চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪৫

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪৫
Writer Asfiya Islam Jannat

সময়ের চক্র ঘোরে দ্রুত। চিত্তরঞ্জনকারী ঋতু শরৎ শেষে আগমন ঘটে হেমন্তের। প্রকৃতিতে তখন সৌন্দর্যের জৌলুস নেই, রূপসজ্জার প্রাচুর্য নেই, আছে শুধু কোমলতা। বর্ষার ধারায় সিক্ত পৃথিবী তাপমুক্ত। দিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ার খেলা সৃষ্টি করছে আনন্দের হিল্লোল। নীল অম্বর জুড়ে শুভ্র মেঘমালা। বাতাসের বেগে গাড়ি চলছে আশুলিয়া হাইওয়ে। স্পর্শী সিটে গা হেলিয়ে আর্ট এক্সিবিশনের সময়সূচি আরেকবার দেখে নিল।

শিল্পকলা একাডেমি সাময়িকভাবে তিনদিনের জন্য একটি চিত্রকর্ম প্রদর্শনী আয়োজন করেছে যার মধ্যে তার দু’টি চিত্রাকর্ম নির্বাচিত হয়েছে। প্রদর্শনী আজ দুপুর থেকে শুরু তাই বেলা হতে না হতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে সে।টানা কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন আর্ট এক্সিবিশনে তার চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়ে আসছে। অনুভূতি বিশেষ বলে কিছু নেই।তথাপি কেন জানি আজ তার উচ্ছাস, আনন্দের রেখা বেশ বিস্তৃত। প্রবল মনোযোগের সাথে সময়ের কাঁটা গুনছে মন। ঈপ্সিত ব্যক্তিটির দেখা মিলবে বলেই কি এত অস্থিরতা,ব্যাকুলতা?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কে জানে। স্পর্শী নিজের অনুভূতির জোড়ার শান্ত করতে নেত্রপল্লব বন্ধ করে ক্ষণকাল স্থির হয়ে বসলো। ভাবতে থাকলো তাদের শেষ সাক্ষাৎকারের কথা। ঠিক দুইমাস আগে, কক্সবাজার থেকে আসার সপ্তাহখানেক পরই নির্বাণ বিদায় নিয়ে ঢাকায় শিফট হয়ে যায়। জয়েন করে নতুন চাকরিতে। সেখান থেকেই যোগাযোগ চলে মুঠোফোনে। ধীরে ধীরে কাজের অবকাশ কমে, চরম ব্যস্ততা ঘিরে ধরে মানুষটাকে। কথা বলার সময় হয়ে আসে সংকীর্ণ। কদাচিৎ কৃত্রিম পর্দায় চোখাচোখি হওয়ার সুযোগ মিলে তো মিলে না।

ক্লান্ত থাকে মানুষটা, স্পর্শী বুঝে। তাই নিজের মন আনচান করা সত্ত্বেও নির্বাণ জ্বালাতন করে না বেশি৷ সময়-সুযোগ না হওয়ায় নির্বাণ আসতে পারে না তার সান্নিধ্যে। চলন্ত সময়ে দেখা হয় না একটি বারের জন্যও। তথাপি দূরে থেকে যতটুকু যোগাযোগ হয় নির্বাণ যথাসাধ্য চেষ্টা করে তাকে আগলে রাখার৷ কিন্তু যার দর্শন পেতে তৃষ্ণার্থ আঁখিপল্লব, কথায় কি তৃষ্ণা মিটে? স্পর্শী একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, আর সে-টা পেলেও বটে। আর্ট এক্সিবিশনের বাহানায় ঢাকা আসার জন্য বাসায় মানিয়ে নিল সবাইকে সে। সে সাথে, এক্সিবিশন চলাকালীন সে নির্বাণের সাথে থাকবে বলে জানিয়েও দেয়। নির্বাণের কথা শুনে আপত্তি করে না কেউ। স্পর্শী নিলুফার কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে নির্বাণের বাসার এড্রেস যোগাড় করে নেয়। তবে তাকে বলে রাখে নির্বাণকে যাতে এ বিষয়ে তিনি না জানান। সে ভড়কে দিতে চায় মানুষটাকে। নিলুফা তখন আলগোছে হাসে। তাকে দেখে নির্বাণ রিয়্যাকশন কি হবে তা ভাবতেই উত্তেজনায় স্পর্শী চোখ খুলে বসে। মনের মাঝে চলতে থাকে রাজ্যসম আল্পনা-জল্পনা।

