আকাশে তারার মেলা শেষ পর্ব 

আকাশে তারার মেলা শেষ পর্ব 
আসরিফা সুলতানা জেবা

এই তুই হাত ছাড়ছিস কেন? চোখ বুঁজবি না একদম।দেখ চারটা মাস ধরে অনেক নাটক করেছিস। আমার কিন্তু এবার সহ্যশক্তি হারিয়ে যাচ্ছে। এক হাত লাগিয়ে দিব গালে।তুলি তুই ভালো করেই জানিস রাগ উঠলে কেউ তোকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। শক্ত কর নিজেকে। এখনও তোর আমার থেকে রেহাই পাওয়ার সময় আসে নি।

তুলির শিথিল হয়ে যাওয়া হাত টা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে পাগলের মতো প্রলাপ করতে লাগল আদ্র। এই বুঝি তার নিশ্বাস আঁটকে যাবে। তুলির দু চোখ বুঁজে যাওয়া যেন তার মস্তিষ্কে হারানোর ভয় জাগিয়ে দিল পুনরায়। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ল। আদ্রর চিৎকার বাহির থেকে আরিয়ান ও রিম শুনতে পেয়ে দৌড়ে এল। আদ্র কে অস্থির অবস্থায় দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল দু’জন। তুলির শ্বাস চলছে কিন্তু রেসপন্স করতে পারছে না। রিম আরিয়ান কে ইশারা করল আদ্র কে সামলাতে। নিজে দৌড়ে চলে এল ডাক্তার ডাকতে। আরিয়ান আদ্র কে পিছন থেকে জরিয়ে ধরে তুলির কাছ থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করতে লাগল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ। আদ্রর সুঠাম দেহের শক্তির তুলনায় তার শক্তি নগন্য। ডাক্তার দৌড়ে আসলেন কেবিনে। আদ্র কে অনেক চেষ্টা করে ও সরাতে পারল না।ঠাই বসে রইল তুলির হাত টা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে। ডাক্তার তুলি কে চেকআপ করে আরেকটা টুল টেনে আদ্রর পাশে বসল। আদ্র তখনও তুলির মলিন, নির্জীব শ্যামলা চেহারার দিকে তাকিয়ে। ডাক্তার মিনহাজ আদ্রর বাহুতে হাত রাখতেই আদ্র ওনার দিকে দৃষ্টি স্থাপন করল।

“দেখুন না ডা. মিনহাজ আমার ওয়াইফ কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। বিশ্বাস করুন ওকে আমি নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রেখেছি। শুধু! শুধু তিন বার থাপ্পড় মেরেছি রাগের মাথায়। তাছাড়া চুল পরিমাণ ক্ষতিও আমি ওর হতে দেই নি। তবুও কেন ওর এতো বড় অসুখ হল? থাপ্পড় মারলে কি এত বড় অসুখ হয় ডক্টর?”

ধরফর করে উঠল ডক্টর মিনহাজের বুকটা আদ্রর কাতর স্বরে পাগলাটে কথা শুনে। একজন ডাক্তার হয়ে আদ্র এতোটা জ্ঞান শূন্য কিভাবে হয়ে পড়ল? তিনি যেন কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। কতবার এই ছেলের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে তার। এই ছেলের প্রশংসা শুনেছে কত ডাক্তারদের কাছে। অথচ আজ যেন সম্পূর্ণ বিপরীত একটা মানুষ দেখছেন ওনি। আসলে পৃথিবীতে কিছু কঠোর মানুষ সর্বদাই ভালোবাসার কাঙাল হয়। কঠিন মন গলে তরলে পরিণত হয় ভালোবাসা নামক অসীম অনুভূতির নিকট।

আদ্রই যেন ওনার কাছে জলজ্যান্ত প্রমাণ। নিস্তেজ হয়ে চোখ বুঁজে থাকা তুলির দিকে চেয়ে বুকটা হাহাকার করে উঠল ওনার। মনে পড়ে গেল নিজের স্ত্রীর কথা। আদ্রর মতো পাগল না হলেও ভিতরে ভিতরে পুড়েছেন ওনি স্ত্রীর মৃত্যুতে। বিয়ের একবছর পর এক্সিডেন্টে নিজ অর্ধাঙ্গিনী কে হারিয়ে তিনি একাই কাটিয়ে দিয়েছেন নিজের জীবনের এতগুলো বছর। সাথে সজীব রেখেছেন ভালোবাসার স্মৃতি গুলো। জীবন তো কারো জন্য থেমে থাকে না। প্রকৃতি নিজ দায়িত্বে সময়ের প্রবাহে কাটিয়ে দেয় মায়া। কিন্তু আদ্র?

আদ্র কি পারবে হারিয়ে সময়ের স্রোতে নিজেকে সামলে নিতে? হঠাৎ ড. মিনহাজের মনে ধ্বনিত হলো পারবে না ছেলেটা। মরে যাবে। হতাশার একটা নিশ্বাস ছাড়লেন তিনি। মনে আশার আলো জাগিয়ে উঠে দাঁড়ালেন কেবিন থেকে বের হওয়ার জন্য। একটু আগেই জুনিয়র চিকিৎসকের ফোন পেয়ে ছুটে এসেছেন। কেবিন থেকে বের হতে হতে উচ্চারণ করলেন ” আকস্মিক মৃত্যু আসলে কিছুই করার থাকে না হাতে তবে মৃত্যুপথযাত্রী কে আল্লাহ চাইলে সুস্থ করে দিতে পারেন। শুধু প্রয়োজন আল্লাহর রহমত এবং ওনার উপর ভরসা রেখে সঠিক চিকিৎসা চালানো।”

আরিয়ান,রিমি আদ্রের দিকে চেয়ে আছে এক পলকে। অনুশোচনায় ভুগছে দু’জন। তুলির চেয়ে ও বেশি কষ্ট অনুভূত হচ্ছে ওদের আদ্রর জন্য। সব জেনেও ওরা কি একটা বার আদ্র কে খুঁজে বের করতে পারত না? চেষ্টা টা আগে করলে হয়তো চার টা মাস ধুঁকে ধুঁকে মরত না আদ্র ও তুলি। আজ রিমের মনে হচ্ছে তুলি ভুল ছিল। ভুল ছিল তার সিদ্ধান্ত। উপস্থিত বুদ্ধি টুকুও হয়তো তুলির নেই। নয়তো কি আদ্রর মতো মানুষ কে ছেড়ে আসতে পারে? ভালোবাসা কখনও ঘৃণায় পরিণত হয় না এটাও কি তুলি বুঝতে সক্ষম হয় নি? অথচ আজ সময় হারিয়ে বাঁচার ইচ্ছে জেগেছে তার। আদ্রর ভিতরটা অগ্নি বলয়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে।

তুলির হাতের ভাজে অনবরত ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে চলেছে। তার তো এতটুকু ও হদিস নেই রুমে সে ছাড়াও আরো দু’জন মানুষের অস্তিত্ব আছে। বুক চিরে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এল রিমের। আরিয়ানের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে মনের সুপ্ত কোণে গেঁথে নিল কিছু বাক্য। “আমি কখনও তুলির মতো ভুল করব না আরিয়ান। যদি কখনও বিরাট অসুখে ভুগি তখনও প্রতিটি সেকেন্ড তোমার কাছেই থাকব। কখনও তোমার সান্নিধ্য ত্যাগ করব না শেষ নিঃশ্বাস অব্দি।

