চিলেকোঠায় সমাপ্তি সিজন ২ গল্পের লিঙ্ক ||লেখিকা- মিহি

চিলেকোঠায় সমাপ্তি সিজন ২ পর্ব ১+২
লেখিকা- মিহি

“আয়াশ ভাইয়া এক্সিডেন্ট করছে ভাবী। আপনি তাড়াতাড়ি আসেন।” তূর্যর কথা শোনামাত্র মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে সিদ্ধির। আজ তার আর আয়াশের প্রথম বিবাহবার্ষিকী আর আজকের দিনে কিনা তার স্বামীর প্রাণ সংশয়ে? সিদ্ধি তাড়াহুড়ো করে ঘর ছেড়ে বেরোতেই দেখল তার বাবা আজও বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। সিদ্ধি এইমুহূর্তে সেসবে পাত্তা দিল না। সায়ন সাহেবকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল।

চিন্তায় হাত পা কাঁপছে সিদ্ধির। না জানি কী হলো আয়াশের, তূর্য তো ঠিকমতো কিছু বলছেও না। বড়সড় কোন দুর্ঘটনা ঘটলো না তো? আয়াশের অনিষ্টের আশঙ্কায় সিদ্ধির চোখ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করেছে। আবারো তূর্যর নম্বর ডায়াল করলো সিদ্ধি। লাভ হলো না, নম্বর বন্ধ বলছে। সিদ্ধি কাঁদছে, রিকশাওয়ালা লোকটা একবার পিছনে ফিরে তাকালো। বোধহয় সিদ্ধির জন্য মায়া হলো সামান্য।

সিদ্ধি নাফছীর কাছে কল দিল, নাফছীও কল ধরছে না। তূর্যর নম্বরে ক্রমাগত ডায়াল করে চলেছে সে। একটু পর তূর্য কল ধরলো। কল ধরেই বললো,”ভাবী, তাড়াতাড়ি আয়াশের বাড়িতে আসেন। জোহরা খালা আর নাফছী খুব কাঁদছে।” সিদ্ধি কিছু বলার আগেই আবারো কলটা কেটে গেল। সিদ্ধির এখন চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কী হচ্ছে এসব তার সাথে? সবেমাত্র আয়াশকে নিয়ে জীবনের সবচেয়ে রঙিন মুহূর্তগুলো শুরু করেছিল সে অথচ শুরুতেই কিনা এমন ঝড় এসে তার জীবনটা উলট-পালট করে দিল? সিদ্ধির ফর্সা মুখ কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে উঠেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“কীরে তূর্য? সব রেডি তো? কেক কই?”
-“উফ আয়াশ! এত টেনশন করছিস কেন তুই? সব হয়ে যাবে। কেক আসছে।”
-“হুশ! তোর কেক আসার আগে যদি সিদ্ধি চলে আসে? এত সুন্দর করে সব প্ল্যান করেছি আর সামান্য কেকের জন্য যদি সব ভেস্তে যায়, তোর খবর আছে।”
-“মাফ কর বাপ। আমি আবার কল দিচ্ছি।”

আয়াশ বেলুনগুলো নিয়ে দেয়ালের সাথে আটকাতে যায়। দেয়ালে সুন্দর করে লেখা হয়েছে হ্যাপী অ্যানিভার্সারি আয়াশ-সিদ্ধি। পাশে বেলুনগুলো লাগালে দেখতে সুন্দর লাগবে। আয়াশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ভাগ্যিস কাল হাবিজাবি বুঝিয়ে সিদ্ধিকে বাবার বাড়ি পাঠাতে পেরেছিল নাহলে আজ এতকিছু প্ল্যান করতেই পারতো না। জোহরা বেগম আয়াশের উপর বেশ রেগে আছেন।তিনি বারবার বলছেন,”তোদের এসব প্ল্যানের চক্করে মেয়েটা কাঁদছে নিশ্চিত! ছিঃ ছিঃ! সারপ্রাইজ দিবি ঠিক আছে, তাই বলে এক্সিডেন্টের কথা বলে ডাকার কী আছে? আহা রে মেয়েটা আমার।” তিনি আয়াশের সাথে কোনরকম কথাই বলছেন না কিন্তু আয়াশ তো জানে সিদ্ধিকে ডাকলে সিদ্ধি হুট করে আসবে না, হাজারটা প্রশ্ন করবে। হয়তো বুঝেও যাবে সবকিছু। তাহলে সারপ্রাইজটাই মাটি হয়ে যাবে।

