ছায়াস্পর্শ পর্ব ২৩ (২)

ছায়াস্পর্শ পর্ব ২৩ (২)
জান্নাত চৌধুরী

মাত্রই দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে আরাধ্য। হাতে গায়ের জড়ানো কালো গেঞ্জি ধরা। ঘামাত্বক উদাম শরীরের বুকের উপর কিছুর অস্তিত্ব পেতেই থমকে যায় সে। হাত রাখে ইফরাহর মাথায় শরীরটা অসম্ভব কাপছে মেয়েটার। জড়োসড়ো হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে ‌ আরাধ্যের বুকে। আরাধ্য লম্বায় ৫ দিন ৮ , ইফরাহ কতই বা হবে খুব জোর
৫ ফিট ১। বুকে পড়তেই মাথা ঠেকে যায় ঠিক আরাধ্যের বুকে! ধুকপুকানি বাড়ে, ব্লাড চলাচল অগণিত। নড়ে চড়ে ওঠে ‌ ইফরাহ, পারে তো আরাধ্যের বুকে ঢুকে যায়। আরাধ্য হাতের গেঞ্জি মাটিতে ফেলে একহাতে মোবাইল চেপে অন্য হাত ইফরাহর মাথায় ছুঁয়ে রেখে ডাকে –

“-রক্তকমলিনী”
ভীষণ কাঁপছে ইফরাহ, ব্যাপারটা আমলে এলোনা আরাধ্যর। ঘটেছে কি বোঝেনা সে
ইফরার গলা কাঁপছে , তির তির করছে ঠোঁট। আরাধ্য তাকে স্বাভাবিক করতে বলল – “ ভয় পেয়েছো ?”
নড়াচাড়া করছে না মেয়েটা, তবে ভয়ের কথা কানে আসতে আরো জোরে খামচে ধরে আরাধ্যের পিঠের মাংস। নখ ডেবেছে হয়তো? আরাধ্য বিন্দুমাত্র নড়লো না ডান হাতে ফোনের ফ্লাশ তুলে ঘরে একবার নজর বুলালো ‌
মোম মাটিতে পড়ে নিভে আছে। তেমন সন্দেহ ভাজক কিছু নজরে এলো না। আরাধ্য দম নিল ,হাতের ফোন মুখে চেপে ধরে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল ইফরাহকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আজ মেয়েটা প্রতিরোধ করছে না, কাঁদছে । উফ ‌ এই মেয়ের চোখের পানি ভীষণ পোড়ায় ‌ আরাধ্যকে। বিছানার কাছে এগিয়ে এসে শুইয়ে দেয় ইফরাহকে। কপালের বাচ্চা চুলগুলো সরিয়ে দিতে গেলে বোঝে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক। ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে আরাধ্য দ্রুত কপালে ,গালে, গলায় হাত ছুঁয়ে বলল
-ওরে এত গরম কেন?
ইফরাহর ঠোঁট অসম্ভব কাপছে ! ‌ আরাধ্য তার গালে হাত রেখে ডাকে
“-ইরা ! এই মেয়ে , কখন হলো এসব ? জ্বর বাঁধালে কি করে।”
-দয়া করুন , মেরে ফেলুন আ- আমাকে।

ইফরাহ বিড়বিড় করে ,আরাধ্যে কিছুটা ঝুকে গিয়ে শুনতে চায় সে কথা। তবে কানে আসে না , মাত্রাধিক জ্বর বাড়ছে বিছানা ছেড়ে গোসলখানার দিকে এগিয়ে যায় আরাধ্য। চোখে মুখে পানির ঝাপটা মারে। আয়নায় ‌ প্রতিবিম্ব পড়ছে ,ডান ভ্রুর কাছে লাল কিছু একটা লেগে রয়েছে। আরাধ্য তাকায় আয়না দিকে ,শান্ত মুখে এক পৈশাচিক ছাপ। বাঁকা হাসি, ভীষণ ভয়ঙ্কর লাগছে মুহূর্তটাকে। পাশ হতে সাবান হাতে তুলে ঘষতে থাকে। হাত ধোয়া হতেই উল্টেপাল্টে দেখে।

আজ চোখ কিছু বলছে ,ওই যে বিছানায় শুয়ে থাকা তার বোকা মানবীর নজরে যদি এই হাসি পড়তো‌। তবে তার রহস্য খুঁজতে ঘৃনা জন্মাতো। তখন কি এই লোকটা তা মেনে নিত? খুব নিতো। ভালোবাসা হজমের থেকে ঘৃণার পাত্র হওয়া অনেক সহজ। এটা এক “রক্তের গীতওয়ালা” তৈরি হওয়ার কথা
এক বালতি পানি হাতে ঘরে এলো, বিছানার কাছে ওটাকে রেখে এগিয়ে যায় মাটিতে পড়ে থাকা মোমবাতির কাছে মাটি থেকে ওটা তুলে আবারও আগুন দেয় তাতে। আলমারি থেকে পাতলা এ কাপড় নিয়ে আসে ইফরাহর কাছে। আরাধ্য মেয়েটাকে ধরে কিছুটা সরিয়ে শুইয়ে দেয়।

