চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২২

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২২
Writer Asfiya Islam Jannat

বিছানার একপার্শ্বে দেয়ালে মেরুদণ্ড ঠেকিয়ে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে বসে আছে স্পর্শী। দৃষ্টি তার স্থির উড়ন্ত নীলাভ পর্দার দিকে। পর্দার আস্তরণ ভেদ করে এক মুঠো রোদ হামাগুড়ি খাচ্ছে শুভ্র মেঝেতে। নিদ্রাভর নয়নে ভাসছে শ্যামপুরুষের স্নিগ্ধ মুখশ্রী, মনের দুয়ারে বিচরণ করেছে তার সাথে কাটানো স্মৃতি। কিঞ্চিৎ সময় আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা স্মৃতি চারণ হতেই স্পর্শী নিজ অজান্তে হাত ছোঁয়ায় কপালের মধ্যভাগে। মানুষটার অকৃত্রিম স্পর্শ লেগে আছে এইখানে। মুহূর্তে লালাভ রঙটি নিবিড়ে খেলা করে যায় ফুলো দু’টি গাল জুড়ে। হেসে উঠে সে। তবে, ঘটনার আকস্মিকতা তখনও তার মাঝে বিরাজমান। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ বলে উঠে,

— কি রে হাসছিস কেন এইভাবে?
চমকে উঠে স্পর্শী। দরজার ধারে সালেহাকে দেখে অপ্রস্তুত কন্ঠে বলে, “কিছু না এইভাবেই।”
সালেহা সন্দিহান দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে চুলে হাত খোপা করতে করতে বলেন, “নির্বাণের পরিবার কেমন ছিল? আর তাদের ব্যবহার?”
“সব ভালো ছিল মা, চিন্তা কর-না। দেখো, আসার সময় নানাজান আমাকে দু’জোড়া স্বর্ণের চুড়ি দিয়েছেন।”
কথাটা বলে স্পর্শী নিজের দুই হাত সামনের দিকে তুলে ধরে। সালেহা সেটা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন, ঠোঁটের কোণে ফুটে তার তৃপ্তির হাসি। প্রফুল্ল কন্ঠে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ভালো হলেই তো ভালো। তা চুড়ি দুইটা বেশ সুন্দর। সাবধানে রাখিস নিজের কাছে, হারিয়ে ফেলিস না। এখন, খাবার দিয়েছি খেতে আয়।”
স্পর্শী মাথা দোলায়, “আচ্ছা।”
“আর শুন, ব্যাগ থেকে বাসি জামাগুলো নামিয়ে রাখিস। বুয়া আসলে ধুতে দিয়ে দিব।”
“আচ্ছা।”

সালেহা আর কিছু বলেন না, নীরবে রুমটা প্রস্থান করেন। স্পর্শী হাতের কাজটুকু সেড়ে বাহিরে চলে আসে। টেবিলের নিকট আসামাত্র পার্শিয়া উচ্চস্বরে ডাক দিয়ে উঠে। স্পর্শী পার্শিয়ার দিকে তাকানো মাত্র সে দৌড়ে আসে। স্পর্শী মিষ্টি হেসে হাটু গেঁড়ে বসে হাত দু’টো মেলে ধরতে পার্শিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কোলে। স্পর্শী বেশ আদুরে ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে দেয় পার্শিয়ার ধূসর রঙ্গের কেশে। তবে, পার্শিয়ার চেঁচানো থামে না। নিজ ভাষায় যতটুকু সম্ভব অভিযোগ জারি করছে সে। অভিমানী কন্ঠে যেন প্রশ্ন করছে, “আমাকে ফেলে তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? তুমি জানো না আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না? তাহলে আমাকে একা রেখে গেলে কেন?”
স্পর্শী হাসে। নিবিড় বন্ধনে পার্শিয়াকে আবদ্ধ করে আহ্লাদী সুরে পার্শিয়াকে ভুলাতে থাকে। একটা সময় গিয়ে পার্শিয়া শান্ত হয়। মমতাময় পরশ পেতে মাথা হেলিয়ে স্পর্শী বা বাহুতে ঘেষে।

