চিলেকোঠায় সমাপ্তি সিজন ২ পর্ব ৩

চিলেকোঠায় সমাপ্তি সিজন ২ পর্ব ৩
লেখিকা- মিহি

সিদ্ধি বেশ যত্ন নিচ্ছে নিজের। সবসময় আয়াশের আশেপাশে থাকার চেষ্টা করে। আয়াশের সবটুকু ঘিরে শুধু সিদ্ধি। জোহরা বেগম রোজ নিয়ম করে সিদ্ধিকে দিনে তিনবেলা ভরপেট খাওয়ান। বাচ্চার মতো “খাবোনা খাবোনা” করতে করতে একসময় ঠিকই খেতে হয় তাকে। আয়াশের কাছেই তার যতশত আবদার। কখনো এটা খাবো, কখনো ওটা খাবো। সিদ্ধি এখনো সায়ন সাহেবের সাথে কথা বলে উঠতে পারেনি। সায়ন সাহেবকে সুসংবাদ জানানোর জন্য মন আকুল হয়ে আছে তার। সিদ্ধি ঠিক করেছে আজ বাড়ি গিয়ে সায়ন সাহেবকে এ বাড়িতে নিয়ে আসবে। মেয়েদের প্রথম সন্তান সাধারণত বাবার বাড়িতে হয় কিন্তু ও বাড়িতে তো সিদ্ধির মা নেই। তাই সায়ন সাহেবকেই এ বাড়িতে এনে সবার মধ্যে থাকতে চায় সিদ্ধি। জীবনের এই আনন্দমাখা মুহূর্তে সে তার দুই পরিবারকেই নিজের পাশে দেখতে চায়।

আয়াশের ক্লিনিকে কিছু কাজ আছে, তার উপর আজকের দিন করে সে গ্রামে যায় তবে এ সপ্তাহে মনে হয় গ্রামে যাওয়া হচ্ছে না। সিদ্ধিকে নিয়ে একটা ভালো গাইনোকলজিস্টের কাছে যেতে হবে। আয়াশ মনে মনে ভাবে আজ যদি সে ডেন্টিস্ট না হয়ে গাইনোকলজিস্ট হত, তাহলে কেমন হতো? ভাবতে ভাবতেই আপনমনে হেসে ওঠে সে। ঠিক সেসময় রুফু চায়ের কাপ নিয়ে আসে আয়াশের স্টাডি রুমটাতে। রুফুকে আসতে দেখে দরজাতেই থামিয়ে দেয় আয়াশ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“রুফু, আমি কাজ করছি। যাও এখন।”
-“আপনার চা’টা? রেখেই যাই?”
-“আমি সকালে কী খাই না খাই সেটা সম্পর্কে এখনো অবগত নও তুমি। চা’টা বরং তুমি খাও।”
আয়াশের কথা শেষ হতে না হতেই সিদ্ধি এক মগ কফি হাতে ঘরে ঢোকে। রুফু তখনো দরজায় দাঁড়িয়ে। আয়াশ সিদ্ধির হাত থেকে কফিটা নিয়ে তাতে চুমুক দিতে দিতে বললো,” আমার চায়ের অভ্যেস নেই সেজন্যই বললাম তোমায় খেতে। এখন তুমি আসতে পারো।” রুফু ঠোঁটের কোণে হাসি ঝোলালেও তার বিবর্ণ মুখখানি মনের কথাটা বেশ ভালোই তুলে ধরলো। সিদ্ধি বেশ আহ্লাদীভাবে আয়াশের কোলের পর বসলো। সিদ্ধির এমন আচরঢে আয়াশ যেন আকাশ থেকে পড়লো। তার রাগকন্যার হঠাৎ হলো কী আজ? এমন আদর-আহ্লাদ! কী মতলবে এত কাছে আসছে কে জানে! মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ে আয়াশ আবারো কফিতে চুমুক দিল।

-“আয়শু! শুনো না।”
-“আয়শু আবার কে?”
-“তুমি! আনরোমান্টিক ছাগল একটা!”
-“ইশস! এসব আজগুবি নামে না ডেকে কী লাগবে সেটা বলো।”
-“আমি আজ বাবার সাথে দেখা করতে যাবো। চলো না আমায় রেখে আসো।”
-“আজ ডাক্তারের সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা। আমি কাল তোমায় নিয়ে যাবো বাড়িতে। আচ্ছা?”
-“নাহ! আজই যাবো মানে আজই।”
-“যথা আজ্ঞা মহারানি।”

