চন্দ্রাস্ত পর্ব ৯

চন্দ্রাস্ত পর্ব ৯
ফারহানা কবীর মানাল

হাবিবের অফিস যতক্ষণে শেষ হলো, ততক্ষণে সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। আকাশে অসংখ্য তারা ঝলমল করছে। থেমে থেমে ঠান্ডা বাতাস বইছে। মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। সে রাস্তার একপাশে সরে দাঁড়াল। বাদশা বলল, “আজ-কাল সজীব ভাইয়ের মন বেশ ভালো। সবসময় ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি ধরে রাখে।”
হাবিব বলল, “অফিসের বস কাজের প্রশংসা করলে যে কেউ হাসি-খুশি থাকবে৷ এখানে বিস্মিত হবার কিছু নেই।”
“ব্যাপারটা আমার কেমন অন্যরকম লাগছে। অফিসে নতুন একটা মেয়ে এসেছে না? কি যেন নাম! ও হ্যাঁ মুন্নী। তার সাথে ভালোই খাতির করেছে।”

“করুক না। তাতে আমাদের কি? যে যার নিজের কর্মফল ভোগ করবে।”
“শালার কপাল ভালো৷ খুব ভালো একটা বউ পেয়েছে। কখনো কোন ঝামেলার কথা শুনি না।”
“মানুষ জনে জনে বউয়ের সাথে সমস্যার কথা বলে বেড়ায় না।”
বাদশা একটু মিইয়ে গেল। নরম গলায় বলল, “তা ঠিক৷ তবে আমি শুধু আপনাকেই আমার সমস্যার কথা বলি। অন্য কাউকে বলি না।”
হাবিব জবাব দিলো না। বাদশা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। উৎসাহী গলায় বলল, “একটা কথা জানতে চাইব? যদি কিছু মনে না করেন আর কি!”
“কি কথা?”
“অফিসে কাজে যে হোটেলে উঠেছিলাম, সেখানে আপনার সাথে এক মেয়েকে বসে থাকতে দেখেছিলাম। মেয়েটা কে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হাবিব গম্ভীর গলায় বলল, “কেন জানতে চাইছেন?”
“এমনি! বিশেষ কোন কারণ নেই। পরিচিত ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন তাই জানতে চাইছি। আগে-পরে কখনো কোন মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলতে দেখিনি তাই আর কি।”
“ওহ আচ্ছা।”
বাদশা সরু চোখে তাকাল। রাস্তায় গাড়ি চলাচল বেশ ভালো। ল্যামপোস্টের আলোয় অন্ধকার কিছুুটা মিইয়ে এসেছে। সে হাত উঁচু রিকশা দাঁড় করালো। রিকশায় বসতে বসতে বলল, “হাবিব ভাই, সাবধানে যাবেন। দেশের অবস্থা ভালো না।”

হাবিব বিরক্ত মুখে মাথা নিচুু করে রইল। হঠাৎই তার শরীর খারাপ লাগছে। মিলির কে’স নিয়ে কথা বলার জন্য দারোগা সাহেব থানায় ডেকেছেন। বলেছেন, ‘অফিস শেষ করেই চলে আসবেন। দ্বিতীয়বার যেন বলতে না হয়।”
মিলি যা করে রেখে গেছে তাতে তাকে সন্দেহের বাইরে রাখার সুযোগ নেই। বরং তাকেই অপরাধী মনে হচ্ছে।
সে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। থানার দিকে যাবার জন্য রিকশা ঠিক করল। আগের দারোগা বদলি হয়ে গেছে। সে থাকলে হয়তো ঝামেলা কিছুটা কম হত। চেনা পরিচিত ছিল। হাবিব আবারও ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
নাইমা সন্ধ্যার পরপর বই পড়তে বসে। আজও বসছে। তবে মন লাগাতে পারছে না। নানান চিন্তা মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। সে একটা খাতা বের করল। সাদা কাগজে এক নম্বর দিয়ে লিখল–

