আকাশে তারার মেলা পর্ব ২১+২২

আকাশে তারার মেলা পর্ব ২১+২২
আসরিফা সুলতানা জেবা

ব্যাগপ্যাক নিয়ে পরিপাটি হয়ে তুলি দ্রুত বেগে নিচে আসল।আহান ও ঝুমু মাত্র সবার থেকে বিদায় নিয়ে বের হচ্ছিল তখনই তুলি হাপাতে হাপাতে পিছু ডাকল। থমকে গেল আহান ও ঝুমু। তুলির হাতে ব্যাগ দেখে প্রচন্ড অবাক হল সবাই। সায়েরা বেগম কাছে এসে বিস্মিত গলায় বললেন,,

–” তুই কোথায় যাচ্ছিস তুলি?”
–” আম্মু আমি কুমিল্লা যাব আহান ভাইয়ার সাথে।”–এক নিশ্বাসে কথাটা বলে থামল তুলি।
তুলির জবাব শুনে স্থবির হয়ে গেলে সায়েরা বেগম। বাকি সবাই ও ব্যাপক বিস্মিত। আমরিন এগিয়ে এসে বলল,,
–” পাগল হয়েছিস তুলো? দু’দিন বাদেই তোর বিয়ে। পরশু দিন গায়ে হলুদ। তুই এখন কুমিল্লা যাবি?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–” বিয়ে বলেই তো যেতে চাচ্ছি। বিয়ের আগে একবার নিজের জন্মস্থানে যেতে চাই। ওনি তো যেতে দিত না। এখন যখন সুযোগ পেয়েছি মিস করতে চাই না। আজ আর কালকের তো ব্যাপার। পরশু ঠিক সকালে আহান ভাইয়া, মামা-মামী, খালা মণির সাথে চলে আসব।”
–” তোর মাথা টা খারাপ হয়ে গেছে। জ্বরের ঘোরে আবল তাবল বকছিস। ভাইয়া কে কিন্তু আমি বলি নি তোর জ্বর এসেছে। ওনি সকাল সকাল ইমারজেন্সি থাকায় বের হয়ে গেছেন। একবারও যদি জানতে পারেন তোর জ্বর হয়েছে কোথাও যাওয়া তো দূরের কথা ঘর বন্দি করে রাখবে। ওয়েট আমি এখনই বলছি।”

আমরিন ফোন টা বের করতেই তুলি খপ করে ছিনিয়ে নিল। করুন স্বরে সবার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল-
–” আব্বু- আম্মু আমাকে যেতে দাও প্লিজ। আমার খুব ইচ্ছে করছে একবার বাড়িতে যেতে। আমায় যেতে দাও প্লিজ। আমার জ্বর সামাল দেওয়ার অভ্যেস আছে। আমি একদম ঠিক আছি। গায়ে হলুদের দিন সকালে আমি চলে আসব।”

সায়েরা বেগম এগিয়ে এসে কপালে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বর কিছুটা কমেছে। সকালের দিকেই জ্বর এসেছে। আদ্র শুনলে সব ফেলে ছুটে চলে আসবে, অস্থির হয়ে পড়বে তাই সায়েরা বেগম আর জানান নি। নিবিড় কিছু মেডিসিন দিয়েছে আর ওনি যতটুকু পেরেছেন সেবা করেছেন তুলির। এক ঘন্টা আগেও যেই মেয়েটা বিছানা থেকে উঠতে পারছিল না এখন কুমিল্লা যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। নিজের জন্মস্থানের প্রতি সবারই আলাদা টান থাকে তুলির ক্ষেত্রে ও তেমনটাই। মেয়েটার করুন চাহনি উপেক্ষা করতে পারলেন না তিনি। আবার ছেলের জন্য ও চিন্তা হচ্ছে। বাড়িতে এসে তান্ডব চালাবে তুলি কে দেখতে না পেলে। তবুও তিনি তুলির আবদার ফেলতে পারলেন না। গালে হাত রেখে বললেন,,

–” সাবধানে যাস। আদ্র আসলে কি করবে আমি জানিনা। এখন তো তুই যাচ্ছিস কিন্তু আদ্র আসার পর যা হবে তার জন্য কিন্তু আমি দায়ী হব না বলে দিলাম।”
তুলি তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। সায়েরা বেগম কে শক্ত করে জরিয়ে ধরে বলে উঠল-
–” অসংখ্য ধন্যবাদ আম্মু। আমি কিন্তু আবার ফিরে আসব তোমাদের মাঝে। আর এবার একদম পার্মানেন্ট হয়ে যাব তোমাদের পরিবারে। সারাজীবন তোমাদের সাথেই কাটাব।”
–” তুই আমাদের পরিবারেরই একজন মা। এখন শুধু সুস্থ ভাবে ফিরে আসিস। তোর আম্মু তোর অপেক্ষায় থাকবে। ”
–” আচ্ছা আম্মু। ”

আমরিন, ইনশিতা, রাদিফ সাহেব সবাই কে বিদায় জানিয়ে তুলি গাড়িতে উঠে বসল। তখনই হাতের মোবাইল টা মৃদু শব্দ করে উঠল। স্ক্রিনে চাইতেই চক্ষুদ্বয়ে ভেসে উঠল আদ্রর মেসেজ। তুলির মলিন চেহারায় এক ফোঁটা হাসির ঝলকের দেখা মিলল। উপর থেকে মেয়েটা নিজেকে যত স্ট্রং দেখায় ভিতর থেকে তার চেয়েও অধিক নরম। এই যে জ্বরে তার ভিতর টা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে তবুও উপর থেকে নিজেকে বেশ স্ট্রং জাহির করেছে সে। মেসেজ টা ওপেন করে মনের কুঠিরে বাক্যগুলো তটস্থ করে নিল তুলি।