ডাক্তার মিনহাজ তুলির রিপোর্ট গুলো ভালো করে চেক করলেন। বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে আদ্রর কাছে আসল। আদ্রর দৃষ্টি নিবদ্ধ তুলির চেহারায়। চোখের পলক ও ফেলছে না সে। মনে পড়ে গেল সেই ছোট্ট তুলির কথা। অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। ডাক্তার মিনহাজ আদ্রর পাশে বসে বলে উঠলেন,

” মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনতে হবে আদ্র। তুমি পাগলামি করলে বেডে শুয়ে থাকা মেয়েটা ভেঙে পড়বে। আশা করি এজ অ্যা ডক্টর তুমি একজন রোগীর জন্য হলেও ভাববে নয়তো স্বামী হিসেবে নিজের অর্ধাঙ্গিনীর জন্য। ”
চোখ বুঁজে নিজেকে শান্ত করে নিল আদ্র। অস্থির নয়নে ফুটে উঠল আশার প্রদীপ। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া স্বরে বলল,
” ভবিষ্যতে কি হবে বা বর্তমানে কি ঘটবে আমি জানিনা ডাক্তার। তবে এতটুকুই জানি আমার নিশ্বাস মিশে গেছে এই মেয়েটার সাথে। এই মেয়েটার শ্বাস প্রশ্বাস চলা মানেই আমার অস্তিত্ব টিকে আছে। আমি একবার ও বলব না আমার তুলি কে বাঁচিয়ে দিন।শুধু এতটুকুই বলব আমার অস্তিত্ব টা বিলীন হতে রক্ষা করুন।”

বিস্মিত না হয়ে পারল না রুমে উপস্থিত মানুষ গুলো। কি নাম দেওয়া যায় এমন ভালোবাসা কে? এতো আকুতি, এতো কাতরতা! রিমের কাছে তুলি কে অভাগিনী মনে হচ্ছে। যাদের জীবনে ভালোবাসা এলেও সেটা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে না। সারাজীবনই প্রাপ্তির খাতা থাকে শূন্য। ডাক্তার মিনহাজ নিজের কাঠ পুড়া অধরযুগল ভিজিয়ে রিপোর্ট গুলো এগিয়ে দিল আদ্রর দিকে।

এম-৩ বা এপিএল নামক ব্ল্যাড ক্যান্সার সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে আশা করি। একিউট মায়েলোব্লাসটিক লিউকেমিয়া মূলত আট প্রকারের। যেমনঃ এম- ০,১,২,৩,৪,৫,৬,৭। এ এমএল এম -২ ও ৪ কে শুধু কেমোথেরাপি দিয়ে টানা ৪ মাস চিকিৎসা করলে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর এম-৩ বা এপিএল নামক ব্ল্যাড ক্যান্সার কে পর্যায় বুঝে শুধু ওষুধ বা কেমোথেরাপি দিয়ে টানা ছয় মাস থেকে দুই বছর চিকিৎসা করলে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ৮০ শতাংশের বেশি। তবে এটা পর্যায় বুঝে শুরু থেকেই ট্রিটমেন্ট চালালেই আর আল্লাহ চাইলেই সুস্থ হওয়া পসিবল। অবশ্যই বুঝতে পারছো তোমার ওয়াইফ কোন ধরনের ব্ল্যাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। তবে,,

আদ্র তীর্থের কাকের মতো চেয়ে ডাক্তার মিনহাজের দিকে। কেউ যেন তার গলা চেপে ধরেছে যার ফলে শ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। রুহু টা আর্তনাদ করে উঠছে বার বার। তুলি কে নিজের বুকে ঢুকিয়ে রাখতে পারলেই বুঝি তার হৃদপিণ্ড শীতল হতো। অথবা তুলির সঙ্গে সঙ্গে নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারলেই তার শান্তি মিলবে। একটা ভুল সিদ্ধান্ত সবকিছু তছনছ করে দিল। এতোটা মাস কাছে থাকলে হয়তো আদ্র কিছু করতে পারত। সুস্থ করে তুলতে পারত।

এখনও যে পারবে না এমন তো না। পারবে সে দিন রাত এক করে তুলি কে সুস্থ করে তুলবে। প্রতিবারের মতো তুলি কে ভিক্ষা চাইবে আল্লাহর কাছে। ব্লাড ক্যান্সার শব্দ টা শুনলেই মানুষ আঁতকে উঠে। হাল ছেড়ে দেয়। ভয় গ্রাস করে দুর্বল করে দেয় মানুষের বেঁচে থাকার স্পৃহা। চেষ্টা না করেই হাল ছেড়ে দেয়। যেমনটা করেছে তুলি। অথচ ভয় না পেয়ে শুরু থেকেই নিজেকে শক্ত করে ট্রিটমেন্ট চালিয়ে গেলে সুস্থ হয়ে উঠা যায়। জীবন -মরণ সেটা তো আল্লাহর হাতে। ডাক্তার কয়েক মাস বাঁচবে বলে ধারণা করলেও দেখা যায় কিছু মানুষ বছরের পর বছর ক্যান্সার নিয়ে বেঁচে আছে। আবার কেউ কেউ আল্লাহর রহমতে ও চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে।

“তোমার ওয়াইফের শুরু থেকেই ওষুধের দ্বারা চিকিৎসা চলছিল। আমাদের হাতে এখনও সুযোগ আছে আদ্র। আল্লাহর অশেষ কৃপায় ও সঠিক সময় চিকিৎসা শুরু করে দেওয়ায় এতোদিন টিকে আছে মেয়েটা নয়তো বুঝোই তো। এটা মিরাক্কেল ও বলতে পারো তবুও একটা সুযোগ আল্লাহ তোমায় দিয়েছেন। আর দেরি করা ঠিক হবে না। নেমে পড়ো নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে। ”

আদ্রর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। কৃতজ্ঞতার চোখে আরিয়ান ও রিমের দিকে চাইল। আরিয়ান আর রিম জানার পর থেমে থাকে নি। তুলির অনিচ্ছা থাকা স্বত্তেও চিকিৎসা চালাতে হয়েছে ওদের জোরে। ওরা জানে না এটা কতটুকু কাজে লাগবে তবে মন প্রাণে চাই তুলি বেঁচে থাকুক অনেকগুলো বছর তার ডাক্তার সাহেবের জন্য। এক মিনিট হোক আর এক সেকেন্ড তুলির সমাপ্তি যেন তার ডাক্তার সাহেব কে ঘিরেই হয়। আদ্র উঠে দাঁড়াল। ডাক্তার মিনহাজের সাথে আলোচনা করে তুলি কে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগল। ওইখানে গিয়ে সাময়িক ট্রিটমেন্টের পর সব কাগজপত্র রেডি করে পাড়ি জমাবে বিদেশ।

শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবে সে। ব্যর্থ হলে নিজেও হারিয়ে যাবে তুলির সাথে। তুলি বিহীন আর একটা মুহুর্ত ও সে চায় না । করিডোর দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে নিজের বাবা -মা, বোন, বন্ধুমহল কে এগিয়ে আসতে দেখল। কে বলবে এগুলো আদ্রর বন্ধুমহল? তুলি শুধু আদ্রর জীবনে নয় নিজের মায়া দিয়ে গেঁথে গেছে সবার হৃদয়ে। চক্ষুজোড়া লাল রঙে ছেয়ে আছে আদ্রর। ছেলের বিধস্ত অবস্থা দেখে সায়েরা বেগম ছেলে কে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলেন। ছেলের অবস্থাই ওনাকে জানান দিচ্ছে তুলি ঠিক কেমন অবস্থায় আছে! এতো সুখময় মুহুর্তের কেন অবসান ঘটল? সব তো ঠিক থাকতে পারত। কেন এতো ছোট্ট বয়সে ক্যান্সার নামক ব্যাধির সাথে লড়তে হচ্ছে মেয়েটার? লড়াইয়ে জিতে যাবে নাকি নিঃশেষ হয়ে যাবে চিরতরে?

তুলির ঠোঁটে লজ্জালু হাসি। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে যাচ্ছে শিহরণ। হৃদয়ের গহীনে শীতলতার বিস্তার। গলায় আদ্রর ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া পেতেই একটা হার্ট বিট মিস করল। বুঁজে থাকা চোখ দুটো মেলে এক পলক চাইল আদ্রর দিকে। আদ্র তুলির গলায় মুখ গুঁজে চোখ বুঁজে শুয়ে রইল। বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। এই দশটা দিন একটুও থেমে থাকে নি। তুলির পাসপোর্ট, ভিসা রেডি করতে একটু ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। ঘুম ও হারাম হয়ে গেছে। নির্ঘুম কাটানো প্রতিটা রাত ও তাকে বড্ড শান্তি দেয়। কারণ রাত জেগে তো সে তার তুলার সেবা করতে পারে,ঘুমন্ত মুখটা অবলোকন করতে পারে। ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া বুকে এতটুকুই যেন এক ফোঁটা বৃষ্টির পানির ন্যায় ঝরে পড়ল। স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দিল আদ্রর বিষাদে ছেয়ে থাকা মন। তুলি নড়ে উঠল।

এতো মাস পর প্রিয় মানুষ টার এতো কাছে আসাটা তুলির হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক করে তুলছে। হসপিটালে থাকতে থাকতে পাগল হয়ে যাচ্ছিল তুলি। কিছুটা সুস্থ হতেই আদ্র কে আকুতি মিনতি করে বাসায় চলে এল তিনদিন হয়েছে। আগের থেকে অনেকটা সুস্থ। ” আমাকে ক্যান্সার নামক ব্যাধি এতোটা গ্রাস করতে পারে নি আদ্র যতটা আপনার অনুপস্থিতি গ্রাস করেছে আমায়। আমি প্রতিনিয়ত যন্ত্রণায় সিক্ত হতাম আপনাকে ছাড়া। আপনিই আমার ভালো থাকার উপশম। অথচ বিয়ের দিন কতটা বোকামি করেছি। আমাদের জীবনের চার টা মাস কে নরকে পরিণত করেছি। আসলেই আমি আহাম্মক!” কথাগুলো ভেবেই একটু হাসল তুলি। আদ্রর চুলে হাত দিতেই মাথা তুলে তুলির মুখ বরাবর চাহনি নিক্ষেপ করল। দু’জনের মাঝে কিঞ্চিত দূরত্ব। তুলির বলতে ইচ্ছে করছে ” আপনাকে ঠকানোর শাস্তি সরূপ সবটুকু দূরত্ব ঘুচিয়ে নেন আদ্র।”

তুলির গোলাপি মসৃণ ঠোঁটে ঠোঁট রাখল আদ্র। এক হাত দিয়ে আদ্রর ঘাড় খামচে ধরল। ডুবে গেল আদ্রর নীলাভ চোখের মাদকতায়। চোখের পলকেই ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল আদ্র। তুলি কে সম্পূর্ণ বেড রেস্ট দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আর উপায় নেই। নিজের পায়ে হাঁটার মতো শক্তি আর তুলি পায় না। একটু তেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পা ফুলে গেছে। সারা শরীরে থেকে থেকে ব্যাথা। তবুও মেয়েটার মুখে ম্লান হাসির ঝিলিক। আদ্র কাভার্ড থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে পা বাড়াতে নিলে তুলি হালকা হেসে দুর্বল স্বরে বলে উঠল-

” এখন কি আর সিগারেট খান না? অন্য সময় তো আপনার মুখ থেকে সিগারেটের সুবাস আসত।”
বাঁকা হাসল আদ্র। ঝটপট হাতের কাপড়গুলো সোফায় ফেলে কাছে এসে ঝুঁকে পড়ল তুলির মুখের দিকে। ঠোঁট প্রসারিত করে–” সিগারেট খাওয়ার নেশার চেয়ে আমার তুলার প্রতি মারাত্মক নেশা। এখন যখন তুলা-ই আমার বুকে তখন সিগারেটের নেশা ও ফিকে। তাই ছেড়ে দিয়েছি।”

আদ্রর এমন লাগামহীন বেহায়া কথা শুনে তুলি ঢোক গিলল। ঠোঁট কামড়ে মুখ টা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল। চোখে মুখে ছুঁয়ে যাচ্ছে আদ্রর গরম নিশ্বাসের উত্তাপ। বুক টা কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। আদ্র সরে যেতে নিলে সাহস জুগিয়ে বলে উঠল-
” আমরা তিন কবুল বলব না আদ্র?”
থ মেরে তুলির দিকে চেয়ে রইল আদ্র। তুলির সারা মুখ জুড়ে লজ্জার রেখা প্রতিফলিত যা আদ্র কে ঘোরে নিমজ্জিত করে ফেলল। নেশামিশ্রিত স্বরে জবাব দিল,

” তোমার ট্রিটমেন্ট শেষ হলেই আমরা নতুন ভাবে আবার সব সাজাব।”
” উঁহু! কালকেই কি লাল বেনারসি পড়ে আমি আপনার বধূ হতে পারি?”
কি বলে সম্বোধন করব আপনাকে? ডাক্তার সাহেব নাকি আদ্র? দু’ নামেই ডাকতে ইচ্ছে করে। দু’টো নামই যেন আমার কাছে নেশায় ভরপুর কোনো মোহ। মানুষ এক অথচ দু’ নামেই শোভা পায় তাকে। আচ্ছা ডাক্তার সাহেব বলেই নাহয় সম্বোধন করি?উঁহু!
নীলাভ চোখের অতি সুদর্শন যুবক,