দরজায় জোরে খটখট শব্দ শুনে আয়াশ বুঝে গেল নির্ঘাত সিদ্ধি এসেছে অথচ এই তূর্যর অর্ডার করা কেক এখনো এলো না। কত সাধ করে আয়াশ সিদ্ধির জন্য স্পেশাল চকলেট কেক অর্ডার করেছিল কিন্তু সেই কেক এলোই না। আয়াশ লুকিয়ে পড়লো আর নাফছীকে বললো যেয়ে দরজা খুলতে। নাফছী দরজা খুলে দিতেই সিদ্ধি হড়বড়িয়ে ঘরে ঢুকলো। আশেপাশে কিছুই খেয়াল করলো না, আয়াশকে খুঁজতে লাগলো। এমন সময় আয়াশ আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললো,”সারপ্রাইজ! হ্যাপি অ্যানিভার্সারি।”

আয়াশের কথা শুনে হতবিহ্বল হয়ে যায় সিদ্ধি। ফর্সা মুখে কান্নার দাগ এখনো দৃশ্যমান। আয়াশের জন্য সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে সে আর আয়াশ কিনা বিবাহবার্ষিকীর সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ওকে এভাবে ডেকেছে? কটমট করে আয়াশের দিকে তাকিয়ে আছে সিদ্ধি। আচমকা একটা বক্স হাতে ছেলে এসে সিদ্ধির হাতে কেকটা ডেলিভারি দিল। সিদ্ধি কেকটা বক্স থেকে বের করলো। আয়াশ ঢোক গিলে বললো,”বউ, আসো কেক কাটি।” আয়াশের কথা শেষ হতে না হতেই সিদ্ধি সমস্ত কেকটা আয়াশের মুখে ছুঁড়ে মারলো।

শুধু মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, আয়াশের সমস্ত মুখে কেকটুকু ভালোভাবে মাখিয়েও দিল। আয়াশ করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিদ্ধির দিকে। সিদ্ধির রাগ তখনো কমেনি। তূর্যর দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালো যেন ভস্ম করে দেবে ওকে। তূর্য ভয়ে “ভাবী আসসালামু আলাইকুম” বলে কোনরকমে অন্য ঘরে গেল। নাফছীও আর ওখানে থাকলো না। জোহরা বেগম তো অনেক আগেই চলে গেছেন। আয়াশ সমানে ঢোক গিলছে। সে নিশ্চিত এবার সিদ্ধি তাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। নিষ্পাপ শিশুর মতো মুখ করে আয়াশ বললো,

-“বউ, রাগ করো না প্লিজ।”
-“কে তোর বউ? তুই না মরছিস? মরেই যা।”
-“এত্ত রাগ বাব্বাহ! আমার বউটা রাগ করলে তো একদম টমেটোর মতো লাল হয়ে যায়। আসো তো টমেটো বউ, কেক কাটবো।”
-“তোকে কাটবো আমি। ছুরিটা কই? কীরে, ছুরি কই?”
আয়াশ সিদ্ধির কথা শুনে টেবিলের পাশ থেকে ছুরিটা নিয়ে আলতো করে পকেটে ঢুকালো, সিদ্ধি আশেপাশে ছুরি খুঁজছে। আয়াশ যতই সিদ্ধিকে মানানোর চেষ্টা করছে, সিদ্ধি ততই রেগে আগুন হচ্ছে।
-“ও বউ শোনো না! তুমি না খেয়ে থাকলে তো আমার বেবীটাও না খেয়ে থাকবে।”
-“বেবী? সেটা কবে হলো?”
-“হতে তো দেরী নাই।”