আয়াশ হাসতে হাসতে সিদ্ধিকে জড়িয়ে ধরলো। সিদ্ধি আয়াশের চুল ধরে টানতে লাগলো। কফিটুকু শেষ করে আয়াশ সিদ্ধিকে বললো রেডি হয়ে থাকতে, ক্লিনিকের সামান্য কাজটুকু শেষ করেই সে এসে সিদ্ধিকে নিয়ে যাবে।
সিদ্ধি তো বেশ খুশি তবে তার লজ্জা লাগছে। বাবাকে নানা হওয়ার সংবাদ দিতে গিয়ে লজ্জা পাবে না তো সে? পাওয়াটাই স্বাভাবিক না কি? মাত্র তো বিয়ে, এখন বাচ্চা- এবার বুঝি পরিপূর্ণ হতে চলেছে সিদ্ধির সংসার। লাল পাড়ের হালকা সাদা একটা শাড়ি পড়ে সিদ্ধি, চুলগুলো খোঁপা করে খোঁপায় কাঁটা গোঁজে। সিদ্ধির কাছে বরাবরই নিজের চোখজোড়া বড্ড প্রিয়। সে নিজেও জানে না সে কেন এমন। বড়োই যত্ন করে চোখজোড়ায় কাজলের ছোঁয়া দেয় সে। এখন রেডি সে। চুপচাপ বিছানায় বসতেই নাফছী ছুটে এসে সিদ্ধির কাছে বসে।

-“ভাবীইইইইইই। আমি ফুপু হবো। ইশস! কী সুন্দর, গোলুমোলু দুটো বাচ্চা আমার কোলে বসে থাকবে।”
-“ওরে বাবা! দুটো?”
-“হ্যাঁ। দেখো তোমার টুইন বেবী হবে। তোমার জন্য আমি অনেকগুলো জোড়া কলা এনেছি।”
-“পাগলী মেয়ে!”
হাসতে হাসতেই সিদ্ধি দরজার দিকে তাকাতেই খেয়াল করল রুফু আয়াশের স্টাডিরুমে উঁকিঝুঁকি মারছে। আয়াশ তো ক্লিনিকে, তাহলে এই মেয়ে ও ঘরে উঁকি দিচ্ছে কেন? সিদ্ধি কিছু বলতে যাবে তার আগেই আয়াশের গলা শুনতে পেল। আয়াশ ডাকছে সিদ্ধিকে। নির্ঘাত আয়াশ ক্লিনিক থেকে চলে এসেছে। সিদ্ধি নাফছীকে বিদায় জানিয়ে জোহরা বেগমের ঘরের দিকে এগোলো। তিনি তখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। সিদ্ধি আর বিরক্ত করলো না তাকে। নাফছীকে বলে রাখলো তারা দ্রুতই চলে আসবে। নাফছী মাথা নেড়ে স্বাচ্ছন্দ্যে সায় দিল। আয়াশ আর সিদ্ধি বেরিয়ে পড়লো। আয়াশ-সিদ্ধি বেরোতেই রুফু আড়ালে হেসে ওঠে। নাফছীর প্রথম থেকেই রুফুকে বেশ সন্দেহ হচ্ছে কিন্তু আপাতত এসবে পাত্তা দিল না সে। বাড়িতে নতুন সদস্য আসছে, তাই একটা ঘর সাজাতে হবে। নাফছী ব্যস্ত হয়ে পড়ে একটা ঘর সাজাতে।

-“তূর্য! আমায় মাফ করে দাও প্লিজ। আমি সত্যিই এসবের কিছুই জানতাম না।”
-“জানতেন না মানে? এতবড় পাপকর্ম করে এসে আপনি বলছেন জানতেন না? আপনার একটা অবৈধ সন্তান আছে, এ কথা যদি গ্রামের কেউ জানতে পারে, তাহলে তো আমাদের বংশের মুখে চুনকালি পড়তে বাদ রইবে না।”
-“এখন কী করবো তুমিই বলো।”

