চিলেকোঠায় সমাপ্তি শেষ পর্ব || লেখিকা মিহি

চিলেকোঠায় সমাপ্তি পর্ব ১১ + শেষ পর্ব 
লেখিকা- মিহি

“পৃথিবীতে সব সম্পর্কে একটা করে বাঁধা আসেই। কেউ কাটিয়ে উঠতে পারে, কেউ কেউ পারে না।”
শ্রাবণ হয়তো না পারারই দলের। সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে চলে যাওয়ার দলে সে। আজ শ্রুতির প্রতি তার অনুভূতিগুলো আগের মতোই প্রখর শুধু প্রাপ্তির আশাটুকু ফিকে হয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করতেই শ্রাবণের চোখের সামনে ভেসে উঠে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া রাতটা।

নেশায় টালমাটাল শ্রাবণ। মদ খায়নি সে তবুও কেন এমন নেশা হলো বোঝার চেষ্টা করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক নারী প্রতিচ্ছবি। শ্রাবণ নেশার ঘোরে জিজ্ঞাসা করলো,”কে?” নারীটির থেকে কোন উত্তর পাওয়া গেল না বরং সে ধীরে ধীরে শ্রাবণের কাছে এলো। শ্রাবণের কানের কাছে মুখ নিয়ে ‘শ্রুতি’ কথাটা বলতেই শ্রাবণের সারা শরীরে বিদ্যুতের ন্যায় কম্পন সৃষ্টি হলো। শ্রাবণের খুব ইচ্ছে হলো শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরতে। সে তা করলো না। শ্রুতির হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,”শ্রুতি, তোমায় ভালোবাসি। বড্ড বেশি ভালোবাসি। তোমায় বলার সাহস নেই বলে ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম। তুমি আটকালে না আমায়। কেন আটকালে না, হ্যাঁ? আমায় ছাড়া তো খুব ভালো থাকবে, সেজন্য? আমি যে মরে যাবো।” নারীটি তখনো কিছু বললো না, শ্রাবণকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। শ্রাবণ তার কাঁধে মাথা রেখে বললো,”ভালোবাসি তোমায়।”

‘শ্রাবণ!’ শ্রুতির কণ্ঠে নিজের নামের চিৎকার শুনে সামনে তাকালো সে। শ্রুতি সামনে? তাহলে যে তাকে জড়িয়ে রেখেছে, সে কে? নেশায় তখনো চোখে ঝাপসা দেখছে শ্রাবণ। শ্রুতিকে কিছু বোঝানোর সুযোগ পেল না সে। শ্রুতি কোন কথা না বলেই বেরিয়ে গেলো, হাতে থাকা লাল গোলাপটা ফেলে দিল ডাস্টবিনে। শ্রাবণ পিছু নিলেও শ্রুতিকে বোঝানোর মতো উপায় ছিল না। তানভী তখনো ওখানে বসে কাঁদছে।শ্রাবণ সরাসরি বাসায় যায়। গোসল করার পর নেশার মাত্রা কিছুটা কমে। এরপর সে বুঝতে পারে তার জীবনে কী অঘটন ঘটে গেছে। তানভীকে জিজ্ঞাসা করলে সে শুধুই স্যরি বলে কিন্তু শ্রাবণ বুঝেছে শ্রাবণের বউ হয়ে ঐ বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্যই এ প্ল্যান করেছে তানভী যে বুদ্ধি শ্রাবণ তাকে দিয়েছিল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শ্রাবণের আর ভালো লাগছে না। এত চাপ সে নিতে পারছে না। হয়তো শ্রুতিকে আর সামনাসামনি কখনো মনের কথা বলা হবে না। শ্রুতির জন্য একটু আগে লেখা চিঠিটা একটা বইয়ের সাথে এক ক্লাসমেটের হাত দিয়ে শ্রুতির জন্য পাঠায় সে। তারপর নিজের ব্যাগ নিয়ে বের হয় বাড়ি থেকে। বাড়িওয়ালাকে ডেকেছিল সকালেই, তার হাতে টাকা বুঝে দিয়ে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে যায় শ্রাবণ।