১.ঘরের মধ্যে লা’শ পড়ে আছে। অথচ বাড়ির কেউ কিছু জানে না।
(অর্থাৎ খু’নি পরিচিত কেউ একজন। যে জানত বাড়ি কখন ফাঁকা থাকে।
অথবা বাড়ির কেউই খু’নটা করেছে। দোষ এড়াতে নিজের অনুপস্থিতির কথা বলছে)
২.বাড়িতে মিলির বান্ধবী এসেছিল। মিলির মায়ের সাথে তার কথা হয়েছে। তবে সে মেয়েটাকে আগে থেকে চিনত না। হতে পারে ওই মেয়েটাই খু’ন করেছে। এখন আত্নগোপনে আছে।
৩.ভাবী(নববী) মিলিদের বাড়িতে গিয়েছিল। সে বলছে- সে খু’ন করেনি। আবার তাকেও কেউ দেখেনি। অর্থাৎ বাড়ি ফাঁকা ছিল।
নাইমা কিছুক্ষন খাতার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর তড়িঘড়ি করে উঠে নববীর ঘরে চলে গেল। নববী তখন বিছানায় বসে আছে। তার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। সে নববী কাছে গিয়ে বসল। নিচু গলায় বলল, “ভাবী তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।”

নববী দরজার দিকে তাকাল। নাইমা দরজা ভেজিয়ে দিয়েছে। নববী বলল, “কি বলবে? তোমার ভাই এসেছে?”
“না, ভাইয়া এখনও আসেনি। মিলি আপুর ব্যাপারে কথা বলতে চাই।”
“তার ব্যাপারে আমি কি জানব বলো?”
“সিরিয়াস কিছু নয়। তুমি বলেছ- তুমি ওদের বাড়িতে গিয়েছিলে।”
“হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।”
“কখন গিয়েছিলে? গিয়ে কি কি দেখছ?”
“সকালে রান্নার পরপরই গিয়েছিলাম। গতকাল রাতে মিলি আমাকে কল দিয়েছিল। বলল সে এমন এক উপায় পেয়েছে যে হাবিব তার হয়ে যাবে। খুব তাড়াতাড়ি তার হয়ে যাবে। আমি কিছুই করতে পারব না। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব। আমার রূপ সৌন্দর্য কোন কাজে আসবে না। এতটুকু বলে কল কেটে দিয়েছে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, সাথে প্রচন্ড রেগে গেছি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।”

“ওদের বাড়ি গিয়ে কি দেখলে? তাছাড়া তুমি কাউকে কিছু না বলে একা কিভাবে গেলে?”
“আম্মাকে বলেছিলাম- ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। তোমার ভাই কিছু জানত না।”
“তারপর? যখন তুমি গেলে তখন ওদের বাড়িতে কেউ ছিল না?”
“না, কেউ ছিল না। ঘরের দরজা খোলা, আমি সোজা মিলির ঘরে ঢুুকলাম। দেখলাম মিলি খাটের ওপর বসে দেয়ালের দিক ফিরে আছে। আমি ওর নাম ধরে ডাকলাম। বললাম, ‘তুুমি যত চেষ্টাই করো না কেন হাবিব কখনো তোমার হবে না।’

মিলি আমার দিকে ফিরে হাসল। ওর সারা মুখে আচঁড়ের দাগ। ক্ষত থেকে র’ক্ত বেরিয়ে আছে। মিলি খুব বিশ্রীভাবে হাসছিল। আমি খুুব ভয় পেয়ে গেলাম। তড়িঘড়ি করে ফিরে চলে আসলাম।”
“এর বাইরে আর কিছু নেই? মিলি আপুর সাথে কথা হয়নি?”
“না কোন কথা হয়নি। ওর হাসি দেখে আমি!”
নাইমা নববীর হাতের ওপর হাত রাখল। অসম্ভব কোমল গলায় বলল, “দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ভাইয়া এসব নিয়ে রাগ করবে না।”
“যদি রাগ করে, যদি ভুল বোঝে। কি করব?”

