চিত্রাঙ্গনা পর্ব ২৭

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ২৭
ইশরাত জাহান জেরিন

সন্ধ্যার ধোঁয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারে পরিবেশ কেমন যেন গুমোট হয়ে আছে। বৃষ্টির জলধারা যেখানে স্নিগ্ধতা ছড়ানোর কথা, সেখানে উল্টো একপ্রকার অস্বস্তিকর ভ্যাপসা উষ্ণতা ঘনীভূত হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশের ভারী মেঘমালার নিচে বাতাস নিস্তব্ধ। আর্দ্রতা বাতাসের প্রতিটি কণায় জমাট বেঁধে রয়েছে।
ফারাজ বাড়িতে নেই। চিত্রার জ্বর কমে গেছে, শরীরেও আর কোনো দুর্বলতা বোধ হচ্ছে না। সন্ধ্যার আগে ফারাজ তাকে ওষুধ ও খাবার খাইয়ে বাইরে গেছে। সারাদিন ঘরের মধ্যে বন্দি থেকে থেকে একঘেয়েমি চেপে ধরেছে চিত্রাকে। আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকা যায়? মন যেন হাঁপিয়ে উঠেছে।
চিত্রা স্থির করল, একটু বাগানে গিয়ে হাঁটবে। মিতালিকে ডেকে সে তার সিদ্ধান্ত জানাল। কিন্তু মিতালি সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি তুলল, “এমন সময় বাগানে যাওয়ার কী দরকার? কয়েকদিন আগেই তো সেখানে দুইডা লাশ পাওয়া গেছে!” তবে চিত্রা সে কথায় কান দিল না। মনস্থির করে ফেলেছে, নিষেধ শুনলে আর চলবে না। ঠিক তখনই আয়েশা এগিয়ে এসে বলল, “আমি তোমার সঙ্গে যাব।” চিত্রা তাকেও নিজের সঙ্গে নিয়ে দেয়।

বাগানের অন্তিম প্রান্তে কর্মীদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে কর্মরত নারী শ্রমিকদের বেশিরভাগই কাজ শেষে নিজ বাড়িতে ফিরে যায়, হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া। মিতালি তাদেরই একজন, যদিও তার নিজস্ব বাড়ি-ঘর ও পরিবার আছে। তবে সে কাজ নেওয়ার আগেই বলে রেখেছিল এখানেই থাকবে। তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার পর থেকেই সৎ মায়ের অত্যাচারে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। আর কতদিন সহ্য করা যায়? মুক্তির আশায় সে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। আয়েশাও দাদিকে নিয়ে এখানেই থাকা শুরু করেছে। অন্ধকার বাগানে তিনজন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ মিতালির ফোন বেজে উঠল। চিত্রা একবার চোখ ফিরিয়ে তাকাল। তারপর আবার হাঁটা শুরু করল। সে বড় করে ঘোমটা টেনে নিয়েছে। শরীর থেকে জ্বর পুরোপুরি সরে যায়নি, তবু গুমোট ঘরের দেয়ালের মাঝে বন্দি থাকাটা যেন আরও অসহনীয়। তাই সে বাইরে এসেছে। নীরবতার মাঝে শ্বাস নিতে, গাঢ় অন্ধকারের গভীরে প্রশান্তি খুঁজতে।
” মিতালি তোমার ফোনটা দেওয়া যাবে।”বলল চিত্রা।
মিতালি কোনো জবাব দিল না। শুধু নিঃশব্দে নিজের বাটন ফোনটা চিত্রার দিকে বাড়িয়ে দিল। তবে খানিকটা দ্বিধার সুরে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“খালু জানলে সমস্যা হইব না তো?”
চিত্রার কণ্ঠে নিরাসক্ত আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠল, “সে জানবে কিভাবে? কেবল একটা কণ্ঠ শুনতে চাইছে মন, শুনেই কল কেটে দেবো।”
চিত্রা ফোনটা হাতে নিয়ে একটু আড়ালে সরে গেল। ঠিক তখনই কর্মীদের থাকার দিক থেকে একটা লোক মিতালির দিকে এগিয়ে এল। তার পরনে সাধারণ শার্ট আর লুঙ্গি, বয়স খুব একটা কমও নয়, আবার খুব বেশি বলেও মনে হয় না। অন্ধকারে মিতালির মুখ চিনতে দেরি হলো না লোকটার।
“এই মিতালি, এদিকে আয়!”
মিতালি পা বাড়ায় না, স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটা মুখ দিয়ে অদ্ভুত সব শব্দ করে তাকে কাছে ডাকছে।
বিরক্ত হয়ে মিতালি একবার চোখ ফেরাল চিত্রার দিকে। কোথায় সে? হুট করে কই চলে গেল?
“উনি তোমাকে বিরক্ত করছে? বলো আমায়? শালাকে একেবারে গু খাইয়ে ছাড়ব!” আয়েশার গলায় চিরপরিচিত দম্ভ।
“উঁহু। এসবে তুমি জড়াইও না,” মিতালি দ্রুত বলে উঠল।
“এসব ভয় পায় না আয়েশা। আমি তো একবার পুলিশের পকেট পর্যন্ত মেরেছি! বুকে সাহস না থাকলে এসব কাজ করা যায়? আমি কোনো সাধারণ নারী নই, এক্কেবারে মহীয়সী নারী! সামনের বছর বেগম রোকেয়ার অ্যাওয়ার্ডটা আমাকেই দেওয়া উচিত!”