কখনও আপনার নেশাক্ত আঁখি যুগল দ্বারা রাতের আকাশে তারার ছড়াছড়ি দেখেছেন? কখনও কি উপলব্ধি করতে পেরেছেন জড়ো হয়ে ঝিকিমিকি তারাদের গঠিত মেলার পিছনে লুকিয়ে থাকে রহস্য? আপনি আমার জীবনে শুকতারা হয়ে এসেছেন। যেই শুকতারার প্রতি মোহিত হয়ে প্রতি রাতে আকাশে তারার মেলা দেখা আমার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। একটা সময় চাঁদ খুব ভালো লাগত আমার কাছে। যেদিন থেকে আমার হৃদয়ে আপনার আগমন সেদিন থেকেই অকারণেই প্রিয় হয়ে উঠেছে তারার মেলা।

শুনেছি খুব প্রিয় হয়ে উঠা জিনিস নাকি খুব দুঃখের কারণ হয়ে উঠে। আমার ক্ষেত্রে ও তাই হয়েছে আদ্র। সঠিক মানে টা বুঝতে পেরেছি তারার মেলার পেছনে লুকিয়ে থাকা রহস্যের। আকাশে তারার মেলা মানে কোনো সুখ নয় বরং এক রাশ বিষাদ। মানুষের মনটা যখন বিষাদের অতলে ডুবে যায় ঠিক তখনই রাতের আকাশে তাকালে বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ শ্বাস। বুঝতে পেরেছিলাম সচরাচর মানুষ তারা দেখার জন্য সম্মোহিত হয় না। হয়তো তারা দেখেই যাদের মনের সুপ্ত কোণে জমা হয় বিষাক্ততা। আমার মনেও জমেছে বিষাক্ত অনুভূতি। বুকে জুড়ে বিস্তার হচ্ছে আপনাকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা। তারার মেলার ভিড়ে প্রতিটা রাত কল্পনায় অনুভব করে যায় আপনাকে।

কেন আমি আপনার হয়েও আপনার হলাম না আদ্র? জানেন আজকাল মনে হয় আমি ভুল ছিলাম। ইচ্ছে করে আপনার কাছে ছুটে যায়। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। কিভাবে আমি আপনার পুরো টা ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেই? এতগুলো মাস আপনাকে নিয়ে সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখেও ছেড়ে আসতে বাধ্য হলাম শরীরে বাঁধানো ক্যান্সার নামক ব্যাধির জন্য। আমার না এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকে জ্বর হতো ঘনঘন। ততটা আমলে নিতাম না।

জ্বর আবার আমার বিশেষ পছন্দ ছিল। অদ্ভুত হলেও এটাই সত্য। আপনাদের বাড়িতে যাওয়ার পর খেয়াল করলাম এখন আর জ্বর হয় না তবে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়তাম একটুতেই। সর্দি হতো না। তবে একদিন খেয়াল করলাম কাশির সাথে রক্ত বেরিয়ে আসছে। আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আদ্র। পরবর্তীতে মনে হয়েছে এটা হয়তো আমার চোখের ভেলকি। কিন্তু জন্মদিনের পরেরদিন ও যখন আবার ঘটনা টা ঘটল তখন আমার একটু একটু করে পরিপক্ব হয়ে উঠা মনটা জানান দিল এটা একদমই স্বাভাবিক না। একবার ভেবে নিলাম আপনাকে জানাব।

কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল যদি সিরিয়াস কিছু হয়ে থাকে আপনার নীল বর্ণের চোখে ভেসে উঠা যন্ত্রণা, কষ্ট আমি কিভাবে সহ্য করব? আমি পারি নি আদ্র। পরমুহূর্তে আমার একটা কথাই মাথায় আসল কুমিল্লা গিয়ে সবার অগোচরে ডাক্তার দেখানো টা জরুরি। তাই আপনাকে না বলেই চলে গেলাম। সেদিন বিকেলেই ঝুমু আপু কে আমার পুরোনো বান্ধবীর বাসায় যাব বলে কনভিন্স করলাম। আমার বান্ধবী ইশরার আম্মু ছিলেন একজন ডাক্তার। আন্টি কে সব খুলে বলতেই তিনি আমাকে একজন ডক্টর দেখান। সমস্ত চেকআপ+ টেষ্ট করিয়ে আমি চলে আসি বাসায়।

আর হসপিটালে আন্টির পরিচিত এক নার্সের সাথে কথা বলে আসলাম রিপোর্ট যখনই দেয় ফোন দিয়ে আমায় যেন জানিয়ে দেয়। আন্টি ব্যতীত অন্য কেউ যেন কিছু জানতে না পারে। রিপোর্ট আনতে অবশ্য আমি পরের দিন যেতাম কিন্তু তার আগেই আপনি আমায় ঢাকা নিয়ে আসলেন। খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম আপনি যদি কিছু বুঝে যান। নার্স অনেক বার ফোন দিলেও বিয়ের চক্করে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। হলুদের সেই রাতে আমার খেয়াল হল রিপোর্ট গুলোর কথা। তখনও ফলাফল জানা হয় নি আমার।

তার আগেই পাল্টে গেল সবকিছু। সেই রাতে আমাদের মাঝে ঘটেছিল অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু মুহুর্ত। তবে আমার একটা বারের জন্য ও মনে হয় নি আপনি অপরাধ করেছেন আদ্র। কেন মনে হয় নি বলতে পারবেন আপনি? আমার মন সেটা মানতে রাজি ছিল না। আমি এখনও বলব আপনি কোনো অপরাধ করেন নি। সেই রাতে দোষী তো আমিও ছিলাম। তলিয়ে গিয়েছিলাম আপনার চোখের মাদকতায়। আপনার নেশার ঘোরে ডুবে গিয়েছিলাম আমিও অনাকাঙ্ক্ষিত সেই মুহুর্তে। আমি জানি সামিরা আপু ইচ্ছে করে এমনটা করেছে। যখন ওনার চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম সব যেন পরিষ্কার হয়ে গেল।

আসলে কিছু মানুষ কে ভালো হওয়ার সুযোগ দিলেও, আপন করে নিলেও মানুষ গুলো তার মর্মার্থ বুঝে না। সকাল থেকেই প্রতিটা সেকেন্ড অপেক্ষার প্রহর গুণেছি কখন আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। শতবার কল্পনায় বর সাজে এঁকেছি আপনায়। কিন্তু হাজারো স্বপ্ন, হাজারো কল্পনা নিমিষেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল যখন হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো রিপোর্ট ও বার্তা দ্বারা জানতে পারলাম ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত আমি। দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। আপনার চেহারা ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে। ঘাবড়ে গিয়েছিলাম প্রচন্ড।

বেনারসি টা আঁকড়ে ধরে আপনার নিকট পা বাড়াতে নিলেই আমার মন টা আমায় থামিয়ে দেয়। চিৎকার করে বলে উঠে তুলি তুই আজকেই মরে যাবি জেনেও মানুষ টা তোকে বিয়ে করবে কিন্তু তুই একটা বার ও ভেবেছিস এতে তার জীবনটা বরবাদ হয়ে যাবে। আজ বিয়ে টা নাহলে বেঁচে যাবে মানুষ টা। হয়তো সময়ের স্রোতে পরিবারের জন্য হলেও বাধ্য হয়ে কারো সাথে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নিবে। ভালোবাসা মানে তো ত্যাগ। তাহলে কেন তুই নিজের সার্থ দেখবি?

