আকাশে তারার মেলা পর্ব ২৫+২৬

আকাশে তারার মেলা পর্ব ২৫+২৬
আসরিফা সুলতানা জেবা

মাঝ রাতে ঢিলা একটা টি শার্ট পড়ে খালি পায়ে হুড়মুড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল আদ্র। ছেলে কে এভাবে বেড়িয়ে যেতে দেখে বুক টা কেঁপে উঠল রাদিফ সাহেবের। চোখে টলটল করতে লাগল জল। চশমা টা খুলে চোখের পানি মুছে মেয়ের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে ঘুম ছুটে গেল আমরিনের। কিছুক্ষণ আগেই চোখ লেগেছিল। আজকাল এ বাড়ির কারো চোখেই ঘুম সহজে ধরা দেয় না। এই বুঝি আবারও ঘটে গেল কোনো অঘটন। গলায় ওড়না টা জড়িয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে এসে দরজা টা খুলে দিল। দরজা খুলতেই বাবার অসহায় মুখ টা দেখে কেঁপে উঠল অন্তর আত্মা টা। রাদিফ সাহেব ভেজা কন্ঠে বলে উঠলেন,

–” আমি নিরুপায় রে মা। এতো রাতে তোদের জাগাতে খারাপ লাগলেও বাধ্য হলাম। আমার ছেলেটা আবারও বেড়িয়ে গেছে। নিবিড় কে বলবি একটু আমার সাথে ওর পিছু যাওয়ার জন্য? আমার একার পক্ষে যে ওকে আটকানো সম্ভব না।”
নিবিড় ঘুম ঘুম চোখে বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে এল। চিন্তিত মুখে বলল–” তাড়াতাড়ি চলুন বাবা। দেরি করলে ওকে খুঁজে পেতে কষ্ট হবে।”
–” হুম চলো।”
রাদিফ সাহেব ও নিবিড় তাড়াতাড়ি করে হাতে টর্চ নিয়ে চলে গেলেন। আমরিন সেদিকে চেয়ে থেকে ডুকরে কেঁদে উঠল। বিড়বিড় করে বলল–” কেন তুলি? কেন এমন করলি তুই? কেন আমার ভাই কে জ্যান্ত লাশ বানিয়ে হারিয়ে গেলি? এতো ভালোবাসার এমন প্রতিদান দিতে পারলি তুই? কে জানত তোর ছোট্ট চঞ্চল মনের আড়ালে এতো নিষ্ঠুরতা লুকিয়ে ছিল!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিবিড় ও রাদিফ সাহেব দৌড়াতে দৌড়াতে কিছু দূর আসতেই আদ্র কে দেখতে পেল। হাফিয়ে উঠেছেন তিনি। এ বয়সে ছেলের এতো কষ্ট তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। প্রতিনিয়ত নিজের ছেলেকে চক্ষুদ্বয়ের সামনে ধুকে ধুকে মরতে দেখার মত কষ্ট ওনার মন টা কে বিষিয়ে দিচ্ছে। সুখের সময়গুলো বোধ হয় তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। আদ্র অনবরত ফোন করে যাচ্ছে কাউকে। চোখে মুখে রাগের ছাপ। নিবিড় গিয়ে পাশে দাঁড়াতেই বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকাল। তীক্ষ্ণ মেজাজ নিয়ে বলে উঠল,

” মাঝ রাতেও শান্তি দিবি না তোরা? আবার চলে এলি? পাগল পেয়েছিস আমাকে? সবসময় পিছু কেন নিচ্ছিস? আমার শান্তি চাই। শান্তি!”
কেঁপে উঠল নিবিড়ের হৃদয় টা। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আদ্রর বিরক্তমাখা চেহারা টা দেখে আজ ভীষণ কষ্ট অনুভব হচ্ছে তার। একটা মানুষ কতটা অসুখী হলে একটু শান্তির জন্য আকুল আবেদন করে তা আজ ভালোই বুঝতে পারছে নিবিড়। মেডিকেল কলেজের দুর্দান্ত মেধাবী, সুদর্শন ছেলেটার বর্তমান পরিস্থিতি দেখলে কে বলবে সে একজন বেস্ট হার্ট সার্জন, একজন সুখী মানুষ ছিল। যেই ছেলে নিজের হার্ট কেই সুস্থ রাখতে পারে নি সে আর অন্যের চিকিৎসা কিভাবে করবে। তাই তো ছেড়ে দিয়েছে ডাক্তারি পেশা।নিবিড়ের তো চোখ গুলো দেখলেই ভয় হয়। নির্ঘুম কাটানো নীল বর্ণের চোখ দুটো এখন সর্বদাই লাল রঙে ছেয়ে থাকে। কারণ নীলাভ চোখে মুগ্ধ হওয়া মেয়েটা আজ আর মুগ্ধ হওয়ার জন্য ছুটে আসে না। নিবিড় উত্তপ্ত একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,,

” বাসায় চল আদ্র। রাত দু’টো বাজে। এতো রাতে তুই তুলি ভাবী কে খুঁজে পাবি না।”
“খুঁজলে অবশ্যই পাবো। তোরাই তো আমার তুলা কে আমায় খুঁজতে বাধা দিচ্ছিস। আমি আমার তুলা কে ঠিকি খুজে বের করব।”
নিবিড়ের চোখের কোণে জমে থাকা জল টা গড়িয়ে পড়ল। শার্টের হাতা দিয়ে মুছে ধরা গলায় বলে উঠল-

