চিলেকোঠায় সমাপ্তি পর্ব ৯+১০ || লেখিকা মিহি

চিলেকোঠায় সমাপ্তি পর্ব ৯+১০
লেখিকা- মিহি

-“এক লোক ওনাকে পাঁচ লাখ টাকা দিছিল আপনার বাবা এবং ঐ ব্যবসায়ীরে সপরিবারে মারার লাইগা।
আমার স্বামীরে কোন জংলী পশু মারেনি। ঐ নরকের কীটটাই আমার স্বামীকে মেরে ফেলার লাইগা ঐ জঙ্গলে ফালাই আইছে।”
-“আপনি এত নিশ্চিত কীভাবে?”
-“আমার স্বামী জঙ্গলের খুটিনাটি রাস্তা চিনতো, বহুবার পুলিশের ভয়ে জঙ্গলে যাইয়া রইছে। জংলী পশুর থেকে বাঁচার সব মন্তর তার জানা। তাইলে ঐরম একটা মানুষ কেমনে পশুর আঘাতে মইরা যায় আমারে কন।”

কথাটুকু বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠে রমিজ আলীর স্ত্রী লতা। মেয়েটার উপর একটু-আধটু সন্দেহ হচ্ছে আয়াশের। একটু আগে মুখই খুললো না অথচ পাঁচ হাজার টাকার লোভে এখন সব গড়গড় করে বলছে আবার কাঁদছেও। এই মেকি কান্না ধরতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি তার তবে লতার বলা কথাগুলো যে পুরোপুরি মিথ্যা এমনটাও নয়। লতার কথার মধ্যে সততা আছে তবে কোন একটা বিষয় লুকোচ্ছে লতা যা তার মুখের রঙই বলে দিচ্ছে।
-“আপনার স্বামীকে এসব করতে আটকাননি কেন?”
-“তূর্য ভাইজান! আমার উনি এইসব ছাইড়া দিতে চাইছিল কিন্তু আপনার চাচাই কইছে এসব ছাড়লে তারে আর আমাগোরে গ্রামছাড়া করবো। আমরা হইলাম গিয়া গরিব মানুষ, গ্রাম ছাইড়া কই যাইতাম?”
-“পুলিশে জানাতেন বা আমাকেই বলতেন।”
-“তুমি যে তোমার চাচারে যাইয়া কইবা না তার গ্যারান্টি কী?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তূর্য চুপ হয়ে যায়। লতার কথা যুক্তিযুক্ত। পরিবারের সদস্য যেহেতু লতা ভাবতেই পারে সেও খারাপ। তূর্যর কেন যেন আজ নিজের চাচার প্রতি অনেক বেশি ঘৃণা লাগছে। এতদিন চাচার সব খারাপ কাজের কথা জানলেও তাকে ঘৃণা করেনি সে কিন্তু আজ তার প্রতি ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসছে তূর্যর। আয়াশ চুপচাপ লতার সব কথা শুনলো তবুও তার মনে হচ্ছে লতা কিছু একটা লুকোচ্ছে। লতার সামনে তা স্বীকার করলো না সে। লতার হাতে পাঁচ হাজার টাকা গুঁজে দিতেই লতার চোখ চকচক করে উঠলো অথচ এতক্ষণ তার কান্নাই থামছিল না। হাসিমুখে দরজা লাগালো সে। লতা দরজা লাগাতেই আয়াশ তূর্যকে সাথে করে নিয়ে চুপিচুপি লতার ঘরের জানালার পাশে এককোণে দাঁড়ালো। আধখোলা জানালার ফাঁক দিয়ে ব্যতিব্যস্ত লতাকে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। বাটন ফোন হাতে নিয়ে কাকে যেন বারবার কল দিচ্ছে সে কিন্তু অপর পাশের ব্যক্তিটি কল রিসিভ না করায় লতা বারবারই বিরক্ত হচ্ছে। কিছু সময় পরপর আবার ঐ লোককে দু-চারটে অকথ্য ভাষায় গালিও দিচ্ছে। একটু পর ফোন ফেলে অন্য ঘরে চলে গেল লতা। আয়াশ আর তূর্য লতার জানালার কাছ থেকে সরে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো। তূর্যর সারা চেহারায় প্রশ্নবোধক চিহ্নের ন্যায় একটা ভাব ফুটে উঠেছে। তূর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল আয়াশ।