-“তুই…তুই একটা…তোর সাথে কথাই বলবো না আমি। বের হ আমার রুম থেকে।”
-“এত রাগ করলে কিন্তু অন্য কেউ নিয়ে যাবে তোমার বরকে।”

আয়াশের মুখ থেকে কথাটা শোনামাত্র চোখে জল আসে সিদ্ধির। আয়াশকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আয়াশ অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। রাগ ভেঙেছে মহারানির। আয়াশ মুচকি হেসে সিদ্ধিকে কোলে করে নিচে নিয়ে আসে। সিদ্ধি লজ্জায় চোখ বন্ধ করেছে। তূর্য আরেকটা কেক এনেছে, আগের কেকটা তো আয়াশের মুখে ছেপে গেছে। কেকটা টেবিলে রেখে উপরে সুন্দর করে মোমবাতি সাজালো তূর্য। আয়াশ মুখ ধুয়ে এসে সিদ্ধির পাশে দাঁড়ালো। দুজন এখন একসাথে কেক কাটবে। মোমবাতি নেভাতেই সকলে হাততালি দিল। কেক কাটলো দুজনে।

আয়াশ প্রথমে সিদ্ধিকে কেক খাওয়ালো। সিদ্ধি আয়াশকে কেক খাওয়াতে যাবে এমন সময় কেউ আয়াশের নাম ধরে ডেকে উঠলো। আয়াশ ও সিদ্ধি তাকালো সেদিকে। কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি পড়া একটা উনিশ-বিশ বছরের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। সিদ্ধি অবাক দৃষ্টিতে আয়াশের দিকে তাকালো। মেয়েটা এসেই কাঁদতে কাঁদতে আয়াশের পায়ের কাছে বসে পড়লো। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,”আপনি আমায় ছেড়ে কেন চলে এসেছেন? আমি আপনাকে কত খুঁজেছি। নিজের স্ত্রীকে একা ফেলে চলে আসতে লজ্জা লাগলো না আপনার?”

সিদ্ধি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। কী বলছে এই মেয়ে? আর আয়াশই বা কিছু বলছে না কেন? সিদ্ধি হাতে রাখা কেকটুকু মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। আয়াশ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। মেয়েটা তখনো মেঝেতে আয়াশের পায়ের কাছে বসে কাঁদছে। আয়াশ একটু জোরেই চেঁচালো মেয়েটার উপর। মেয়েটা উঠে কাঁদো কাঁদো গলায় জোহরা বেগমের কাছে গিয়ে বললো,”আম্মা, আমার নাম রুফাইদা, ছোট্ট করে সবাই রুফু ডাকে। বিশ্বাস করেন, আপনার ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল। আপনার ছেলে আমার সাথে থাকছেও অনেকদিন।

তারপর হঠাৎ করেই শহরে আইসা আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিছে। আম্মা, আপনিই কন আমি কী করমু।” মেয়েটার কান্নায় জোহরা বেগমের মন খানিকটা মলিন হলো কিন্তু কোন ভিত্তি ছাড়া এই মেয়ের কথায় বিশ্বাস করে তিনি তো নিজের ছেলেকে অবিশ্বাস করতে পারেন না। সত্যিটা কী তা খুঁজে বের করতে হবে। তিনি নাফছীকে বললেন মেয়েটাকে তার ঘরে নিয়ে যেতে। মায়ের এমন কথায় নাফছী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অতঃপর রুফুকে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোল। আয়াশ সিদ্ধিকে কী করে বোঝাবে এখন? মেয়েটা দরজা অবধি খুলছে না। রুফু মেয়েটাকে যে বেশ পরিকল্পনা করে এখানে পাঠানো হয়েছে তা বেশ বুঝতে পারছে আয়াশ কিন্তু কে পাঠালো তাকে আর কেনই বা পাঠালো?