শ্রুতির হাতে শ্রাবণের লেখা চিঠিটা,
“শুনেছিলাম মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নাকি চট করে ধরে ফেলে কোন ছেলে তাদের দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকায়। আমার দিকে তাকিয়ে কখনো তোমার মনে হয়নি, এই ছেলেটা তোমার দিকে কতটা ভালোবাসার চোখে তাকায়? তানভীর সাথে যা হয়েছে, যদিও কিছুই হয়নি কিন্তু দোষটা আমার ছিল না শ্রুতি। আমি অরেঞ্জ জুস খেয়েছিলাম, তাতে ড্রাগস ছিল আমি জানতাম না। একটা সুযোগ দিতে সব বোঝানোর। যাই হোক, তুমি সুখে থাকবে এইটাই চাই আমি। ভালোবেসেছি তোমায়, বাসি, বাসবো। চলে যাচ্ছি, খুঁজো না আমায়। পৃথিবী তো গোল, হয়তো কোন একদিন না চাইতেও দেখা হয়ে যাবে। তুমি মুখ ফিরিয়ে নিও, আমি আফসোসে তিলে তিলে ঐদিনই শেষ হয়ে যাবো। আর কেউ থাকবে না তোমায় কষ্ট দেওয়ার।”

ইতি~শ্রাবণ”
চিঠিটা পড়ে ছিঁড়ে ফেলে শ্রুতি। মুখটা তখন বিবর্ণ। মন তখনো তাকে বলে চলেছে,”ক্ষমা করবি না ওকে। ও ক্ষমার যোগ্যই না।” শ্রুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তানভীকে আশেপাশে দেখতে পেল না। তানভী আর শ্রাবণ নামক দুই ব্যক্তির হারানোতে তার অনুভূতি পাথর হয়ে গেছে, কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে তো চায়নি ওদের হারাতে কিন্তু ক্ষমাও তো করতে পারবে না। হোক সব মিথ্যে তবুও ওর দেখা ঐ অনাকাঙিক্ষত মুহূর্তটুকু তো সত্যি ছিল। পারবে না সে ওদের ক্ষমা করতে। ভেঙে যাওয়া গ্রুপটাই এখন কেবল শ্রুতি, অয়ন, সিদ্ধি।

আজ সিদ্ধির বাগদান। তাহমিদ পুরো বাড়ি সাজিয়েছে। সায়ন সাহেব হাসপাতালেই আছেন। বাগদানের পর দুজন যেয়ে পা ছুঁয়ে দোয়া নিয়ে আসবে। সিদ্ধির নিজেকে কোন যন্ত্র মনে হচ্ছে কেননা মানুষের তো অনুভূতি থাকে কিন্তু তার মাঝের সব অনুভূতি যেন শেষ হয়ে গেছে। একটা মানুষ ঠিক কতটা সময় ধৈর্য ধরে থাকতে পারে? বাবার অসুস্থতা, হারিয়ে ফেলা ভালোবাসা, অপরিচিত একজনের সাথে বাগদান- সবকিছুর মাঝে সে ঝুলে আছে। গত এক মাসে ওষুধও খায়নি সে। মাথাটা বড্ড যন্ত্রণা করছে। তাহমিদ দেখতে এসেছে সিদ্ধির সাজা কতদূর। সিদ্ধিকে দেখেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। অবশেষে সে নিজের ভালোবাসাকে নিজের করে পাচ্ছে।

তারেক রহমান চিৎকার করে হাসছেন। আজ জীবনের সব প্রাপ্তি তার পায়ের কাছে এসে মাথা নুইয়েছে। চাইলেই তিনি সেসব তুলে বুকে জড়াবেন, নইলে আরো বড় কোন প্রাপ্তির জন্য ষড়যন্ত্র করে যাবেন। আচমকা তার ফোনে একটা কল আসলো। নম্বর চেক করে দেখলেন বিদেশী কোম্পানির মালিক। ফোন ধরে মিনিট পাঁচেকের মতো কথা বললেন যার পরিশিষ্ট এই যে তারা আজ সন্ধ্যের মধ্যে দেশে আসছেন। তারেক রহমান বেশ খুশি মনে নিজের ছেলের বাগদানে তাকে আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি মানা করলেন না। তারেক রহমানের খুশিতে মাটিতে পা অবধি পড়ছে না। তার মনে হচ্ছে তিনি খুশির ঠেলায় শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছেন।