-“কিছু বুঝিসনি, তাই তো?”
-“হ্যাঁ! ঐ মহিলা কাকে কল দিচ্ছিল?”
-“ঐ লোকটাকে যে ওর স্বামীকে টাকা দিয়েছে।”
-“কিন্তু ও যে বললো ঐ লোকটাই ওর স্বামীকে খুন করেছে। তাহলে নিজের স্বামীর খুনীকে সে কেন কল করবে?”
-“সবকিছু প্রি-প্ল্যানড। ঐ খুনী জানতো আমি এখানে আসবো। তাই আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে।”
-“এখন কী করবি?”
-“খুনীকে ধরবো।”
-“কীভাবে?”
-“আমায় একটা ছোটখাটো পেন ক্যামেরার ব্যবস্থা করে দে।”
-“লতার ঘরে লাগাবি?”
-“হুম।”
আয়াশ ঠিক কী করতে চাচ্ছে তা এখনো বুঝে উঠতে পারছে না তূর্য তবে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে। তূর্যর মনে আপাতত নিজের চাচার প্রতি মারাত্মক বিদ্বেষ জন্মে গেছে। কোন এক অজ্ঞাত কারণে তার এখন এটাও ধারণা হচ্ছে যে আয়াশের বাবাকে যারা মারতে চেয়েছিল তাদের সাথে তার চাচার কোন না কোন প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ যোগসূত্র তো অবশ্যই রয়েছে। এর পেছনে অবশ্য একটা যুক্তিযুক্ত নোংরা কারণও আছে কিন্তু নিজের চাচার করা নোংরামির কথাটা আয়াশকে কীভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারছে না তূর্য।

বাসায় এসে দরজা খোলা দেখে ঘাবড়ে যায় সিদ্ধি। সে তো লক করে গিয়েছিল আর বাবারও এখন আসার কথা না। চটজলদি ঘরে ঢুকে আশপাশটা বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে সে। নাহ! বাবা তো আসেননি। তাহলে দরজা খোলা কীভাবে? সিদ্ধি কি তবে দরজা খোলা রেখেই চলে গিয়েছিল? নিজের মনভোলা কাজের জন্য নিজেকে তাচ্ছিল্য করে পানি খাওয়ার জন্য রান্নাঘরের দিকে এগোয় সিদ্ধি। রান্নাঘরে গ্যাস স্টোভের উপর পাতিল চড়ানো, পাতিলে চা পাতা। সিদ্ধির স্পষ্ট মনে আছে তার বাবা আটটার মধ্যে চা খেয়ে বেরিয়েছেন আর সে বেড়িয়েছে ন’টার পর। এই সময়ের মধ্যে চা তো বানায়নি সে। তাহলে চা কে বানালো? সিদ্ধির মাথা ঘুরছে। ফোনটা হাতে নিয়ে সায়ন সাহেবের নম্বর ডায়াল করতেই শুনতে পেল ড্রয়িংরুম থেকে শব্দটা আসছে। সেদিকে দৌড় দিল সে। দেখল সোফার এককোণে তার বাবার ফোনটা পড়ে আছে। সিদ্ধি কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা তুললো। ফোন হাতে নিয়ে কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। আচমকা হাতের চাপ লেগে একটা ভয়েস মেইল অন হলো। পুরুষালি গলায় কে যেন কথা বলছে,”দেখুন মিস! আপনার বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছেন। আমি ওনাকে নিয়ে হসপিটালে এসেছি। আপনি তাড়াতাড়ি *** হসপিটালে চলে আসুন।”