” আর কত খুঁজবি আদ্র? চার মাস ধরেই তো পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিস। কখনও কুমিল্লা যাচ্ছিস আবার ঢাকা ফিরে আসছিস তো কখনও ঢাকার অলি গলিতে হেঁটে বেড়াচ্ছিস। কত’শ লোক লাগিয়ে রেখেছিস ভাবী কে খোঁজার জন্য তবুও কেন এতো অস্থির হয়ে পড়ছিস? রাত-বিরেতে কেন খোঁজার জন্য পাগলামি করছিস? ফিরে চল ভাই। একবার তাকিয়ে দেখ তোর বৃদ্ধ বাবার দিকে। লোকটা তোর জন্য ছুটে এসেছে। তোর কষ্ট আমাদের ঘুমোতে দেয় না। আমাদের বুক টা ফেটে যায় আদ্র। আমরা সবাই মিলে তো খুজছি। যেই মানুষ টা ইচ্ছে করে হারিয়ে যায় পৃথিবীতে তাকে খুঁজে বের করা খুবই কঠিন আদ্র। খুবই কঠিন।”

নিবিড়ের দিকে এক পলক চেয়ে রাদিফ সাহেবের ছলছল চোখে দৃষ্টি রাখল আদ্র। আচমকাই ওনার পা জড়িয়ে বসে পড়ল রাস্তায়। চমকে উঠলেন রাদিফ সাহেব। নিমিষেই হার্টের ব্যাথা টা বেড়ে গেল। আদ্র কন্ঠে আকুলতা নিয়ে বলে উঠল-
” বাবা জীবনে একবার আপনার সামনে কেঁদেছিলাম তুলি কে পাওয়ার জন্য। আজ আপনার পা জড়িয়ে আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বায়না করতে ইচ্ছে করছে একটু সুখ একটু শান্তি এনে দিবেন বাবা? আমি একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিতে চাই। আমার দম টা বন্ধ হয়ে আসে। প্রতিটা মুহুর্তে বুকের বা পাশ টায় অসহনীয় পীড়ন হয়। আমি ঘুমোতে পারি না। তুলি কে পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি,,। আমি সুস্থ হয়ে যাব। আমার কিছু চাই না শুধু একটুখানি স্বস্তি চাই। আমার তুলি কে চাই।”

স্যান্ডেল পড়া পায়ে তরল কিছুর স্পর্শ অনুভব করতেই রাদিফ সাহেব হু হু করে কেঁদে দিলেন। নিজেকে শক্ত রাখতে পারলেন না তিনি। পারলেন না ছেলের চোখের জল দেখে আজ কঠোর থাকতে। একটা সময় ছেলের চোখের জল দেখেও কঠোর থেকেছিলেন। আজ শত চেষ্টা করেও, চেয়েও ছেলের জন্য মেয়েটা কে এনে দিতে পারছেন না তিনি। তিনি হাঁটু মুড়ে বসতেই নিবিড় এগিয়ে এল। আদ্রর কোনো হেলদোল নেই। একদম নির্জীব হয়ে আছে। আঁতকে উঠল নিবিড়। রাদিফ সাহেবের বাহুতে হাত রেখে বলে উঠল-
“বাবা এক্ষুনি আদ্র কে হসপিটালে নিতে হবে৷ ওকে স্বাভাবিক লাগছে না। আমি আমরিন কে ফোন দিচ্ছি গাড়ি নিয়ে আসার জন্য। ”
রাদিফ সাহেব আদ্রর বাহু ঝাঁকাল। চোখ মুখ খিঁচে মূর্তির ন্যায় বসে আছে আদ্র। আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল রাদিফ সাহেবের মনের ভিতর। ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন তিনি।

হাসপাতালের করিডোরে বসে আছে সবাই। সায়েরা বেগম কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সাগরের হাত টা ধরে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে রিমি। মাঝ রাতে ও ঘুম নেই কারো চোখে। আদ্রর জন্য ছুটে এসেছে সবাই।পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা পায়েল শাশুড়ির শত বাঁধার পরও ছুটে এসেছে অন্তু কে নিয়ে প্রাণের বন্ধুর জন্য। অন্তর হাত টা ধরে বুকে মাথা রেখে নীরবে কাঁদছে সে। কেন তুলি চলে গেল?কোথায় হারিয়ে গেল আদ্র কে এতো ভালোবেসে? থাকলে হয়তো আজ পরিস্থিতি টা অন্যরকম হতো। আমরিন দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছেড়ে চোখ বুঁজে ফেলল। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল প্রকান্ড ঝড় উঠা সেই দিনটার কথা।

আমরিন কে দৌড়ে বেরিয়ে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল আদ্র। শাড়ি বেজিয়ে পড়ে যেতে নিলে সামলে নিল নিবিড়। আমরিন হাপাঁতে হাপাঁতে আদ্রর হাতে একটা কাগজ দিল। সবাই আতঙ্কিত চোখে চেয়ে আমরিনের দিকে। আদ্র কাগজ টা মেলে পড়তে শুরু করল।
❝ ক্ষমা করে দিবেন আদ্র। আমার পক্ষে আপনাকে বিয়ে করাটা কোনোভাবেই সম্ভব না তাই পালিয়ে যেতে বাধ্য হলাম। নতুন একটা জীবন শুরু করার অনুরোধ রইল নতুন কাউকে নিয়ে। ❞