বালতি হতে পানি ঢালছে তার মাথায় ,বেশ কিছু সময় পানি ঢালার পর তোয়ালে হাতে মুছে দেয় মাথাটা। ইফরাহর ব্লাউজের উপরি ভাগ ভিজে উঠেছে, আরাধ্য একবার তাকালো সেদিকে। ঠোটের ফাক গড়িয়ে একটা চ” সূচক শব্দ বেরিয়ে এলো তার।শুকনো কাপড়ে ইফরাহর গলার পাশ মুছে আরাধ্য এগিয়ে যায় ‌ বেলকনির দিকে সিগারেট জ্বালালো আকাশটা নিকষ কালো। চাঁদ নেই, তারার দেখাও মিলছে কম। আরাধ্য সিগারেট লম্বা এক টান মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছুঁড়ে আকাশ পানে।

দূরের ঘরটায় আলো জ্বলছে ,সেদিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে সিগারেট শেষ না করেই ঘরে ফিরে । ইফরাহর চোখের কোনায় হালকা পানি। আরাধ্য তাকায় , মাথার চুল গুলো একবার টেনে বলে
-তোমার এই পুরুষ নারী লোভী নয় !কোন কালে ছিল না, তবে তোমার কাছে এলে পুরুষত্ব ফিকে মেয়ে।
আজ ইফরাহ আরাধ্যের কথায় উত্তর করল না। যদিও সব সময় চুপ থাকে, যখন মুখ খুলে দু তিনটে তিতা কথা শুনিয়ে ছাড়ে। আরাধ্য বিছানায় ওঠে , জ্বর কমেছে কিনা দেখে নিয়ে দু হাতে জড়িয়ে ইফরাহ কে। উদাম শীতল শরীরে গরম নিশ্বাস ‌ কামনা জাগিয়ে তুলছে, সেদিকে খুব একটা পাত্তা দেয় না দিয়ে দুইএকবার বউয়ের চুলের ফাকে হাত বুলিয়ে ঘুমে পারি দেয়

দিনটা শুক্রবার বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠে ইফরাহ। জ্বর নেমেছে, শরীরে এক অসম্ভব ব্যথা অনুভব হচ্ছে। আবহাওয়া তীব্র প্রখর, গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়ার ছোঁয়া। আরাধ্য ব্রাশ হাতে ছাদের এদিক ওদিক কিছু সময় হেঁটে ঘরে আসে। ইফরাহ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে, আরাধ্য সেদিকে একবার উকি মেরে ঢুকে যায় ফ্রেশ হতে । মিনিট পাঁচেক পর বেরিয়ে আসে। চোখে মুখে পানি, বিছানার কোন হতে তোয়ালে তুলে এগিয়ে যায় বেলকনিতে। ইফরাহ আনমনে-

-জ্বর কমেছে
‌ আরাধ্যের কথা কানে গেছে কিনা ঠিক বোঝা যায় না। মেয়েটা এক মনে তাকিয়ে বাগানের গাছগুলো দেখছে! আরাধ্য ইফরাহর নজর সই একবার তাকিয়ে বলে
-ব্যারামের শরীর আমি ছুঁয়ে দিলে সহ্য হবে তো ?
নজর ঘুড়ায় ইফরাহ , শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে লোকটার দিকে। আরাধ্য হেসে বলল
-ভং ধরেছো কেনো ?
“-রাতে কোথায় ছিলেন, কি করেছেন? খুন করে ফিরেছেন না মারামারি করেছেন।
আরাধ্য ঠোঁট উল্টিয়ে সব প্রশ্ন শুনে বলল-

“দম নাও এবার তো হার্ট ব্লক হবে!”
“-উত্তর করুন”!
“-কিছু করিনি কাজ ছিলো।”
“-মিথ্যা আউড়াচ্ছেন”
কিছু সময় ভাবার মতো করে গাট হয়ে রইল আরাধ্য
“-ঠিক বলেছি কিনা? “
“-বড্ড বুলি ফোটে তোমার মুখে!”
কঠিন হয় ইফরাহর কন্ঠ “‌ প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছেন?
আরাধ্য পুরোদমে অগ্রাহ্য করে মেয়েটার প্রশ্ন। হাতে তোয়ালে কাঁধে রেখে ঘরে ঢুকে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বুজে নিল ইফরাহ। আরাধ্য ঘরে এসে সিগারেট ঠোঁটে চেপে লাইটের খুঁজে চলেছে, এদিক যদি কোথাও না পেয়ে গলা ছাড়ে