সাঁঝ শেষে আঁধারে আবৃত হয় নীলাভ আকাশ। শুভ্র মেঘ রূপান্তরিত হয় কৃষ্ণবর্ণে। তীব্র অনিলের আনাগোনায় ঝমঝম শব্দ করে উঠে বৃক্ষের দল। সময় নিয়ে ডেকে উঠে মেঘদূত। ঝড় আসার আশঙ্কা। কিন্তু আবহাওয়া নিয়ে যে স্পর্শীর কোন ধ্যাণ নেই। সে নিমগ্ন অন্য কাজে। দীর্ঘ বিরতির পর আজ আবার তার হাতে উঠেছে রঙ-তুলি। গভীর মনে সে আঁকতে ব্যস্ত কারো মুখশ্রী। এই প্রথম প্রচেষ্টা তার। আগে কখনো কারো মুখশ্রী আঁকার ক্ষীণ চেষ্টাও করেনি সে। তবে এইবার কেন করছে কে জানে? টানা তিনঘণ্টা ক্যানভাসে কাঠ পেন্সিলের সুক্ষ্ণ,পুরু আঁচড়ে অর্ধেক স্কেচ সম্পন্ন হয়। ক্লান্তিমাখা নিঃশ্বাস ফেলে নাক অবধি আঁকা স্কেচটির দিকে একমনে তাকায় স্পর্শী। মানবটির মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া চুলগুলো কিছুটা এলোমেলো, চোখের মনিতে দৃঢ়তা,প্রখরতা স্পষ্ট। চোখের নিজে কিঞ্চিৎ খাদ, নাকের দিকে বসন্তের গাঢ় দাগ। প্রতিচ্ছবিটি অর্ধাংশ হলেও পরিস্ফুট নির্দেশ করছে এক ব্যক্তির দিকেই। মানুষটি স্পর্শী বড্ড কাছের। বড্ড!

স্পর্শী হাসে। হঠাৎ সে অনুভব করলো তার মন তীব্রভাবে চাইছে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কন্ঠ শোনার, তার মুখ দর্শন করার। সে যতই অস্বীকার করুক না কেন, নিভৃতে মানুষটা তারও অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তাও বাজে এক অভ্যাসে। কিছু সময় স্পর্শী ভাবলো। ফোন দিবে কি-না, ফোন দিয়ে কি বলবে? ফোন দেওয়া কি ঠিক হবে তার? বুঝে উঠতে পারলো না সে। কিয়ৎক্ষণ অস্থিরচিত্তে কাটিয়ে স্পর্শী উঠে দাঁড়ায়। বিছানার উপর থেকে নোংরা হাতেই ফোনটি মুঠোয় পুরে নিল। ডান হাতের তর্জনীর সাহায্যে কন্ট্রাক্ট লিস্ট স্ক্রোল করলো সে, নির্বাণের নাম্বার স্ক্রিনে রেখে ভাবলো আবার। অতঃপর লম্বা নিঃশ্বাস টেনে ডায়াল করলো নির্বাণের নাম্বারে।

দুপুরে খেয়ে ভাতঘুম দেয় নির্বাণ। সেই ঘুম গিয়ে ভাঙ্গে সন্ধ্যার নামার ঠিক পড়ে। তন্দ্রাঘোর কাঁটামাত্র নির্বাণের মাঝে অদৃশ্য এক ব্যাকুলতা ঘিরে ধরে। মন জুড়ে বিচরণ করে এক কৃষ্ণময়ী নারী আর কিছু অশোভন চিন্তাধারা। যা কি-না পীড়িত করছে নির্বাণের অন্তঃস্থলকে। তবে, ভিতরে ভিতরে সে দগ্ধ হলেও বাহির দিয়ে তার অভিব্যক্তি নিত্যদিনকার মতই শীতল। নিজের অনুভূতি থেকে ছাড় পেতে ব্যস্ততায় নিজেকে নিমজ্জিত করার চেষ্টা করে।