~❝আমি আজ অবিশ্রান্ত। আমার তুলার শ্যামারঙা মুখটা দেখার জন্য বড্ড তৃষ্ণার্ত আমি। ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে যায়। আলিঙ্গন করে নেই নিজের দুই বাহুতে। ডাক্তার হয়ে খুব বড় ভুল করে ফেলেছি। সবার হার্টের সেবা করতে গিয়ে নিজের হৃদপিণ্ডটা কে পুড়াচ্ছি।❞
মেসেজ টা পড়ে তুলি দু চোখ বুঁজে সিটে মাথা এলিয়ে দিল। বাক্য গুলো তুলির হৃদয় জুড়ে অনাবিল শান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে। অনুভূতি গুলো গভীর হতে গভীরতম হচ্ছে। গলাটাও প্রচন্ড পিপাসিত হয়ে উঠল। মনে পড়ে গেল জন্মদিনের সেই রাতের কথা। সেদিন হয়তো একটু বেশিই আবেগী হয়ে উঠেছিল। নিজেকে তলিয়ে দিয়েছিল আদ্রর নেশাময় চাহনিতে।

★সেদিন,,,
আদ্রর কথার মানে ঠাওর করতে না পারলেও তুলি অনুভবের অন্তরালে হারিয়ে যেতে লাগল। মন বলে উঠল- ” বিয়েটা আজই কেন হল না? আজ হলে তো আজই এই শান্তির ছায়ায় ঘেরা বাড়িটা তে ছোট্ট একটা সংসার গড়ে ফেলতে পারতাম। সবাই কে দেখিয়ে বলতে পারতাম এটা আমার ডাক্তার সাহেবের বানানো শুধু একটা বাড়ি নয়। এটা তো আমাদের ভালোবাসার চাদরে মোড়ানো ছোট্ট একটা ভালেবাসাময় সংসার।”
ঘাড়ে কোমল ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই ভাবনার অন্তর থেকে বেরিয়ে এল তুলি। দু চোখের পাতা এক করে পেটে বিচরণ করা আদ্রর হাত টা খামচে ধরল। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া কন্ঠে অস্ফুটস্বরে ডেকে উঠল,,

–“ডাক্তার সাহেব!!”
–“হু।”
–” আপনি আমার হৃদয়ের সুবাসিত ফুল। যেই ফুলের সুবাসে আমার মন অবাধ্য হয়ে পড়ে প্রতিবার। প্রাণ পণে ছুটে যায় সুবাসিত সেই ফুল কে একবার শুধু একটি বার অনুভবে ছোঁয়ার আশায়।”

প্রেমময় বাক্যগুলো নিজের অজান্তেই গড়গড় করে বলে বসল তুলি। রোবটের মতো দাড়িয়ে আছে আদ্র। তুলির পেটে রাখা হাত দুটোও ঢিল হয়ে এসেছে। অনুভূতি গুলো নিমিষেই যেন থমকে গেল। আদ্রর কোনো রেসপন্স না পেয়ে তুলি লজ্জায় চুপসে গেল। এতোক্ষণে বুঝতে পারল অতিরিক্ত আবেগে আর ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ায় কেমন কথা বলে বসেছে। ধীরে ধীরে আদ্রর দিকে ঘুরে তাকাতেই চাঁদের আলোয় চোখে পড়ল আদ্রর ঠোটের কোণে ফুটে থাকা মুগ্ধময় হাসিটা। একদম স্থির অথচ অধরে হাসি। ঢুক গিলল তুলি।

এই হাসি তুলির অনলে পুড়ানো হৃদয় কে ও শান্তি দিতে সক্ষম। মাঝে মাঝে তুলির মনে হয় তুলি যদি জীবনে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে ও থাকে তখন আদ্রর মুখের হাসি টা যেন তাকে এক রাশ প্রশান্তি এনে দিবে। মুহুর্তের মধ্যে গুড়িয়ে দিবে, নিঃশেষ করে দিবে সবটুকু কষ্ট। আদ্রর জ্যাকেটে খামচে ধরে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুলি।কোনো হেলদোল নেই আদ্রর। এবার বেশ সংশয়ে ভুগছে তুলি। কথাটা কেমন প্রভাব বিস্তার করেছে আদ্রর মনে সঠিক বুঝতে পারছে না সে। জ্যাকেট থেকে দু হাত কিছু টা ঢিল করতেই চেপে ধরল আদ্র। তুলির গালে ভালোবাসার আলতো ছোঁয়া একে দিল অতি সন্তর্পণে। অতিশয় মোলায়েম কন্ঠে বলল,,