লিখাগুলো পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেল আদ্র। নিমিষেই মনে হল তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। পুরো দুনিয়াটা হঠাৎ করে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ে শীতল স্রোতের বদলে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কাগজ টা হাতের মুঠোয় নিয়ে পাগলের মত তুলির রুমে ছুটে আসল। ওয়াশরুম, বেলকনি পুরো বাড়ির আনাচে কানাচে খুজেও তুলির কোনো অস্তিত্ব পেল না। হাঁটু গেড়ে গগনবিদারী চিৎকার করে উঠল আদ্র। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ধূলিসাৎ হয়ে গেল এতো বছরের জমানো সব স্বপ্ন।

তুলি পালিয়ে গেছে এটা কোনোক্রমেই কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। ভাই কে চিৎকার করতে দেখে কেঁদে দিল ইনশিতা, আমরিন। রিমি তো আজ আনন্দের অশ্রু দেখতে চেয়েছিল তবে আদ্রর চোখে কেন বিষাদের জল। হাসি-খুশি বিয়ে বাড়ি টা নীরবতায় ছেয়ে গেল। আহান-ঝুমু ও স্তম্ভিত। আচমকা আদ্র উঠে এসে সামিরার গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। মাটিতে ছিটকে পড়ল সামিরা। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠল সে। রনক,ইনশিতা সহ সবাই প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে ইনশিতা সামিরা কে তুলতেই আদ্র ইনশিতা কে সরিয়ে সামিরা কে টেনে সবার সামনে ছুড়ে ফেলল। রনক এগিয়ে আসতেই রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দমে গেল রনক। আতঙ্কিত স্বরে প্রশ্ন করল,

“সামিরা কি করেছে ভাই?”
আদ্রর ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। সামিরার দিকে তাকিয়ে চিৎকার বলে উঠল-
” তুই কি ভেবেছিস তুলি কে সরিয়ে দিলে আমি তোকে বিয়ে করে নিব? কান খুলে শুনে রাখ। তুলি আমার বউ। কাবিন নামায় স্বাক্ষর করে অনেক আগেই ওকে আমি নিজের অর্ধাঙ্গিনী বানিয়ে নিয়েছি। তোর সব চেষ্টা বৃথা। নাকি ম্যারিড ছেলে কে ও বিয়ে করতে চাস তুই? ”
আদ্রর কথা শুনে সবাই অবাকের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল এটা জেনে আদ্র আগেই বিয়ে করে নিয়েছে। রাদিফ সাহেব একটুও চমকালেন না। তিনি বিষয়টা জানতেন। সামিরা ভয়ার্ত চোখে চেয়ে থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
” আমি তুলি কে কিছু করি নি আদ্র।”

রাগটা দ্বিগুণে পরিণত হল। হাটু গেঁড়ে হাতের ছুরি টা দিয়ে সামিরার হাতে আঁচড় কাটতেই চিৎকার করে কেঁদে উঠল সামিরা। রনক এগিয়ে এসে বোন কে আগলে নিল। কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,
“পাগল হয়ে গিয়েছেন আপনি আদ্র ভাই? কি করছেন এসব?”
” হে,, হয়ে গিয়েছি আমি পাগল। তোর বোন কে বল আমার বউ কে বের করে দিতে নয়তো আজ ওর লাশ ফেলব এখানে। তুই জানিস তোর বোন কাল আমার শরবতে অ্যালকোহল মিশিয়ে আমার সাথে অবৈধ ভাবে মিলিত হওয়ার ফন্দি এঁটেছিল? আমাকে ও তুলি কে আলাদা করতে চেয়েছিল? কিন্তু সফল হয় নি। আমার তুলি ঠিক সামলে নিয়েছে। ও কখনও আমায় ছেড়ে যেতে পারে না। আমি ওর অস্তিত্বে মিশে আছি। আমাকে ছাড়া ও বাঁচবে না। তোর বোন কে বল আমার তুলি কে ফিরিয়ে দিতে।”

বিষিয়ে উঠল রনকের মন টা। সেই সাথে বিমূর্ত রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। রনক সামিরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“আদ্র ভাই যা বলছে সব সত্যি? ”
” হুম তবে আমি তুলি কে কিডন্যাপ করি নাই ভাইয়া। তুলি কোথায় আমি কিছুই জানি না।”
সাথে সাথেই সামিরার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল রনক। একটা মেরে ক্ষান্ত হয় নি সে। পর পর আরো দু’টো থাপ্পড় বসিয়ে আদ্রর হাত ধরে বলল,
” আমাকে ক্ষমা করে দিন ভাই। সামিরা হয়ত সত্যি বলছে। তুলি ভাবী কোথায় ও হয়ত জানে না।”
সামিরা নত মস্তকে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল-

” কাল আমার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল কিন্তু আমি সত্যি বলছি আমি তুলি কে কিছু করি নি। তুমি যা শাস্তি দিবে মাথা পেতে নিব। কিন্তু তুলি কে এনে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। ও কোথায় আমার জানা নেই। ”
কথা না বাড়িয়ে আদ্র বেড়িয়ে পড়ল তুলির খোঁজে। আহান,রনক,অন্তু, সাগর,নিবিড় সবাই মিলেও খোঁজে পেল না তুলি কে। আদ্র সোর্স ব্যবহার করে ও তুলির কোনো হদিস পেল না। তুলি বিহীন ধুধুর মরুভূমি পৃথিবী টা আদ্রর কাছে।পৃথিবীর সব রং যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে।