সে জবাব দিলো না। এতক্ষণ নববী যা যা বলেছে সবকিছু খাতায় নোট করে নিয়েছে। হাবিব দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুকল। ক্লান্ত গলায় বলল, “নাইমা এক গ্লাস পানি দে। পিপাসা লেগেছে।”
নাইমা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালল। পানির গ্লাস হাবিবের হাতে দিয়ে বলল, “তোমার সাথে কথা আছে ভাইয়া। ফ্রেশ হয়ে একবার শুনে যাবে।”
“ঠিক আছে। তুই যা, আমি আসছি।”
হাবিব বিছানায় বসল। নববী বলল, “কি হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেন?”
“দারোগা সাহেব থানায় ডেকেছিলেন। নানান কথা জিজ্ঞেস করলেন। বিপদ যেন পিছু ছাড়ছে না।”
“আল্লাহ চাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

সে কিছু বলল না। গামছা হাতে বাথরুমে ঢুকে গেল। গায়ের ভেতর কেমন কুটকুট করছে। সময় নিয়ে গা ধুতে হবে। নববী বলল, “এখন সময় নিয়ে গোসল করতে হবে না। ঠান্ডা লাগবে।”
নাইমা ঘরের ভেতর পায়চারি করছে। হাবিবকে সবটা বলে দেয়া ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছে না। কিন্তু সে একাই বা কি করবে? কেসের কোন তথ্য তার কাছে নেই। কেউ কিছু বলবেও না। সে অনেক সময় নিয়ে ভাবল।
শরিফা বেগম ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি করছিলেন। তিনি দেখলেন- হাবিব নাইমার ঘরে ঢুকে গেল। ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। তিনি ব্যস্ত পায়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়ালেন। একটু আগেই খবরে দেখেছেন- বাবা মেয়েকে ধ’র্ষ’ণ করেছে। যেখানে বাপের কাছেই মেয়ের নিরাপত্তা নেই, সেখানে ভাইয়ের নিশ্চয়তা কি? শরিফা বেগম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। দরজার সামনে গিয়ে কান খাড়া করে রইলেন।
হাবিব ঘরে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে খাটের ওপর বসল৷ নাইমা তার দিকে খাতাটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “মিলির আপুর ব্যাপারটা নিয়ে এতটুকু লিখেছি। তুমি দেখে নাও।”
হাবিব মনযোগ সহকারে সবটা পড়ল। তরল গলায় বলল, “নববী তোকে বলে গিয়েছিল? বললে তুই বাঁধা দিসনি কেন?”

“ভাবী আমাকে বলে যায়নি ভাইয়া। মিলি আপু ড্রেসিং টেবিলের ওপর ভাবীর মতো একই কানের দুল দেখে সন্দেহ করেছিলাম। সন্দেহ করেছিলাম কারণ- ভাবীর কানে তখন ওই দুল ছিল না।”
“নববীর কানের দুল?”
“না কানের দুল ভাবীর নয়। একই রকমের। দুল নিয়ে জিজ্ঞেস করতে ভাবী তার জোড়া দেখাল। তবে নিজের মুখে বলেছে সে ওই বাড়িতে গিয়েছিল।”
হাবিব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। নাইমা বালিশের নিচ থেকে কানের দুল জোড়া বের করে ভাইয়ের হাতে দিলো। বলল, “এই যে।”
হাবিব অনেকক্ষণ ধরে সেটা নেড়েচেড়ে দেখল। সরু গলায় বলল, “হুবহু এক রকমের। কিন্তু মিলি এটা কোথায় পেল!”