–” আমি যদি তোমার জীবনের সুবাসিত ফুল হয় তবে তুমি তো আমার পরিচর্যাকারী। যার পরিচর্যা বিহীন মুর্ছে যাব আমি। নিঃশেষ হয়ে ঝরে যাবে আমার অস্তিত্ব। ”
শ্রুতিমধুর কথাগুলো কর্ণকুহর হতেই তুলি দ্রুত বেগে মাথা গুঁজে দিল আদ্রর বুকে। ধরা গলায় বলে উঠল-
–” আমার সবটুকু দিয়ে আগলে রাখব আপনাকে। কখনও ঝরে পড়তে দিব না। কখনও কেউ আপনার কাছ থেকে আমাকে সরাতে পারবে না।”
–” তুমি চাইলেও আমি সরতে দিব না। খুন করে ফেলব একদম। বহুবছর বাঁচার ইচ্ছে আমার তোমার সাথে। ”
নিস্তব্ধ অনুভূতি নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে রইল তুলি। খুন হতেও রাজি সে আদ্রর হাতে। কারণ আদ্র কে ছাড়া যে সে নিজেই বিলীন হয়ে যাবে। চোখ বুঁজে আদ্রর হৃদস্পন্দন অনুভবে মত্ত হয়ে পড়ল। আচমকা হাতে টান পড়তেই নড়ে উঠল তুলি। চোখ মেলে তাকাতেই দেখল ঝুমুর ঠোঁট নাড়ানো। কিছু হয়ত বলছে কিন্তু ভাবনায় এতোটাই বিভোর ছিল তুলি কিছুই শুনে নি। গাড়িও কখন থেমেছে সেই খেয়াল ও নেই। ভালো করে উঠে বসতেই ঝুমু বলে উঠল-

–” ঠিক আছো তুলি?”
–” ঠিক আছি ভাবী। কিছু বলছিলে?”
–” হুম। তোমার ভাইয়া বলছিল কিছু খাবে কিনা?”
–” পানি! পানি খাব ভাবী।”
–” আচ্ছা পানি নিয়ে আসতে বলেছি আমি। আর কিছু খাবে না?আহান বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।”
–” আর কিছু লাগবে না ভাবী।”
আর কিছু না বলে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইল তুলি। আদ্র কে সামান্য সময়ের ব্যবধানেই খুব মিস করছে মেয়েটা। ইচ্ছে করছে ফিরে যেতে। আবার ইচ্ছে করছে একটা দিন কুমিল্লায় কাটাতে। বিড়বিড় করে বলল–” আমি আপনার টানে আবারও ফিরে আসব আদ্র। আবারও ফিরে আসব আপনার ভালোবাসা পাওয়ার লোভে।”

রোগী দেখা শেষ করে তড়িঘড়ি করে মোবাইল টা পকেটে ঢুকিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এল আদ্র। মেজাজ তুঙ্গে উঠে আছে তার। বুকের বা পাশ টায় আজ মৃদু ব্যাথা করছে। মনটা কেমন শূন্য শূন্য হয়ে আছে। তার বিশেষ কারণ হল সকাল থেকে তুলি কে দেখতে না পারা টা। মেয়েটার বাচ্চা বাচ্চা কন্ঠস্বর টাও আজ শুনে নি সে। ভীষণ বিরক্তি লাগছে তার নিজের পেশার উপর। সকালেই বেরিয়ে এসেছে। ওটি শেষ করে রোগী দেখা কম্পলিট করে মাত্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অজস্র ক্লান্তি ভর করে রেখেছে। আদ্রর এই ক্লান্তি গুলো তুলি কে এক নজর দেখলেই যেন সেড়ে যাবে। গাড়িতে উঠতে নিলেই কোথা থেকে সামিরা দৌড়ে এসে উপস্থিত হল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল আদ্র। সামিরা হালকা হেসে বলল,,

–” কেমন আছো আদ্র?”
–” এখন এসব বলার সময় নেই আমার হাতে।”
সোজাসাপ্টা জবাব দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল আদ্র। সাথে সাথেই সামিরা পাশের সিটে উঠে বসল। প্রচন্ড অবাক হল আদ্র। রক্তিম হয়ে আসল দু চোখ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
–” এগুলো কেমন ফাজলামি? তুই আমার গাড়িতে কেন উঠেছিস?”
–” আসলে তোমাদের বাসায় যাব ভাবী কে দেখতে। হসপিটালে এক ফ্রেন্ডের সাথে এসেছিলাম। তোমাকে দেখে ভাবলাম তোমার সাথেই চলে যায়।”

চোখ বুঁজে রাগ টাকে কিছুটা দমিয়ে নিল আদ্র। কোনো কথা না বলে গাড়ি স্টার্ট দিল। সামিরা ও কিছু না বলে সারা রাস্তা চুপ করে থাকল। গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে বাড়িতে ঢুকে গেল আদ্র। দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে তুলির রুমের সামনে আসল। সায়েরা বেগম ভীত মন নিয়ে পিছু পিছু আসলেন। রুমে ঢুকে চারদিকে চোখ বুলিয়ে তুলি কে কোথাও পেল না আদ্র। বেলকনিতে ও নেই। ওয়াশরুমের দরজা ও বাইরে থেকে লাগানো। তার মানে তুলি ওয়াশরুমে ও নেই। তরতর করে তুলি কে দেখার তৃষ্ণা বেড়ে গেল আদ্রর। বুকের যন্ত্রণা টাও প্রখর হতে লাগল। সায়েরা বেগমের দিকে ঘুরে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই চোখ গেল দেয়ালে টেপ দিয়ে আটকে রাখা সাদা চিরকুটের দিকে যাতে তুলির স্পষ্ট সুন্দর হাতের লেখা।