পরিণত হয়েছে ধূসর কিংবা সাদাকালো তে। মেঘে ছেয়ে গেছে তারার মেলায় মুখরিত হয়ে থাকা আকাশ টা। ঘুম হারাম করে প্রতি টা দিন,প্রতিটি মুহুর্ত শান্তির খুঁজে ছুটে বেড়াচ্ছে সে। যেখানে প্রিয় মানুষ টা হারিয়ে গেলে ছেলেরা সন্ন্যাসীর রূপ ধারণ করে, মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে সেখানে আদ্র পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে মোনাজাতে তার তুলা কেই চেয়ে যাচ্ছে। সবার ভালোবাসার ধরন আলাদা। কেউ কেউ হারিয়ে অতি শোকে পাথর হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ পাহাড়সম যন্ত্রণা নিয়েও ফিরে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে যায়। আদ্রর দুর্বলতা আদ্র কে গ্রাস করেই নিল। তুলি শুধু নিজে যায় নি নিয়ে গেছে আদ্রর বেঁচে থাকার অবলম্বন টুকু।

ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই নিবিড় এগিয়ে গেল। ডাক্তার ইশতিয়াক চিন্তিত মুখে বললেন,
” কতবার বলেছি ড. আদ্র আহনাফ যেন কোনো স্ট্রেস না নেয়। ওনি আমার কথা একদমই শুনছেন না। ওনি একজন হার্ট সার্জন ওনার হার্ট সম্পর্কে বেটার ধারণা আছে তবুও কেন ওনি এমন করছে বুঝতে পারছি না। ওনি নিজেও জানেন এমন চলতে থাকলে এক সময় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে মারা যেতে পারেন। ”
কথাটা বলেই সূক্ষ্ম একটা নিশ্বাস ছাড়লেন ড.ইশতিয়াক। সায়েরা বেগম সবটুকু শুনতে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ওনার খুব অভিমান জমেছে তুলির প্রতি। এতো করে বলেও কিভাবে পারল মেয়েটা তার ছেলে কে ছেড়ে যেতে! নিবিড় করুন স্বরে বলল,

“আমরা ভিতরে যেতে পারি?”
“হুম আসুন।”
সায়েরা বেগমও রাদিফ সাহেব কে নিয়ে আমরিন ও নিবিড় কেবিনে গেল। সবাই কে দেখে মৃদু হাসল আদ্র। সায়েরা বেগমের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
” সামান্য একটু বুকের বা পাশ টা ব্যাথা করছিল। তোমার পুত্রবধূ ফিরে আসলে ঠিক এটার উপশম হয়ে যাবে।”
আদ্রর হাত টা ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন সায়েরা বেগম। ড.ইশতিয়াক কিছুটা সাহস জুগিয়ে বলে উঠলেন,
” আমার মনে হয় কি ওনি বেঁচে নেই। নয়তো এতো খোঁজার পরও কি আপনারা পেতেন না?”
ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল আদ্রর মস্তিষ্কে। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেতে লাগল হৃদপিণ্ড। চোখে রাগের ছাপ স্পষ্ট। আঁতকে উঠল নিবিড় ও আমরিন। আদ্র দাঁতে দাঁত চেপে আওয়াজ করে বলে উঠল-

” আমার বউ বেঁচে আছে। অভিমান করেছে হয়ত আমার উপর তাই লুকিয়ে থাকছে। আমি জানি আমি ওকে খুঁজে বের করে যখন অভিমান ভাঙাব তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠবে। আমার বুকে মাথা এলিয়ে বলবে –আমি তো আপনার অপেক্ষায় ছিলাম ডাক্তার সাহেব।
“লেখক হিসেবে আপনার জীবন কাহিনি জানার খুব ইচ্ছে মিস শ্যামবর্ণা। আমার তো মনে হয় আপনার জীবন কাহিনি টা বেশ ইন্টারেস্টিং হবে এবং তা নিয়ে আমি সুন্দর এক উপন্যাস রচিত করতে পারব।”
পুরুষালি সাবলীল কন্ঠ শুনে মাথায় ওড়না টা ভালোভাবে টেনে নিল জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা। তারপর সম্মুখে দূরত্ব রেখে দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চাইল। ছেলেটার দিকে এক পলক চেয়ে বাহিরের পুকুরের পানিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,,

” আমি তুলি। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসে আপনাদের সাথে দেখা হওয়া। আপনাদের এনজিও তে ছোট্ট একটা চাকরি পাওয়া দয়ার খাতিরে ব্যাস এতটুকুই আমার জীবন।”
মৃদু হাসল ছেলে টা। বাহিরে দৃষ্টি রেখে বিমূর্ত স্বরে বলল,
” আমি তো আপনার আঠারো বছরের জীবন কাহিনি জানতে চাইছি। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসার কারণ,শুধু কি বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন বলে নাকি হবু বরও খারাপ ছিল?
হু হু করে কেঁদে উঠল তুলির মনটা। গলায় কঠোরতা রেখে তুলি জবাব দিল,

” উনার মতো ছেলে হয়তো আপনি লাখে একটাও খুঁজে পাবেন না। আর না কোনো মেয়ে আমার মতো ভালোবাসা পাবে।”
” তাহলে পালিয়ে কেন এলেন? যার এতোটা প্রশংসা করছেন এতোটা ভালোবাসেন তার কাছে কি একটা বার ও বলতে পারলেন না সবটা খুলে? তার কি জানার অধিকার ছিল না?”
” জানার চেয়ে ভালো থাকার অধিকার ছিল তার। তৎক্ষনাৎ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেত তার মনটা। আমাকে কোনোক্রমেই ছাড়ত না তবে প্রতিটা মুহুর্তে মরণ যন্ত্রণা পেত। সময়ের স্রোতে একসময় তার জীবন টায় বরবাদ হয়ে যেত। যাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি তার এতো সুন্দর জীবনটা আমি কিভাবে নষ্ট করে দিতাম?”
“আপনার কি মনে হয় এখন আপনাকে ছাড়া ভালো আছে?”

