চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪৭

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪৭
Writer Asfiya Islam Jannat

পৌষের শেষভাগ৷ হিম বাতাসের অহর্নিশ আনাগোনা। পাতা কাঁপছে থরথর করে। তুলোরাশি মিইয়ে আছে নিস্তব্ধ আকাশের অন্তরালে৷ মধ্যখানে অর্ধবৃত্ত চাঁদটি তাকিয়ে আছে নিষ্পাপ পলকে। দীর্ঘ রজনী কাটছে আলসেভাবে। গায়ে পাতলা এক চাদর জড়িয়ে বই সামনে নিয়ে পড়ছে স্পর্শী। ফাইনাল সেমিস্টার চলছে তার। পরশুদিন ‘ইনওর্গান কেমিস্ট্রি’ পরীক্ষা তার।

ঘন্টাখানেক হলো একটানা পড়ে চলেছে সে। এর মাঝে হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র চ্যাপ্টারই শেষ করতে পেরেছে সে। কেন যেন পড়ায় মন নেই তার। হয়তো হাতে আরেকটা দিন সময় আছে বলে। কাল সব পড়ে নিবে ভেবে মস্তিষ্ক ঝিমুচ্ছে। আঁখি জোড়ায়ও তন্দ্রা লেপ্টে আছে আষ্টেপৃষ্টে৷ নেত্রপল্লব লেগে আসছে বারংবার। শত চেষ্টা করেও তন্দ্রাভাব কাটাতে না পেরে স্পর্শী ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকায় নিজের ডান দিকে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে অবসন্ন কন্ঠে বলে সে, “আর পারছি না। আমি ঘুমোতে গেলাম।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এতক্ষণ ধরে নির্বাণ স্পর্শীকে ভিডিও কলে রেখেই নিজের কাজ করছিল, সাথে স্পর্শী পড়ায় কোথাও আটকে গেলে সেটা বুঝিয়েও দিচ্ছিল। স্পর্শী কন্ঠস্বর শোনামাত্র নির্বাণ চোখ তুলে তাকায়। শানিত কন্ঠে বলে, “একদম না৷ এখনো অনেক পড়া বাকি আছে তোমার। এগুলো শেষ করবে কখন তুমি?”
স্পর্শী মুখ ছোট করে বলে, “কাল সকালে উঠে পড়ে নিব। সময়ের মধ্যে সব চ্যাপ্টারও শেষ করে ফেলব। প্রমিস! আপাতত ঘুমের জ্বালায় মারা যাচ্ছি আমি। ঘুমাবো!”

“সকালের আশায় কোন জিনিস রাখতে মানা করেছি তোমায়। পড়া এভাবে খালি পিছাবে শেষ আর হবে না। পরে দেখা যাবে পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে কিন্তু তোমার পড়া আর শেষ হয়নি।”
“হবে না এমন। সত্যি!”
“না মানে না। এই চ্যাপ্টার শেষ করে তারপর ঘুমাবে তুমি৷ ঘুম বেশি পেলে চোখে-মুখে পানি দিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে নাও। দেখবে আর ঘুম পাচ্ছে না।”

স্পর্শীর মুখশ্রী পাংশুটে দেখায়। বলে, “আমার আর এনার্জি নেই।”
“স্পর্শী! যাও বলছি৷ কোন বাহানা শুনতে চাই না আমি।”
স্পর্শী মুখ বিকৃতি করে উঠে দাঁড়ায়। বিরবির করে বলে, “ধ্যাৎ! ভাল্লাগে না।”
কথাটা বলতে বলতে স্পর্শী রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে নির্বাণ পিছন থেকে ডাক দেয়, “স্পর্শী শুনো!”
স্পর্শী পিছনে ঘুরে দাঁড়ায়৷ গম্ভীরমুখে বলে, “আবার কি?”
“মা কি এখনো জেগে আছে?”