~”প্রথমেই আমি দুঃখিত ডাক্তার সাহেব। আপনি তো যেতে দিতেন না তাই না বলেই চলে গেলাম। আজ নিয়ে মাত্র দুটো দিন থাকব।”
চেপে রাখা রাগ তীব্র আকার ধারণ করল আদ্রর। চিরকুট টা হাতে নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিল। সায়েরা বেগমের দিকে না তাকিয়েই চলে গেল নিজের রুমে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসে নিজের দু হাত দিয়ে মাথার চুল মুষ্টিবদ্ধ করে নিল। যার কাছে ছুটে এল চোখের তৃষ্ণা মেটাতে সেই গায়েব। হাতের কাছের ফ্লাওয়ার বাজ টা খুব জোরে দেয়াল বরাবর মেরে দিল যা প্রচন্ড আওয়াজ তুলে খন্ড খন্ড হয়ে পড়ে রইল ফ্লোরে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে তুলি কে কল দিতেই ফোন বন্ধ পেল। চরচর করে রাগ চেপে বসল মাথায়। নিজেকে এলোমেলো লাগছে আদ্রর। ক্লান্তি, রাগ সব মিলিয়ে বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেছে মনটা।

দক্ষিণা হাওয়ার তালে তালে তুলির চুল গুলো অবাধে উড়ছে। ছাদের কার্ণিশ ঘেষে দাড়িয়ে আছে অনেক্ষণ যাবত। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। প্রখর রোদ্দুরের তাপের অস্তিত্ব ও বিলীন হয়ে গেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে কল্পনায় আঁকছে আদ্রর হাসোজ্জল চেহারা টা কে। মনে পড়ে যাচ্ছে আদ্রর প্রথম দিনের বলা সেই কথাটা। আজকাল তার কাছে তুলি নামের চেয়ে তুলা নামটাই বিশেষ পছন্দ। মাত্র কয়েক ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু এখনই তুলির দম বন্ধ হয়ে আসছে আদ্র কে ছাড়া। নিজেকে শূন্য শূন্য লাগছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি নিঃশ্বাস টুকু সঙ্গ ছেড়ে দিবে। কোনোমতে রাত টা পার করে ফিরে যাবে তুলি। মোবাইল টা চার্জ না থাকায় বন্ধ ছিল। অন করে আদ্রর নাম্বারে কল দিতেই ফোন বন্ধ পেল। ফের কল দিতেই আবারও বন্ধ পেল।

আদ্র রাগ করে নি তো? আমি বোধ হয় ভুল করে ফেলেছি। কেন যে টানে টানে চলে এলাম? আর যাদের জন্য আসলাম তারা ফিরেও তাকাল না। কথাগুলো ভেবেই হতাশার দীর্ঘ একটা শ্বাস বের হয়ে আসল বুক চিরে। এসেই মামার বাড়িতে গিয়েছিল তুলি। মামা হাসিমুখে কথা বললেও দূর দূর করে দিয়েছেন মামী। আহানের কাছ থেকে জানতে পারল এতোদিন সব খরচ সবকিছুর দায়িত্ব আদ্র বহন করেছে। তুলির মামা এক টাকাও খরচ করেন নি তুলি কে ঢাকা পাঠানোর পর। নিজের পাওনা থাকা সত্ত্বেও তুলি কিছু বলতে পারে নি। বলবেই বা কিভাবে? এই মানুষ গুলোও তো তার আপনজন। এক টাকাও চায় না তুলির। তার জীবনের সব চাওয়া তো আদ্র কে ঘিরেই। কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে গড়িয়ে পড়া জল টুকু মুছে নিল তুলি। পিছন ফিরে ঝুমু কে দেখতে পেয়েই বলে উঠল-

–” আমি তো সেই কখন থেকেই রেডি হয়ে ছাদে দাড়িয়ে বাতাস খাচ্ছিলাম। এতোক্ষণ লাগল তোমার?”
তুলির কথায় মৃদু হাসল ঝুমু। গালে হাত রেখে বলল,,
–” চলো।”

রাত এগারোটা বাজে। আহানের রুমে ঝুমু ও খালা মণির সাথে আড্ডা দিতে ভীষণ ব্যস্ত ছিল তুলি। আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু ছিল আদ্র ও তার পরিবার। সবার সম্পর্কে নতুন করে বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠেছে। ওনারা চিনলেও আদ্রর পরিবারকে নতুন করে উপস্থাপন করল। আদ্রর কথা বলতে গিয়ে মনে ভীষণ ভালো লাগা, লজ্জা দুটোই করছিল। যার প্রভাব এখনও বর্তমান। বুকটাও হাহাকার করছে। এই নিশি রাতেই ছুটে যেতে মন চাইছে আদ্রর কাছে। কাল সকালেই বেরিয়ে পড়বে ঢাকার উদ্দেশ্যে।

চাপানো দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করতেই অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে গেল তুলি। হাতড়ে হাতড়ে লাইট অন করতেই নিলে কেউ প্রচন্ড জোরে চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। ধুক করে উঠল তুলির বুকটা। ভয়ে চিল্লাতে নিলে মুখে চেপে ধরল অজ্ঞাত ব্যাক্তি। হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রম তুলির। বুকের ধরফরানি বেড়ে গেল বহুগুণ। নিজেকে ছাড়ানোর প্রাণ পণ চেষ্টা করতেই তীব্র ধাক্কা অনুভব করল। তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ল বিছানায়। বাতাসে জানালার পর্দা এলোমেলো হতেই রুমে এসে চাঁদের মৃদু আলো প্রবেশ করল। পিলে চমকে উঠল তুলির।