আর্ট এক্সিবিশনের আজ প্রথমদিন হওয়ায় সেখান থেকে বের হতে সময় লেগে গেল একটু বেশি৷ সায়াহ্নের আকাশে সূর্য হেলে পড়েছে প্রায়। স্পর্শী একবার সময়ে নজর বুলিয়ে রিকশা উঠে পড়ে সে। প্রবল আগ্রহ, উন্মাদনা কাজ করতে থাকে মনের মাঝে৷ কিন্তু সে-টা বেশিক্ষণ টিকলো না। প্রত্যেক মোড়ের আঁকেবাঁকে জ্যামের সম্মুখীন হয়ে, অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘতর হতে দেখে বিষাদ,তিক্ত হলো অনুভূতি। বিতৃষ্ণায় মুখ কুঁচকালো সে। আধা ঘন্টার রাস্তা যেখানে সেখানে পাক্কা দুই ঘন্টার বেশি সময় লাগলো। রিকশা যখন গুলশানের চব্বিশ নাম্বার রোডে এসে থামলো, স্বস্তি মিললো যেন তখনই।

সে সময় রাত নয়টা ছুঁইছুঁই। ভাড়া মিটিয়ে নিজের ব্যাগপত্র নিয়ে নেমে পড়ে সে। রাস্তার ধারে হরিদ্রাভ আলো জ্বলছে। যানবাহন শূণ্য পরিবেশ হলেও, জন-মানব শূণ্য নয়। স্পর্শী আশপাশ তাকায়। অ্যাড্রেসটা আরেকবার ভালো মত দেখে নেয় কিন্তু সেটা ঠিক আয়ত্ত করতে না পেরে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুই-এক লোককে জিজ্ঞেস করে অবশেষে সে খুঁজে পায় নিজ গন্তব্যে। সব ততক্ষণ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটে এরপরেই৷ মূল দরজা দিয়ে ঢোকার সময় দারোয়ান আঁটকায় তাকায়। কয় তলা যাবে? কার ফ্ল্যাটে যাবে? তার সাথে সম্পর্ক কি? দারোয়ানের এরূপ শ’খানেক প্রশ্নের বিপরীতে স্পর্শী একবাক্যে উত্তর দেয় আর ভিতরে যেতে চায়। কিন্তু দেয় না সে। সন্দেহপ্রবন দৃষ্টিতে তাকায় সে, “ভাইজান রে পোন দিয়া জিগান লাগবো আফনারে ঢুকবার দিমু কি-না।”

স্পর্শী মেজাজ চটে যায় এবার। সে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে, “আজীব তো! যেখানে আমি বলছি আমি তার ওয়াইফ, সেখানে এত যাচাই-বাছাই এর কি আছে?”
“হেতি আমারে কইয়া রাহে নাই কেউ তার বাইত যাউনের জন্য আইলে হেতিরে ঢুকবার দিতে৷ জিগান তো লাগবোই আমার। আর রাইত-বিরাতে এমনেই কারো ঢুকবার দিবার পারুম না।”
স্পর্শী মুখ কুঁচকায়, “আমি যে আসছি তা জানায়নি, সারপ্রাইজ দিব বলে। তাই আপনাকে কিছু বলেন নি তিনি। বুঝেছেন? এখন যেতে দিন আমায়।”