-“আপনার সন্তানকে ভুলে যান। সে যে আপনার সন্তান এটাও ভুলে যান। সে যে পরিচয়ে বড় হয়েছে, সে সেই পরিচয় ঘিরেই বেঁচে থাক। তার জীবনে কোনরকম অধিকার দাবি করবেন না আপনি।”
-“তাই বলে একটাবার নিজের সন্তানকে দেখতে পাবো না?”
-“এই একুশ বছরে যখন না দেখে থেকেছেন, তখন বাকি জীবনটাও পারবেন। দয়া করে নিজের স্বার্থের জন্য কারো ঘর ভাঙতে উদ্যত হইয়েন না।”

তূর্যর কথায় সলজ্জভাবে মাথা নত করে আনিস। সত্যিই তার মতো নির্লজ্জ, নিচ মানুষ এ পৃথিবীতে হয় না। যদিও সে নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় কিন্তু সব ভুলের কি প্রায়শ্চিত্ত করা সম্ভব হয়? হয় না তো। আনিসের এখনো মনে আছে মেয়েটার কথা। বিবাহিত হলেও মেয়েটার রূপের মায়ায় পড়েছিল। মেয়েটার স্বামী বেজায় রাগী প্রকৃতির। সেজন্য মন খারাপ থাকতো মেয়েটার। দুর্বল জায়গাটাতেই আঘাত করেছিল আনিস। মিষ্টি মিষ্টি মুখের কথায় প্রেমের জালে ফাঁসায় মেয়েটাকে। অতঃপর সর্বনাশ করেই যোগাযোগ বন্ধ। মেয়েটাও একদিন স্বামী নিয়ে গ্রাম ছাড়লো। তারপর আর মুখোমুখি হতে হয়নি তার সাথে। আচ্ছা মেয়েটার স্বামী কি জানে সন্তানটা আসলে তার না? অনুশোচনায় চোখ বেয়ে ক্রমাগত অশ্রু ঝরছে তার। কেন যেন আজ নিজেকে এ পৃথিবীর নিকৃষ্টতম কীট মনে হচ্ছে। মাথার উপর ফ্যানটা ঘুরছে সজোরে অথচ কুলকুল করে ঘামছে আনিস। চোখ উপরে ঘূর্ণায়মান ফ্যানটার দিকে।

চিলেকোঠায় সমাপ্তি সিজন ২ পর্ব ১+২

সিদ্ধি বেশ ফুরফুরে মেজাজে কলিং বেল চাপলো। উৎসাহে কুলাচ্ছে না, পরপর তিনবার কলিং বেল চাপতেই দরজাটা খুলে গেল। ভেতর থেকে এক ভদ্রমহিলা, বেশ সুসজ্জিত সাজে দরজাটা খুলে দিলেন। পোশাক জানান দিচ্ছে তিনি বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের কোন মহিলা, বয়স সর্বোচ্চ চল্লিশের কোঠায়। সিদ্ধি আর আয়াশ হতভম্ব দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভদ্রমহিলা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন ওদের দিকে।”কে এসেছে শোভা?” বলতে বলতে সায়ন সাহেব ভদ্রমহিলার পাশে এসে দাঁড়ালেন।সামনে আয়াশ আর সিদ্ধিকে দেখে সায়ন সাহেব যতটা না আশ্চর্য হয়েছেন, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আশ্চর্য হয়েছে সিদ্ধি।

সোফার একপাশে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে সিদ্ধি, মুখোমুখি বসে আছেন শোভা নামক ভদ্রমহিলা। বাড়ির পরিবেশ থমথমে, কেউ কোন কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। শোভা অবশ্য সবার জন্য চা করে এনেছে কিন্তু সিদ্ধি তা মুখেই দিচ্ছে না। আর দিবেই বা কিভাবে? যে বাবা কয়েকদিন আগেও তার মায়ের কথা ভেবে কাঁদতেন, সে বাবাই কিনা আরেক মহিলাকে বাড়িতে এনে তুলেছেন? অন্তত নিজের মেয়েকে জানাতে পারতেন, সিদ্ধি তো মানা করতো না। বরং সেও চায় তার বাবা ভালো থাকুক। শোভা সিদ্ধির হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দেয় কিন্তু সিদ্ধি ধরে না। কাপটা মেঢেতে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। ভেঙে যাওয়া কাপটার দিকে তাকাতেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায় সিদ্ধির।

চিলেকোঠায় সমাপ্তি সিজন ২ পর্ব ৪