কখনো রুম জুড়ে পায়চারি করে, তো কখনো বুকশেলফ থেকে পছন্দের বইটি বের করে মনোযোগ স্থির করার চেষ্টা করে। কখনো বা ভার্সিটির লেকচার গুছিয়ে, কখনো স্লাইড তৈরি করে৷ কিন্তু সবই যেন আজ বিফলে যাচ্ছে, মন বসছে না কোথাও। উৎকন্ঠা, ব্যগ্র মন কি আর খোরাক মিটা না পর্যন্ত ক্ষান্ত হয়? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সে। মোবাইল হাতে নিতেই আগমন হলো নাহিদের, “কি করছো ভাই?”

নির্বাণ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, “কিছু না। কেন কোন দরকার?”
“খালি যেহেতু আছিস সেহেতু আমার কিছু উপকার করে সোয়াব কামা।”
বিস্তৃত হেসে বললো কথাটা নাহিদ। নির্বাণ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “কি চাই তোর?”
“আমাকে এই ট্রামগুলো বুঝিয়ে দে। আগামাথা কিছু বুঝতাসি না।।”
“কোন বই এইটা?”
“নিউক্লিয়ার ফিক্সিস।”

নির্বাণ মোবাইল পার্শ্বে রেখে নাহিদের কাছ থেকে ফোনটা হাতে নেয়৷ ম্যাথ আর ক্যালকুলেশনে একবার চোখ বুলিয়ে নাহিদকে বুঝিয়ে দিতে শুরু করে। বোঝানোর শেষে নাহিদ বলে উঠে, “তোর এতটুকু মাথায় এত এত থিওরি, ম্যাথ,ইকুয়েশন রাখোস কিভাবে? এত স্টোরেজ আমদানি কোথা থেকে করোস? তোকে দেখলেই আমার ডিপ্রেশন মোড অন হয়ে যায়।”
“কাজ শেষ হলে চোখের সামনে থেকে বিদায় হো।”

নাহিদ ভেংচি কেটে বলে, “দোয়া দিতে চাইসিলাম যে, এক হালি বাচ্চার বাপ হো। কিন্তু তুই ওইটার যোগ্যই না। ইশশ! আমার ভাবীর জীবনটাই গেল তোর সাথে বিয়ে হয়ে। এই জন্যই বলে, একটি ভুল সারাজীবনের কান্না।”
নির্বাণ রোষানল দৃষ্টিতে তাকালো। তা দেখে নাহিদ ভ্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে বলে, “আরেহ আমার ভাইটা কত কিউট,সুইট। একদম শিম্পাঞ্জির মত, ভাবী তোকে পেয়ে খুব লাকি।”

কথাটা বলেই নাহিদ কেটে পড়ে। নাহিদ কেটে পড়তেই নির্বাণের অস্থিরতা দ্বিগুণ। নিজের সাথে প্রায় এক প্রকার যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে ফোন লাগায় স্পর্শীর নাম্বারে। তবে রিং ঢোকা মাত্র অতি মিষ্ট সুরে এক নারী বলে উঠে, “আপনি যে নাম্বারে ফোন করেছেন তা এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার কল করুণ।”

মুহূর্তেই নির্বাণের ভ্রু কুঁচকে গেল। পরপর পাঁচবার কল মিলালো সে। তবে, প্রতিবারই একটি কথা প্রতিধ্বনিত হলো, “কলটি এখন ব্যস্ত আছে।” নির্বাণ বুঝে উঠতে পারলো না স্পর্শী এত কথা বলছেটা কার সাথে? নির্বাণ আরও কয়েকবার ফোন মিলালো কিন্তু ফলাফল সেই আগের ন্যায় রইলো। বিতৃষ্ণায় মুখ ঘুচে এলো নির্বাণের। তীব্র আক্ষেপ নিয়ে কিছু একটা বিরবির করলো। শেষে রাগ সংযত করতে ন পেরে ফোনটা উল্টো করে ফেললো বিছানার উপর। ক্ষণেই ফোনটা চাপ খেয়ে বন্ধ হয়ে গেল। অপরপ্রান্ত হতে কেউ শুনতে পেল “সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না” -এর মত তীক্ত ধ্বনি। অথচ নির্বাণ জানলোই না অপরপ্রান্তে থাকা মানুষটিও দীর্ঘসময় যাবৎ তার নাম্বারেই কল মিলাতে ব্যস্ত ছিল।