অন্য সময় হলে মিতালির মুখে এমন কথা শুনে নিশ্চিত হাসি আসত। কিন্তু এবার আর এল না। এখন শুধু এখান থেকে দ্রুত সরে যাওয়াটাই জরুরি।
“কিরে মিতালি, আমি আসব নাকি তুই?”আবারও সেই কর্কশ পুরুষালি কণ্ঠস্বর।
মিতালি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করল। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত পরই ফিরে এলো। তবে এবার তার চোখে অস্বস্তির ছাপ। ফিরে এসে চিত্রাকে দেখতে পেলো। চিত্রা আর আয়েশার সামনে এসে খানিকটা কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়ালো সে।
“কি হয়েছে, মিতু? ওরা কারা?” চিত্রার স্বর সন্দেহপ্রবণ।
“এই বাড়িতেই কাম কররে। রাজন ভাইয়ের লোক।”
“তোমাকে এত চিন্তিত লাগছে কেন?”
“ক-কই না তো, আপা! চলেন, ভেতরে যাই। খালু আইসা যদি দেখে আমরা বাগানে টইটই করতাছি, তাইলে রাগ করবো।”
চিত্রা আর কিছু না বলে হাঁটতে শুরু করল। তবে যাওয়ার আগে একবার পেছন ফিরে তাকাল সেই লোকটার দিকে। বাতির ম্লান আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠল তার লোভাতুর দৃষ্টি, বিকৃত হাসি। চিত্রা আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না। দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।

বদ্ধ স্যাঁতস্যাঁতে একটি ঘর। চারপাশে ভাসমান এক বিদঘুটে আঁশটে গন্ধ। যেন গলিত মাছের অন্তর্গত পচন ছড়িয়ে আছে বাতাসে। এখানে স্তূপ করে রাখা হয় নানান জাতের মাছ। তারপর সেগুলোকে প্রসেসিং করে রপ্তানিযোগ্য করা হয় বিদেশি বাজারের জন্য। ফারাজ ধাতব চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। অস্থিরতা তার চেহারায় স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। চারপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে কালো পোশাক পরিহিত মানুষ। নিঃশব্দ, নড়াচড়া নেই, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা ছায়ামূর্তির মতো। তাদের মাঝে কয়েকজন বহিরাগতও আছে। বিদেশি কায়দার দানবীয় শরীর, দীর্ঘকায়, পেশিবহুল। শুধু উপস্থিতিতেই ভয় ছড়ানোর ক্ষমতা রাখে এরা।
ঘরটায় অসহনীয় গরম। বাতাস থমকে আছে। এখানকার ভারী দুর্গন্ধ দম বন্ধ করে রেখেছে সবকিছুকে। ফারাজ বিরক্ত হয়ে নিজের গা থেকে কালো ব্লেজারটা খুলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অভ্রর দিকে বাড়িয়ে দিল। কণ্ঠে স্পষ্ট বিতৃষ্ণা,