দারোয়ান পান চিবুতে চিবুতে বলে, “অফেক্ষা করোন লাগব। ভাইজানের অনুমতি ছাড়া যাইবার দিবা পারুম না। আমগোও কিছু নির্দেশ আচে।”
“আচ্ছা জ্বালা তো।”
দারোয়ান স্পর্শী কোন কথা গায়ে না মেখে সোজা নির্বাণের ফোনে ফোন মিলায়। দুইবার রিং হতেই নির্বাণ ফোন ধরে। দারোয়ান বলে, “ভাইজান আফনার লগে একখান মেমসাহেব দেখা করবার আইসে৷ হেতিরে কি উপরে পাঠাইয়া দিমু?”
নির্বাণ ভ্রু কুঁচকায়, “কে এসেছে? নাম জিজ্ঞেস করেন তার, চাচা।”
দারোয়ান আচ্ছা বলে স্পর্শীকে তার জিজ্ঞেস করে, “আফনের নাম কি?”

স্পর্শী আকাশসম বিরক্ত নিয়ে বলে, “স্পর্শী।”
দারোয়ান নামটা বুঝতে না পেরে বলে, “কিডা?”
স্পর্শী এবার গলা উঁচিয়ে বলে, “স্পর্শী!”
নামটা দারোয়ানের বোধগম্য হওয়ার পূর্বেই নির্বাণের কর্ণকুহরে কন্ঠস্বর এবং নাম দুইটাই ঝংকার তুললো। মানুষটিকে চিনতে ভুল করলো না এক বিলম্বও। অবাক হলো সে। স্পর্শী এখানে এসেছে? এই প্রহরে? বিশ্বাস হলো না বিষয়টা। হতবিহ্বল, বিমূঢ়তা কাটিয়ে উঠার পূর্বেই সে দ্রুত বলে ওঠে, “চাচা, ওকে দাঁড় করান আমি আসছি।”
কথাটা বলেই নির্বাণ ফোন কাটে। দারোয়ান আড়চোখে তাকিয়ে বলে, “ভাইজান কইসে আফনারে দাঁড়াইতে। হেতি আইতাসে।”

কথার বিপরীতে স্পর্শী দাঁতে দাঁত চেপে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। সুন্দর এক সাজানো-গোছানো পরিকল্পনায় আগুণ লাগিয়ে দিয়ে বেটা কি নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বলছে, ‘সে আসছে।’ মনটা চাচ্ছে তাকে এখনই, এই মুহূর্তে জীবন্ত কবর দিয়ে ফেলতে। তার সারাদিনের কষ্ট এভাবে পানিতে ভাসিয়ে দিল লোকটা? ভীষণ কান্না পায় তার। মানুষটা আশ্চর্যান্বিত চেহেরা দেখার জন্য কতটাই না উৎফুল্ল ছিল সে। এখন তো সব গুড়ের বালি। শুধুমাত্র এই দারোয়ানটার জন্যে। স্পর্শী পারছে না তো কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। নিজের রাগ দমন করে স্পর্শী তপ্তশ্বাস ছাড়ে। ক্ষণকালের মধ্যে নির্বাণ এসে হাজির হয় নিচে।

স্পর্শী তাকায় সেদিক। কাঙ্ক্ষিত মানুষটার ঝলক পেতেই যেন মরুর বুকে নামে এক পশলা বৃষ্টি। তৃষ্ণার্থ নয়নের আশ মিটে। পড়নে নির্বাণের বাদামি টি-শার্ট, ব্লু ট্রাউজার। সিক্ত চুলগুলো অবিন্যস্ত রূপে ছড়িয়ে আছে তার ললাট জুড়ে। বুঝতে দেরি নেই, মানুষ বাসায় এসেছে বেশি সময় হয়নি। ফ্রেশ হয়েছিল সবে, এর মাঝেই কাহিনী যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।
নির্বাণ স্পর্শীর সামনে এসে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এখানে কি করছো? আর তুমি যে আসবে আমাকে আগে জানাও নি কেন?”
স্পর্শী দারোয়ানটা দিকে অগ্নিদীপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “কাউকে সারপ্রাইজ দেওয়ার প্ল্যান ছিল কিন্তু কিছু মানুষের মাতব্বরির জন্য সেটা আর হয়ে উঠলো না।”