স্পর্শী ভ্রু কুটি সংকুচিত করে একপলক নির্বাণের তাকায়। অতঃপর ঘড়ির দিকে তাকায়। বারোটার বেশি বাজে। সে বলে, “হ্যাঁ জেগে আছে৷ এসময় মা একটা নাটক দেখে, ড্রয়িংরুমে হবে নিশ্চয়ই।”
“তাহলে মাকে বল কফি করে দিতে একটু। সে করে দিবে।”
মুহূর্তেই স্পর্শী সুধীর হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। নির্বাণের চিন্তা কোথায় সেটা বুঝতে পেরে স্মিত কন্ঠে বলে, “আমি ঠিক আছি। কফি লাগলে নিজেই বানাতে পারব।”
নির্বাণ কন্ঠে আক্রোশ মিশিয়ে বলে, “পাকনামো করতে বলা হয়নি তোমাকে। যা বলছি তা কর। নাহলে আমি নিজেই মাকে ফোন দিব এখন।”

স্পর্শী তটস্থ হয়ে বলে, “আপনি কি পাগল? এতটুকু বিষয়ের জন্য মাকে ফোন দেয় কেউ?”
নির্বাণ গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে, “আমার দৌড় কতদূর সেই ধারণা আদৌ আছে তোমার? নেই তো। তাই যা বলছি সেটা কর। মাকে গিয়ে বল কফি করে দিতে।”

স্পর্শী মুখ ফুলালো। প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে গটগট করে চলে গেল বাহিরে। সাহেলাকে এক কাপ কফি দিতে বলে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে থাকে সে। মনে পড়ে তার নির্বাণের সাথে কাটানো সেই মুহূর্তগুলো। এক্সিবিশন শেষে আরও চারদিন নির্বাণের কাছে ছিল সে। সেই সময়টুকু নির্বাণ তার যত্নে কোন ত্রুটি রাখেনি। আগলে রেখেছিল খুব সন্তর্পণে। অফিস থাকাকালীন ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে প্রতি প্রহরে। সাথে যখন ছিল তখন তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসের খেয়াল ছিল নির্বাণের-ই। সেখান থেকে তার ফিরে আসতে ইচ্ছে না করলেও আসতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে। সামনে পরীক্ষা, পড়া বাকি যে।

বাসায় আসার পর তাকে পড়ানোর দায়িত্ব নির্বাণ নিজ থেকেই পালন করতে শুরু করে। পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর স্পর্শীর রাত জেগে যতটুকু সময় পড়ে ততটুকু সময় নির্বাণও অপরপাশে নেট সংযোগের মাধ্যমে তার সাথে জেগে থাকে আর নিজের কাজগুলো করে। কদাচিৎ স্পর্শী আটকে গেলে তাকে বুঝিয়ে দেয়, ইমপোর্টেন্ট টপিকগুলো রি-মার্ক করে দেয়। সব ভেবে স্পর্শীর ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হয়।

মিনিট দশেক পর হাতে একটা কফি নিয়ে আসলো সে। ল্যাপটপ দরজার দিকে মুখ করে রাখায় নির্বাণ দেখতে পেল স্পর্শীকে। ক্ষণেই বলে ওঠে সে, “আস্তে-ধীরে আসো৷ পড়ে যাবে কফি, পরে অঘটনটা ঘটাবে। হাত এখনো সাড়েনি তোমার।”
স্পর্শী স্থির হয়ে দাঁড়ায়, এক ঝলক তাকায় বা হাতের দিকে। ঝলসে গিয়ে চামড়া উঠে গিয়েছে সেখানে। চারপাশ কালসেটে হয়ে কুঁচকে আছে কেমন করে৷ জ্বালা করে না এখন তেমন তবে বীভৎস দেখায় তার নিকট। কতদিনে যে ঠিক হবে এটা যে জানে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে। ম্রিয়মাণ নয়নে তাকায় সামনে, “কিছু হবে না।”

কথার বিপরীতে নির্বাণ অসন্তোষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এমন সময় পার্শিয়া দরজা সামনে এসে দাঁড়ায়। মৃদু কন্ঠে শব্দ করে। স্পর্শী ঘাড় ঘুরিয়ে পার্শিয়াকে দেখে ডাকে নিজের কাছে৷ ঠিক সে মুহূর্তে পার্শিয়া ল্যাপটপের স্ক্রিনে নির্বাণকে দেখে মুখ ঝামটা মেরে অন্যদিকে চলে গেল। নির্বাণ লক্ষ করে বিষয়টা। অভিব্যক্তি স্বাভাবিক রেখে আনমনে আওড়ায়, “ওর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি? সমস্যা কি আমার সাথে? আজিব!”