দু’চোখ বুঁজে এল তুলির। প্রশ্ন টা হৃদয়পটে বিচরণ করতে লাগল। আঘাত করতে লাগল অনবরত। কে জানত তার আঠারো বছরের জীবনে এতকিছু ঘটে যাবে? যাকে ছাড়া এক মুহুর্ত ও নিজেকে কল্পনা করতে পারত না, পাগলামি করত তাকে ছেড়ে চারটা মাস থাকতে হবে?
” ভালো নেই আমি ডাক্তার সাহেব। শরীরে বাসা বাধা অসুখের চেয়ে আমার মনের অসুখ টা প্রখর। প্রতিটা মুহুর্তে মরণ যন্ত্রণা অনুভব হয় আপনাকে ছাড়া। মাঝে মাঝে মনে হয় বিলীন হয়ে গেছে আমার ভিতরকার অস্তিত্ব। তবুও! তবুও আপনার দেওয়া ভালোবাসা নিয়ে বাধ্য হয়ে বেঁচে আছি আমি। জানিনা আর কতদিন অথবা কত মিনিট শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারব।”

মনের কথাগুলো মনে চেপে রেখেই তুলি দূর্বল গলায় বলে উঠল-
“ভালো নেই ওনি ও। তবে সময়ের ব্যবধানে এক সময় নতুন একটা জীবন তো শুরু করতে পারবেন। আচ্ছা রিম আপু আসবে না?”
ছেলেটা মুচকি হাসল। মাথা চুলকে বলল,
“আসবে। কিন্তু বুঝেনই তো পালিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি তাই শশুড় আব্বা বড্ড ক্ষেপে আছে। আমার বউ টা কে বের হতেই দেয় না বাসা থেকে।”

তুলি আর কিছু বলল না। ছেলেটার নাম আরিয়ান। পেশায় একজন লেখক। ছোট্ট এই এনজিও টা সে ও তার গার্লফ্রেন্ড মিলে খুলেছে যে বর্তমানে তার জীবনসঙ্গিনী। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে কোনো দিকে যাওয়ার মতো নির্দিষ্ট স্থান ছিল না তুলির। উপায় না পেয়ে ট্রেন স্টেশন এসে যেই ট্রেন পায় তাতেই উঠে পড়ে। ট্রেনেই পরিচয় আরিয়ান ও রিম এর সাথে। জীবনের পুরোটা খুলে না বললেও রিম এর কাছে পালিয়ে আসার কারণ টা বলেছে। রিম অত্যাধিক মিশুক স্বভাবের একটা মেয়ে। নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল তুলি কে কিন্তু তুলি যায় নি। তাই রিম তাদের এনজিও তেই থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এনজিও দেখার দায়িত্ব দিয়েছে সেই সাথে তুলির ভরনপোষণের দায়িত্ব ও নিয়েছে। আরিয়ান তুলি কে হাসানোর জন্য মাঝে মাঝে মিস. শ্যামবর্ণা নামে সম্বোধন করে।

“এই তুলি অসুস্থ শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মাথা ঘুরে পরে যাবি তো?”
আতঙ্কিত কন্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে রিম তাড়াহুড়ো করে তুলির কাছে এসে দাড়াল। হাত টা ধরে বিছানায় নিয়ে বসিয়ে আরিয়ানের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে চাইল। রাগে গিজগিজ করতে করতে বলে উঠল-
” তুমি জানো না ও ভীষণ অসুস্থ? তবুও ওকে দাঁড় করিয়ে রাখলে কেন হু? অসুস্থ একটা মেয়ের সাথেও নিজের কাব্যিক কথার ঝুলি খুলতে হবে তোমার?”
আরিয়ান কিছু বলতে নিবে তার আগেই তুলি ধীর স্বরে বলল,

” কারো দোষ নেই আপু। আমার ভালো লাগছিল না তাই জানালার কাছে দাড়িয়েছিলাম। তোমাদের অপেক্ষায় ছিলাম। তোমাদের কাছে একটা দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি। আমানতও বলতে পারো।”
আরিয়ান ও রিম অবাক চোখে চেয়ে রইল। তুলি বালিশের নিচ থেকে খামে ভর্তি একটা চিঠি এগিয়ে দিল রিমের দিকে। হালকা হেসে বলল,
“চিঠি টা আমার ডাক্তার সাহেবের কাছে পৌঁছে দিও আপু। এখন না যখন সময় হবে।”
দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছাড়ল রিম। চোখ দুটো পানিতে টুইটুম্বুর হয়ে উঠেছে তার। নিজের ফোনটা ও ব্যাগ থেকে একটা সিম বের করে ফোনে লাগিয়ে এগিয়ে দিল তুলির দিকে। আলতো হেসে বলল,

” তোর ডাক্তার সাহেব দু দিন আগে রাত দু’টোর দিকে এই নাম্বারে পাগলের মতো কল দিচ্ছিল। তাই উপায় না পেয়ে সিম টা খুলে ফেলি। এভাবে কতদিন ফোন দিয়ে কথা না বলে সেকেন্ডের জন্য ওনার বিষাদ মাখা কন্ঠ টা শুনবি? একটা বার কল দিয়ে কথা বল। এভাবে সবকিছু থেকে ওনাকে অজ্ঞাত রাখতে পারিস না তুলি। আমারই ওনার কন্ঠ শুনলে কষ্ট হয় তোর কি হৃদয় টা একটুও কেঁপে উঠে না?”
চোখ ছাপিয়ে জল নেমে এল তুলির দু চোখ থেকে। ক্ষত-বিক্ষত তো তার হৃদপিণ্ড চার মাস আগেই হয়ে গেছে এখন সেই ক্ষত যেন নতুন করে তাজা হয়েছে। নিজের মন কে বেঁধে রাখতে চেয়েও অক্ষম। এখনও ইচ্ছে হয় ফিরে যেতে। আদ্র কে বুকে মাথা রেখে একটু শান্তি পেতে। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,