কথাগুলো উদয় হতেই ঝটপট একটা চিরকুট লিখে সবার অগোচরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম সেদিন। ইচ্ছে করছিল নিজেকে নিজে গলা টিপে মেরে ফেলি। খুব কষ্ট হচ্ছিল আপনাকে ছাড়া। সেদিনই ট্রেনে দু’টো ভালো মানুষের সাথে দেখা হয় আমার। আরিয়ান ও রিম আপুর সাথে। মানুষ দুটো আমাকে আগলে রেখেছে। নিজেদের সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পেরেছেন করেছে। তবুও আমি জানি আমি বাঁচব না আদ্র। যেখানে আপনাকে ছাড়া নিঃশ্বাস ফেলতে গেলেও মনে হয় কেউ গলা চেপে ধরেছে আমি সুস্থ কিভাবে হব বলুন? আচ্ছা আদ্র আপনি তো হার্টের ডক্টর।

আল্লাহ কি আমায় হৃদরোগ দিতে পারতেন না? কেন আপনাকে নিজের অস্তিত্বে মিশিয়েও হারিয়ে যেতে হচ্ছে আমার? জীবনটা কেন সবসময় সুখময় হয় না? দুঃখ আসা টা কি জরুরি? আপনি আমার জীবনে আসার পর যত সুখ পেয়েছি এতো সুখ কোনো মেয়ে পেয়েছে কিনা তাতে সন্দেহ আছে আমার। অতি সুখ আমার কপালে সইল না আদ্র। আপনি কি কখনও খেয়াল করেছেন আমি কোনোদিন ও আপনাকে ভালোবাসি বলি নি? শতবার চেষ্টা করেছি কিন্তু বার বার “ভালোবাসি” শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে লজ্জায় নুইয়ে পড়েছি। প্রতিবার থমকে যেত আমার হৃদপিণ্ড। কখনও কি আপনাকে ভালোবাসি বলার সৌভাগ্য টা আমার হবে আদ্র?

আঁধারের ছড়াছড়ি চারপাশে। কিন্তু কৃত্রিম রঙা আলোয় আদ্র দের বাগান টা একদম আলোকিত হয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্র মূর্ছে যাওয়া লাল গোলাপ টার দিকে। ফুল টা যেমন সময়ের ব্যবধানে মূর্ছে পড়েছে তেমনি সেও তো মূর্ছে পড়বে তুলি বিহীন। বুকের ধুরফরানি বেড়ে যাচ্ছে বার বার। নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করার পরও হারিয়ে ফেলার ভয় আঁকড়ে ধরছে মনে। বিষাক্ত ফোড়ার মতো বিষাক্তময় ব্যাথা হৃদয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে এইবার বুঝি হার্ট টাই ব্লক হয়ে যাবে। হাতের চিঠিটা নিয়ে রুমে আসল আদ্র। তুলির ঘুমন্ত চেহারায় দৃষ্টি বুলিয়ে চিঠিটা খুব যত্ন করে ডায়েরির ভাঁজে রেখে দিল। তুলি কড়া ওষুধের তেজে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। আওয়াজবিহীন নিঃশব্দে পাশে বসল আদ্র। কপালে ছুঁয়ে দিল শুকিয়ে যাওয়া নিজের ওষ্ঠদ্বয়। এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তুলির চোখের পাতায়। কানের কাছে মুখ টা নিয়ে ফিচেল স্বরে বলে উঠল-
” হয় আমার জীবনের প্রতিটা সকাল তুমিময় হোক, নয়তো তুমি বিহীন আমার মৃত্যু হোক।”

ছাদে জমপেশ আড্ডা বসেছে সবার। অন্তু-পায়েল, সাগর-রিমি, নিবিড় -আমরিন,ইনশিতা -রনক,আরিয়ান-রিম, আহান-ঝুমু সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে। এতোদিন এই বাড়িটার প্রত্যেক টা মানুষের অনুভূতি গুলো যেন মৃত ছিল। তুলির আগমনে সবকিছু আবার কেমন সজীব হয়ে উঠেছে। যদিও তুলির অসুস্থতা কারো মনেই শান্তি দিচ্ছে না তবুও মেয়েটা যতটা সময়ই থাকবে ওকে খুশি রাখার চেষ্টা করে যাবে সবাই। হায়াত মওতের মালিক তো আল্লাহ।

কিন্তু আমরা চাইলে অসুস্থ মানুষ কে ভালোবাসা, স্নেহ দিয়ে তার মন টা কে আনন্দে ভরিয়ে দিতে পারি। হোক না সে দৈহিক ভাবে অসুস্থ একটু চেষ্টায় মনটা কে তো সুস্থ রাখা যায়। ছাদে পাটি বিছিয়ে গোল হয়ে বসে আছে সবাই কিছুটা জায়গা খালি রেখে। দরজার দিকে সবার নজর কখন তাদের কাঙ্ক্ষিত মানুষ দু’টো উপস্থিত হবে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না তাদের। আদ্র কে তুলি কে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসছে। তুলি আদ্রর বুকে মুখ গুঁজে চুপ করে আছে।

আজ অসহায় বলে নয়তো কখনও সবার সামনে আদ্রর কোলে উঠা তার পক্ষে সম্ভব হত না। তৎক্ষনাৎ মৃত্যু হত লজ্জায়। তুলিকে বসিয়ে দিয়ে আদ্র নিজে বসে পড়ল পাশে। সবাই মুগ্ধ চোখে চেয়ে দু’জনের দিকে। তুলির গায়ের জ্যাকেট টা আরো ভালো করে জড়িয়ে দিল আদ্র। বেশ ঠান্ডা আজ। তার উপর ছাদে দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। শিহরণ জাগিয়ে যাচ্ছে সবার দেহে। তুলি কে নিজের সাথে আলতো হাতে জড়িয়ে নিল আদ্র। হালকা হেসে সবার উদ্দেশ্যে বলল -” কি তোরা চেয়ে থাকবি নাকি গান টান গেয়ে ও শুনাবি? আমার বউয়ের মেহেদী রাত টা এভাবে ভেস্তে যেতে দিস না।”

সবাই এক গাল হাসল। রিমি ও রিম দু’জনে হাতে মেহেদি নিয়ে তুলির কাছে এসে বসল। দু’জন কে দেখেই মুচকি হেসে দু হাত মেলে ধরল তুলি। এই মেয়ের অমায়িক হাসি টা সবার মন কেড়ে নিল। আদ্র অপলক চোখে চেয়ে রইল। শীতল স্রোত বয়ে গেল অন্তরে। রিমি ও রিম তুলি কে মেহেদী দিয়ে দু হাত রাঙিয়ে দিতে লাগল। কিছুটা নিচু স্বরে তুলি বলে উঠল- ” আদ্র” লিখবে কিন্তু আপু। কথাটা রিমি ছাড়াও আদ্রর কর্ণগোচর হল। ঠোঁটের কোণে প্রতীয়মান হল প্রস্ফুটিত হাসি। মেয়েটা এখনও বাচ্চা। এখনও অবুঝ মন তার। অথচ এ বয়সেই লড়াই করে যাচ্ছে আদ্রর সাথে বাঁচার জন্য। একটা সুন্দর সংসার গড়ার জন্য। অন্তু আদ্র কে তুলির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে গলা খেঁকিয়ে বলে উঠল- ” আজ যার যার অপূর্ণ কথা আছে মানে মনের মধ্যে চেপে রাখা সব কথা উগলে দাও। হি হি!”