“আইসক্রিমটাকে নিয়ে আসো কুদ্দুসের বাপ।”
অভ্র কোনো জবাব দিল না। কেবল পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা কালো পোশাকধারী এক ব্যক্তির দিকে তাকাল। ইঙ্গিতটা বুঝতে দেরি হলো না লোকটার। লোকটি নিঃশব্দে ঘুরে দাঁড়াল। পেছন থেকে আরেকজনকে সঙ্গে নিল। তারপর দু’জন মিলে এগিয়ে গেল হিমবাহের দিকে। সেই কক্ষ, যেখানে হিমায়িত পদ্ধতিতে মাছ সংরক্ষণ করা হয়। আপাতত তাদের মূল উদ্দেশ্য সেখানেই। কয়েক মুহূর্ত পর, তারা ফিরে এল। তবে এবার শূন্য হাতে নয়। একজনকে টেনে নিয়ে এসেছে সঙ্গে। লোকটি জমে কাঠ হয়ে গেছে। বরফের পিণ্ডের মতো নিথর। মাত্রই তাকে হিমবাহ থেকে বের করা হয়েছে। শরীরে রক্তের কোনো প্রবাহ নেই বলেই মনে হয়। অথচ এখনো শ্বাস চলছে। প্রাণটুকু টিকে আছে কোনোরকমে। হয়তো বেশি সময় সেখানে রাখা হয়নি, রাখা হলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই নিথর হয়ে যেত।
কক্ষের উষ্ণতার সঙ্গে হিমায়িত শরীরের সংঘাতে লোকটি কাঁপছে। দাঁতে দাঁত লেগে বিকট আওয়াজ তুলছে। ফারাজ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। শুধু ঠান্ডা, নিরাসক্ত দৃষ্টি। লোক দু’টো পরে থাকা লোকটার দিকে এগিয়ে আসতেই ফারাজ হাত দিয়ে ইশারায় তাদের সরে দাঁড়াতে বলল।
“আইসক্রিমটাকে একটু গলতে তো দে।”

লোক দু’টি ধীরে ধীরে সরে দাঁড়ায়। পরিবেশের ভারী নীরবতার মাঝে অভ্র এখনো নিশ্চল, নিঃশব্দ। তার চিবুক শক্ত হয়ে আছে। নাকে ক্রমাগত ধাক্কা দিচ্ছে মাছের কাঁচা পচা গন্ধ। বাতাসের আর্দ্রতাও চিটচিটে হয়ে উঠেছে। ঘামের সাথে মিশে এক অস্বস্তিকর আস্তরণ গড়ে তুলেছে গায়ের ওপর। কিন্তু ফারাজ?
সে কি ভাবে বসে আছে? ফারাজ তার হলস্টার থেকে কোল্ট পাইথনটা বের করে হাতে নিয়ে ভালো করে খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে দেখল। দেশে আসার পর পিস্তল ছুঁয়ে দেখা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে সে। এসব কি ফেয়ার? উঁহু! মোটেই নয়। ফারাজ পিস্তলের দিকে গভীর মনোযোগ দিয়েই পরে থাকা লোকটাকে প্রশ্ন করল,
“এই যে চান্দু তুমি যে বাটপারি করলে আমার সঙ্গে এখন তোমার সঙ্গে কি করা উচিত বলো তো? ইউম্যান ফ্রাই করা উচিত কি?”
লোকটির দেহ ঠান্ডায় অবশ হয়ে আসছে। তবুও আতঙ্কের জ্বর তার শরীর বেয়ে ধাপে ধাপে চুঁইয়ে পড়ছে। আধনগ্ন দেহ কাঁপছে অবিরাম। হাড়ের ভেতরে বরফগলা স্রোত বয়ে চলেছে। তার ফ্যাকাশে ঠোঁট কেঁপে ওঠেল অস্ফুট শব্দ ফিসফিসিয়ে বেরিয়ে আসল কণ্ঠনালী ছুঁয়ে,