ব্যস্ত সন্ধ্যে, চারিদিকে মানুষের আনাগোনা। শতভাগ মানুষই কেবল তাহমিদের পরিচিত হয়তো বা সিদ্ধির বাবারও কিন্তু এত অপরিচিত মানুষগুলোর ভীড়ে সিদ্ধির চোখজোড়া একজনকেই খুঁজছে। সে কি আসবে? সে কি আদৌ জানে আজ সিদ্ধির বাগদান? জানার কথাও না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিদ্ধি। তাহমিদের বন্ধু-বান্ধবীরা সিদ্ধিকে ঘিরে বসে আছে। হঠাৎ সিদ্ধির মনে পড়ে তার বন্ধুদের কথা। এতক্ষণ মাথাতেই ছিল না ওদের কথা। সব কেমন যেন চটজলদি হয়ে গেল। কারো সাথে কথা বলার সুযোগটা অবধি পায়নি সে। আচ্ছা, সে নাহয় পরিস্থিতির চাপে কথা বলার সুযোগ পায়নি কিন্তু বন্ধুদের মাঝে একজনও সিদ্ধির নূন্যতম খোঁজটুকু নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলো না? এই ছিল তাদের বন্ধুত্ব? নীরব অভিমানের শিকলে জড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল সিদ্ধি। অথচ সে জানেনা তার সাধের বন্ধুগুলোর মাঝে কোন ফাটল ধরেছে। এজন্যই বলে, একজন কখনোই নিজের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অন্যজনের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারে না।

মানুষের আনাগোনা কমে গেছে। তাহমিদ এলো সিদ্ধির কাছে, সিদ্ধিকে নিচে নিয়ে যেতে। তাহমিদ সিদ্ধির দিকে হাত বাড়াতেই সিদ্ধি হাত ছাড়িয়ে নিল। কাঁপা স্বরে বললো,”আমি যেতে পারবো।” তাহমিদ কিছু বললো না। মুচকি হেসে সায় দিল। সিদ্ধির হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কেন যেন মনে হচ্ছে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে সে যা করছে তার পরিণতি কিছুতেই ভালো হবে না, কোনভাবেই না। এক পর্যায়ে মাথা ঘুরতেই বেসামাল হয়ে পড়ে যেতে ধরে সিদ্ধি কিন্তু তাহমিদ ধরে ফেলে। তাহমিদের স্পর্শে আরো কান্না আসে সিদ্ধির।

তাহমিদের এই স্পর্শের দ্বারা এ সম্পর্কে কেবল সিদ্ধি নিজের বাধ্যতা খুঁজে পায়, ভালোবাসা নয়। একজনকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে ফেললে নাকি দ্বিতীয় কাউকে কখনোই ভালোবাসা যায় না। সিদ্ধি ভেবেছিল কথাটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আজ মনে হচ্ছে আসলেই ভালোবাসা মানুষকে কতটা দুর্বল করে ফেলতে পারে। আমরা ভালোবাসি কেবল প্রথমবার, পরবর্তীতে যা হয় তা কেবল দায়িত্ব কিংবা অনুভূতির ভুল সংকেত।

সাজসজ্জায় মুখরিত সারা বাড়ি। একটু পরেই শুরু হবে বাগদান অনুষ্ঠান। তাহমিদ-সিদ্ধি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ভিডিও কলে সায়ন সাহেবকে সবই দেখানো হচ্ছে। তিনি একেবারেই নিস্তব্ধ, চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। পরিস্থিতির কাছে নিজের পরাধীনতা মেনে নিয়েছেন তিনি। সিদ্ধির দৃষ্টি ধীরে ধীরে ঝাপসা হচ্ছে। চোখ খোলা রাখার সমস্ত চেষ্টা যেন বৃথা। আচমকাই চোখ বন্ধ করে ঢলে পড়ে সে মেঝেতে।