চমকিত নয়নে তুলি আদ্রর দিকে চাইল। অন্তুর অদ্ভুত কথা শুনে পায়েল দাঁতে দাঁত চেপে বলল -” তোমার মনে নিশ্চয়ই কোনো কথা চেপে রাখছো। এই আবার কোনো মেয়ের চক্করে পড়ো নাই তো?”
পায়েলের কথা শুনে সবাই জোরে হেসে উঠল। অন্তু ভয়ার্ত চোখে বলে উঠল- “নাউজুবিল্লাহ বউ। এই অন্তু তোমাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।”

পায়েল লজ্জায় একটু হাসল। আজকাল বড্ড বেশিই লজ্জা লাগে তার। অন্তু কে আগের মতো বকাঝকা ও করে না। পাশে বসে থাকা অন্তুর হাত টা চেপে ধরে বাহুতে মাথা হেলিয়ে দিল। অন্তু ধীর কন্ঠে বলল–” খারাপ লাগছে?” পায়েলের নিরলস জবাব–“না।”
তুলি ওদের দিকে চেয়ে হালকা হাসল। মনের মাঝে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে সবার সামনেই আদ্র কে বলল–” আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই ডাক্তার সাহেব। ”

চোখের ইশারায় সম্মতি জানাল আদ্র। সবার দিকে চেয়ে লজ্জায় নত মস্তকে তুলি বলে উঠল- “ভালোবাসি আদ্র।”
ঝড়ের বেগে কিছু একটা আছড়ে পড়ল আদ্রর বুকে। দ্রিমদ্রিম শব্দ হতে লাগল। হৃদস্পন্দনের বেগ বেড়ে গেল দ্বিগুণ। সে তো কোনোদিনও তুলির মুখ থেকে এই কথাটা শোনার জন্য জোর করে নি। ঠিক এই কারণেই হয়তো করতে পারে নি। পিচ্চি একটা মেয়ের মুখে “ভালোবাসি” শব্দটা ধারালো ছুরির মতো বিঁধছে। অনুভূতিগুলো দলা পাকিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে।

তুলি কে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলতে ইচ্ছে জাগছে আদ্রর। সবাই হাত তালিয়ে দিয়ে চিল্লিয়ে উঠল। তুলি এক রাশ লজ্জা নিয়ে মাথা তুলতেই চোখ আঁটকে গেল আদ্রর মুগ্ধতায় ভরপুর হাসিটায়। আবেগের তুমুল বর্ষণ হতে লাগল তুলির মনের গহীনে। হালকা হালকা লাগছে মন টা। কতকাল পরে সফল হয়েছে সে ভালোবাসি বলতে। শূন্য থাকা মনটা আবারও পূর্ণ হয়ে গেল। আদ্র এক হাত বাড়াতেই তুলি মেহেদী রাঙা দু হাত উপর তুলে মুখ লুকাল আদ্রর বুকে। সবার চোখে আনন্দের অশ্রু। তুলির চোখে মুখে লজ্জার ছাপ। এই বুকে মুখ লুকাতে পারলেই বুঝি বেঁচে যায় সে। রাদিফ সাহেব ও সায়েরা বেগম ছাদের দরজায় দাড়িয়ে চোখ মুছতে লাগলেন। আদ্রর বুকে তুলি কে দেখে মনটা ভরে গেল তাদের। বাবা -মা কে দেখতে পেয়ে আসার জন্য ইশারা করল আদ্র। হাতে ফলের প্লেট টা নিয়ে এগিয়ে আসলেন দু’জন। তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের হাতে আপেলের একটা পিস খাইয়ে দিলেন রাদিফ সাহেব। বয়স্ক দু’জন প্রেমিক যুগল ও আজ মেতে উঠেছেন আড্ডায়।

লাল খয়েরী বেনারসি টা হাতে নিয়ে তুলির দিকে এগিয়ে এল আদ্র। নিজ হাতে আজ নিজের বউকে সাজাবে সে। তুলি স্থির হয়ে বসে আছে। আদ্র সাদা একটা পাঞ্জাবি পড়েছে যার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ তুলির। চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়েছে তার। তুলির মন জুড়ে অনুভূতির বিচরণ হতে লাগল। আদ্র কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল –” দাঁড়াতে পারবে? ”
“পারব”।

দুর্বল শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল তুলি। আজও সারাদিন হসপিটালে ছিল মেয়েটা। শরীরের অবস্থা ততটা ভালো না। কাল বিকেলেই দু’জনের ফ্লাইট লন্ডন পাড়ি জমানোর জন্য। বিয়ে টা বাদ দিতে চেয়েছিল আদ্র তুলির কথা ভেবে। কিন্তু তুলির একরোখা জেদের কাছে হার মানতে হল তাকে। শুধু অসুস্থ বলে বেঁচে যাচ্ছে বেচারি নয়তো আদ্রর রাগী রূপ থেকে তার রেহাই ছিল না। এতক্ষণে তো আদ্রর বলিষ্ঠ হাতের চার-পাঁচটা থাপ্পড় খেয়ে নাকের পানি চোখের পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। সুযোগ বুঝে তুলি যেন বাঘিনী হয়ে উঠেছে। তার একটাই কথা–” ফ্লাইট যেহেতু কালকে আজকে রাতে বিয়েটা হলে মন্দ কি?

” আদ্র খুব যত্ন করে বেনারসি টা পড়িয়ে দিল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে হিজাব ও বেঁধে দিল মাথায়। বড় লাল ওড়না টা মাথায় জড়িয়ে দিল। তুলি অবাক হয়ে গেল আয়নার দিকে তাকিয়ে। সে তো ভেবেছিল চেহারার যে হাল এতে বোধহয় পেত্নীর মতো লাগবে। কিন্তু হিজাবে দারুণ লাগছে তাকে। তুলি দুঃখ প্রকাশ করেছিল চুল অনেক ঝড়ে পরে গেছে কিভাবে এই চুল বাঁধবে। আদ্র তখন মুখ ফুটে কিছু বলে নি বরং ইউটিউবে হিজাব বাঁধা শিখে নিয়েছে। তুলি আদ্রর হাত টা ধরে বলে উঠল- ” আর কত করবেন আমার জন্য? ”
” যতটুকু করলে তোমার মুখে হাসি দেখব ঠিক ততটুকুই।”