“এই মেয়ে সত্যি করে বলো কে তুমি? আমার উপর এমন নিকৃষ্ট অভিযোগ কেন লাগিয়েছো তুমি? আমি তো তোমাকে চিনিও না।” কথা শেষ করে আয়াশ পেছনে ঘুরতে যাবে এমন সময় রুফু তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আয়াশ ছাড়াতে চেষ্টা করে কিন্তু রুফু ছাড়ে না। আচমকা হাততালির শব্দে দরজার দিকে তাকায় আয়াশ। সিদ্ধি দাঁড়িয়ে। আয়াশ রুফুকে ফেলে সিদ্ধির দিকে দৌড় দেয়।
সিদ্ধি আয়াশের কোন কথাই শুনছেনা। সে এ বাড়িতে থাকবে না। আয়াশ যতই সিদ্ধিকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, সিদ্ধি কানেই নিচ্ছে না। ঘরে ঢুকে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে সে। আয়াশ করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

-“এতটুকুই ছিল আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস?”
-“বিশ্বাসের প্রশ্ন তোমার মতো বিশ্বাসঘাতকের মুখে মানায় না। আমার আগেও তোমার জীবনে কেউ ছিল তাহলে তাকে নিয়েই থাকতে। আমার জীবনটা কেন নষ্ট করলে?”
-“আমি সেই ছোট থেকেই শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।”
-“উফ! আবার নাটক। তোমার সাথে আমার দেখাই হয়েছে কলেজ লাইফে আর তুমি কিনা আমায় ছোট থেকে ভালোবাসো? ফাজলামি করতেছো আমার সাথে?”

-“তোমার ওসব মনে নেই সিদ্ধি কিন্তু প্লিজ আমায় ভুল বুঝো না। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।”
-“তোমার সাথে আমি কোন কথা বলতেই ইচ্ছুক না।”
আয়াশকে সামনে থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সামনে এগোয় সিদ্ধি। আচমকা মাথাটা ঘুরে উঠে। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নেয় সিদ্ধি। আয়াশ সিদ্ধিকে ধরে ফেলে, কোলে করে বিছানায় বসায়। সিদ্ধি নড়ছে না। আয়াশ পানি ছিটায় সিদ্ধির মুখে, লাভ হয় না। চিৎকার করে মা আর নাফছীকে ডাকে।

আচমকা আয়াশের এমন চিৎকারে জোহরা বেগম আর নাফছী ভয় পেয়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে ঘরে ঢুকে দেখেন সিদ্ধি জ্ঞান হারিয়েছে। আয়াশ চটজলদি ডাক্তারকে কল করে। নাফছী সিদ্ধির পাশে বসে আছে। জোহরা বেগম দোয়া পড়ছেন। আচমকাই কী হলো মেয়েটার!
ডাক্তার সাহেবা আসতে আসতে আধঘণ্টা লাগলো। তিনি এসে সবাইকে ঘর থেকে বের হতে বললো। ডাক্তার সাহেবা চেকআপ করলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলো সিদ্ধির। ডাক্তার সাহেবাকে দেখেই সে কিছুটা বিচলিত হলো।
-“ডাক্তার সাহেবা আপনি? কী হয়েছে আমার?”
-“আরে শান্ত হোন মিসেস.চৌধুরী। আপনি মা হতে চলেছেন।”
-“আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু ডাক্তার সাহেবা, এ কথা আমার পরিবারকে জানাবেন না।”
-“সে কী! কেন?”
-“আমি তাদের নিজের মুখে বলতে চাই।”
-“বেশ বেশ। আমি আসছি তাহলে।”