পার্শিয়ার এমন ব্যবহারে স্পর্শী হাসে। পিছ থেকে আর ডাক দেয় না সে। দরজা ভিড়িয়ে চুপচাপ খাটে গিয়ে বসে। কফি খেতে খেতে পুনরায় পড়া শুরু করে। রেডক্স স্ট্যাবিলিটি এন্ড রেডক্স রিয়্যাকশন চ্যাপ্টার পড়ার সময় এক জায়গায় আটকে যায় স্পর্শী। সে নির্বাণকে সেই টপিকটা বুঝিয়ে দিতে বললে নির্বাণ নিজের স্ক্রিন শেয়ার দিয়ে বোর্ডে পুরো টপিকসটা ডিটেইলসে বুঝিয়ে দিতে থাকে। স্পর্শী মনোযোগ দিয়ে বুঝতে থাকে সে-টা। আঁখিপল্লবে পুনরায় তন্দ্রা ভর করতেই বালিশ সামনে টেনে উপর হয়ে শুয়ে পড়ে সে। মিনিট কয়েক গড়াতেই নিষুপ্তিছন্নে নিমজ্জিত হয় সে। ঈষৎ মুহূর্ত পর নির্বাণ বোঝানোর ফাঁকে জিজ্ঞেস করে, “এই জিনিসটা বুঝেছ তুমি?”

উত্তর আসে না এপাশ থেকে। নির্বাণ পুনরায় প্রশ্ন করে, এবারও সাড়াশব্দ পায় না সে। নির্বাণ ভিডিও কনফারেন্সে ফিরে এসে দেখতে পায় মুখের সামনে ল্যাপটপ রেখে স্পর্শী ঘুমিয়ে পড়েছে। এক গাছি চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো মুখশ্রী জুড়ে। বাচ্চা বাচ্চা লাগছে পুরা। ঘুম ভাঙ্গায় না আর সে। স্মিত মুখে তাকিয়ে থাকে। আকস্মিক তার ইচ্ছে করে স্পর্শীর চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে নিতে৷ কিন্তু এটা যে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়৷ নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মোহগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো স্ক্রিনের দিকে। ক্ষণেই নিজেকে ছন্নছাড়া লাগলো তার। মস্তিষ্ক হলো শূণ্য। আনমনে আওড়ায় সে, “মনোহারিণীর সম্মোহনের সামনে মদ্যপনেশাও অতি নগন্য।”

এডমিশনের কিছু কাজে বের হয়েছে স্পৃহা। কিছু ফরমালিটি পূরণ করা বাকি আছে তার। শত চেষ্টা করেও পাবলিকে সুবিধা করতে পারেনি সে। এর জন্য তার মন ক্ষুণ্ণ হয়েছিল বটে কিন্তু পরবর্তীতে মা-বাবা-বোনের কথায় সাহস পায় সে। ব্যর্থতা ভুলে কাছেই একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে নে সে। কাজ শেষে স্পৃহা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে এমন সময় নাহিদ তার সামনে এসে হাজির হয়। নাহিদকে দেখামাত্র স্পৃহা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়। অকস্মাৎ নাহিদ স্পৃহার হাত চেপে ধরে বলে, “এদিক আসো আমার সাথে। কথা আছে।”

স্পৃহা হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলে, “কিন্তু আমার নেই। হাত ছাড়ুন আমার, বাসায় যাব আমি।”
নাহিদ শুনে না। হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় করে বলে, “বাড়াবাড়ি করবে না স্পৃহা। আমি শুধু একটাবার তোমার সাথে কথা বলতে চাই। কথাটুকু শুনো আমার। এরপর চৌরাস্তায় যাও আর জাহান্নামে যাও আই রিয়ালি ডোন্ট কেয়ার।”