কথাটা বলেই তুলি কে কোলে তুলে নিল। একহাতে দরজা মেলতেই হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও বেঁচে গেল সব। দরজার বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিল সবকটা। ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে এল আদ্রর। দুষ্ট স্বরে বলে উঠল- ” এখনও কবুল বলি নি আগে আগেই বাসর ঘরের সামনে লাফালাফি! ইন্টারেস্টিং। ভেরি ইন্টারেস্টিং। ফুলশয্যা পড়ে হবে তোরা টাকার জন্য পরেই ভিক্ষুকের মতো দাঁড়িয়ে থাকিস।”
বেক্কল বনে গেল সব। আদ্রর রসাত্মক কন্ঠ শুনে তুলি জড়তা সংকোচে ওড়না দিয়ে নিজের মুখ টা ঢেকে ফেলল। সামনের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে আদ্র একটু ঝুঁকে বলল–” আঁচলে মুখ ঢেকে লাভ কি হবে বলো? আমি জ্ঞান হারাব, মরেই যাবো তবুও আমার হাত থেকে তোমাকে বাঁচাতে পারবে না কেউ। ” আদ্রর মুখে এমন কথা শুনে তুলি থমকে গেল। সাগরের বিয়ের রাতের কথা মনে পড়ে গেল তার। মিনমিন স্বরে বলে উঠল- ” ছি! কি অসভ্য গান।”

দরজায় এখনও দাড়িয়ে রইল সব। বিস্ময় কাটিয়ে নিবিড় বলে উঠল- ” আমি যা শুনেছি তোরাও কি তা শুনেছিস?” সবাই একসাথে হু বলে উঠল। নিবিড় বাঁকা হেসে বলল–” আমাদের ভিক্ষুক বলল আদ্র। ওকেও ভিক্ষুক বানানোর দায়িত্ব আমাদের। কি বলো বন্ধুমহল ও বউ? আমরিনের তীক্ষ্ণ স্বর–” আমাদের বলে নি ভাইয়া আপনাকে বলেছে কারণ আপনিই আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন। তো পুরোটাই আপনার উপর মানায়। ” কথাটা বলে আর এক মিনিট ও দাঁড়াল না আমরিন। দাঁড়ালে নিবিড়ের লাল চোখের শিকার হতে হতো। বিয়ের পর থেকে অজানা কারণেই নিবিড় কে ক্ষেপাতে বড্ড ভালো লাগে ওর। সবাই প্রচন্ড শব্দ করে হেসে দিল।

দু’ পাশে দু’জন বসে আছে। মাঝখানে পাতলা একটা কাজ করা সাদা কাপড়ের পর্দা। আদ্রর দৃষ্টি পর্দা বেধ করে লজ্জায় মাথা নত করে রাখা তুলির উপর গিয়ে পড়ছে। ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি তার। এই মুহুর্ত টার জন্য কতগুলো বছর ধরে অপেক্ষা তার। কিছু সময়ের জন্য ভুলে যেতে ইচ্ছে করছে দুঃখময় প্রহর গুলো। কাজী সাহেব তুলি কে কবুল বলতে তাড়া দিতেই তুলি লাজুক চোখে পাতলা ওড়নার আবরণ দিয়ে আদ্রর দিকে এক পলক তাকাল। নম্র স্বরে উচ্চারণ করল–” কবুল, কবুল, কবুল।” সাথে সাথেই আদ্র ও তুলি উভয়ের হৃদয়ে সৃষ্ট হল কম্পন।

ফুলে সজ্জিত বিছানায় বসে আছে তুলি হাঁটু মুড়ে। সব দূরত্ব কেটে গিয়ে আজ দু’জন এক হয়েছে। তুলির সারা শরীরের লোম খাঁড়া হয়ে যাচ্ছে এটা ভাবতেই আজ থেকে নতুন একটা জীবন শুরু হয়েছে তাদের। যেই জীবনে প্রতিটা রাত কাটবে আদ্রর বুকে। প্রতিটা সকাল শুরু হবে আদ্রর স্নিগ্ধময় চেহারা দেখে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত এগারো টা বাজে। আদ্র এখনও কেন আসছে না? এক ঘন্টা আগে এসে নিজের হাতে ভাত খাইয়ে, ওষুধ খাইয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে বেড়িয়ে গেছে। এখনও আসার নাম গন্ধ নেই। “আপনি এতগুলো বছর অনেক অপেক্ষা করেছেন আদ্র, আজ নাহয় আমিই একটু অপেক্ষা করি।”– বিড়বিড় করে কথাটা বলে তুলি হালকা হাসল।

ডক্টর মিনহাজের সাথে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত আদ্র। আজকে সকালে তুলির কিছু টেস্ট করিয়েছিল সেগুলো সম্পর্কে জানানোর জন্য ফোন দিয়েছেন ডক্টর মিনহাজ। গতকালই ঢাকা এসেছেন তিনি। সপ্তাহের চারদিন ঢাকাতেই রোগী দেখেন। ওনার সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলে রুমে আসল। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তুলি নড়েচড়ে বসল। আঁড়চোখে পাশে তাকাতেই নিজের খুব কাছে আদ্র কে আবিষ্কার করল। দু হাতে শাড়ির কিছু অংশ মুঠোতে পুরে নিল। আদ্রর শরীর থেকে ভেসে আসা পারফিউমের সুবাস নাকে এসে ধাক্কা লাগছে। মনে অনুভূতিরা খেলে বেড়াচ্ছে। মস্তিষ্কে খেলে যাচ্ছে আদ্রর প্রথম দিনের সেই কাছে আসার মুহুর্ত টা।

এতোদিনে বেশ বুঝতে পেরেছে তুলি আদ্র প্রথম দিন ছাদে তাকে লজ্জা ও বিস্ময়ে ফেলার জন্যই না চেনার ভান করেছিল। এই মানুষ টা তাকে লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলার জন্য পারফেক্ট। মাথায় স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠল তুলি। আদ্র হিজাব টা খুলে তুলির শাড়ির সেফটিপিন গুলো খুলে দিল। শরীরে আদ্রর স্পর্শগুলো ঝড় তুলতে লাগল তুলির বুকে। গাল দুটো লাল হয়ে এল তার। থমকে গেল আদ্র। তুলির লজ্জামাখা চেহারা তার মনে নেশা ধরিয়ে দিল। আস্তে আস্তে নিজের মুখ এগিয়ে নিল তুলির গলায়। অধরদ্বয় ছুঁয়ে দিতেই আদ্রর চুলে হাত মুষ্টিবদ্ধ করল তুলি।

শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রমশ ভারী হয়ে আসতে লাগল। বদ্ধ রুমে ছড়িয়ে পড়তে লাগল দু’জনের গরম নিঃশ্বাস। গলা থেকে মুখ তুলে তুলির বদ্ধ চোখের পাতায় চুমু খেল আদ্র। আরেকটু জড়োসড়ো হয়ে গেল তুলি। কিছু সেকেন্ড পরেই নিজেকে শূন্যে অনুভব করতেই গলা জরিয়ে ধরল তার ডাক্তার সাহেবের। তুলি কে নিয়ে বারান্দায় পাতা ডিভাইনে শুয়ে পড়ল আদ্র। চাঁদের আলো এসে ঠিকরে পড়ছে দু’জনের গায়ে। তুলি নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে আদ্রর বুকে মাথা রেখে। আদ্র মাথায় চুমু খেতেই তুলি তড়িঘড়ি করে উঠে বসল। হকচকিয়ে গেল আদ্র। উঠে তুলির পাশে বসতেই তুলি আদ্রর চোখে চোখ রেখে বলে উঠল- ” চার টা মাস কেন দূরে ছিলাম আমি আদ্র? আমি কিভাবে পারলাম আপনাকে কষ্ট দিতে? ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে আমার। ”