” আমার খুব কষ্ট হয় আপু। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে কেউ যেন আমার আদ্র কে এনে দেয়। আমার নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয় ওনাকে ছাড়া।”
” তুলা,,,,,!”
চেনা স্বর, অতি প্রিয় সেই ডাক কর্ণকুহর হতেই চমকে উঠল তুলি। প্রচন্ড জোরে কেঁপে উঠল তার হৃদপিণ্ড। বিস্মিত চোখে একবার রিমের দিকে তাকিয়ে মোবাইলের দিকে তাকাল। মুহূর্তেই গলা শুকিয়ে এল। ওই পাশ থেকে আদ্রর স্বর ভেসে আসছে কানে অনবরত। রিম কি তার সাথে বেইমানি করল? না সে তো ছোট বোনের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এমন একটা পদক্ষেপ নিল। ভয়ে কল টা কেটে দিল তুলি। আদ্রর মুখে ফিরে পাওয়ার হাসি।

নাম্বার টা থেকে গত পাঁচ দিনে তিনবার ফোন এসেছে। আদ্রর মনে কিছু টা সন্দেহ জেগেছিল এবং সে নাম্বার ট্রেস করে তার লোক দিয়ে খুঁজে বের করেছে রিম কে। আজই ফোনে রিমের সাথে কথা হয়েছে তার। রেডি হয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বেরই হচ্ছিল তখনই ফোন টা বেজে উঠতেই নিজের অস্তিত্বের সন্ধান পেয়ে গেল নিশ্চিতভাবে। অসুস্থ ছেলে কে তাড়াহুড়ায় বেড়িয়ে যেতে পিছু ডাকল সায়েরা বেগম কিন্তু আদ্র থামল না। গাড়িতে উঠতে উঠতে এতটুকু বলে গেল–“তোমার পুত্রবধূ নিয়েই ফিরব।” কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। রাদিফ সাহেব, নিবিড়, আমরিন কে ফোন দিতে লাগলেন।

আদ্র যতটা পারছে গাড়ি স্পিডে চালিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছাল। সন্দেহের ভিত্তিতেই সে টিকেট কনফার্ম করে রেখেছিল। তুলি চোখের জল ফেলতে ফেলতে রিমের দিকে চেয়ে বলল,
“এটা তুমি কি করলে আপু? তুমি ওনাকে চিন না এখনই ছুটে আসবে পাগলের মতো। কি করলে এটা? আমাকে এই অবস্থায় দেখলে সইতে পারবেন না ওনি।”

“এমনিতেই তো পাগল হয়ে যাচ্ছিল তোকে ছাড়া। আমি আর কোনো কথা শুনছি না তুলি। চার টা মাস দমিয়ে রেখেছিস আমাদের। এই চার মাসে আমরা তোর মায়ায় এভাবে জড়িয়ে গিয়েছি আর যেই মানুষ টা এতোগুলো বছর ধরে তোকে ভালোবাসে তার অবস্থা? চলেই তো যাবি তাকে এক পলক দেখে নাহয় বিদায় হ।”
কথাগুলো বলেই অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিল রিম। চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। বুক ফেটে কান্না আসছে তার তুলির জন্য। তুলি মনে ভয় নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল। তবে কি শেষ পর্যন্ত মুখোমুখি হতেই হবে আদ্রর!

সকাল পেরিয়ে বিকাল। বিকেল বললে ভুল হবে তাও শেষ হবার পথে। নীলচে আকাশে হালকা রক্তিম আভা ফুটে উঠছে। দুরুদুরু বুক নিয়ে তুলি বসে আছে। সত্যিই আদ্র আপনি আসবেন? আচ্ছা আমি কি জবাব দিব আপনাকে? কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছি মনে তবুও কেন বার বার বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে? আমি পারব তো আপনাকে সব বলতে? নাকি অসম্পূর্ণই থেকে যাবে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মাথাটা ভার হয়ে এল তুলির। ধীর পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল সে। মাথার ঘোমটা টা ফেলে আয়নায় দৃষ্টি রাখল। নিজেকে দেখে নিজের কাছেই ভালো লাগছে না। সাথে সাথেই মাথা নত করে ফেলল।

ঘাড়ে গরম নিশ্বাস পেতেই শরীরের প্রত্যেক টা রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ জেগে উঠল। মনে আশঙ্কা নিয়ে আয়নায় চোখ রাখতেই বুক টা ধুক করে উঠল প্রচন্ড বেগে। দমিয়ে রাখা অনুভূতি গুলো সজীব হয়ে উঠল। চোখের পলকেই পিছু ঘুরে মানুষ টার বুকে আছড়ে পড়ল তুলি। আজ আর বাঁধা মানছে না কোনো অনুভূতি।চার মাসের দূরত্ব তিলে তিলে পুড়িয়েছে দু’টো হৃদপিণ্ড। আদ্রর বুকে খামচে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিল তুলি। ভিজিয়ে দিতে লাগল আদ্রর ছাই রঙের শার্ট টা। নিজের শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তুলি কে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল আদ্র।একটুও বিলম্ব করলে এই বুঝি হারিয়ে যাবে তুলি। বুকের বা পাশের ব্যাথা টা বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তবুও মন জুড়ে বয়ে যাচ্ছে শীতল বাতাস। তার তুলা কে ফিরে পাওয়ার আনন্দ। তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো করে চুমু খেল। অস্থির স্বরে বলে উঠল-