❝কেউ তোর জন্য পাগল হয়ে যাবে সেটা দেখে তুই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবি তাই না? কারো গলায় ফাঁস লাগিয়ে তুই মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়াবি? তোর ডানা আজ ছাটাই করেই ছাড়ব।❞
কথাগুলো বলেই সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তি টা তুলির উপর ঝুঁকে পড়ল। ভয়ে কাচুমাচু করে মুখ ঘুরিয়ে নিল তুলি। নিজের উপর ভারী কিছু অনুভব না করতে পেরে আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে দেখল আদ্র এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে। আদ্র কে নিজের খুব নিকটে আবিষ্কার করলেও দু’জনের মাঝে দূরত্ব রয়েছে কিছুটা।

আদ্র বিছানায় তুলির দু পাশে হাত রেখে অগ্নি চোখে তাকিয়ে। ফর্সা চেহারা টায় লাল আভা স্পষ্ট যা চাঁদের মৃদু আলোয় দিব্যি চক্ষুগোচর হচ্ছে তুলির। তুলি স্বপ্নেও ভাবে নি আদ্র চলে আসবে এখানে। আসল তো আসল তাও এভাবে ভয়ার্ত রূপ ধারণ করে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল তুলির। বুকের দরফরানি বাড়তে লাগল ক্রমাগত। অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দনের শব্দ হয়তো আদ্রর কর্ণপাত হচ্ছে অনাসয়ে। আদ্র কাছে এসেছে কিন্তু কখনও এমন করে তো কাছে আসে নি। তুলির মনে হচ্ছে এই বুঝি আদ্র নিজের সবটুকু ভার ছেড়ে দিবে তার উপর আর হৃৎস্পন্দন ও থেমে যাবে সাথে সাথেই। অগোছালো অনুভূতি, হৃদয়ের অনবরত কম্পন মিলিয়ে বেসামাল হয়ে পড়ছে তুলি।

আদ্রর রক্তিম বর্ণ ধারণ করা নীলাভ দু চোখ স্থির তুলির ভয়ার্ত চেহারায়। হয়তো তৃষ্ণার্ত দু চোখ তাদের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত। মাথায় চেপে থাকা রাগ টাও পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। কেন তুলি না বলে চলে এল? কেন সারাটা দিন ধরে তার স্নিগ্ধ চেহারা টা দেখা থেকে বঞ্চিত করল? কেন বুকের বা পাশ টায় ব্যাথার সৃষ্ট করল? কোনোভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না আদ্র। তুলির আরেকটু কাছে যেতেই আঁতকে উঠল তুলি। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল-

–” কককি করছেন আদ্র? ”
–” তুই এতো সাহস কোথায় পেয়েছিস তুলা? ভালোবাসা পেয়ে আমার হাতের থাপ্পড়ের কথা ভুলে গেলি? কি বলেছিলাম তোকে? বলি নি তুই একটুও দূরে যেতে চাইলে আমি একদম খুন করে ফেলব?”
আদ্রর অগ্নি ঝরা চোখের দিকে তাকিয়ে তুলি আমতা আমতা করে বলল,
–” আমার মনটা আসার জন্য ছটফট করছিল আদ্র। আপনি না করতেন তাই না বলে চলে এসেছি। আমি কাল সকালেই আবার ব্যাক করতাম।”

মেজাজ আরো গরম হয়ে এল আদ্রর। তুলির উপর থেকে উঠে বসে একটানে তুলি কে নিজের বুকে এনে ফেলল। নাকে হালকা ব্যাথা পেয়ে আহ্ করে উঠল তুলি। আদ্রর জ্যাকেটে খামচে ধরল নিজেকে সামলানোর জন্য। সাথে সাথেই জ্যাকেট থেকে হাত দুটো টেনে ছুটিয়ে নিল আদ্র। দুই বাহুতে শক্ত করে চেপে ধরে রাগী কন্ঠে বলে উঠল-
–” আমি মরে গেলে তুই ব্যাক করতি? তোর মন আমার জন্য ছটফট করে নি? কয়েক ঘন্টায় পাগল বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছিস। তোকে ছাড়া শ্বাস নেওয়া টা ও দায় হয়ে পড়ছিল। নিজেকে বাঁচানোর জন্য, হৃদপিণ্ডের একটু ব্যাথা কমানোর জন্য ছুটে এসেছি তোর কাছে। আমার বুকের বা পাশ টায় হাত রেখে দেখ কতটা যন্ত্রণা হচ্ছিল আমার। আমার স্পন্দন গুলো কেমন দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। ”

তুলির হাত টা টেনে বুকের বা পাশে রাখল আদ্র। নিমিষেই ধুক করে উঠল তুলির বুকটা। আবেশে বুঁজে এল দু চোখ। চোখের পাপড়িগুলো ভিজে গেল পানিতে। একটা ম্যাচুরিটি সম্পন্ন মানুষ এতটা ডেস্পারেট হতে পারে? কাউকে এক পলক দেখার জন্য, চোখের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এভাবে ছুটে আসতে পারে? ভালোবাসায় এতটা ধৈর্য হারা হতে পারে? ছেলে টা কি সত্যিই তুলির ডাক্তার সাহেব? কোথায় গেল আজ তার ডাক্তার সাহেবের ধৈর্য্য শক্তি? এই মুহুর্তে তুলির মনে পড়ছে সেদিনের কথাটা যেই রাতে সিলেট থেকে ফিরে এসেছিল ওরা। আদ্র বুকে জরিয়ে নিয়ে বলেছিল পৃথিবীর যেই প্রান্তেই থাকুক না কেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জন্য হলেও ছুটে আসবে তার কাছে। সত্যিই এসেছে। তুলির বুক জুড়ে অসহনীয় পীড়া অনুভব করতে লাগল। মাথা গুঁজে নিশ্চুপ হয়ে রইল আদ্রর বুকে। আদ্রর বুকে হাত টা এখনও স্থির। তুলির শরীরের গরম উত্তাপ পেতেই আদ্র স্তম্ভিত হয়ে গেল। হৃদয়ের ব্যাথা টা পলকেই বেড়ে গেল। সেই সাথে বুক টা হাহাকার করে উঠল। তুলি কে বুক থেকে উঠিয়ে অস্থিরতা নিয়ে বলল,,