ডাক্তার সাহেবা হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন। ডাক্তার সাহেবা চলে যেতেই আয়াশ দৌড়ে এসে সিদ্ধিকে জড়িয়ে ধরে। সিদ্ধিও আলতো করে জড়িয়ে ধরে আয়াশকে। কানের কাছে মুখ এনে বলে,”আপনি বাবা হচ্ছেন আয়াশ সাহেব।” সিদ্ধির বলা এক বাক্যে আয়াশের সারা শরীরে বিদ্যুতের ন্যায় কম্পন সৃষ্টি হয়। সিদ্ধিকে কোলে তুলে চিৎকার করে ওঠে আয়াশ। জোহরা বেগম মুখ টিপে হাসছেন আর নাফছী তো নাচতে শুরু করেছে। আয়াশের খুশির কোন কূল-কিনারা নেই। কিন্তু কথায় আছে না যেখানে সুখ, সেখানেই দুঃখ। রুফু মেয়েটা ঘরের এককোণে এসে দাঁড়ালো। রুফুকে দেখতেই রাগে সিদ্ধির মুখ লাল হয়ে উঠলো।

এই মেয়েটাকে সে বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারে না। রুফু এসে সিদ্ধির পাশে বসে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,”আপা, আপনার বাচ্চারে নিয়ে আপনি থাকেন, আমার স্বামীরেও নেন কিন্তু একটাবার আমার কথা ভাবেন। সারা গ্রামে চুনকালি পড়ছে আমার মুখে যে আমার স্বামী আমারে রাইখা চইলা গেছে। আমার কী হবে বলেন।” বলতে বলতেই রুফু কেঁদে ওঠে। সে ভেবেছিল সিদ্ধি আবারো আয়াশের উপর চড়াও হবে কিন্তু তা হলো না বরং সিদ্ধি বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বললো,”তোমার আর কোথাও যেতে হবে না। এ বাড়িতেই থাকো। তোমার আমি আবার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।” সিদ্ধির এমন কথায় রুফু খানিকটা থতমত খেয়ে যায়।

-“কী রুফাইদা? থাকবা না?”
-“আবার বিয়ে কেন? আমার স্বামী তো আছেনই।”
-“ডিভোর্স দিবে আয়াশ তোমায়।”
-“আসতাগফিরুল্লাহ! ওমন কথা কইয়েন না আপা।”
-“তুমি এখন যাও। আমি পরে কথা বলবো তোমার সাথে।”
রুফু মাথা নেড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সিদ্ধি নাফছীকে ইশারা করে রুফুর পিছনে যেতে। নাফছী খুব সাবধানে রুফুর পেছন পেছন যায়। আয়াশ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিদ্ধির দিকে। মেয়েটা করছেটা কি!

-“কী করছো তুমি সিদ্ধি? কিছুইতো আমার মাথায় ঢুকছে না। তুমি কী কোনভাবে রুফুকে ট্র্যাক করার চেষ্টা করছো?”
-“রুফু কী রে? রুফাইদা ডাকবি। তোর আসল বউ নাকি ঐটা?”
-“ইশস! মায়ের সামনে তুই-তুকারি করছো, লজ্জা লাগে না তোমার? কেমন জানি হচ্ছো দিন দিন। বেহায়া!”
-“আহা! তোমার কত হায়া! যাও আমার জন্য অনেকগুলো আইসক্রিম নিয়ে আসো।”
-“এই সময় তো টক খেতে মন চায়।”
-“কয়টা বাচ্চা হইছে তোর? যেটা বলছি সেটা আন।”

সিদ্ধির ঝাড়ি খেয়ে আয়াশ মাথা চুলকাতে চুলকাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আর এদিকে জোহরা বেগমের হাসি থামছে না। আয়াশ যখন পেটে ছিল তখন রফিকউদ্দিন সাহেবের সাথে এমন করতেন তিনি। মুহূর্তগুলো এখন শুধুই স্মৃতি- ভাবতেই চোখ নোনা জলে ভরে আসে তার। সিদ্ধির মাথায় হাত রেখে দোয়া করে ঘর ছেড়ে বের হোন। সিদ্ধি সায়ন সাহেবকে কল দেয়। তিনি যে নানা হচ্ছেন কথাটা তো জানাতে হবে তাকে।