“স্যা..স্যার…. ক্ষ..মা করে দেন। ভু..ল হয়ে গে..ছে আমা..র।”
লোকটার স্বর জড়ানো, ভাঙা। যেন কোনো মৃতপ্রায় প্রাণী শেষ শক্তিটুকু নিংড়ে নিচ্ছে জীবন ভিক্ষার জন্য। ঠান্ডার চেয়েও প্রবল শঙ্কা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। অথচ সামনে বসে থাকা পুরুষটির মুখে একটুকরো অনুকম্পাও নেই।
“ক্ষমা?” ফারাজ মুখ বাঁকিয়ে হাসল। তাচ্ছিল্যমিশ্রিত সেই হাসি। অদ্ভুত সেই হাসির ধরণ।
“হেরে কুদ্দুসের বাপ এই হাফ নেংটুর অপরাধের পান্ডুলিপিটা একটু পাঠ করে শুনাও তো। শালার জাঙ্গিয়া টা দেখেছো নি? ক্যালভিন ক্লাইন । এই নিমকহারাম আমার নাম বেঁচে কি লেভেলের মাল কামিয়েছে ভাবা যায়? জাঙ্গিয়ার ব্র্যান্ডও ফুটপাত থেকে ক্যালভিন ক্লাইনে চলে গেছে। ফোনটা দাও তো কেউ… একটা চু চেড পোস্ট দেই।” অভ্র খানিকক্ষণ চুপ থেকে ভ্রুকুটি করে সুরে সুরে মিলিয়ে বলল,
” বুঝেন না ভাই অল্প পানির মাছ বেশি পানিতে গেলে যা হয় আরকি। ফুটানি করে বেশি।” অভ্র মুখ বাঁকিয়ে থেমে পুনরায় বলল,

“শালা ভাব ধরে গুলশান,
ভেতরে ভেতরে গুলিস্তান।
বাপরে ডাকে বাজান,
ধুইয়া খায় মান সম্মান।”
“ওয়াউ কিয়া কবিতা হে। এত চুন্দুল কবিতা পারো দেখেই তো ব্যাটা তোমার বিয়ে হয় না। ধারাও তোমার জন্যও চু চেড মার্কা একটা পোস্ট করতে হবে দেখছি।”
ফারাজ লোকটার সামনে ফারাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। তার বুটের নিচে শুকনো মেঝে চাপা পড়ে ক্ষীণ খসখসে শব্দ হচ্ছে। সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পড়ে থাকা লোকটিকে দেখল। চোখেমুখে কোনো অনুভূতি নেই। লোকটা ভয়ে হেঁচড়ে পিছানোর চেষ্টা করল। তবে অধিক সময় ঠান্ডায় জমে থাকার কারনে হাত পা অবশ হয়ে গিয়েছে। নড়চড়ের একদমই শক্তি নেই। ফারাজ হাটু গেঁড়ে লোকটার সামনে ঝুঁকে বসল। পকেট থেকে লাইটার বের করে ধরিয়ে লোকটার গলার কাছটায় ছুঁয়ে দিতেই চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল ঘরটায়। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করার জন্য অবশ হাত-পা ছোড়াছুড়ি শুরু করল লোকটা।