-“কীরে সোহেল? পাইলি?”
-“স্যার এদিকেই তো লাগে। এক্সাক্ট লোকেশন ট্রেস করতে পারতেছি না। ফোন অফ করে ফেলছে বেটা।”
-“আচ্ছা শোন। দেখ আশেপাশে কোথাও শুনশান বাড়ি কিংবা গোডাউন আছে কিনা।”
-“আচ্ছা স্যার।”
-“আর শোন, ঐ দুজন যেন বিন্দুমাত্র খবর না পায় আমরা এসবের সাথে জড়িত না হলে আমার চাকরী রিস্কে পড়ে যাবে।”
কনস্টেবল সোহেল গাড়ি থেকে নামতেই অট্টহাসি হাসেন ইন্সপেক্টর জয়নব। বেশ ভালোভাবেই ষড়যন্ত্রের বেড়াজালটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এবার তবে চুনোপুটিসহ রাঘব-বোয়ালগুলোকেও খতম করার সময় এসে গেছে।
সিদ্ধি বিছানায় শুয়ে, এখনো জ্ঞান ফেরেনি তার।তাহমিদের রাগে হাত-পা কাঁপছে। সিদ্ধিকে দুটো থাপ্পড় দিয়ে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হচ্ছে,”আংটিটা পড়েই জ্ঞান হারাতে পারলি না?” তারেক রহমান গেস্টদের এটেন্ড করছেন।তাহমিদ সিদ্ধির পাশে বসে নখ কামড়াচ্ছে। একটু পরেই তারেক রহমান এসে বসলো তাহমিদের পাশে।

-“ভালোই হয়েছে মেয়েটা অজ্ঞান হয়েছে। বিদেশী কোম্পানির লোকগুলোর আসতে আরো আধ ঘণ্টার মতো লাগবে।”
-“বাবা, রাখো তো তোমার কোম্পানি। যত তাড়াতাড়ি বাগদান শেষ হবে তত ভালো। তারপরেই ঐ আয়াশকে মেরে ফেলবো আমি।”
-“সবদিক ভাবতে হয়। কোম্পানিটার সাথে আমাদের ডিল হয়েছে, এরপর সম্মান না দিলে পরে বিপদে পড়বো। কি এক গ্রামের স্কুল, তা নিয়ে আবেগের শেষ নাই। ঐ রফিকউদ্দিনকে মারাটা কিন্তু সহজ ছিল নাহলে এত সহজে স্কুলের প্রপার্টি পেপার্স আমরা পেতাম না। গ্রামে ঐ একটাই ছিল অতিশিক্ষিত, ঐটা মরছে। ব্যস! কয়েক লাখ টাকার বদলে কোটি টাকার ডিল লক হলো। চার লাখ টাকার জমি বেচলাম আড়াই কোটি দিয়ে।”

-“তোমার টাকার গল্প রাখবা? জ্বালিয়ো না তো বাবা।”
-“যাচ্ছি। সিদ্ধি উঠলে নিচে নিয়ে আয়।”
তারেক রহমান চলে গেল। তাহমিদ সিদ্ধির দিকে তাকিয়ে আছে। ঘুমন্ত এই সিদ্ধিকে তার পছন্দ নয়। তার পছন্দ নিশ্চুপ সিদ্ধিকে যে চুপচাপ তার কথাগুলো শুনবে শুধু। বিরক্ত লাগছে তার। বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকে সিদ্ধির কাছ থেকে উঠে নিচে বন্ধুদের কাছে আসে তাহমিদ।
সিদ্ধি আজও ক্যাম্পাসে আসেনি, ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। অয়নের কিছুটা চিন্তা হচ্ছে, তার উপর শ্রুতির সকাল থেকে মনমরা হয়ে বসে আছে। শ্রুতিকে ডাকলো অয়ন।

-“শ্রুতি, কী হয়েছে তোর?”
-“শ্রাবণ চলে গেছে রে।”
-“চলে গেছে মানে? কাল না তোর ওকে প্রপোজ করার কথা ছিল? সেজন্যই তো তোদের প্রাইভেসির কথা ভেবে আমরা কেউই যাইনি।”
-“তুই আর সিদ্ধি যাসনি, তানভী ঠিকই গিয়েছিল। আমার আর শ্রাবণের সম্পর্কটা নষ্ট করার জন্যই গিয়েছিল ও।”
-“কী বলছিস কী এসব? মাথা ঠিক আছে তোর? ও কেন তোর আর শ্রাবণের সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইবে?”
-“জানিনা আমি।”
-“কী হয়েছে পরিষ্কার করে বল তো।”

শ্রুতি গতরাতের ঘটনা সব বললো অয়নকে। তানভীর কাণ্ডকারখানা শোনার পর অয়নের মাত্রাতিরিক্ত রাগ উঠলো। কতটা নোংরা হলে কেউ একইসাথে বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার অবমাননা করতে পারে? তানভীর কথা না হয় বাদই দিল অয়ন কিন্তু শ্রাবণ? সেও এত সহজে হার মেনে নিল? নাহ! আর চুপ করে থাকলে এ বন্ধুত্বের অস্তিত্বই থাকবে না। সিদ্ধিকে জানাতে হবে সব।
-“শ্রুতি! আমার মনে হয় আমাদের সিদ্ধির সাথে কথা বলতে হবে।”
-“ওর ফোন তো অফ। ওর বাড়িতে যাই চল।”
-“হুম চল।”

ইন্সপেক্টর জয়নব বেশ সন্তর্পণে গোডাউনটার দিকে এগোচ্ছেন। এই গ্যাংটাকে ধরতে পারলে আজ তার প্রমোশন আর যদি না পারেন তাহলে খবর লিক হয়ে সাসপেন্ড। কনস্টেবল সোহেলও আশেপাশের দেখে পা ফেলছে জয়নবের পেছন পেছন। আচমকা সামনে তাকাতেই দেখলো তালাবদ্ধ একটা গোডাউন, আশেপাশে কেউ নেই। জয়নবের একটু সন্দেহ হলো, কাউকে আটকে রাখলে তো আশেপাশের অন্তত একজনকে রাখা উচিত লক্ষ রাখার জন্য কিন্তু সেরকম কাউকেই তো এখানে দেখা যাচ্ছে না। মস্তিষ্কটাকে আসামীর মতো করে খাটালো জয়নব। যদি সে আসামী হত, তাহলে এখানে কোন লোক রাখত না কেন? কেউ যাতে সন্দেহ না করতে পারে? মস্তিষ্কের দেওয়া সাজেশনটা পছন্দ হলো জয়নবের। ধীরে ধীরে গোডাউনের ভেতরে ঢুকলো সে। সোহেলও পেছন পেছন ঢুকলো। ভেতরে ঢুকতেই জয়নব দেখলো চেয়ারে দুজনকে শিকল দিয়ে বাঁধা, দুজনই অজ্ঞান। সোহেলকে বলে শিকল খোলানোর ব্যবস্থা করল সে। অতঃপর আয়াশ এবং তূর্যর মুখে পানি ছিটালো। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরলো দুজনের কিন্তু মাথার পেছনের অংশটা তখনো ব্যথা করছে আয়াশের। ইন্সপেক্টর জয়নব তূর্যের পিঠে চাপড় দিয়ে এপ্রিশিয়েট করলেন।