” কেন চলে এলে তুলা? আমায় কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাচ্ছিলে? জানো আজ চেয়েও রাগ করতে পারছি না তোমার উপর। কিভাবে করব বলো? আজ যে আমি আমার অস্তিত্বের দেখা পেয়েছি। মরণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছি। এই মেয়ে তুমি তো খুব ভালো করেই জানতা আমার জীবন টা তোমাকে কেন্দ্র করে তাহলে কিভাবে পারলে এতো নিষ্ঠুর হতে? সবসময় তো বলতা আদ্র আপনাকে আঁচলে বেধে রাখব,অন্য কারো হতে দিব না তাহলে তুমি কিভাবে নিশ্বাস নিতে পারলে আমাকে ছাড়া?”

তুলি নিশ্চুপ হয়ে মুখ গুঁজে রেখেছে আদ্রর বুকে। আজও লেগে পড়েছে আদ্রর হৃৎস্পন্দন পরিমাপ করার চেষ্টায়। শান্তি অনুভব হচ্ছে তার। কতকাল এই বুকে মাথা রাখা হয় নি, এই শান্তি টুকুও পাওয়া হয় নি। গভীর ভাবে আদ্রর বুকের বা পাশে নিজের অধর ছোঁয়াল। আজও থমকে গেল আদ্র। হৃদপিণ্ডের উঠানামা হতে লাগল দ্রুত গতিতে। তুলির মুখটা বুক থেকে তুলতেই অন্তর টা নড়ে উঠল তার। তুলি তার ডাক্তার সাহেবের নীলাভ চোখের দিকে চেয়ে আলতো ঠোঁট প্রসারিত করল।

গলা জরিয়ে উঠে দাঁড়াল আদ্রের পায়ের পাতায়। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আদ্র কোমর জরিয়ে উঁচু করে মুখ বরাবর তুলে ধরল। টুপ করে কপালে চুমু খেল তুলি।আদ্রর ঠোঁটে আলতো ঠোঁট ছুঁয়ে কপালে কপাল ঠেকাল। শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরল আদ্র। দু চোখ বন্ধ হয়ে আসল দু’জনের। অনুভব করতে লাগল সুখময় মুহুর্ত টা। চোখের পাতা ভিজিয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জমে থাকা অশ্রু। দু’জনেই নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত। নাকে নাক ঘষে আদ্র আবারও বলে উঠল,

“কাঁদছিস কেন? এতো মাস আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করিয়ে ক্ষান্ত হস নি তুই?এখন কেন আবার কেঁদে আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিস? ”
” আপনি কেন কাঁদছেন আদ্র? নীল বর্ণের চোখে কান্না বেমানান। নিজের এমন হাল করেছেন কেন?সন্ন্যাসী হওয়ার ইচ্ছে জাগছিল বুঝি?ডাক্তার রা কিন্তু সন্ন্যাসী হয় না।”–কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল তুলি।
“খুন করে যদি বলো মরে গেছি কেন তাহলে এ প্রশ্নের জবাব আমি কোনো কালেও দিতে পারব না তুলা।”
আদ্রর কথা শুনে তুলি আরো জোরে কেঁদে উঠল। এতক্ষণ ধরে গুছিয়ে নেওয়া সব কথা এলোমেলো হয়ে গেল। তবুও কোনোমতে কান্নার মাত্রা কমিয়ে ভেজা কন্ঠে বলে উঠল-

” আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই আদ্র।”
আদ্র চোখ মেলে তুলির জলে টুইটুম্বুর ডাগরডাগর আঁখিদ্বয়ে দৃষ্টি রাখল। বজ্রপাতের ন্যায় ছলকে উঠল সারা দেহ। তুলির চোখ গুলো একদম ড্যাবে গেছে। কালো হয়ে গেছে চোখের নিচ। আগের চেয়েও অনেক শুকিয়ে গেছে মেয়েটা। তার নিকট মনে হচ্ছে কেউ তার কলিজায় ছুরি গাঁথছে।করুণ স্বরে বলল,
“বলো।”
” আদ্র আমি আপনাকে,,!”
এক পা পিছিয়ে গেল আদ্র। চোখের পলকেই থমকে গেল তার দুনিয়া। তুলি তার কথা সমাপ্ত করার আগেই ঢলে পড়ল প্রিয় মানুষ টার বুকে। চিৎকার করে আদ্র তুলি কে ডাকতে লাগল। পালস চেক করে কোলে তুলে নিল তাড়াতাড়ি করে। আরিয়ান,রিম দৌড়ে আসল রুমে। তুলির অবস্থা দেখে আঁতকে উঠল দু’জন। আরিয়ানের হাত টা ধরে কাঁদতে লাগল রিম। আদ্র গাড়িতে উঠে ড্রাইভার কে তাড়াতাড়ি করে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলল। তুলির মাথা বুকে চেপে ধরে চোখ মুখ খিঁচে রইল। বর্ষণ থেমে নেই। অশ্রু গুলো বর্ষণের ন্যায় অবাধে গড়িয়ে পড়ছে। হারানোর তিক্ত যন্ত্রণার ভয় আবারও মনে চেপে বসেছে। আদ্র বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,
” এবার উদাও হলে আমার শ্বাস টুকু কেড়ে নিও তুলা।”

“শরীরে এতবড় রোগের বাসা বাঁধিয়ে ওনি এতটা হেয়ালি পনা কিভাবে করলেন এটা ভেবে আমি সত্যিই প্রচন্ড অবাক হচ্ছি আদ্র। আমি জানি তোমার মানতে কষ্ট হবে তবুও বলতে হচ্ছে পেশেন্টের অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল।”
থ মেরে দাড়িয়ে রইল আদ্র। চোখে কোনো জল নেই। পকেটে থাকা মোবাইল টা বেজে উঠছে বার বার। হয়তো আমরিন, পায়েল ওরা ফোন দিচ্ছে। চট্টগ্রাম এসে এনজিও তে পৌঁছার আগে ফোন করে বলেছিল তুলির খোঁজ পেয়েছে। কথাটা শুনা মাত্রই সবাই রওনা দিয়েছে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। হয়তো পথিমধ্যে আছে। ডাক্তারের সাথে কোনো কথা না বলে বারণ সত্বেও আদ্র দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল আইসিইউ রুমে।

সাথে সাথেই তার শরীরের প্রত্যেক টা লোম খাঁড়া হয়ে গেল। আইসিইউ রুমে কতশত রোগীর চিকিৎসা করেছে সে কখনও তো এমন ভয় লাগে নি। কখনও তো কেঁপে উঠে নি অন্তর। অক্সিজেন মাস্ক লাগানো তুলির ঘুমন্ত মুখ টা দেখে আজ কেন তার কোনো মুগ্ধতা কাজ করছে না? হাঁটতে পারছে না আদ্র। থেমে যাচ্ছে পা। বহু কষ্টে সামনের দিকে এগিয়ে নিল নিজের পা দুটো। কাঁপা কাঁপা হাতে টুল টা টেনে বসে তুলির এক হাত নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দিল।

তিনঘন্টা ধরে ঘুমোচ্ছে মেয়ে টা। আদ্রর হার্টের ব্যাথা টা ক্রমশ বেড়েই চলছে। পেয়েও কেন হারিয়ে ফেলছে সে তার তুলা কে? প্রকৃতি এতো নিষ্ঠুর কেন হল তাদের প্রতি?এখনও যে দু’জনের অনেক কিছু বলা বাকি। অনেক স্বপ্ন পূরণ করা বাকি।তার মনটা যে অসীম আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে তুলির মুখে অদ্ভুত, উদ্ভট কথাগুলো শুনার। এই বুঝি গায়ে নীল শাড়ি জড়িয়ে সামনে দাড়িয়ে বলবে-“আদ্র আপনি শুধু আমার।” মাথা নত করে কপাল ঠেকাল আদ্র তুলির আঁকড়ে ধরে রাখা হাতে। নড়ে উঠল তুলি। হাত টা ছাড়িয়ে নিল আদ্রর কাছ থেকে। অক্সিজেন মাস্ক টা খুলে নরম স্বরে বহু কষ্টে বলল,

আকাশে তারার মেলা পর্ব ২৩+২৪

“কাঁদছেন কেন আপনি? একটু হাসবেন প্লিজ?”
তুলির কথা শুনে আদ্রর মাথায় রাগ চেপে বসল। আবার ঠোঁটে ফুটে উঠল মৃদু হাসি। কিভাবে পারে এমন পরিস্থিতিতে এসেও একটা মেয়ে এমন উদ্ভট কথা বলতে? আদ্রর ঠোঁটের কোণে অজান্তে ফুটে উঠা হাসি দেখে এক রাশ মুগ্ধতা, এক রাশ শান্তি জড়ো হল তুলির মনে। হঠাৎই হুঁশ আসল আদ্রর। অক্সিজেন মাস্ক টা লাগিয়ে দিতে নিলে তুলি বাঁধা দিয়ে আদ্রর হাত টা শক্ত করে ধরল। মিনমিন স্বরে বলে উঠল-
” আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়া আমার নিষেধ। আব্বু,আম্মু,আমরিন,ইনশিতা আপু, অন্তু ভাইয়া, আহান ভাইয়া সবাই কে বলবেন আমায় ক্ষমা করে দিতে। সবাই কে এক নজর দেখার খুব ইচ্ছে করছে আদ্র। ততটুকু সময় পাবো তো আমি?”

তুলির কপালে, গালে অজস্র চুমু খেল আদ্র। এ কেমন যন্ত্রণা? এ কেমন প্রহর? বাঁচবে না সে এক মুহুর্ত ও এই মেয়েটা কে ছাড়া। আদ্রর রক্তিম চোখের জল ভীষণ ভাবে পুড়াচ্ছে তুলির ছোট্ট মনটা কে। আদ্রর গালে হাত রেখে কান্নামিশ্রিত দূর্বল কন্ঠে বলে উঠল-
“আমি আপনার সাথে একটা সংসার গড়তে চাই আদ্র। বাঁচতে চাই আমি।”
গালে রাখা হাত টা টেনে তালুতে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল আদ্র। ধরা গলায় উচ্চারিত হল,
” তুই আমার সাথে বেইমানি করেছিস তুলা।”
তুলির চোখে জল,ঠোঁটে হেরে যাওয়ার হাসি। শিথিল হয়ে আসল হাতের ভাঁজে নিবদ্ধ,,,,

আকাশে তারার মেলা শেষ পর্ব