“বাচ্চাদের মতো এসব করে পার পাবে না সাবিব। এত আকুতি করার আগে একবার ফারাজ এলাহীর কথা ভাবা উচিত ছিল না? আমার নাম করে চাকরির কথা বলে কয়টা নারীকে বিদেশ পাচার করেছো শুনি চান্দু?”
সাবিব নিশ্চুপ। ফারাজের ঠোঁটে বিদ্রূপাত্মক হাসির রেখা ফুটে ওঠল। নিস্তরঙ্গ ভঙ্গিতে সে উঠে দাঁড়ালো। অথচ চোখের তারায় জ্বলে ওঠল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।
অকস্মাৎ সে পায়ের তলায় চেপে ধরল সাবিবের গলা। চাপ বাড়তেই লোকটির কণ্ঠনালী থেকে অস্ফুট গোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসল। একটা অসহায় পশুর আর্তনাদ যেন। ফারাজের ভ্রূ কুঁচকে যায়। বিরক্তির ছায়া তার মুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠল। গম্ভীর কণ্ঠে সে ফিসফিসিয়ে বলে, “জলদি বল।”

কিন্তু সাবিবের ঠোঁট কাঁপলেও শব্দ বেরোয় না। মৃ*ত্যুর অন্ধকার তার শ্বাসনালী বেয়ে ক্রমশ নেমে আসছে। নিশ্বাস নিভে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে ফারাজ পা সরিয়ে নেয়। যেন এ যাত্রায় সে কেবল সিদ্ধান্তের রূপরেখা টেনেই ক্ষান্ত।
আসলে, ফারাজ হয়তো আদৌ তাকে কিছু করত না। বহুবার সুযোগ দিয়েও আজ তার ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সাবিব তারই লোক। দেশে থেকে কার্যক্রম চালায়। ‘কাজ’ শব্দটি ব্যবহার করলেও প্রকৃতপক্ষে কাজের আড়ালে করে এক ঘৃণ্য অপরাধ। নারী পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে সাবিব। অন্ধকার জগতের সেই কদর্য ব্যবসা, যেখানে জীবনের দামে বিকোয় স্বপ্ন। তবে এসব বিষয়ে ফারাজের আপত্তি থাকার কথা ছিল না। কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো তার স্বভাবে নেই। কিন্তু যখন সেই অন্ধকার তার নামকে আবৃত করতে উদ্যত হয়, তখন কি চুপ থাকা চলে? ছয় মাস ধরে সাবিব অসহায় নারীদের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাচার করছে।

প্রতিশ্রুতি দেয় স্বপ্নের মতো ভবিষ্যতের, অথচ বাস্তবে নিয়ে যায় এক বিভীষিকাময় বন্দিত্বের দিকে। শুরুর দিকে ফারাজ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু ক্রমশ তার নামকে জড়িয়ে কালিমালিপ্ত করার প্রয়াস বাড়তে থাকলে সে আর নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারেনি। কারণ ফারাজ তার নামকে কলুষিত হতে দিতে পারে না। কাউকেই সে এই সুযোগ দেবে না। সে টেবিলের ওপর রাখা টাইটানিয়াম জারটি হাতে তুলে নিল। ভেতরে টগবগ করে ফুটছিল ফ্লুরোসিক এসিড। সাবিব আতঙ্কে খানিকটা পিছু হটতেই দুইজন লোক শক্ত হাতে তাকে চেপে ধরল। ফারাজ গুনগুন করে নব্বইয়ের দশকের একটা ইংরেজি ফোক গান গাইতে গাইতে ধীরে ধীরে জারটি কাত করল সাবিবের বুকের ওপর। ভেতরে খুব বেশি এসিড ছিল না। তবে যতটুকু ছিল ততটুকুই যথেষ্ট।