নির্বাণ একপলক স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে দারোয়ানের দিকে তাকায়। বুঝতে দেরি নেই কাহিনী আসলে কি। নির্বাণ ফাঁকা কাশি দিয়ে বলে, “আচ্ছা তুমি আসো আমার সাথে।”
কথাটা বলে সে স্পর্শী কাছে গিয়ে ওর হাত থেকে ছোট কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে নেয়৷ একহাতে ব্যাগ ও অন্যহাতের মুঠোয় স্পর্শী বাহু ধরে নির্বাণ দারোয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে, “চাচা, ও আমার স্ত্রী। চিনে রাখুন, পরেরবার থেকে ওকে আটকাবেন না আর।”

দারোয়ান মাথায় নাড়ায়, “আইচ্ছা।”
নির্বাণ চলে আসে সেখান থেকে। লিফটে ঢুকে বাটন চাপে। স্পর্শী একপাশে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে৷ রা নেই তার মুখে। বিশ্রি এক অনুভূতির সম্মেলন চলছে চিত্তের দুয়ারে। নির্বাণও নীরব থেকে স্পর্শী দিকে তাকিয়ে। বাহির থেকে অভিব্যক্তি তার বেশ শান্ত দেখালেও ভিতরে ভিতরে তখনও ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠতে পারে নি সে। মেয়েটা এতদূর থেকে এসেছে কি শুধুমাত্র ওর সাথে দেখা করবে বলে? ভড়কে দিবে এই আশায়? ঠোঁটের কোণে ফুটে মিহি রেখা। লিফট ফিফ্থ ফ্লোরে এসে থামে। নির্বাণ আগে বের হয়, পিছে স্পর্শী৷ নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে নির্বাণ স্পর্শীকে আগে ভিতরে যাওয়ার জন্য রাস্তা দেয়। স্পর্শী বাসার ভিতর ঢুকতেই নির্বাণও ঢুকে। ব্যাগগুলো নিয়ে সোজা শয়নকক্ষের দিকে চলে যায়৷ ব্যাগগুলো একসাইডে রেখে বলে, “তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও আগে।যাও!”

স্পর্শী মাথায় দুলায়। নির্বাণের স্বভাব সম্পর্কে সে পূর্ণরূপে অবগত। নোংরা অবস্থা সে কখনোই স্পর্শীকে ক্ষান্ত হয়ে বসতে দিবে না। যতক্ষণ না সে ফ্রেশ হয়ে আসছে নির্বাণ ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকবে। এত শুচিবাই লোকটা। স্পর্শী ব্যাগ থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়তে নির্বাণ রুম থেকে বেরিয়ে যায়৷

ফ্রেশ হয়ে এসে স্পর্শী শয়নকক্ষ থেকে বের হয়ে সামনের রুমে আসে। চারদিকে চোখ বুলায় সে। দুইরুমের ফুললি ফার্নিশড ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে নির্বাণ। প্রচন্ড সাজানো-গোছানো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ফ্ল্যাটটি। নিত্যদিনের জীবনে প্রয়োজন সকল কিছুই উপস্থিত এখানে৷ আসবাবপত্র থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিকস,থালাবাসন,গৃহসজ্জার সামগ্রী সবই আছে। দেখে বোঝা দায়, নির্বাণ এখানে একা থাকে। যে কেউ এই ফ্ল্যাটে আসলে এটাই ভাববে নির্বাণ তার সপরিবার অথবা বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকে৷ স্পর্শীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ পুনরায় রুমে এসে মুঠোফোন বের করে বাসায় ফোন দিয়ে জানিয়ে দেয় সে নির্বাণের সাথে আছে। বাসায় কথা বলে ফোন রাখার পর পরই নির্বাণ একগ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে হাজির হয়৷ গ্লাসটা স্পর্শীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “ক্লান্ত তুমি। এটা খাও ফ্রেশ লাগবে।”