–” জ্বর কখন এসেছে? তোমার তো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। এই তুলা? জ্বর কখন এসেছে?”
নিশ্চুপ তুলি। আদ্রর অস্থিরতা দেখে তার বুকটা বেগতিক ধুকপুক করছে। কি জবাব দিবে বুঝতে পারছে না। সকাল থেকে জ্বর জানলে আদ্র তো মেরেই ফেলবে। হয়তো নিজে কষ্টে জর্জরিত হয়ে পড়বে। তুলি কে নিশ্চুপ দেখে আদ্র হাত টা ধরে রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠল-
–” এই মেয়ে কথা বলছিস না কেন? তোর শরীরের উত্তাপ আমার মনটা কে পুড়িয়ে দিচ্ছে। চুপ থেকে আমায় আর কষ্ট দিস না তুলি।”
টলটল চোখ আদ্রর মলিন চেহারায় নিবদ্ধ করল তুলি। সামান্য জ্বরে আদ্রর এতো কষ্ট হচ্ছে। এতোটা পাগলামি করছে। যদি! না আর ভাবতে পারছে না। যেভাবেই হোক আদ্র কে শান্ত করতে হবে। আদ্রর এক হাত নিজের দু হাতে পুরে নিল তুলি। ধরা গলায় বলল,,

–” আপনি অস্থির হবেন না ডাক্তার সাহেব। সামান্য একটু জ্বর সকাল থেকে। আমি ঠিক আছি।”
–” ডাক্তার তুই নাকি আমি? আর সকাল থেকে জ্বর। তারপরও তুই অসুস্থ শরীর নিয়ে চলে এলি? এতো শখ তোর এখানে থাকার? ঠিক আছে থাক। কখনও আর তুই ঢাকা যাবি না। আমাকে ছেড়ে থাকতে চেয়েছিস তো থাক এখানে।”

কঠোর স্বরে কথাগুলো বলে তুলি কে ছাড়িয়ে উঠে পড়ল আদ্র।ভীষণ রাগ হচ্ছে তার তুলির উপর।ভিতর টা পুড়ে যাচ্ছে মেয়েটার জন্য। পা বাড়িয়ে চলে গেল রুম থেকে। তুলি হতবিহ্বল হয়ে বসে রইল বিছানায়। নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ছে জল। সত্যি সত্যি আদ্র তাকে ফেলে চলে গেল? আর কি নিবে না? কষ্ট হচ্ছে তার খুব। কেন আসতে গেল এখানে।

আদ্র ভীষণ কষ্ট পেয়েছে তা ঠিক বুঝতে পারছে। দুর্বল শরীর নিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল। জ্বর টা হুট করেই বেড়ে গেছে। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল হাত টাও খানিকটা ফুলে গেছে ও ব্যাথা করছে। এক কদম বাড়াতেই মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলে আঁকড়ে ধরল কেউ। ঝাপসা চোখে চাইতেই আদ্রর চেহারা টা ভেসে উঠল। তুলির ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল সূক্ষ্ম হাসি। আদ্র তাড়াতাড়ি করে তুলি কে কোলে নিয়ে পা বাড়াল রুমের বাহিরে। আহান দাঁড়িয়ে রুমের সামনে। আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,,

–” তুলির কি হয়েছে ভাই?”
–” আমি তুলি কে নিয়ে যাচ্ছি আহান। খালা মণি কে জানিয়ে দিস।”
–” এতো রাতে? আজ থেকে যাও।”
–“না। এমনিতেই অনেক দেরি করে ফেলেছি। আজকেই চলে যাব।”
আদ্রর মুখের উপর আর কোনো কথা বলার সাহস পেল না আহান। পিছু পিছু এল গাড়ি পর্যন্ত। তুলি সব শুনলেও চুপ করে আছে আদ্রর বুকে মাথা রেখে। এখন তুলি কিছু বললেই রাগ টা আরো বেড়ে যাবে আদ্রর তাই সে চুপচাপ। গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে আদ্র ও উঠে পড়ল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে নিজের এক হাত দিয়ে তুলি কে কাছে এনে বাহুতে আবদ্ধ করল। তুলি মলিন কন্ঠে বলে উঠল-

–” এভাবে আপনার কষ্ট হবে তো আদ্র। ”
–” তুই যেই কষ্ট দিয়েছিস তার কাছে এই কষ্ট টা খুবই নিছক। ”
কেঁপে উঠল তুলির মনটা। একটা বার আদ্র কে বলে আসা উচিত ছিল তার। কিছু একটা মনে পড়তেই বিষন্ন মনে বলে উঠল-
–” আপনি খেয়েছেন আদ্র?”
–” সারাদিন পানি ছাড়া আর কিছুই না।”