নাহিদের কথা শুনে স্পৃহা একমুহূর্তের জন্য থমকায়। অভিমান হয় রাজ্যসম। নয়নের তারা চিকচিক করে উঠে। এতটাই নিষ্ঠুর বুঝি মানুষটা? কি অবলীলায় বলে দিল কথাগুলো সে। কই আগে তো এভাবে কথা বলতো না তার সাথে। তাদের প্রণয়ের শুরুতে সে যতই রাগ-অভিমান দেখাতো না কেন বুঝতো সে। তাহলে আজ নয় কেন? তার মানে কি সত্যিই শুরু থেকে সবটা মিথ্যে ছিল? সব ছলনা ছিল? রাগে-ক্ষোভে দাঁতে দাঁত চেপে তাকায় সে নাহিদের পানে। হাত মোচড়াতে থাকে ছাড়া পাবার আশায়। দুইজনের হাবভাব নজর কাড়া হওয়ায় যাতায়াতকৃত সকলে আড়চোখে তাদের দেখতে শুরু করে। নাহিদ সেটা লক্ষ্য করে বলে, “রাস্তায় আছি আমরা তামাশা কর না। চল আমার সাথে। আমাকে জোর করতে আর বাধ্য কর না।”

স্পৃহা কিছু বলতে নেয় কিন্তু পরক্ষণে নাহিদের ক্রোধান্বিত রক্তিম নেত্রের দিকে তাকিয়ে আর বলার সাহস পায় না। এর মূখ্য কারণ সে কখনো নাহিদকে রাগতে দেখে নি। তার সামনে তো এক্কেবারেই না। উপরন্তু স্পৃহার মনও টানছে নাহিদের সাথে যেতে৷ তাই অবশেষে সে রাজি হলো নাহিদের সাথে যেতে। নাহিদ আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে একটা রিকশা ঠিক করে স্পৃহাকে নিয়ে সেটায় উঠে পড়ে।

কাঁচা রাস্তার উপর রিকশা চলছে আপন গতিতে। অসমান জায়গায় চাকা পড়তেই ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে সশরীর। যতবারই এমন হচ্ছে সামনের দিকে হেলে পড়ছে স্পৃহা। বিরক্তি খেলা করছে চোখে মুখে তার।নাহিদ বিষয়টা খেয়াল করে নিঃশব্দে রিকশার হুট তুলে দেয়। স্পৃহার সামনে দিয়ে হাত নিয়ে অপরপাশে কাঠটা ধরে বসে থাকে সে৷ স্পৃহা এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কিছু বলে না সে। মনে জাগে একটা প্রশ্ন, “নাহিদ কি তাহলে এখনো তার চিন্তা করে?”

তাদের প্রণয়ের সূচনা হয় সাদামাটাভাবেই। কক্সবাজার থেকে আসার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় কানেক্টেড ছিল তারা। কথা চলতো প্রতিনিয়ত। ধীরে ধীরে, স্পৃহার অজান্তেই নাহিদ তার মনে বিশেষ একস্থান দখল করে ফেলে। আলাদা এক ভালোলাগা কাজ করতে শুরু করে তার প্রতি। আর এই ভালোলাগা যে কবে ভালোবাসায় পরিণত হয়ে যায় কে জানে। তবে মনের কথা প্রথমে নাহিদই বলেছিল। স্পৃহাও ফেরাতে পারিনি তাকে। সেখান থেকেই রচিত হয়েছিল তাদের প্রেমকথন। খুনসুটির মাঝেই যেতে শুরু করে তাদের সময়। তবে প্রণয়ের শুরু নাহিদ করলেও শেষ করেছিল স্পৃহা। বিশ্বাস ভেঙেছিল স্পৃহার যার দরুন আর এক প্রহর না ভেবে নাহিদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে বসে সে। যদিও কারণটা ছিল দুইজনের কাছেই স্পষ্ট তবুও নাহিদের বলার ছিল অনেক কিছু। শুধু অপেক্ষায় ছিল একটি সুযোগের যা কি-না গিয়ে পেল আজ সে।