স্পর্শী চোখ পিটপিট করে তাকায়৷ হাতে গ্লাসটা নিয়ে বলে, “থ্যাংক ইউ।”
নির্বাণ হাসে৷ স্টাডির টেবিলের সামনে গিয়ে ল্যাপটপের সাটার অফ করে বলে, “তুমি আসবে আমাকে জানালেই পারলে। তোমাকে এগিয়ে নিয়ে আসতাম আমি।”
স্পর্শী গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে তেঁতো মুখে বলে, “পরিকল্পনা ভিন্ন ছিল। নিচে দারোয়ান না আঁটকালে হয়তো সে-টা কার্যকরীও হতো।”

নির্বাণ স্পর্শীর দিকে এগিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে বলে, “কে বলেছে কার্যকরী হয়নি? হয়েছে তো। যাকে তুমি ভড়কে দিতে চেয়েছিলে সে কিন্তু বেশ ভড়কেছে।”
স্পর্শী ব্যঙ্গার্থে বলে ওঠে, “হ্যাঁ খুব।”
নির্বাণ স্পর্শীর দিকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ঝুঁকে বলে, “কি বিশ্বাস হয় না আমায়? তা তোমাকে এখন বিশ্বাস করাতে কি করতে হবে আমায়? জড়িয়ে ধরব নাকি চুমু খাব? নাকি দুইটোই চলবে?”
স্পর্শী সবে শরবতটা খেয়েছিল৷ নির্বাণের কথা শুনে সে বিষম খেল। নির্বাণ কাছে এসে স্পর্শী পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “আরেহ বাবা আস্তে৷ মজা করছিলাম আমি।”

কিছুটা সময় লাগে স্পর্শীর স্বাভাবিক হতে। তবে হৃদস্পন্দন তার স্বাভাবিক গতি ছাড়িয়ে অস্বাভাবিকভাবে চলতে শুরু করে। মন কেমন করে উঠে যেন। গাল ঢাকা পড়ে রক্তিম চাদরে, “আপনি দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন। নির্লজ্জ লোক একটা৷”
“বউয়ের কাছে নির্লজ্জ হলে সেটা দোষের না।”
স্পর্শী কথা ঘুরানোর জন্য বলে, “বউ বিহীন ভালোই তো চলছে জীবন। আস্ত এক সংসার পেতে বসে আছেন এখানে। আপনাকে দেখে কেউ বলবে আপনি এই বাসায় একা থাকেন?”
নির্বাণ হাসে, “সবাই কি আর ভিতরের খবর জানে নাকি? জানলে নির্ঘাত ধরে বেঁধে আমার আমানত আমার কাছে দিয়ে যেত। তখন কষ্ট পেতে হতো না আমায়।”

স্পর্শী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, “হুহ! যতসব বাজে কথা।”
নির্বাণ স্পর্শীর পাশে বসে, “যাই হোক। এখন বলো ঢাকায় কাজে এসেছ নাকি আমার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে?”
“শিল্পকলায় একটা আর্ট এক্সিবিশনে চলছে। সেখানে আমার আঁকা দুইটা ছবি নির্বাচিত হয়েছে, সে সুবাদে তিনদিন ওই এক্সিবিশন এটেন্ড করতে হবে বলে এসেছি। তবে মূল উদ্দেশ্য এখানে আসাই ছিল।”
শেষের কথাটা স্পর্শী একটু আস্তেই বলে। নির্বাণের কর্ণগোচর হলে সে বলে, “আচ্ছা! তবে পরেরবার এমন পাগলামি করো না৷ রাস্তা-ঘাট নিরাপদ না। আমাকে বল আগে, আমি এগিয়ে নিয়ে আসব নে।”
“আচ্ছা।”
নির্বাণ উঠে দাঁড়ায়, “বুয়া সন্ধ্যায় এসে রেঁধে গিয়েছে, এসো খেয়ে নাও। বাকি কথা পড়ে বলব।”