নিজেকে নিজেরই খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে তুলির। নিজের প্রতি রাগ চেপে রাখতে না পেরে আদ্রের বুকে মাথা রেখে নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগল। এতো ভালোবাসা তুলি আগলে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। নিজের সবটুকু দিয়ে আদ্র কে ভালোবেসে ও নিজের অজান্তে কষ্ট দিয়ে ফেলছে। কেন এতো ভালোবাসার মাঝেও কষ্টগুলো চলে আসে? অপ্রত্যাশিত তুলির কাছে এতটা প্রণয়। আদ্রর বুকে মুখ গুঁজে রইল তুলি। বাহির থেকে বাতাস এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে দু’জন কে। নিকষ কালো আঁধারে গাড়ি ছুটে চলেছে ঢাকার উদ্দেশ্যে।

সূর্যের কিরণ জানালার পর্দা বেদ করে রুমে এসে পড়তে লাগল। শরীর ঘেমে একাকার তুলির। সূর্যের আলো রুমে আসতেই তুলি প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে চোখ মেলে চাইল। সায়েরা বেগম কে মাথার কাছে বসে থাকতে দেখে খুব অবাক হল। রাতে তো গাড়িতে আদ্রর বুকে ঘুমিয়ে পড়েছিল।তারপর আর কিছুই খেয়াল নেই তার। তুলি কে চোখ মেলতে দেখে সায়েরা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
–” উঠে পড়েছিস? তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে। জ্বরের ঘোরে কিনা কি খেয়েছিস রাতে। এখন ভালো করে খেয়ে আরো সুস্থ হতে হবে। কাল থেকেই তো তোদের বিয়ের অনুষ্ঠান। ”
তুলি নিষ্পলক চোখে চেয়ে থেকে বলল,,

–” তোমার ছেলে কোথায় আম্মু?”
সায়েরা বেগম উত্তপ্ত একটা শ্বাস ছেড়ে আঙুল দিয়ে ইশারা করলেন সোফার দিকে। আঙুল বরাবর চোখ যেতেই তুলি অসহায় চোখে তাকাল। আদ্র ঘুমিয়ে আছে সোফায় মাথা হেলিয়ে। সায়েরা বেগম হতাশ কন্ঠে বলে উঠলেন—

–” ঠিক এজন্যই তোকে যেতে দিতে চাইছিলাম না। কাল এসে তোকে না পেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছিল। রুমের অর্ধেক জিনিস ভেঙে ফেলেছে। আমার ছেলেটা তো এমন ছিল না রে তুলি। এতো ধৈর্যশীল ছেলেটা তোর বেলায় কেমন অধৈর্য্য হয়ে পড়ে। তোর প্রতি দিনকে দিন ওর দুর্বলতা বেড়েই চলেছে। ভোর রাতের দিকে যখন তোকে নিয়ে ফিরেছে ওর চোখে মুখে ভয় দেখে অন্তর টা কেঁপে উঠেছিল আমার। কিছুক্ষণ আগেও তোর পাশে ছিল। জ্বর সেড়ে যাওয়ায় আমাকে বসিয়ে সোফায় গিয়ে মাথা এলিয়ে দিল। ঘুমিয়েছে নাকি সজাগ ঠিক বুঝতে পারছি না। এতটুকু বুঝতে পারছি আমার ছেলেটা বাঁচবে না তোকে ছাড়া।ওকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনও ভাবিস না মা।”

তুলি স্তব্ধ হয়ে গেল। সায়েরা বেগম রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আদ্রর ভালোবাসা প্রতি মুহুর্তে চমকে দেয় তুলি কে। কপালের ঘাম টুকু মুছে ধীর পায়ে আদ্রর কাছে এসে দাঁড়াল তুলি। আদ্রর মুখে ক্লান্তির ছাপ। তুলির ইচ্ছে করছে সবটুকু ক্লান্তি কেঁড়ে নিতে। আদ্রর দিকে একটু নত হয়ে গালে একটা চুমু খেল তুলি। কোমরে চাপ অনুভূত করতেই সারা শরীর ঝিকে উঠল তুলির। তাল সামলাতে না পরে মুখ থুবড়ে পড়ল আদ্রর উপর। ঠোঁট দুটো ঠেকল আদ্রর গলায়। লজ্জায় শিউরে উঠল পুরো দেহ। গাল দুটো টমেটোর মতো লাল হয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে মুখ তুলতেই আদ্রর নেশাময় লাল চোখে চোখ আঁটকে গেল। ঘুম না হওয়ায় দু চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে।

–” তোমার ডাগরআঁখিদ্বয় আমার নীলাভ দু চোখে ডুবে গেলে আমিও তলিয়ে যাই তোমার মারাত্মক নেশায়।”
আদ্রর ঠোঁটে মৃদু হাসি। অদ্ভুত লজ্জাময় কথাটা শুনে তুলি মুখ ঘুরিয়ে হেসে দিল। তুলির কোমর আঁকড়ে ধরেই আদ্র তুলি কে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বিস্ময়কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তুলি। পাত্তা না দিয়ে আদ্র তুলি কে বিছানায় বসিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আসল। তুলি হতভম্বের মতো শুধু চেয়ে রইল। আদ্র পাশে শুয়ে টান দিয়ে বুকে নিতেই চোখ বড় বড় তাকাল তুলি। নিশ্বাস ভারী হয়ে আসল। হৃদপিণ্ডের উঠানামা হতে লাগল দ্রুত গতিতে। বহু কষ্টে বলে উঠল-