কথাটা শোনামাত্র সিদ্ধির মনে হয় চারিপাশ শুণ্য আর এ শূন্যস্থানেই উদ্দেশ্যহীনের মতো ভাসছে সে। তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরোয় সিদ্ধি। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তার। রিকশা ডাকবে সেটুকু জোরও পাচ্ছে না। কোনমতে একটা রিকশা থামিয়ে অনেক কষ্টে হাসপাতালের নামটুকু বললো সিদ্ধি। সিদ্ধির কান্না থামছে না কিছুতেই। বাবা ছাড়া আর কে-ই বা আছে তার জীবনে? মায়ের চলে যাওয়ার পর আয়াশ নামের ছেলেটাও থো হারিয়ে গেল সিদ্ধির জীবন থেকে। এখন কি বাবাও আর তার কাছে থাকতে চাচ্ছেন না? কথাগুলো ভাবতেই আবারো কান্নায় নিঃশ্বাস আটকে আছে সিদ্ধির। সামান্য রাস্তাটুকুও যেন ফুরাচ্ছে না আজ। সিদ্ধির মাথা ঘুরছে, ইন্দ্রিয় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মনে একটাই চিন্তা, বাবার কিছু হবে না তো?

শ্রাবণের খুব অস্থির লাগছে আজ। কেন লাগছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। সন্ধ্যের পার্টির জন্য সব ঠিকঠাক করে এসেছে সে। এখন শুধু নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে শ্রুতিকে নিজের মনের কথা বলার জন্য। শ্রাবণ যতবারই কথাটা ভাবছে ততবারই তার হাত-পা কাঁপা শুরু করছে। বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজই হলো বন্ধুকে ভালোবাসার কথা বলা, পাছে বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে। শ্রাবণের অস্থিরতা তাকে আরো অশান্ত, উগ্র করে তুলছে। কীভাবে কী করবে সব গুলিয়ে ফেলছে সে। কয়েকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল শ্রাবণ। ঢকঢক করে গ্লাসভর্তি পানি শেষ করলো। মনে মনে শপথ করলো,”হয় আজ শ্রুতিকে মনের কথা বলবে নয়তো এই শহরে আজই শেষ দিন তার।” শেষবারের মতো বাসাটা পর্যবেক্ষণ করলো। কলেজ লাইফের শুরুতে বাসাটা ভাড়া নিয়েছিল, নিজের মতো করে সাজিয়েছিল। আজ যেন সবকিছু ভেঙে-চুরে ছেড়ে যাচ্ছে সে।

আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের মুখটা পর্যবেক্ষণ করছে তানভী, ঠোঁটে শয়তানি হাসি। সুন্দর মুখটা আজ কেন যেন শয়তানি হাসিটার কারণে বিভৎস, ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। ড্রেসিং টেবিলে থাকা কাজলটুকু চোখে লাগায় তানভী, টকটকে লাল রঙে রঞ্জিত করে ঠোঁটদুটো। নীল পাড়ের সাদা শাড়ির সাথে এ সাজ বড্ড মানিয়েছে তাকে। ঘর থেকে বের হতেই তানভীকে জেরা করে তার মা।
-“কোথায় যাচ্ছিস তুই এই সন্ধ্যেবেলা?”
-“তোমার জামাই ডেকেছে দেখা করতে।”
-“ভালো যা! রাতে থাকতে বললে ও বাড়িতেই থাকিস।”
-“বিয়ে হয়নি মা আমাদের।”
-“তাতে কী? দুদিন পরেই তো বিয়ে!”
-“ছিঃ!”

আর কিছু বললো না তানভী। তার মা কেমন চরিত্রের মহিলা সে জানে। তার বাবার দ্বিতীয় পক্ষ হলো তার মা। জেনেশুনে একজন বিবাহিত পুরুষের গলায় ঝোলা মেয়ে আর যাই হোক, ভালো চিন্তার অধিকারী কখনোই হতে পারে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানভী। মনে মনে বলে,”আজ আমি যা যা করতে যাচ্ছি, তার জন্য হয়তো তিনটে জীবন উলট-পালট হবে। দুটো পরিবারের ইজ্জত ধূলিসাৎ হবে তবুও আমার এটা করতেই হবে। নিজেকে বাঁচাতে, নিজের স্বার্থে। আমি যা করতে যাচ্ছি এর পরে মাফ চাওয়ারও যোগ্যতা আর রাখিনা আমি।”
তূর্যর বাড়িতে গণ্ডগোল চলছে। এ গণ্ডগোলের কারণ অবশ্য এক হিসেবে ধরলে আয়াশ। তূর্য বাড়িতে ঢুকেই তার চাচার কুকীর্তি নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকে। এক পর্যায়ে তার বাবা তায়েফ উদ্দিন অসুস্থ শরীর নিয়ে উঠে আসেন।