-“থ্যাংকস তূর্য। তুমি আগেই আমাকে সব না জানালে আমরা এতদূর আসতে পারতাম না। অবশ্য তোমার হ্যালো শোনার পর আর কোন কথা না শুনে ভয়ই পেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা কল কাটতে ভুলে গিয়েছিল এণ্ড থ্যাংক গড ওদের সব কথা রেকর্ড হয়েছে।”
-“ধন্যবাদ তো আমাদের আপনাকে দেওয়া উচিত স্যার।”
-“তোমরা তাড়াতাড়ি জীপে এসে বসো, আমি অপেক্ষা করছি। আর শুনো তোমার চাচা নিজের সব দোষ স্বীকার করেছেন কিন্তু এও বলেছেন যে রফিকউদ্দিনের খুনে তার কোন হাত নেই। দুলাভাই তাকে মাফ করেছেন। তুমিও করে দাও।”
জয়নব আর সোহেল চলে যেতেই আয়াশ বাঁকা দৃষ্টিতে তূর্যর দিকে তাকায়।
-“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তুই যেদিন সব বললি, সেদিনই আমি ইন্সপেক্টর সাহেবকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। উনি সম্পর্কে আমার দূরসম্পর্কের মামা হন।”
-“বুঝলাম। এখন চল, সিদ্ধির ওখানে যেতে হবে।”
-“হুম চল।”

সিদ্ধিকে বাড়িতে না পেয়ে আশেপাশে খোঁজ নিয়ে শ্রুতি-অয়ন জানতে পারলো আজ সিদ্ধির বাগদান আর সিদ্ধির বাবা হাসপাতালে। ওরা চটজলদি তাহমিদের ঠিকানা নিল। ভেবেছিল হয়তো এসে দেখবে বাগদান চলছে কিন্তু তা হলো না। শ্রুতি আর অয়ন এসে দেখলো সিদ্ধির জ্ঞান নেই, তখনো বিছানায় সে। শ্রুতির কান্না পাচ্ছে এখন। এত দ্রুত বুঝি জীবনের মোড়গুলো ঘোরে? এই তো দুদিন আগেও সব স্বাভাবিক ছিল।
বিদেশী কোম্পানির লোকগুলো এসেছে। তারেক রহমান বেশ তোষামোদ করছেন তাদের। তাহমিদের রাগে গা জ্বলছে। সবাইকে কি খেতে ডেকেছে সে? যে জন্য ডেকেছে, সেই কাজটাই তো হচ্ছে না। সিদ্ধির ঘরে এখন শ্রুতি আর অয়ন বসে। তাহমিদ ছাদে, নিচে কী হচ্ছে তার কোন ধারণা নেই। আচমকাই খবর পেল সিদ্ধির জ্ঞান ফিরেছে। তাহমিদ হন্তদন্ত হয়ে নিচে গেল। সিদ্ধির পাশে বসলোবেশ উত্তেজিতভাবে। পাশে যে শ্রুতি আর অয়ন ছিল তা খেয়ালই করলো না।
-“তুমি ঠিক আছো তো? কী হয়েছিল তোমার? উফফ! কত্ত টেনশন করছিলাম। আঙ্কেলও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চলো তাড়াতাড়ি বাগদান সেরে আঙ্কেলের কাছে যেতে হবে।”

-“কী হয়েছে বাবার?”
-“তেমন কিছু না! সেসব কথা পরে, আগে তো আংটিবদল হোক।”
-“আমার বাবার অসুখ আর আপনি পড়ে আছেন আংটি নিয়ে?”
-“তুই যাবি কিনা? চল!”

সিদ্ধি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। এমন করছে কেন ছেলেটা। শ্রুতি আর অয়নও অবাক। শেষমেষ তাহমিদ সিদ্ধির হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলো। সিদ্ধি ছাড়ানোর চেষ্টা করলে আরো চেপে ধরলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সিদ্ধিকে ওয়ার্ন করলো, পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাগদান না হলে তার বাবাকে মেরে ফেলা হবে। তাহমিদের কথায় আঁতকে উঠলো সিদ্ধি। এ কোন ঝামেলায় পড়লো সে? তাহমিদ নিজেও জানেনা সে কী করছে। সিদ্ধিকে পাবার আকুলতায় মানসিকভাবে উত্তেজিত সে। সিদ্ধিকে নিচে নিয়ে আসতেই পুলিশ ঢুকলো বাড়িতে। জয়নব, সোহেলসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ ঘিরে ধরলো তারেক রহমান আর তাহমিদকে।