পরেরদিন এক্সিবিশন থেকে একটু দ্রুত ফিরলো স্পর্শী। উদ্যোগ নিল আজ সে নিজ হাতে নির্বাণের জন্য রান্না করে, তাকে খাওয়াবে। যদিও রান্না-বান্না এবং ঘর গোছানোর জন্য একটা কাজের লোক রাখা আছে। তিনি সকাল আর সন্ধ্যা দুইবেলা এসে কাজ করে যান। তাকে আজ সন্ধ্যায় এসে রেঁধে যেতে মানা করা হয়েছে। স্পর্শী মুখ-হাত ধুয়ে রান্নাঘরে ঢুকে। সে আগেই নিলুফার কাছে ফোন করে নির্বাণের সকল পছন্দ খাবারের নামসমূহ জেনে নিয়েছে। ফলস্বরূপ, সেই অনুযায়ী রান্নার প্রস্তুতি নিল সে।

রান্না যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন ডোরবেল বেজে উঠলো। ঘর্মাক্ত শরীর নিয়েই স্পর্শী ছুটলো গেইটের দিকে। গেইট খুলে নির্বাণকে দেখে বিস্তৃত হাসলো সে। বিপরীতে নির্বাণও হাসে। ঘরে ঢুকে বলে, “এখন আমার আসলেই মনে হচ্ছে আমি সংসার করছি।”

“হয়েছে। যান এখন ফ্রেশ হয়ে আসেন। রান্না প্রায় শেষ আমার।”
নির্বাণ কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “তুমি রান্না করছো?”
“হ্যাঁ!”
“কেন বুয়া আসে নি আজ? সকালে তো আসলো।”
স্পর্শী বলে, “আমি আপনার জন্য নিজ হাতে রাঁধতে চেয়েছিলাম তাই তাকে আসতে মানা করেছি।”
“শুধু শুধু পাগলামি করো তুমি।”
“জামাই আমার, রান্না আমার, পাগলামিও আমার। আপনার কি, হ্যাঁ? যান এখন, ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
স্পর্শীর শাণিত কন্ঠ শুনে নির্বাণ নীরব বনে যায়। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার পানে। অতঃপর বলে, “আচ্ছা। তবে সাবধানে কাজ কর।”

স্পর্শী মাথা নাড়ে। নির্বাণ সেটা দেখে চলে যায় রুমে৷ স্পর্শীও ছুটে রান্নাঘরের দিকে। ভাত চড়িয়েছিল চুলোয়।
ভাত হয়ে গিয়েছে দেখে পানি ফেলতে যায় সে। হাড়িতে ভাতের পাতিল বসানোর সময় অসাবধানতার বশত পাতিল ফুঁসলে গিয়ে ফুটন্ত পানি,ভাত গড়িয়ে পড়ে তার বা হাতে। পাতিল ছুটে যায় নিচে। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো ভাতের দানাগুলো। প্রচন্ড জ্বালা করে উঠে সেই জায়গাটি। তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ভাসে বাতাসে। নির্বাণ তখন সবে বাহিরের জামা ছেড়ে ঘরের পোশাক পরিধান করেছিল মাত্র। স্পর্শীর কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে প্রায় একপ্রকার দৌঁড়ে রান্নাঘরের দিকে আসে সে। উৎকন্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে? চিৎকার ক…”