তুলি কে নিজের বুকে টেনে নিল আদ্র। মোলায়েম কন্ঠে বলল–” জীবনে সবক্ষেত্রে মানুষ উপস্থিত বুদ্ধি খাটাতে পারে না। যেখানে বিপদে ম্যাচুরিটি সম্পন্ন মানুষ গুলোই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে সেই জায়গায় তোমার মতো অবুঝ মনের কিশোরী একটা মেয়ের ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই স্বাভাবিক। আমার কোনো রাগ, অভিমান নেই তোমার প্রতি। আমি তোমাকে সীমাহীন ভালোবাসি তুলি। তোমার নিঃশ্বাস থমকে গেলে থমকে যাব আমিও।”

আঁতকে উঠল তুলি। আদ্রর কপালে, গালে অসংখ্য চুমু খেল। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাতে লাগল। অস্থির কন্ঠে- ” আর কখনও এমনটা বলবেন না আদ্র। আমি আপনার সাথে বাঁচতে চাই। আমাদের সুন্দর একটা সংসার হবে আদ্র। আমি ভুল করব আপনি ঠিক আগের মতো আমাকে শাসন করবেন। আর আমি ভয়ার্ত চোখে আপনার নীল চোখের,,,”

কথাটা আঁটকে গেল তুলির। রক্তজবার ন্যায় টকটকে লাল হয়ে গেল দু চোখ। কাশির চোটে আদ্রের সাদা পাঞ্জাবি রক্তে লাল হয়ে গেল বুকের কাছের অংশ । রক্তের ছিটেফোঁটা গিয়ে পড়ল চোখে। চোখ বুজে নিল আদ্র। ঘনঘন শ্বাস নেওয়া তুলির মাথা টা চেপে ধরল রক্তে রাঙানো পাঞ্জাবি তে। দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল আদ্রর। তুলি হাঁপাতে হাঁপাতে খামচে ধরল আদ্রর বুকের কাছের অংশ। হাজারো কথা বলতে চাইছে সে। বলতে চেয়ে ও পারছে না। আর এক মুহুর্ত ও দেরি না করে আদ্র তুলি কে কোলে তুলতে নিলেই তুলি স্থির, নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ঢলে পড়ে রইল আদ্রর বুকে। শক্ত করে তুলি কে জড়িয়ে ধরে বসে থাকল আদ্র। কানের কাছে মুখ নিয়ে আদর মাখা কন্ঠে ডেকে উঠল তুলি কে–” তুলা!”

কিন্তু নিশ্চুপ তুলি। আদ্র ভ্রু কুঁচকে আবারও ডেকে উঠল।
“কথা বলবা না বউ?”
তুলি কে প্রতিবারের মতো নিশ্চুপ থাকতে দেখে রাগ হল না আদ্রর। মৃদু হেসে তুলির কানের পিঠে চুমু খেল। যন্ত্রণায় ছেয়ে গেল হৃদপিণ্ড। ঠোঁট দুটো প্রসারিত রেখেই বলল,
” তুমি আর কথা বলবে না জানি তো। বোবা হয়ে গেছো চিরকালের জন্য। আচ্ছা আমি শাসন করার জন্য এমন করছো তাই না? তুমি তো অভিনয় ও শিখে গেলা তুলা। আচ্ছা সাড়া দাও নাহলে কিন্তু আমি তোমাকে বেলকনি থেকে ফেলে দিব। তখন ব্যাঁ ব্যাঁ করে কাঁদলেও লাভ হবে না।”

আকাশে তারার মেলা পর্ব ২৫+২৬

পীনপন নীরবতা ছেয়ে আছে চারদিকে। তুলিও হারিয়ে গেছে সেই নীরবতার ভিড়ে। আদ্রর কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। হাত দু’টো কাপছে অনবরত। তুলির সারা শরীর জুড়ে শীতলতা। কাঁপা কাঁপা হাতে তুলিকে বুকে আগলে রেখে বিদ্রুপের স্বরে বলে উঠল,
” আমি এতোগুলো বছর অপেক্ষা করলাম কিন্তু তুমি আমার জন্য আরেকটু সময় অপেক্ষা করতে পারলে না তুলা? ধোকা দিলে আবারও? কিন্তু আমি যে বেহায়া ছুটে যাব তোমার কাছে। আমাদের কি সৌভাগ্য দেখেছো তুলা? সংসার করা হয় নি কিন্তু তুমি আমার বুকে নিজের মাথা রেখে চিরতরে ঘুমিয়ে গেলে। তোমায় বুকে আগলে রেখে ঘুমিয়ে যাব আমিও এখন। এই তো আরেকটু তুলা। আরেকটু,,,!”
রক্ত বর্ণ ধারণ করা দু-চোখ আবেশে বুঁজে এল আদ্রর। ঠোঁট গিয়ে ঠেকল তুলির চুলের ভাজে। হৃদপিণ্ডের ব্যাথায় ছটফট করতে লাগল ভিতরটা। থমকে গেল নিঃশ্বাস!

( আসসালামু আলাইকুম প্রিয় পাঠক /পাঠিকা। আমি জানি আজ আপনারা খুব বেশি রেগে যাবেন আমার উপর। আপনারা খুব বেশি ভালোবাসা দিয়েছেন আদ্র ও তুলিকে। আপনাদের প্রতি অনেক অনেক ভালোবাসা রইল। অনুরোধ করব রেগে থাকবেন না আমার উপর। অনেক অপেক্ষা করিয়েছি আপনাদের আর অপেক্ষা করাব না। খুব মিস করব আপনাদের কে। কেউ কাউকে অধিক ভালোবাসলে মায়ায় জড়িয়ে গেলে কখনও কখনও সত্যিই অপরজনের টানে টানে হারিয়ে যায় সে নিজেও। পরিশেষে এটাই বলব গল্পে শুরু থেকে শেষ অব্দি কোনো ভুল ত্রুটি থাকলে এবং আমি কোনো খারাপ আচরণ করে থাকলে ক্ষমা করে দিবেন। ভালো থাকবেন সবাই। আল্লাহ হাফেজ। )

(লেখাঃআসরিফা সুলতানা জেবা ) এই লেখিকার আরও লেখা গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন এবং এই গল্পের সিজন ২ পড়তে চাইলেও এখানে ক্লিক করুন

4 COMMENTS

  1. ato kno kosto hoi golpo gula porle…. janen seser part gula porer somoy coker pani sob bada upekka korecelo ….. koto odbut dunia ….. ??????

  2. Apo janen apnar golpota pore ami khob khob kosto peyechi, khob kanna korechi??.R akta kotha amar akta fgriend er na o jeba ?.tobe golpo ta khob sondor hoyeche tobe khob kostokor chilo. Golpo ta pore ami 2 minit kanna korechi??,balo thakbe r beshi beshi golpo diben amar jonno

Comments are closed.