লোকালয় হতে কিছুটা দূরে অবস্থিত একটা পার্কে এসে বসে স্পৃহা আর নাহিদ। দুইজনই নিশ্চুপ। কথা শুরু করবে কোথা থেকে সেই দ্বিধায় আছে হয়তো। সময় গড়ায় ঈষৎ৷ স্পৃহা মাথা নুয়ে বসে ছিল তখন, নাহিদ বলে ওঠে, “ওই ভিডিওটা ওপেন কর তো যেটা সে রাতে তুমি আমাকে দিয়েছিলে।”
স্পৃহা দৃঢ় চোখে তাকায় নাহিদের পানে। ভিতরটা হাহাকার করে উঠে পরক্ষণে। মানুষটা কি ইচ্ছে করে করছে এসব? তাকে কষ্ট দিতে চাইছে? কম্পিত গলায় বলে সে, “কেন? আমাকে আরও কষ্ট দেওয়া বাকি আছে আপনার?”
নাহিদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, “তোমাকে যদি আমার কষ্ট দেওয়ারই হতো তাহলে এখানে নিশ্চয়ই আনতাম না আমি তোমায়। এতক্ষণে তুমি আ….”

বাকি কথাটুকু আর না বলে হজম করে নেয় সে। অসম্পন্ন বাক্যটুকু স্পৃহাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিবে ভেবে। নিজের রাগ কোনমতে সংযত করে বলে, “মাথা গরম কর না স্পৃহা। যা বলছি তা কর।”
স্পৃহা ক্ষণকাল স্থির হয়ে বসে থেকে ফোন ঘেটে সেই ভিডিওটি চালু করলো। ভিডিওতে দুইজন ব্যক্তি পাশাপাশি বসে আছে। তার মধ্যেই একজন হচ্ছে নাহিদ। পাশে এক রমনী, তাকে চিনে না স্পৃহা৷ অকস্মাৎ নাহিদ সেই রমনীর দিকে তাকিয়ে ‘আই লাভ ইউ’ বলে ওঠে।

বিপরীতে রমনীটি খুশিতে আপ্লূত হয়ে ‘আই লাভ ইউ টু’ বলে নাহিদের গলা জড়িয়ে ধরে তার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। ভিডিওটি শেষ হয় এখানেই, পলকে চোখের কোণে জল ঝরে স্পৃহার। বক্ষঃস্থলে অস্বাভাবিক ব্যথা অনুভব হলো। ভালোবাসার মানুষটাকে অন্যের বাহুদ্বয়ে আবদ্ধ দেখা কোন নারীই বা সহ্য করতে পারে? আদৌ কেউ কি পারে?
স্পৃহা সে অবস্থায় পুনরায় সেই একই প্রশ্ন যে-টা সে মাস খানেক আগে করেছিল, “এবার বলুন, ভিডিওটা মিথ্যে। সব ছলনা। আপনি বলেন নি মেয়েটাকে ভালোবাসি কথাটা। বলুন!”

নাহিদ ঈষৎ সময় নীরব থেকে দ্বিতীয়বারের মত সেই অনাকাঙ্ক্ষিত স্বীকারোক্তিটিই করে, “ভিডিওটি মিথ্যে নয়।”
স্পৃহা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। চোখ ঘুরিয়ে তাকায় অদূর নিস্তেজ বৃক্ষের দিকে। নাহিদ বলে ওঠে, “তবে সত্যও নয়। এর পিছে অন্য কাহিনী আছে। ওয়েট!”
স্পৃহা ফিরে তাকায় না। পাথরের ন্যায় বসে থাকে। নাহিদ সেটা দেখে ফোন বের করে কাউকে কল করে। কয়েকবার রিং হতেই কল ধরে কেউ। প্রফুল্ল কন্ঠে বলে উঠে, “আরেহ কি ব্যাপার! আজ সূর্য কোনদিক দিয়ে উঠছে যে নাহিদ আমাকে ফোন করেছে? আ’ম ফিলিং ব্লেসড।”
নাহিদের চোয়াল শক্ত হলো, “জাস্ট সার্ট আপ তুহিনা। তোমার আজাইরা কথা শুনতে ফোন করিনি আমি। আমি শুধু আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর চাই।”

“এমন কি প্রশ্ন শুনি যে-টা নাকি তোমাকে বাধ্য করলো আমাকে ফোন করতে?”
“তুমি জানো না বুঝি? স্পৃহাকে ওই ভিডিও কেন দিয়েছ তুমি?”
তুহিনা হাসে। বলে, “ওকে সত্যিটা জানাতে। তুমি আর আমি দুইজন দুইজনকে ভালোবাসি, ও আমাদের মাঝে থার্ড পার্সোন। সো ওকে দূরে সরানোর দায়িত্ব আমার নয় কি?”
নাহিদ রেগে গিয়ে বলে, “ইউ বি*! কিসের ভালোবাসার কথা বলছো তুমি? তুমি আর আমি দেড় বছর আগেই ব্রেকাপ করে ফেলেছি। ফর গট সেক! বানোয়াট কাহিনী রটাবে না।”

“বাট আই স্টিল লাভ ইউ। তোমাকে ছাড়া আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না। চল না আবার একসাথে হয়ে যাই৷ তোমাকে পাওয়ার জন্যই তো স্পৃহাকে আমি আমাদের সেই ভিডিওটা দিয়েছিলাম যাতে সে আমাদের মাঝ থেকে সরে যায়। আর ও গিয়েছেও, এখন তো কোন বাঁধা নেই। ফিরে আসো আমার কাছে।”
“গো টু হেল!”
কথাটা বলে নাহিদ ফোন কেটে দিয়ে নাম্বারটা ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দেয়। অতঃপর স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বলে, “এবার বুঝেছ পুরো কাহিনী? নাকি এখনো না?”

স্পৃহা বলে না কিছু। শুধু আড়চোখে তাকায়। এতদিনের পরিচয়ে নাহিদের এমন রাগান্বিত রূপ প্রথমবারেই দেখছে সে। যার দরুণ কেমন ভীতি কাজ করছে তার প্রতি। এদিক নাহিদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “তুহিনা আমার এক্স। ওর সাথে আমার মাস দুই-এক এর সম্পর্ক ছিল যা কি-না দেড় বছর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। তবুও মেয়েটা পিছেই পড়ে আছে আমার। বলতে সাইকো ও একটা। কিভাবে তোমার খোঁজ পেয়েছে আমি জানি না, তবে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করতেই এটা করেছে ও। ভিডিও সেই সময়ের ছিল। বুঝতে পেরেছ নিশ্চয়ই এবার কাহিনীটা কি?”

স্পৃহা মন্থর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আপনি তো আগে কখনো আমাকে তুহিনার কথা বলেন নি। তাহলে আমি জানব কি করে?”
“সেটা আমার ভুল আমি জানি। ও আমার লাইফের ইমপোর্টেন্ট কোন পার্ট ছিল না তাই জানানোর কথা আমার মাথায়ও আসেনি। আর আমি কি জানতাম নাকি ওই এমন এক কান্ড করে বসবে?”

স্পৃহা কথা বলে না। কি বাই বলবে সে? সম্পূর্ণটাই ছিল যে ভুল বোঝাবুঝি। সে এতদিন নাহিদকে ভুল এই বুঝে এসেছিল। সুযোগ দেয়নি একবারও নাহিদকে নিজের কথা রাখতে দেওয়ার। নিজে তো কষ্ট পেয়েছেই, নাহিদকেও দিয়েছে। এখন এ ভুল শুধরাবে কি করে সে? স্পৃহাকে চুপ থাকতে দেখে নাহিদ বলে, “আগে যদি আমাকে কথা বলার সুযোগটুকু দিতে তাহলে ঘটনাটা এতদূর গড়াতো না। কিছু না জেনে শুনেই ভুল বুঝে গেলে আমায়। জানি, বিষয়টা সহজে নিতে পারোনি। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলেও হয়তো এমনই করতো। কিন্তু একটা কথা জানো কি? একটা সম্পর্কের প্রথম ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। ভুল বোঝাবুঝি বহুবার হবে এবং সেটার সমাধান তোমাকেই করতে হবে। দোষী হলে শাস্তি দাও মানুষটাকে সমস্যা নেই কিন্তু সত্যটা জেনে নাও আগে।”