“জানি না ভাইয়া। ভাবীকে কোথা থেকে কিনে দিয়েছিলে?”
“যেখানে গিয়েছিলাম সেখান থেকে নিয়ে এসেছি।”
“ওহ আচ্ছা! ভাইয়া”
নাইমা আর কিছু বলবে আর আগে শরিফা বেগম দরজা ধাক্কাতে শুরু করলেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “নাইমা, দরজা আটকে কি করছিস? এক্ষুণি দরজা খোল।”
হাবিব দরজার হাতল ধরে একটু জোরে টান দিতেই দরজা খুলে গেল। শরিফা বেগম বললেন, “তুই এখানে কি করিস? দরজা আটকে রেখেছিলি কেন?”
হাবিব জবাব না দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। শরিফা বেগম ঘরে ঢুকে নাইমার বাহু চেপে ধরলেন। থমথমে গলায় বললেন, “হাবিব তোর ঘরে কি করছিল? দরজা আটকে রেখেছিলি কেন?”
“কিছুু না এমনি। পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছিল।”
“পড়া বোঝাতে দরজা আটকাতে হবে?”
“এমনি চেপে দেওয়া ছিল। ছিটকিনি লাগালো ছিল না।”
“তোকে ভালো কথা বলছি। তোর বাবা, হাবিব এদের সাথে একা থাকবি না। আর থাকলেও দরজা জানালা খোলা রাখবি।”

“মানে কি? আব্বা ভাইয়া এদের সাথে একা থাকলে কি হবে?”
“বেশি কথা বলিস না। পুরুষ মানুষ পুরুষ মানুষই।”
নাইমা ঠোঁট টিপে হাসল। শরিফা বেগমের কাছে সেই হাসি ভালো লাগল না। তিনি কঠিন মুখে তাকিয়ে রইলেন।
নববী খাটের ওপর বসে পা ঝুলিয়ে রেখেছে। হাবিব তার পাশে গিয়ে বসল। কাঁধে হাত রেখে অসম্ভব কোমল গলায় বলল, “মিলির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে কেন? আমায় বিশ্বাস হয় না।”
“বিশ্বাস হয়। নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি। তোমার সাথে ওর ছবি দেখানোর পরও একবারের জন্য এমন কুৎসিত কথা বিশ্বাস করিনি। তবে ও খুব বাজে কথা বলছিল। বলছিল তোমাকে আমার থেকে দূরে নিয়ে যাবে। তাই সর্তক করতে গিয়েছিলাম।”
“তুমি জানতে না মিলির তোমার ক্ষতি করতে চায়? একবার চেষ্টাও করেছে। তবুুও কেন গিয়েছিলে? তুমি আমাকে হারানোর ভয় পাও আর আমি তোমাকে হারানোর ভয় পাই না?”
নববী জবাব দিতে পারল না। মাথা নিচু করে রইল। হাবিব হাসল। শান্ত গলায় বলল, “কেউ না জানুক, আমার আল্লাহ জানেন- এ জীবনে তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই চাইনি।”
নববীর চোখ ভিজে উঠছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। এ কথার উত্তরে ঠিক কি বলা যায়? হাবিব তার চোখের পানি মুছে দিলো। কোমল গলায় বলল, “কখনো এমন কিছু ভাববে না। এমন কথা চিন্তা করে নিজেকে কষ্ট দেবে না। ঠিক আছে?”

চন্দ্রাস্ত পর্ব ৮

নববী মাথা দোলালো। তার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে হাবিবকে জড়িয়ে ধরে বেশ সময় নিয়ে কাঁদবে। মন সব কষ্ট ধুয়েমুছে ফেলবে।
রাত বাড়ছে। থেমে থেমে একটা পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। রাতের খাওয়া শেষ। সবাই নিজের ঘরে ঘুমচ্ছে। নববীও ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। হাবিব নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে নামল। ধীর পায়ে হেঁটে সোহেলের ক’ব’রের সামনে এসে দাঁড়ালো। কতদিন হয়ে গেছে তার ছেলেটা আর নেই। নিজের প্রথম সন্তান ক’ব’রে শুয়ে আছে। বাবা হয়ে এ কষ্ট সহ্য করা যায় না। হাবিব চোখ থেকে পানি পড়ছে। ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি ধরে রেখেছে।

চন্দ্রাস্ত পর্ব ১০