প্রথম ফোঁটা বুক ছোঁয়া মাত্রই সাবিবের দম ফেটে গেল ভয়াবহ আর্তনাদে। শুরুতে এক মুহূর্তের জন্য কিছুই অনুভব হলো না। তারপরই চামড়ার নিচের স্নায়ুগুলোতে এক অস্বাভাবিক জ্বলুনি ছড়িয়ে পড়ল।
ফুটতে থাকা পানির মতো চামড়ার স্তর গলতে লাগল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জায়গাটি কালচে হয়ে গেল। আরেকটু পড়ে হালকা ধোঁয়া উঠতে শুরু করল। সাবিবের চিৎকার অসহনীয় হয়ে উঠল। যেন শরীর থেকে আত্মা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু তার মুখ চেপে ধরে রাখায় কেবল ভেতর থেকে গুমরে ওঠা বিকৃত গোঙানি বের হলো। তার চোখ বিস্ফারিত। রক্তজবা রঙের শিরাগুলো ফুলে উঠেছে আতঙ্কে। এসিডের প্রভাব মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। যেখানে তরল ছিটে পড়েছিল সেই অংশের মাংস ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যেতে লাগল। সাদা স্তর উন্মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। গলতে শুরু করল সেই স্থান। হাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। সাবিব একবার চাইল নিজের বুকের দিকে। নিজের মাংসের গলে যাওয়া অংশ দেখে তার শরীর শিউরে উঠল। সে কোনোভাবে হাত-পা ছোঁড়ার চেষ্টা করলেই তার দেহ আরো শক্ত করে ধরে রাখা হলো।
ঘরজুড়ে টকটকে পোড়া মাংসের গন্ধ ছড়াচ্ছে। ফারাজ তখনো গুনগুন করছিল। মুখে মৃদু হাসি। চোখে ছিল নির্মম সন্তুষ্টির পরশ।

চারদিক ঘন অন্ধকারে ঢাকা। দূর থেকে ভেসে আসছে ট্রলারের গম্ভীর গর্জন। রাতের নিস্তব্ধতায় নদীর শো শো শব্দ কানে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। নদী এখান থেকে বেশি দূরে নয়। সে কথা মনে করিয়ে দেয় বাতাসের আর্দ্র ঠাণ্ডা স্পর্শ।
ধ্বংসস্তূপে পরিণত তালুকদার বাড়ির সামনে এসে থামল একটি কালো রঙের প্রিমিও। গাড়ির ইঞ্জিন নিভতেই মুহূর্তের জন্য নেমে এলো নিস্তব্ধতা। গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এক লম্বা, চওড়া যুবক।
নিঃশব্দ পদক্ষেপে সে এগিয়ে গেল পুরনো, জরাজীর্ণ গেটের দিকে। মরচে ধরা লোহার ফ্রেম ঠেলে সে ভিতরে ঢুকল। অন্ধকারের শীতল চাদরে মোড়ানো ভগ্নপ্রায় গৃহটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই দৃষ্টিতে এলো হারিকেনের ক্ষীণ শিখা। জ্বলে, নিভে, আবার জ্বলে ওঠে। মুয়াজ্জলের মাটির ঘরের বারান্দায় ঝুলে থাকা সেই আলো প্রহর গুনছে। টিমটিমে সেই ক্ষীণ দীপ্তিতে ছায়া নাচে দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে। যুবকটি ধীরপদে এগোল। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ভিটেটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। স্থির দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ পরখ করল ধ্বংসের স্তূপ। অতঃপর দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেল কবরস্থানের দিকে। চাঁদের আলোহীন রাত্রিতে কবরস্থান নিকষ আঁধারে নিমজ্জিত। মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন বৃক্ষেরা স্তব্ধ। যুবকটি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। কবরস্থানটিকেও অন্ধকারের মধ্যে এক নজর পরখ করে মৃদু কন্ঠে শুধালো,

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ২৬

“ইশরে এত দুরত্ব আর মেনে নেওয়া যায় না। এবার দূরত্ব মেটানোর সময় চলে এসেছে।”
“কেডা তুমি?”
বৃদ্ধ মুয়াজ্জলের কন্ঠস্বর পেতেই লোকটা পেছন ফিরে তাকায়। ঘাড়ে হাত বুলিয়ে নিঃশব্দ হেসে জবাব দেয়,
‘আমি?আমি কেউ না। তবে কারো মৃত্যু কারোবা শুভাকাঙ্ক্ষী।”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ২৮