–“আম্মু চলে আসবে আদ্র।”
–” আসবে না। সারারাত একটুও ঘুমায় নি। এখন তোমাকে বুকে নিয়ে দুই ঘন্টা শান্তিতে ঘুমাতে চাই।”
–” সবাই কি ভাববে? আমাদের তো এখনও বিয়ে হয় নি। একা রুমে,,
–” হুঁশ! ঘুমাতে দাও। তোমার ডাক্তার সাহেব তোমার দিকে কেউ আঙ্গুল তোলার মতো কিছুই করবে না। আর বিয়ে সেটা তো!”
এতটুকু বলেই মুচকি হাসল আদ্র। তুলি চাতক পাখির মতো চেয়ে অসমাপ্ত কথাটা শুনার জন্য। কিন্তু আদ্র তাকে নিরাশ করে কপালে চুমু খেল। আগের কথাটা সমাপ্ত না করেই বলল,,
–” বউ আমার। কে কি বলল তা আমি কেয়ার করি না।”
ভ্রু কুঁচকে তাকাল তুলি। বউ আমার মানে! আদ্র গলায় মুখ গুঁজ তেই সন্দেহের অবকাশ থেকে বেরিয়ে এল। জমে বরফ হয়ে গেল। জমে যাওয়া কন্ঠে উচ্চারণ করল,,

–“আদ্র!”
–” ঘুমোতে দাও নাহলে তোমাকে থাপড়ে একটা দাঁত ও রাখব না।”
দমে গেল তুলি। ভীতু চোখে চেয়ে রইল আদ্রর দিকে।

“জীবনে কিছু পেরেছিস তুই? কখন থেকে বলছি ফুচকা খাবো। তাও খেতে দিচ্ছিস না তুই। ”
রাগে ফুঁশ ফুশ করতে করতে বলে উঠল পায়েল। অন্তু নিরীহ চোখে পায়েলের দিকে তাকিয়ে। বেচারা বেশ দোটানায় ভুগছে। একবার মনে হচ্ছে ফুচকা খেলে পায়েল অসুস্থ হয়ে যাবে আরেকবার মনে হচ্ছে পায়েলের চাওয়া টা পূর্ণ না করলে মনটা কষ্ট পাবে। শপিং মলে এসে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে নিজের রাগী বউ টা কে নিয়ে জানলে আসতই না অন্তু।

এখন তো আদ্র কে ইচ্ছে মতো বকতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু সে তো আরেক বাঘ। দেখা যাবে এক থাপ্পড় দিলেই বেচারা অন্তু শেষ। পায়েল জুয়েলারি দোকানে দাড়িয়ে রাগে গিজগিজ করছে। তুলি, আমরিন, রিমি,সাগর, সবাই কে নিয়ে শপিং করতে এসেছে আদ্র। বিয়ের শপিং কিছুদিন আগেই শেষ করেছে তবুও আজ বন্ধুমহল, বোনদের নিয়ে শপিং করতে এসেছে। পায়েল কে রাগতে দেখে সবাই এগিয়ে আসল। রিমি জিজ্ঞেস করল,

–” কি হয়েছে পায়েল?”
–” কি আর হবে অন্তু আমায় ফুচকা খেতে দিচ্ছে না।”
আদ্র চোখ ছোট ছোট করে তাকাল অন্তুুর দিকে। অন্তু হি হি করে বলল–” ফুচকা খেলে যদি বেবীর সমস্যা হয়? ফুচকা খাওয়া যাবে না।”
সবাই চরম অবাক হল। পায়েলের লজ্জায় ইচ্ছে করছে অন্তুর ঘাড় মটকাতে। এতো বেক্কল কেন অন্তুটা! সবাই যা বুঝার বুঝে গেল। আদ্র সবাই কে নিয়ে দ্রুত বাহিরে এসে ফুচকা স্টলের সামনে হাজির হল। পায়েল তো খুশিতে আত্মহারা। অন্তুর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল

আকাশে তারার মেলা পর্ব ১৯+২০

–” দেখলে আদ্র নিয়ে এসেছে তার মানে কোনো সমস্যা হবে না। বাসায় যাই তারপর মজা বুঝবা।”
অন্তু পায়েলের কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজেই ফুচকা খেতে লাগল। পায়েল মুখ বেকিয়ে ফুচকা খাওয়ায় মনোযোগ দিল। তুলি ওদের খুনসুটি দেখে হালকা হাসল। মনটা ভালো লাগায় ছেয়ে গেল। বাবা-মা হবে কয়েক মাস পর দু’জন অথচ এখনও পাল্লা দিয়ে ঝগড়া করে। উহু! এগুলো তুলির কাছে ঝগড়া নয় খুনসুটিময় ভালোবাসা মনে হয়। কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই চোখ ফিরিয়ে তাকাল তুলি। আদ্রর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি বহমান। তুলির কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীর স্বরে বলে উঠল-

–” আমার অংশ তোমার গর্ভে হলে পায়েলের মতো অভিমান করার সুযোগ দিব না। বরং দু’জন মিলে রাতের আঁধারে জমিয়ে ফুচকা খাব। খাবে তো তুলা?”
কান গরম হয়ে গেল তুলির। লজ্জালু হাসি ফুটে উঠল দু ঠোঁটে। আদ্রর হাত টা খামচে ধরে মাথা নেড়ে সায় দিল। আদ্র মুগ্ধ দৃষ্টিতে লজ্জা মাখা চেহারায় চোখ বুলিয়ে সবার অগোচরে তুলি কে একহাতে জরিয়ে নিল। নিচু স্বরে বলল
“আমি কিন্তু বেস্ট বাবা হব তুলা।”

আকাশে তারার মেলা পর্ব ২৩+২৪