“ইউ বোথ আর আন্ডার এরেস্ট।” জয়নব বললো। বিদেশী কোম্পানির লোকগুলো পালানোর চেষ্টা করলেও সক্ষম হলো না। পুলিশরা সামান্য একটু অন্যমনস্ক হতেই সুযোগটা নিল তারেক রহমান। সিদ্ধির কপালে বন্দুক ঠেকাল। তাহমিদের তখনো রাগে শরীর জ্বলছে। তার উপর নিজের বাবার এমন কাণ্ডে সে আরো বিরক্ত। পকেটে থাকা রিভলবারটা তারেক রহমানের দিকে তাক করে বললো,”বাবা ছাড়ো ওকে।” তারেক রহমান ছাড়লেন না। নিজের পালানোর একমাত্র রাস্তাকে কী করে ছাড়বেন তিনি? তাহমিদ গুলি ছুঁড়লো। সোজা গিয়ে লাখল তারেক রহমানের কপাল বরাবর। সাথে সাথে ঢলে পড়লেন তিনি। সব নিস্তব্ধ। পুলিশ ধীরে ধীরে সবাইকে নিয়ে গেলো। সিদ্ধি ভয়ে যেন কথা বলতেই ভুলে গেছে। আয়াশ ধীরে ধীরে এসে সিদ্ধিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। সিদ্ধি কাঁদতে কাঁদতে বললো,”বাবা হাসপাতালে, আমি বাবার কাছে যাবো।”
আটমাস পর||

চিলেকোঠায় সমাপ্তি পর্ব ৯+১০

-“অবশেষে বিয়েটা হচ্ছে মিস.চাশমিশ!”
-“নিজেও তো চশমা পড়েন।”
-“ইশস! জেনে গেছো? হুশশ!”
-“হুহ!”
ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল দুজন। আজ বিয়ে অথচ বর বউ কিনা ছাদে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। একটু পরেই শ্রুতি এসে নিয়ে গেল সিদ্ধিকে, সাথে আয়াশকে ভেংচি কেটে গেল। আয়াশ কেবল হাসলো, কিছু বললো না।
-“তানভীর খোঁজ পেলি?”
-“না রে সিদ্ধি। ওর আগের বাড়িতে কেউ থাকেনা। যেটুকু খোঁজ নিলাম ও নাকি বিয়ে করে স্বামীর সাথে বিদেশে গেছে।”
-“শ্রাবণ?”
-“আন্টিকে বলেছিলাম। আসবে কিনা জানিনা।”
-“তোর কী মনে হয়?”
-“শ্রাবণ আসবে আর শুধু আসবেই না, ফিরবেও। আমার জন্য।”
-“আয় হায়!”
শ্রুতি লজ্জা পেল। সিদ্ধিকে সাজিয়ে বাইরে আসতেই চোখে পড়ল পরিচিত মুখটা। অয়নের সাথে কথা বলছে সে, গায়ে নীলরঙা পাঞ্জাবি। আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছে ছেলেটা। শ্রাবণকে দেখে শ্রুতির মাথায় কবিতার লাইনগুলো ভেসে উঠে,”দেখা হলো বছর চারেক পর।” অবশ্য শ্রাবণ এখনো শ্রুতিরই আছে। শ্রাবণ শ্রুতির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। শ্রুতি তাকিয়ে রয় সেদিকে। পূর্ণতার অনুভূতিটা খুব সুন্দর, তাই না?

“এত সুন্দর সমাপ্তি হবে? এত সহজে নাহ! অন্তত আমি থাকতে তো না-ই। তোমাদের জীবনে কেবল দুঃখ আসবে আয়াশ-সিদ্ধি। দুঃখের সাগরে ভাসবে তোমরা, তীরে দাঁড়িয়ে তোমাদের মৃত্যু উপভোগ করবো আমি।” বিকট শব্দে হাসে ব্যক্তিটি …

সমাপ্ত

(লেখাঃ লেখিকা- মিহি) এই লেখিকার আরও লেখা গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন এবং এই গল্পের সিজন ২ পড়তে চাইলেও এখানে ক্লিক করুন