করে দেখতে হবে। এমন করে তৈরি করতে হবে যে উঠতে বললে উঠবে বসতে বললে বসবে। ঘরে থাকবে, বাচ্চা পালবে, স্বামীর সেবাযত্ন করবে। এইতো! পায়ের জিনিস মাথায় তুলতে নেই।”
হাবিব হাসল। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “আপনি পুরুষ আর কাপুরুষের পার্থক্য বোঝেন না। একটু পড়াশোনা করবেন। আর কিছু না হোক সামান্য ধর্মীয় জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অবশ্য জ্ঞানের দরকার মানুষের, অ’মানুষ বা পশুদের জ্ঞানের দরকার হয় না।”

সজীব তার কথা বুঝল। মনে মনে দু’টো কুৎসিত গালি দিয়ে বলল, “নিজেকে মহা পন্ডিত মনে করে। নেহাৎ অফিসের কাছে এসেছি, নয়তো এর জবাব দিয়ে দিতাম।” শেষ কথাগুলিও সে মনেমনেই বলল। খাওয়া শেষে তিনজন নিজের ঘরে চলে গেল। বাদশার চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছিল- সে বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছে।
নববীর ঘুম ভাঙল দেরিতে। ততক্ষণে বেলা উঠে গেছে। সে ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসল। রাতে হাবিবের সাথে কথা বলতে গিয়ে বেশ দেরি হয়ে গেছিল। লোকটার নতুন জায়গায় ঘুম আসে না। নিজেও ঘুমায়নি, নববীকেও ঘুমুতে দেয়নি। সে তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামল। কোন রকমের হাত-মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। চুলায় চাল ফুটছে। হয়তো শরিফা বেগম ভাত চড়িয়ে দিয়েছেন। সে রাতের বাসি থালাবাসন গুছিয়ে নিয়ে পুকুরের দিকে গেল। সিঁড়ি দিয়ে দুপা নামতেই তার পা পিছলে পড়ে যাবার জোগাড়। নববী বেশ কষ্টে নিজেকে সামলে নিলো তবে হাতের থালাবাসন ধরে রাখতে পারল না। সবকিছু চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কাঁচের গ্লাস দু’টো ভাঙল। থালাবাসন পড়ার শব্দ শুনে শরিফা বেগম দৌড়ে এলেন। ব্যস্ত গলায় বললেন, “কি হয়েছে? কার কি হলো?”

নববী বলল, “পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলাম আম্মা। তবে সামলে নিয়েছি।” ভয়ে তার গলার স্বর তখনও কাঁপছে।
শরিফা বেগম বললেন, “দেখে শুনে কাজ করতে পারো না? এই অবস্থায় পড়ে গেলে কি হতো তোমার?”
“সাবধানেই হাঁটছিলাম। হঠাৎ কি হলো বুঝতে পারলাম না।”
ততক্ষণে নাইমা মিলি দুজনে পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছে। নাইমা তীক্ষ্ণ চোখে চারদিক দেখল। সরু গলায় বলল, “সিঁড়ির ওপর সাবানের ফেনা দেখা যাচ্ছে। কে এমন করেছে?”
মিলি লজ্জিত মুখে বলল, “আমার কাপড়ে একটু তেল পড়ে গিয়েছিল। তাই ধুয়ে দিয়েছি। রোহান খুব ডাকছিল বিধায় সিঁড়ি ঘাট পরিষ্কার করা হয়নি। আমি খুবই দুুঃখিত নববী।”
“এখন দুঃখিত বলে কি হবে? যদি ভাবী ভালো-মন্দ কিছু হয়ে যেত তখন? তখন কি হলো? মুখে তো খুব বড় বড় কথা বলেন, কাজে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কেন?”

চন্দ্রাস্ত পর্ব ২

মিলির চোখের কোণে পানি চলে এসেছে। শরিফা বেগম কঠিন মুখে বললেন, “যা হবার হয়েছে। আল্লাহর রহমতে কিছু হয়নি। নববী ঘরে যাও, থালাবাসন ধুতে হবে না।”
নববী মাথা দোলালো। ভয়ে তখনও তার বুক কাঁপছে।

চন্দ্রাস্ত পর্ব ৪