ঝাঁজালো বর্ষণের রাত। চারিপাশ আদ্রতায় ঘেরা।
রাস্তার ভাঙা, নিচু অংশে জমে আছে কাঁদা পানি। ঘড়ির কাটা তখন এগারোটা বেজে সাঁইত্রিশের ঘরে পদার্পণ করেছে সবে। স্পর্শী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্ষুব্ধ মনে বৃষ্টিস্নাত পরিবেশ উপভোগ করছিল, ঠিক সে সময় কর্কশ কন্ঠে স্পর্শীর ফোনটা বেজে উঠে। রিংটোন শুনে স্পর্শী বারান্দা থেকে রুমে আসে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে নির্বাণের কল। নির্বাণের নামটি দেখামাত্র অভিমানের পুঞ্জীভূত মেঘ প্রগাঢ়তা পায়। সেসময়, কতবারই না কল করলো সে নির্বাণকে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যস্ত বলছিল তার ফোন, এরপর বন্ধ। উপরন্ত, একটিবারের জন্যও নির্বাণ তাকে কল-ব্যাক করেনি। এই দ্বায়িত্ব তার স্পর্শীর প্রতি?
স্পর্শী ঠিক করলো সে কোনক্রমেই ফোন ধরবে না। মানুষটাও বুঝুক অপেক্ষা জিনিসটা ঠিক কতটা দীর্ঘ এবং কষ্টদায়ক। তবে, কথাটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলো না সে। তৃতীয়বারের মত ফোন বেজে উঠতেই কলটা রিসিভ করলো স্পর্শী। কিছু বলার পূর্বেই কাঠিন্য কন্ঠে নির্বাণ বলে উঠে, “নিচে নামো এখনই। ফাস্ট!”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২১

কথার পৃষ্ঠে কিছু বলার সুযোগ পেল না স্পর্শী। তার আগেই ফোন কেটে গেল। স্পর্শী বিহ্বল, বিচলিত, উৎকন্ঠিত স্তব্ধ হয়ে থাকলো কিয়ৎকাল। অতঃপর বাহিরে না গিয়ে আগে ছুটলো বারান্দার দিকে। সেখান থেকে বাড়ির সামনের রাস্তাটা সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। বারান্দায় এসে স্পর্শী রাস্তার দিকে তাকাতেই দৃষ্টি স্থির হয় কালো রঙের গাড়িটির দিকে। গাড়িটি সে চিনে, বেশ ভালো করেই চিনে। স্পর্শী নিষ্পলক সেদিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তবে, পরমুহূর্তেই রাস্তার ধারে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে তীব্র বর্ষণের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুদ্ধিভ্রষ্ট,বিমূড় প্রায়। নির্বাণ তখন নিবিড়ভাবেই স্পর্শীর বারান্দার দিকে তাকিয়ে ছিল, যার দরুন স্পর্শী ওর দিকে তাকানো মাত্র দৃষ্টি বিনিময় তাদের। ক্ষণেই যেন দুই মরুর বুকে নামে এক পশলা বৃষ্টি। তৃষ্ণা মিটায় অশান্ত মনের। হাতের ইশারায় নির্বাণ পুনরায় স্পর্শীকে নামতে বলে। কিন্তু স্পর্শী তখনও স্থির, তার দৃষ্টি নিবদ্ধ সিক্ত পুরুষের প্রণয়ী অনুভূতি জাগ্রত করা কর্মকাণ্ডে।

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২৩