সিদ্ধি বেশ কয়েকবার সায়ন সাহেবকে কল করে কিন্তু কল ওয়েটিং বলছে। সিদ্ধি বুঝে উঠতে পারছে না এত সময় ধরে তার বাবা কার সাথে কথা বলছে। এরই মধ্যে রুফাইদা সিদ্ধির জন্য এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আসে। সিদ্ধি খায় না, পাশে রেখে দেয়। আয়াশও তখনি আসে সিদ্ধির জন্য তেঁতুলের আচার নিয়ে। আচমকা রুফু আয়াশের হাত থেকে আচারের বয়ামটা নিয়ে কিছুটা আচার মুখে দেয়। তারপর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠে,”আমার আবার আচার বড়ো ভালো লাগে তাই একটু নিলাম। লন আপা খান।”

সিদ্ধির বেশ মন খারাপ হয়। আচারটা আয়াশ তার জন্য এনেছিল তাও প্রেগন্যান্সির প্রথম সময়ে। কত অনুভূতিমাখা একটা মুহূর্ত নষ্ট করে দিল এই মেয়ে। এর একটা বিহিত করতেই হবে। আয়াশ হেসে আচারের বয়ামটা রুফুকেই দিয়ে দিল। বলল,”ওটা তুমিই খাও। আমার স্ত্রীর জন্য আমি আরো এনেছি।” বলেই আরেকটা আচারের বয়াম সিদ্ধির হাতে দিল। এটা দেখে রুফুর মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। বয়াম হাতে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সিদ্ধি হাসছে। হাসতে হাসতেই বললো,”তোমায় না আইসক্রিম আনতে বলেছিলাম? তবে আচার কেন?” আয়াশ হাতে লুকিয়ে রাখা আইসক্রিমের বাটিটাও সিদ্ধির হাতে ধরিয়ে দিল। ব্যস! সিদ্ধির খুশি দেখে কে! সিদ্ধি মনের আনন্দে আইসক্রিম খেতে লাগলো।

-“কাজ হয়েছে রুফু?”
-“জ্বী না! মালগুলো হেব্বি চালাক। ইচ্ছে করে ঘোরাচ্ছে আমায়। তবে আমার নামও রুফাইদা হক। আপনার কাজ হবেই, ডোন্ট ওয়ারি।”
-“বেশি সময় দিতে পারবোনা আমি। দুইদিনের মধ্যে কাজ শেষ করো। কাগজগুলোর আমার দুইদিনের মধ্যেই লাগবে।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে।”
কল কেটে পেছনে ঘুরতেই রুফু দেখলো নাফছী সন্দিহান দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রুফু কপালের ঘাম মোছার ভান করে নাফছীর সামনে থেকে চলে যায়। নাফছী অবশ্য রুফাইদার কথা শোনেনি কিন্তু মেয়েটা যে কোন একটা ষড়যন্ত্রের জাল পাকাচ্ছে তা স্পষ্ট বুঝেছে। কথাটা ভাবীকে জানাতে হবে, ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধির ঘরের দিকে এগোলো নাফছী।

তায়েফউদ্দিনের শরীর আবারো খারাপ হচ্ছে দিনকে দিন। আনিসও আজকাল সব কুকর্ম বাদ দিয়ে ভাইয়ের সেবা করছে। তূর্যর সবদিক একা সামলাতে হচ্ছে। গ্রামে রাস্তা মেরামতের কাজে হাত লাগিয়েছে সে। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই লোকগুলো দায়সারাভাবে কাজ করতে শুরু করবে যেটা তূর্য চায় না। তাই বাড়ির দায়ভারটা আপাতত চাচা আনিসের উপরেই রেখেছে। এত ব্যস্ততার ভিড়েও একটা বিষয় তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সব সত্যিটুকু আয়াশকে বলতে চায় সে কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না। এত বড় সত্যির মুখোমুখি কিভাবে হবে সে?

চিলেকোঠায় সমাপ্তি সিজন ২ পর্ব ৩