প্রশ্ন করার পূর্বেই উত্তর পেয়ে যায় সে। দৃষ্টি গিয়ে নিবদ্ধ হয় স্পর্শীর বা হাতের দিকে৷ মেয়েটা প্রদাহে বা হাতটা ধরেই লাফাচ্ছে আর আর্তনাদ করছে। আঁখির কোণে জলের ধারা। পায়ের কাছে পড়ে থাকা পাতিল থেকে ধোঁয়া উড়ছে। মেঝের অবস্থা এক্কেবারে অশোচনীয়।নির্বাণের আর বুঝতে দেরি নেই এখানে হয়েছেটা কি।ধ্বক করে উঠে মানবটির হৃদয়। শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা হয় তার। কোনরকম নিজেকে সামলে আলগোছে সে স্পর্শীর কাছে এসে ওর হাত ধরে সিংকের নিচে ধরে কলটা ছেড়ে দেয়। দহন,যন্ত্রণায় স্পর্শীর কণ্ঠনালি থেকে কাতর ধ্বনি বেরিয়ে আসে আপনা-আপনি। শরীর কাঁপছে তিরতির করে।

নোনাজলের বাঁধ নেই। হাতে ইতিমধ্যে ফোসকা পড়ে গিয়েছে। কালসেটে হয়ে এসেছে ক্ষতস্থানটুকু। দহনক্রিয়া সহ্য করতে না পেরে স্পর্শী কিছুটা নিস্তেজ হয়ে নির্বাণের শরীরের উপর ভড় ছাড়ে। নির্বাণ আগলে নেয় তাকে। পানির নিচে হাতটা ধরে রাখে অনেকক্ষণ যাবৎ। স্পর্শীর তখনও ছটফট করেই চলেছে। আর্তনাদের ধ্বনি স্পষ্ট ভাসছে নির্বাণের শ্রবনেন্দ্রিয়ে গিয়ে লাগে৷ ক্ষত-বিক্ষত হয় বক্ষঃস্থল। আরও বেশ কিছুক্ষণ পানি দেওয়ার পর নির্বাণ স্পর্শীকে রুমে নিয়ে আসে৷ খাটে ঠেস দিয়ে বসিয়ে টুথপেষ্ট নিয়ে আসে সে৷ বাসায় আপাতত কয়েকটা প্যারাসিটামল বাদে ফাস্ট এইড বা মেডিসিন বলতে কিছু নেই। স্পর্শী সান্নিধ্যে বসে নির্বাণ স্পর্শীর হাতটা টেনে ধরে। খুব যত্নে পেষ্টটা লাগিয়ে দিতে থাকে। ব্যথায় স্পর্শী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। জ্বালায় হাত টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে। নির্বাণ সম্পূর্ণ পেস্টটা লাগিয়ে দিয়ে স্পর্শীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম কন্ঠে বলে, “কাঁদে না, কিছু হয়নি। ঠিক হয়ে যাবে একটুপর।”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪৪

স্পর্শী শুনে না। কেঁদেই চলে। মেয়েটার অশ্রু কোনভাবেই সহ্য হয় না মানুষটার। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে যায়। স্পর্শীকে থামাতে না পেরে নির্বাণ ওকে নিজের বুকে চেপে ধরে৷ শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এসময় শান্ত হয় প্রণয়ী নারীটি। নীরস হয় জলধারা। আঁখিপল্লব এক হয়ে আসে নিভৃতে। নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। ম্রিয়মাণ মুখে তাকায় স্পর্শীর বা হাতে। উৎকন্ঠিত হয় মন। বিদীর্ণ হিয়া জলসে যায় মুহূর্তে। নির্বাণ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনে। খুব সন্তর্পণে স্পর্শী ছুঁয়ে দেয় বালিশে৷ এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে কৃষ্ণময়ী নারীটির বিবর্ণ মুখশ্রীর পানে।

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪৬