চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২০

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২০
Writer Asfiya Islam Jannat

নিশীথের সময়। আকাশে পূর্ণ চাঁদের আবির্ভাব। শৈত্য বাতাস সুক্ষ্ম আঁচড় কাটছে সবুজাভ পাতার কাগজি গায়ে। জ্যোৎস্নার আলো গায়ে মেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছে কৃষ্ণচূড়ার দল। নির্বাণ পায়চারি করতে করতে এসে দাঁড়ালো জানালার ধারে। ক্ষণেই এক মুঠো স্নিগ্ধতা হুমড়ি খেয়ে পড়লো শ্যামপুরুষের ছোঁয়া পেতে। লেপ্টে গেল মুখশ্রী,চিবুক,গলদেশের সহিতে। নির্বাণ মোবাইলের কৃত্রিম পর্দায় সময়টা দেখে নিল একবার। একটার উর্ধ্বে সময় গড়িয়ে গিয়েছে অথচ স্পর্শীর কোন খোঁজ নেই। অনুষ্ঠান থেকে আসার পর সে যে চোখের আড়াল হলো তো হলো। ভুলেও ধরা দিল না নির্বাণের সন্নিধানে৷ হঠাৎ এমন আচরণের মানে বুঝতে পারলো না নির্বাণ। কিঞ্চিৎ প্রহর অপেক্ষা করে নিজ থেকে স্পর্শীর খোঁজ করেছিল কয়েকবার কিন্তু লাভ হয়নি। ধরা দেয়নি ফাঁকিবাজ মেয়েটা।

ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতেই বিতৃষ্ণায় ‘চ’ উচ্চারণ করার মত শব্দ করলো নির্বাণ। বিরক্তির সাথে তাকালো একবার আকাশের পানে, অতঃপর বেরিয়ে এলো রুম থেকে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে রওনা দিল নিলুফার রুমের দিকে। নিলুফার রুমের সামনে আসতেই শুনতে পেল কারো রিনরিনে কথার এবং হাসির শব্দ। নির্বাণ বিরবির করলো,
“আমাকে দহনে দগ্ধ করে দেখো কি নিশ্চিন্তে হেসে-খেলে বেড়াচ্ছে মেয়েটা।”
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল, আলতো হাতে খুললো দরজা। স্পর্শী তখনও নিলুফার সাথে কথা বলায় মশগুল। বুঝতে পারেনি নির্বাণের উপস্থিতি। নির্বাণ গলা ঝেড়ে নিলুফার দিকে তাকিয়ে বলল, “এখনো ঘুমাও নি কেন মা? রাত দেখেছ কয়টা বাজে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিলুফা ও স্পর্শী দু’জনে চকিত দৃষ্টিতে তাকালো দরজার পানে। নির্বাণ স্পর্শীর দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো। স্পর্শী দ্রুত দৃষ্টি সরালো। নিলুফা নিজের চশমা ঠিক করে বলে, “এইতো ঘুমাতে যাচ্ছিলাম।”
নির্বাণ কয়েক কদম এগিয়ে এসে বলে, “তোমাকে না ডাক্তার বলেছে রাত না জাগতে? তাও কথা শুনো না। রাতে ঔষধ খেয়েছ?”
নিলুফা নির্লিপ্ত কন্ঠে বলেন, “হ্যাঁ খেয়েছি।”
“আচ্ছা তাহলে এখন শুয়ে পড়।”

নিলুফা কিছু বলতে যাবেন তার আগেই নির্বাণ পুনরায় বলে উঠে, “স্পর্শী রুমে আসো।”
স্পষ্ট আদেশবাণী। স্পর্শী দৃষ্টি নত রেখেই মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। নির্বাণ এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে দ্রুত পায়ে হেঁটে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। নিলুফা তা দেখে বলেন, “কাল কথা হবে নে। এখন যাও, ডাকছে তোমায়।”
স্পর্শী লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে নিলুফাকে কোনরকম শুভরাত্রি জানিয়ে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে আসে। নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে আনমনে ভাবে,”এমন অদ্ভুত কেন মানুষটা? মায়ের সামনে এইভাবে কেউ রুমে যেতে বলে? উফফ! মায়ের সামনে কি এক অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হলো। মানুষটা স্পষ্টভাষী জানতো কিন্তু তা যে এতটা সেই ধারণা তার ইহকালেও ছিল না।”

অনুষ্ঠান থেকে এসে স্পর্শী ইচ্ছে করেই নির্বাণের সামনে পড়েনি। চক্ষুলজ্জায় নাকি অস্বাচ্ছন্দ্যে সেটা জানা নেই তার। তবে আজ নির্বাণের কথা ভাবনায় আসলেও উৎকন্ঠা, ব্যগ্রতা, ব্রীড়ানতায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল সে। যার দরুন চোখের আড়ালে থেকেই দিনটা কাঁটিয়ে দিয়েছিল, ভেবেছিল রাতটা আজ কথায় কথায় নিলুফার রুমেই কাঁটিয়ে দিবে। কিন্তু তা আর নির্বাণ হতে দিল কোথায়? নৈরাশ্যজনক নিঃশ্বাস ফেলে রুমে ঢুকলো সে। চোখের পলকেই নিজেকে কারো দৃঢ় বন্ধনে নিজেকে আবিষ্কার করলো সে। মুহূর্তেই ভড়কে উঠলো, বিমূঢ় নয়নে তাকালো সামনে। নির্বাণ রোষাগ্নি কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“সন্ধ্যা থেকে কোথায় ছিলে?”
স্পর্শী ফাঁকা ঢোক গিলে বলে, “এইতো এইখানেই।”
“এইখানে বলতে কোনখানে?”
স্পর্শী প্রত্যুত্তর করলো না। তা দেখে নির্বাণ তার আর স্পর্শীর মধ্যবর্তী দূরত্ব ঘুচিয়ে দাঁড়ায়। মন্থর কন্ঠে বলে, “পালিয়ে বেড়াচ্ছ আমার থেকে? কিন্তু কেন? কি করেছি আমি?”
স্পর্শীর প্রায় রুদ্ধশ্বাস অবস্থা এইবার। শব্দ,বাক্য নিঃশ্বাস সব যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে কণ্ঠনালীর মধ্যখানে। টু শব্দ পর্যন্ত করা এখন দায় সমান স্পর্শীর নিকটে। কোনমতে অস্ফুটস্বরে সে বলে উঠে, “তেমন কিছুই না। ভুল বুঝছেন আপনি।”
নির্বাণ কিয়ৎক্ষণ মৌন থেকে বলে, “পরেরবার যেন না দেখি তুমি আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছ। না-হলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

কথাটা বলে নির্বাণ স্পর্শীকে ছেড়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। ছাড়া পেয়ে স্পর্শীর দীর্ঘশ্বাস নেয়, এতক্ষণে তার জানে জান আসলো বোধহয়। আনমনে আওড়ালো, “আছি তো আপনার সাথে শুধু আজকের রাতটা। পরে আমাকে পাবেন কোথায়?”
অকস্মাৎ নির্বাণ মন্থর কন্ঠে বলে উঠে, ” লাইট অফ করে ঘুমোতে এসো।”
স্পর্শী সচকিত দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের অভিমুখে। অতঃপর লাইট অফ করে বিছানার দিকে যেতে শব্দহীনভাবে বলল, “হিটলার একটা।”

রক্তিম অপরাহ্নে হরিদ্রাভ মেঘের অহর্নিশ আনাগোনা। দূরে এক ঝাঁক পায়রা উন্মুক্ত আকাশে ঘূর্ণমান গতিতে উড়ে বেড়াচ্ছে। ভ্যাপসা গরমের আবৃত পরিবেশে ঘাম ঝরছে তিরতির করে। স্পর্শী হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপাল এবং ঠোঁটের উপরিভাগে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিল। ভিড়-ধাক্কায় দমবন্ধ হয়ে আসছে তার, এগুতে চেয়েও এগুতে পারছে না। অবসন্ন দৃষ্টিতে আশেপাশে নাহিদ এবং বাকিদের খোঁজ করলো কিন্তু পেল না তাদের। ভিড়ের মাঝে হয়তো ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে সকলে। বাড়ি থেকে দশ মিনিটের দূরত্বেই একটি মেলা বসেছে। নাহিদ এবং বাকিরা সেখানে ঘুরতে যাবে শুনে স্পর্শীও যোগ দেয় ওদের দলে। নির্বাণ আসেনি সাথে, তার নাকি ভিড়বার জায়গায় পছন্দ নয়। তবে, নির্বাণ বারন করেছিল স্পর্শীকে যেতে। কিন্তু স্পর্শী সে কথা আমলে নেয়নি, নিভৃতে এসে পড়েছিল নাহিদদের সাথে। কিন্তু এইখানে যে এত ভিড় হবে এবং ভিড়ে সে হারিয়ে যাবে তা কি আর সে জানতো? জানলে হয়তো নির্বাণের কথা অমান্য করে এইখানে আসার দুঃসাহসিকতা দেখাত না।

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সে, চেষ্টা করলো ভিড় থেকে বেরিয়ে আসার। এমন সময় পিছন থেকে এক জোড়া পুরুষালি হাত এসে স্পর্শীকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। দৃঢ়ভাবে আগলে নেওয়ার ক্ষীণ চেষ্টা করে। ঘটনাক্রমে স্পর্শী ভড়কে উঠে, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায় কিয়ৎক্ষণের জন্য। এরপর মুহূর্তেই মেজাজ বিগড়ে যায় তার, ঘৃণায় গা ঘিন ঘিন করে উঠে। স্পর্শী পিছনে না ঘুরেই কুনই দিয়ে মানুষটির পেটে আঘাত করতে নিলে সে তার হাত ধরে ফেলে। কাঠ কাঠ গলায় বলে,
“হাত চালানোর আগে দেখে তো নিবে কার উপর হাত চালাচ্ছো? ষ্টুপিড!”
অতি পরিচিত কন্ঠটি কর্ণকুহরে এসে তরঙ্গিত হওয়া মাত্র স্পর্শী চটজলদি পিছন ঘুরে তাকায়। মুখে কালো মাস্ক পড়ে থাকা সত্ত্বেও স্পর্শী কিভাবে যেন চিনে ফেললো মানুষটিকে। মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো, “নির্বাণ আপনি?”

“হাত চালানোর আগে দেখে তো নিবে কার উপর হাত চালাচ্ছো? ষ্টুপিড!”
অতি পরিচিত কন্ঠটি কর্ণকুহরে এসে তরঙ্গিত হওয়া মাত্র স্পর্শী চটজলদি পিছন ঘুরে তাকায়। মুখে কালো মাস্ক পড়ে থাকা সত্ত্বেও স্পর্শী কিভাবে যেন চিনে ফেললো মানুষটিকে। মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো, “নির্বাণ আপনি?”
স্পর্শীর সম্মোধন শুনে নির্বাণ এক মুহূর্তের জন্য থমকায়। অতঃপর অপ্রসন্ন কন্ঠে বলে, “আমি না-হলে কে হবে? আমি বাদে কি আরও আট-দশটা বর আছে তোমার?”
স্পর্শী থতমত খেয়ে বলে, “তা থাকতে যাবে কেন?”
নির্বাণ স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে, “আমি কি জানি?”

স্পর্শী অসন্তোষজনক দৃষ্টিতে তাকায়। নির্বাণের ত্যাড়া উত্তরগুলো তার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। হঠাৎ পিছন থেকে ধাক্কা লাগতেই নির্বাণ স্পর্শীর দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়ে। অনিচ্ছাকৃতভাবেই দৃঢ় হয় বন্ধন। স্পর্শী এইবার যেন মিইয়ে যায়, ব্যগ্র দৃষ্টিতে এদিক-সেদিক তাকায়। নির্বাণ তা দেখে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে খুব সপ্তপর্ণে আগলে নেয় স্পর্শীকে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় সামনে। আপাতত এইখান থেকে বের হতে পারলেই বাঁচে তারা। নির্বাণের তীব্র প্রচেষ্টা ফুলের টোকাও যেন ছুঁতে না পারে স্পর্শীকে। কিয়ৎকালের ব্যবধানেই নির্বাণ ও স্পর্শী বেড়িয়ে আসে ভিড় থেকে। খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পরক্ষণে। কিঞ্চিৎ সময়ের ব্যবধানেই ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা নির্বাণের। আকাশী বর্ণের শার্টটি কুঞ্চিত হয়ে লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। নির্বাণ পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে নিল। অতঃপর রোষানল দৃষ্টি তাকালো স্পর্শীর পানে,

“এত অবাধ্য কেন তুমি? তোমাকে না আমি এইখানে আসতে মানা করেছিলাম? তারপরও কোন সাহসে এসেছ তুমি? দেখলে তো কি বিশ্রী অবস্থা? এই জন্যই মানা করেছিলাম তোমাকে আসতে।”
স্পর্শী স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলে, “আমি জানতাম না-কি এইখানকার অবস্থা এমন হবে?”
“তুমি না জানতে বাকিগুলা তো জানতো। তাও কেন নিয়ে আসলো তোমাকে?”
কথাটা বলে নির্বাণ এক মুহূর্ত চুপ থেকে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকায় স্পর্শীর দিকে, “এক মিনিট, বাকিরা কোথায়? আর তুমি ওই ভিড়ে একা কি করছিলে শুনি?”

স্পর্শী এইবার বিচলিত দৃষ্টিতে তাকায় নির্বাণের পানে। শুকনো গলায় কয়েকবার ঢোক গিলে অস্পষ্ট সুরে বলে, “না মানে… আমি আসলে… ”
“বলবে ওরা কোথায়?”
স্পর্শী চোখ খিঁচে বন্ধ করে গড়গড় করে বলে উঠে, “ওরা কোথায় জানি না। ভিড়ের মাঝে পড়তেই হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি।”

নির্বাণ এইবার শানিত কন্ঠে বলে উঠে, “লাইক সিরিয়াসলি! তুমি বাচ্চা না-কি? এত বড় হয়েও ভিড়ের মাঝে হারায় কিভাবে মানুষ? আর হারিয়েছ ভালো কথা, ওদের ফোন করবে না? কমনসেন্স নেই তোমার?”
স্পর্শী মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে, “ফোন বাসায় ভুলে রেখে এসেছি।”
নির্বাণ দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “নিজেকে ভুলে রেখে আসতে পারলা না? তাহলেই তো হতো।”
স্পর্শী প্রত্যুত্তর করলো না, বিমর্ষচিত্তে গুটিয়ে দাঁড়ালো। আনমনে ভাবলো, “এত বকার কি আছে? মানুষ মাত্রই ভুল। এখন, ভুল মানুষ করবে না-তো কি কুকুর-বিড়ালছানা করবে?”
স্পর্শীকে নীরব থাকতে দেখে নির্বাণ বলল, “আমি যদি না আসতাম তাহলে কি করতে তুমি? ভেবেছ একবার? এত কেয়ারলেস কেন তুমি?”

স্পর্শী এইবার চটে গিয়ে বলে, “নাই-বা আসতেন। আসতে কে বলেছিল আপনাকে? এসেছেন কেন আপনি?”
স্পর্শীর তীব্র প্রশ্নের বিপরীতে নির্বাণের শীতল উত্তর, “বউ লাপাত্তা হলে, না এসে উপায় আছে?”
এই কথার পৃষ্ঠে স্পর্শী চেয়েও প্রত্যুত্তর করতে পারলো না। শিথিলতা কাজ করলো মনের মাঝে। স্পর্শী না পেরে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল স্পর্শী। নির্বাণ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে নাহিদকে ফোন করলো। কয়েকবার রিং হতেই নাহিদ ফোন তুললো। নির্বাণ দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কই তুই?”
নাহিদ আমতা-আমতা করে বলে, “এইতো ভাই মেলাতে। কেন, কি হয়েছে?”

“তোর ভাবী কোথায়?”
“আছে এইখানেই।”
কথাটা শুনে নির্বাণের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে৷ একপলক সে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে, “আচ্ছা! তাহলে সবাইকে নিয়ে বটতলার এদিকে আয়। আমি অপেক্ষা করছি তোদের জন্য।”
নাহিদ ভড়কে উঠে বলে, “তুই মেলাতে এসেছি? কেন, না মানে হঠাৎ? তুই তো সহজতর আসিস না মেলাতে।”
নির্বাণ অটল কন্ঠে বলে, “আসি না বলে কি আসতে পারবো না-কি?”
“তা-না..”

“চুপচাপ যেখানে আসতে বলেছি সেখানে আয়। দেরি করলে খবর আছে তোর।”
কথাটা বলে নির্বাণ কল কেটে দেয়। মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে তাকায় স্পর্শীর দিকে। স্পর্শীকে মুখ ঘুরিয়ে রাখতে দেখে নির্বাণ বলে উঠে, “এদিক তাও!”
স্পর্শী কথাটা শুনেও না শোনার ভাণ করে রইলো। লজ্জায় নাকি অভিমানে কে জানে? মুহূর্তে নির্বাণের দৃঢ় কন্ঠ কুহরিত হলো, “স্পর্শী! তাকাতে বলেছি না আমি? তাকাও।”
বাধ্য হয়েই স্পর্শী পাশ ফিরলো। ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালো নির্বাণের পানে। নির্বাণ এককদম এগিয়ে এসে স্পর্শীর হাতের কব্জি চেপে ধরলো, “পরবর্তীতে আর কখনোই ভিড়বার জায়গায় যাবে না, মনে থাকে যেন।”

স্পর্শী নিরুত্তর থেকে শুধু মাথা দোলালো। নির্বাণ এইবার স্পর্শীকে নিয়েই হাঁটা দিল বটতলার দিকে। যেতে যেতে স্পর্শী দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো রাস্তার ধারেই বসা চুড়িওয়ালার দিকে। বিশাল আকৃতির ঝুড়িতে হরেকরকমের রেশমি চুড়ি সাজিয়ে বসেছেন তিনি। স্পর্শী থমকে দাঁড়াতেই হাতে টান পড়লো। যার দরুন, নির্বাণও দাঁড়িয়ে পড়লো। সে পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? কোন সমস্যা? হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে যে?”
স্পর্শী মৃদুস্বরে বলল, “ওদিকে যাব একটু।”
কথাটা বলে হাতের তর্জনী উঠিয়ে চুড়িওয়ালার দিকে ইশারা করলো। নির্বাণ এক নজর সেদিকে তাকিয়ে স্পর্শীর হাত ছেড়ে দিল, “আচ্ছা যাও। তবে, দেড়ি যাতে না-হয়।”

স্পর্শী সম্মতি জানিয়ে চলে যায় সেদিকে। নির্বাণও যায় পিছু পিছু। স্পর্শী ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে হাঁটু ভেঙে বসলো নিচে, একমনে দেখতে থাকলো চুড়িগুলো। চুড়ির প্রতি সে বেশ দূর্বল, বিশেষ করে রেশমি এবং খাঁজকাটা চুড়ির প্রতি। যখন বা যেখানেই চুড়ি পাবে সে একমুঠ কিনে আনবেই আনবে সে৷ স্পর্শী নিজের জামার সাথে মানানসই একমুঠ চুড়ি নিল। কিন্তু টাকা দিতে নিলে বুঝতে পারলো স্পর্শী মোবাইল সহিতে টাকাও আনতে ভুলে গিয়েছে৷ মন ক্ষুণ্ণ হলো স্পর্শী, নিজেকে দু’গালে দুইটা চড় দিতে ইচ্ছে করলো খুব জোরে। নির্বাণ ঠিক বলে, আসলেই সে কেয়ারলেস। স্পর্শী একপলক তাকালো নির্বাণের পানে, নির্বাণ তখন মোবাইলে কিছু একটা করছে। স্পর্শী একবার ভাবলো নির্বাণের কাছে টাকা ধার চাইবে। কিন্তু পরমুহূর্তে বিষয়টা বিশ্রী ঠেকল বলে আর চাইলো না। যতই হোক এখনো তাদের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক সে-রকম গড়ে উঠেনি। উপরন্তু, কথাটা বলতেও তার কেমন লজ্জা,আড়ষ্টতা কাজ করছে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও চুড়িগুলো ফিরিয়ে দেয় সে। উঠে যেতে নিলে লোকটি বলে উঠে,

“আফামনি, চুড়ি লইবেন না?”
স্পর্শী ক্ষীণ হেসে বলে, “না চাচা। অন্য একদিন এসে নিব নে।”
হঠাৎ পাশ থেকে নির্বাণ বলে উঠে, “নিবে চাচা! আপনার আপামনি যে চুড়ি পছন্দ করেছে ওইটার চার মুঠ দেন।”
লোকটা একগাল হেসে বলে, “আইচচা ভাইজান।”
স্পর্শী গোলগাল চোখে নির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি নিব না চুড়ি। আপনি কেন কিনছেন?”
নির্বাণ একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে, “তোমাকে কথা বলতে বলিনি আমি।”
স্পর্শী কিছু বলতে যাবে তার আগেই নির্বাণ লোকটিকে বলে, “চাচা, চুড়িগুলো এইভাবেই দেন। সে পড়ে যাবে।”
“আইচচা দাঁড়ান, আমি চুড়ি ভাগ কইরা দিতাসি।”
কথাটি বলে লোকটি চারমুঠ চুড়ি ভাগ করে নির্বাণকে দেয়। নির্বাণ সেটা নিয়ে স্পর্শীর এক বাহু টেনে ধরে, খুব সপ্তপর্ণে পড়িয়ে দেয় চুড়িগুলো। মুহূর্তে দু’হাত আবৃত হয় স্বচ্ছ রঙিন প্রণয়ে। অধরের শেষ প্রান্তে খিললো হৃষ্টচিত্তের হাসি।