এখনো তূর্য চুপ হয়নি। সে রীতিমতো শপথ করেছে হয় তার চাচা বাড়ি ছাড়বে নয়তো সে। তায়েফ উদ্দিন কোনদিকে যাবেন বুঝে উটতে পারছেন না। একদিকে ভাই, অন্যদিকে ছেলে। নিজের ভাইয়ের কুকীর্তি তার কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। সেকারণেই তিনি চুপচাপ এককোণে বসে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। তূর্যর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে আজ। একটা মানুষ নিচে নামতে নামতে অর্ধেক হাত গর্তে অবধি পড়ে গেছে অথচ কিনা তওবা করার নাম নেই, সেই ধরনের মানুষকে জুতা দিয়ে মেরে মুখ চুনকালি করিয়ে দিলেও তার নূন্যতম লজ্জাবোধ হবে বলে মনে হয় না। তূর্য জানে তার চাচার জীবনের সবচেয়ে কালো অধ্যায়ের কথা। তূর্যর চাচা আনিস বরাবরের মতো চরিত্রহীন স্বভাবের। গ্রামের একটা মেয়েও তার কুনজর থেকে বাঁচেনি।

লোকটা সবচেয়ে বেশি অন্যায় করেছিল আয়াশের একমাত্র ফুপু রজনীর প্রতি। রজনীর তখন বিয়ে হয়ে গেছে, কোলে আট মাসের বাচ্চা। তূর্যর বয়স তখন আট-নয়। একদিন হঠাৎ তূর্য লক্ষ করল আনিস উদ্দিন রজনীর হাত চেপে ধরছে বারবার। বিব্রত রজনী এই ফাঁকা রাস্তায় আট মাসের বাচ্চা কোলে নিয়ে ক্রন্দনরত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্য তখন কিছু বোঝেনি, রজনী ফুপুকে আবার সে খুবই পছন্দ করত। গলায়-গলায় সখ্যতা যাকে বলে। সে চাচা আর ফুপুর কাছে এসে সালাম দিতেই তার চাচা তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে যায়। তূর্য সামান্য বাকা দৃষ্টিতে তাকালেও তেমন কিছুই বোঝেনি। রজনী ফুপুও তাকে আর কিছু বলেনি কিন্তু একদিন আচমকা শোনা যায় আয়াশের ফুপুর মৃত্যুসংবাদ। তাকে নাকি ধর্ষণ করে রাস্তার পাশে ফেলা হয়েছে। তার আগের রাতেই আনিস উদ্দিনকে রক্তমাখা পোশাকে ঘরে ঢূকতে দেখেছিল তূর্য, কাউকে বলতে পারেনি ভয়ে। ধীরে ধীরে বড় হতে হতে অনুতাপ বাড়তে থাকলো। ঐ আট মাসের বাচ্চা মা হারিয়ে এখন সৎ মায়ের সংসারে বড় হচ্ছে। এর জন্য কোন না কোনোভাবে তূর্যও দায়ী। সে যদি প্রথম দিনেই সবাইকে সব বলে দিত, তাহলে এমন পরিস্থিতি কখনো আসতো না।