স্পৃহা মাথা নুয়ে ফেলে। চোখের চশমা ঝাপসা হয়। মৃদু কন্ঠে বলে, “সরি। এসব আমার দোষই।”
“তোমাকে আমি দোষ দিতে পারছি না কারণ আমি জানি তুমি এখনো ইমম্যাচিউর। এত ভাবনা নিয়ে তুমি কোন জিনিস পর্যবেক্ষণ কর না। কিন্তু এভাবে সম্পর্কও টিকে না।”
স্পৃহা তৎক্ষনাৎ নাহিদের হাত ধরে বলে, “আর কখনো আমি তোমায় ভুল বুঝবো না। আই প্রমিস! প্লিজ এবারের মত সব ভুলে যাও।”

নাহিদ ম্লান হাসে, “চাইলেই কি সব ভুলা যায়? কষ্ট তো কম দিলে না আমায়।”
স্পৃহা এবার ফোঁপাতে শুরু করে, “আ’ম সরি! আমাকে.. আমাকে ছেড়ে..”
বলতে পারলো না স্পৃহা। শব্দ সব আটকালো কণ্ঠনালির মধ্যখানে। নাহিদের মন গললো বোধহয়। প্রেয়সীর কান্না কি আর প্রেমিক পুরুষের মন সইতে পারে? না তো। সে আলগোছে স্পৃহাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে, “হুস! কাঁদে না আর। তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না আমি কোথায়। আছি তোমার পাশে। তবে, আমার আবদার একটাই কখনো বিশ্বাস হারিয়ে ফেলো না অন্যথায় আমাকেও হারিয়ে ফেলবে তুমি।”
স্পৃহা মাথা নাড়ে। অতঃপর নিবিড়ভাবে মিশে যায় প্রিয়তম মানুষটির আলিঙ্গনে।

প্রকৃতির বুকে এবং মানুষের জীবনে দুই জায়গাতেই বসন্তের প্রভাব নাকি বেশ। জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি বলে বসন্তের মাতাল হাওয়ায় ঘটে৷ সত্যি বোধহয় তাই। জীবনের একুশটি বসন্ত সাদামাটাভাবে কাটিয়ে উঠে বাইশতম বসন্ত যে এত রঙিন,নিস্বর্গ হবে তা কি জানতো স্পর্শী? ফাগুনের আগুনে, মন রাঙিয়ে, মাতাল হাওয়া দোলে অন্ত নেই কোন যুবতীর উচ্ছাসে। সবই প্রেমমোহে সিদ্ধ যেন। চারদিকের আড়ম্বর বাড়াচ্ছে যুবতীর মনের ব্যাকুলতা। সময় কাঁটা গুণতে গুণতে অবশেষে প্রিয় প্রহরের দেখা মিলেছে। অবসান ঘটতে চলছে সকল অপেক্ষার,প্রতীক্ষার।

সর্বোচ্চ গতিতে ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে হাত মেলে বসেছে স্পর্শী। হাত ভর্তি তার মেহেদী। পাশেই কেয়া,নিধি বসে গল্পের আসড় জমিয়েছে। খাটের এক কোণে বসে চোখ বড় বড় তাকিয়ে আছে পার্শিয়া। যেন ঘটনা কিছুই বুঝতে পারছে না সে। চারপাশ প্রচন্ড ব্যস্ত। কোলাহল বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। সন্ধ্যায় হলুদের অনুষ্ঠান আর দু’দিন পর বিয়ে। কাজের অন্ত কি আছে? সামি,মাহিন পর্যন্ত গাধার খাটুনি খাটছে বাহিরে। সোড়গোল বেশি হওয়ায় স্পর্শী অতিষ্ট হয়ে বলে, “নিধি দরজাটা লাগিয়ে দে তো। মাথা ধরে যাচ্ছে আমার।”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪৬

নিধি মাথা নাড়িয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিল। বাহির হতে শব্দ কমে আসলো কিছুটা। সাহেলা কিয়ৎকাল আগেই ট্রে-তে করে জুস আর নাস্তা দিয়ে গিয়েছেন। নিধি সেখান থেকে জুসের গ্লাসটা উঠিয়ে নিয়ে খেতে খেতে বলে, “তা স্পর্শীর তোর অনুভূতি কি রে শুনি? তুই তো এখন অফিশিয়ালি মিসেস হিটলার হতে চলেছিস। ফিলিং সামথিং সামথিং?”

চৈতালি পূর্ণিমা শেষ পর্ব