বটতলার সামনে আসতেই দেখা মিললো নাহিদদের। নির্বাণের সাথে স্পর্শীকে দেখে নাহিদ লাফিয়ে উঠলো। উৎকন্ঠা হয়ে বলল, “ভাবী আপনি ভাইয়ার সাথে? আর আপনাকে কোথায় কোথায় খুঁজছি জানেন? একটুর জন্য জানটা কবজ হয়নি আমার। বলে গেলেই হতো একবার, আমরা কি কাবাব ম্যায় ঠ্যাং হতাম বলেন?”
নির্বাণ নাহিদের সামনে এসে ওর কান মলা দিয়ে ধরে বলে, “বেশি কথা না বললে তোর হয় না? আর ওকে এনেছিস যেহেতু দেখে রাখতে পারলি না? কারো দায়িত্ব নিতে না পারলে সাথে নিয়ে আসিস কেন তুই? ও ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিল।”
নাহিদ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে বলে, “ভাই ছাড়! ব্যাথা পাচ্ছি আমি।”

নির্বাণ নাহিদের কান ছেড়ে দিতেই নাহিদ দ্রুত পিছনে সড়ে যেতে নেয়। কিন্তু পায়ের নিচে কাঁদা পড়ায় পা পিছলে যায় তার, যার দরুন নাহিদ সোজা গিয়ে পড়ে গন্ধযুক্ত কাঁদার মাঝে। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে সে। সকলে সে দৃশ্য দেখে উচ্চশব্দ করে হেসে উঠে। নাহিদ মুখ-চোখ ঘুচে বলে, “এই না হেসে আমাকে উঠা। উফফ! আমার কোমর। ”
কথাটা শুনে দ্রুত মৃদুল ও আরেকজন এগিয়ে আসেম ধরে উঠায় নাহিদকে। নাহিদ উঠে দাঁড়াতেই নির্বাণকে উদ্দেশ্য করে বলে, “সব তোর দোষ! তোর জন্য আমি কাঁদাতে পড়লাম।”
নির্বাণ নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে, “তোর কর্মের ফল এইটা।”

নাহিদ দুই কদম এগিয়ে এসে বলে, “তাই না? তাহলে তুইও পাবি তোর কর্মের ফল। দাঁড়া!”
নাহিদকে এগিয়ে আসতে দেখে নির্বাণ কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। রাগান্বিত কন্ঠে বলে, “সামনে আসবি না তুই, তোর শরীর কাঁদা দিয়ে ভরা।”
নাহিদ দাঁত কেলিয়ে হাসে, “জানি ব্রো! কিন্তু আমার না এখন তোকে একটা টাইট হাগ দিতে ইচ্ছে করছে। আফটার অল তোকেও তো আমার ফল দিতে হবে তাই না?”
কথাটা বলে নাহিদ এগিয়ে আসতেই নির্বাণ দ্রুত পায়ে পিছে সরে যায়। উচ্চস্বরে বলে, “আমার সামনে আসলে তোর খবর আছে নাহিদ।”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ১৯

“আজকে যাই বলো আমি কারো কথা শুনবো না।”
এই বলে নাহিদ এগিয়ে আসতে থাকলে নির্বাণ অন্য দিকে চলে যেতে থাকে। নাহিদও নাছোড়বান্দা ন্যায় নির্বার্ণের পিছু পিছু ছুটা শুরু করে। এইদিকে, দুই ভাইয়ের কীর্তিকলাপ দেখে স্পর্শী এবং বাকিরা পেট জড়িয়ে ধরে হাসতে থাকে। ফুল অন সার্কাস!

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২১