তায়েফ উদ্দিন আর আনিস উদ্দিনের মধ্যে চেঁচামেচি শুরু হয়েছে আবার। তূর্যর আর ভালো লাগছে না এসব। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আয়াশের বাড়ির দিকে গেল সে। ছেলেটা একা আছে, না জানি কী করছে! তূর্য আয়াশ আর নিজের সম্পর্কের দিকে তাকালে বারবার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে তার,”ওহে পৃথিবী! শুনছো? এই শহরের ব্যস্ততার ভীড়ে হারিয়ে যায় না সত্যিকারের বন্ধুত্বগুলো!” কথাটা ভাবতেই লজ্জা লাগে তার। অনেকটা সিনেমার মতো হত ব্যপারটা। হাঁটতে হাঁটতে আয়াশের বাড়ির কাছেই এসেছিল সে, আচমকা দেখল লতা মুখ লুকিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছে। বেশ তাড়া আছে মনে হচ্ছে। তূর্য এক দৌড়ে আয়াশের কাছে গিয়ে কথাটা বললো। আয়াশও তাড়াহুড়ো করে তূর্যকে সাথে নিয়ে এলো। লতা তখন ওদের থেকে শ’মিটার খানেক সামনে। লতার পিছু নিতে লাগলো দুই বন্ধু যদি কোন প্রমাণ পাওয়া যায় এ আশায়।

সিদ্ধির হাত-পা কাঁপছে। ডাক্তার বলেছেন হার্ট অ্যাটাক, আপাতত তার বাবা অজ্ঞান অবস্থায় আছেন। পাশে বসে থাকা তাহমিদ ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে সিদ্ধিকে স্বান্তনা দিচ্ছে কিন্তু তা সিদ্ধির কর্ণকুহরে বিন্দুমাত্র কম্পনও সৃষ্টি করতে পারছে না। আচমকা একটা কথা সিদ্ধির কানে ঝংকারের ন্যায় বেজে উঠলো। “আঙ্কেল বলেছেন আগামীকালই আমাদের বাগদান করিয়ে রাখবেন।” তাহমিদের বলা এই কথাটাই সিদ্ধির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। তাহমিদের দিকে চোখ তুলে তাকায় সে। অদ্ভুত ধরনের এক হাসি তাহমিদের ঠোঁটে অথচ সিদ্ধি ভাবলেশহীন।
-“সিদ্ধি, আঙ্কেল আপনাকে বলেনি এসব?”
-“না আর আমি আপাতত বাগদানে ইচ্ছুক না।”
-“দেখুন সিদ্ধি, আমি আঙ্কেলকে কথা দিয়েছি যে বাগদান কালই হবে। উনি এখন যে অবস্থায় আছেন, আমি চাইনা একজন অসুস্থ মানুষকে দেওয়া কথার খেলাপ করতে। দরকার হলে বিয়ে দেরিতেই হবে।”
-“আমার আপনাকে পছন্দ হয়েছে একবারও বলেছি আমি? তাছাড়া বাবা অসুস্থ এখন।”
-“সেজন্যই বলছি আমি। প্লিজ বুঝুন, ওনাকে খুশি রাখতে হবে।”
সিদ্ধি চুপ হয়ে যায়। চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,”আয়াশ! তোমায় দরকার আমার, এ মুহূর্তে তোমায় আমার পাশে দরকার আমার।” ইচ্ছে হলেই বা কী? সব ইচ্ছে কী পূরণ হয়? ইচ্ছে পূরণ হয় না বলেই তো মানুষের বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়। সব ইচ্ছে পূরণ হয়ে গেলে তো জীবন শেষ। ঠিক ঐ গানের লাইনটার মতো,’সব পেলে নষ্ট জীবন।”

আয়াশ যা ভেবেছিল ঠিক তাই। এসবের পেছনে ঐ তারেক রহমান নামক লোকটাই আছে। লতা এসেছিল লোকটার সাথে দেখা করতে, একটা বন্ধ গোডাউনে। লতা তারেক রহমানের সাথে কী নিয়ে যেন কথা কাটাকাটি করছে। লতাকে বেশ ক্ষীপ্ত দেখাচ্ছে, তারেক রহমানও রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আয়াশ ধীরস্বরে তূর্যকে বললো পুলিশে কল করতে। তূর্য নম্বরে ডায়াল করলো। “হ্যালো” বলতেই পেছন থেকে কেউ তূর্যর মাথায় আঘাত করে। আয়াশ পিছনে ঘুরতেই তার কপালেও আঘাত করা হয়।

সাথে সাথে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে দুজন। তাহমিদ বাঁকা হাসি দিয়ে বাবার পাশে এসে দাঁড়ায়। লতা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাবা-ছেলের দিকে। তারেক রহমানের ইশারা পেয়েই বিদায় হলো সে। তাহমিদ হাসছে। সিদ্ধি তাকে বলেছে বাগদানের ব্যবস্থা করতে। এসব এত সহজে হয়নি। সায়ন সাহেবের জ্ঞান ফেরার পর বাগদানের কথা তোলায় সিদ্ধি মানা করে দেয়। সায়ন সাহেব উত্তেজিত হয়ে উঠেন, তখনো ঠিকমতো হুঁশ নেই তার। সিদ্ধি ভাবে সে বাগদানে মানা করায় বাবা কষ্ট পাচ্ছে। তাই সে রাজি হয়ে যায় অথচ ঘটনাটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়। তাহমিদের তো খুশিতে মাটিতে পা পড়ছে না। আয়াশ নামক কাঁটাটাও তার জীবন থেকে সরে গেল। আবার, আজ সিদ্ধিও তার হতে চলেছে। এক ঢিলে দুই পাখি, এর চেয়ে বেশি সুখকর কী হতে পারে?

চিলেকোঠায় সমাপ্তি পর্ব ৭+৮

-“বুঝলে বাবা, খেলাটা কিন্তু ভালোই খেললে।”
-“আরে রাখ তোর খেলা! মাস্টারমাইন্ডের বুদ্ধি সব। আমি তো শুধু স্কুলের জমিটা হাতানোর জন্য এসব করেছি। ঐ জমি এক বিদেশী কোম্পানির কাছে বেঁচে আমি এখন লাখপতি।”
-“কিন্তু ওরা জমিটা কিনলো কেন? এখনো তো কিছুই হয়নি ওখানে। আগের মতোই স্কুল আছে।”
-“ওদের প্রজেক্ট খুবই গোপনীয়, চার বছর ধরে রিসার্চ করে এখন সব ঠিকঠাক করছে। আগামী মাসেই দেশে আসবে।”
-“তাহলে এত আগে কিনে রাখার কারণ কী?”
-“ওসব আমি জানিনা। তুই এই দুটোকে বেঁধে রাখ তো।”
তাহমিদ হাসে। অতঃপর আয়াশ আর তূর্যকে চেয়ারে বসিয়ে হাতে-পায়ে শিকল লাগিয়ে দেয়।

-“আমায় মাফ করবিনা শ্রাবণ?”
-“জানিস তানভী, আমাদের পাঁচজনের মধ্যে যে ভয়টা সবচেয়ে বেশি কাজ করে তা হলো বন্ধুত্ব হারানোর ভয়। তোর মধ্যে যখন সে ভয়টা কাজ করেনি, নিশ্চয়ই তোর কাছে বন্ধুত্বটারও নেই।”
-“শ্রাবণ!”
-“থাক তানভী! প্লিজ আমায় আর ছোট করিস না। যা হওয়ার তোর সামনেই হলো।

শ্রাবণ উঠে আসে। নেশা কাটেনি এখনো তার, টলমল করছে নেশার ঘোরে। শ্রুতির চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না শ্রাবণ। তানভীকে পারলে এখনি খুন করে ফেলে শ্রাবণ কিন্তু পারছে না। বন্ধুত্ব সূত্রে এখনো তানভীর উপর মায়া আছেই কিন্তু তানভী যা করেছে তার জন্য শ্রাবণ কোনদিনই ওকে মাফ করতে পারবে না। নেশার ঘোরে সবকিছু বললেও শ্রাবণ মন থেকেই বলছে কথাগুলো। যার জন্য আজ শ্রুতি তাকে ছেড়ে গেল সেই মেয়েটাকে সে কিছুতেই মাফ করবে না, কিছুতেই না।
আসলে বিষয়টা খুব সহজ, একটা সম্পর্কে তৃতীয় পক্ষ ঢুকলে তার ধ্বংস অবধারিত যেমনটা শ্রাবণ আর শ্রুতির সম্পর্কে তানভীর উপস্থিতিটা।

চিলেকোঠায় সমাপ্তি শেষ পর্ব