-ইরা
ইফরাহ ঘরে আসতেই আরাধ্য কপাল উচিয়ে বলল –
“ম্যাচকাঠি সড়িয়েছো কেন?”
-ছুয়ে দেখিনি।
আরাধ্য অকপটে হাসে – ‌” মিথ্যে বলছো ?
-প্রয়োজন মনে করছি না!
মানে না আরাধ্য জোরপূর্বক হাত বাড়িয়ে চাইলো” ‌ ওটা দাও?
-নেই
“-চাহিদা কি ?”
চমৎকার হাসলো ইফরাহ ফন্দি কাজে দিয়েছে , ‌ ঠোঁট কামড়ে একবার ঢোক গিলে বলল –
-বাড়ি যাব একটু নিয়ে যাবেন?
আরাধ্য সিগারেট আঙ্গুলে চেপে বিছানায় বসে

-এই যে শুরু হইলো চাওয়া পাওয়া —মরণ জালা!
-“স্ত্রীর চাহিদা পূরণ স্বামীর ধর্ম ”
-“এ্যাহ ধর্ম‌ শোনো মেয়ে নারী ততক্ষণ সুন্দর যতক্ষণ এদের দাবি নাই! না হলে এই চেংড়ির দল দাবাইতে দাবাইতে শহীদ বানাই ছেড়ে দেয়।
রসিকতা মোটেও ভালো লাগেনা ইফরাহর ,মুখটায় বিরক্তির ছাপ আরাধ্য ডাকলো
-ইরা
নতুন এক নাম ইফরাহ অবাক হল ,এত সময় খেয়ালে না নিলেও এখন হয়েছে আরাধ্য আবার বলে-
-“এদিকে এসো ,জলদি। ”
এগিয়ে এসে দাঁড়ালো ইফরাহ। আরাধ্য হেচকা টানে কোলের ওপর বসিয়ে নিল তাকে। পেঁচানো চুলগুলো খুলে যেতেই গভীর এক নিঃশ্বাস টেনে মুখ ডুবালো তাতে।

-কবে যেতে চাইছ?
অরাধ্য এলোমেলো চুলে নাক ঘোষে। ইফরাহ অত্যাচার সহ্য করে বলে-
-আজ বিকেলে
মুখ তুলে চায় আরাধ্য ,ডানে বামে একবার করে চোখ ঘুরিয়ে কিছু একটা ভেবে নেয়
-আজ নয় পরে যাবে ক্ষন।
“-কবে ?”
আবার ঘ্রাণ শুকে আরাধ্য। মেয়ের ঘন কালো কেশ হতে মিষ্টি এক সুবাস নির্গত হয়।বড় নিঃশ্বাসে আরো দুবার টেনে বলে-
-“চুলে কি মেখেছো ?”
-কথা পাল্টাবেন না দয়া করে !
“-কাল যেও!

অস্থির মন একটু শান্ত হলো বুঝি ইফরাহর। কিছু সময় অন্যমনস্ক হতেই সুযোগ লুফে নেয় আরাধ্য। ইফরাহর কাঁধে চুল সরিয়ে চুমু এঁকে দেয় তাতে। আরাধ্যের নমনীয় ছোঁয়ায় শরীরের লোম দাঁড়িয়ে ওঠে ‌ইফরাহর ,
মনে এক শীতল হাওয়া বয়ে যায়। আরাধ্য মুখ তুলে হাস্কি সুরে বলে –
-রাতে‌ কি হয়েছিল রক্তকমলিনী? ভয় পেয়েছিলে !
রাতের কথা মনে হতেই বুক কেঁপে ওঠে , আরাধ্যকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে –
-“আপনি খাবেন না?”
অনুসন্ধানী চোখ আরাধ্যের ‌আর্মিতে কয়েক মাস গোয়েন্দা কোর্স করেছিল ,এ চোখের দৃষ্টি বলছে মেয়েটা ভয় পাচ্ছে
আরাধ্য হাসে বাম গালে টোল ফুটেছে। সুন্দর হাসি, ইফরাহ বিরক্ত হয় , ভেনেটির ড্রয়ার হতে লাইটার এনে বাড়িয়ে দেয়। আরাধ্য ঠোঁটে সিগারেট চেপে বলে ওঠে-

-ধরিয়ে দাও।
“-ছিঃ
উচ্চস্বরে হেসে ওঠে আরাধ্য, লাইটার হাতে নিয়ে সিগারেটে আগুন দিয়ে বলে
-টানবে নাকি দেবো, দেই?
-লজ্জা করছে না আপনার এসব বলতে ?
সিগারেট ‌ ফুকিয়ে আঙ্গুলে চেপে ধরে একটু ঘুরিয়ে নেয় আরাধ্য! মুখ ভর্তি ধোঁয়া ফুতে উড়িয়ে ছাড়ে।

বেলা ঘুরিয়ে দুপুরে কাছাকাছি। গ্রামে শোকের ছায়া ভীর জমেছে মাতব্বর বাড়ির উঠানে একটা সাদা লুঙ্গি তার ওপরে গেঞ্জি পরনে। মাটিতে বসে আছে মাতব্বর। নুরজাহান আহাজারি করছে, এক টুকরো সাদা কাপড়ে প্যাচানো একটা মন্ডু রাখা সামনে
জনে জনে মানুষ আসছে কাঁটা মন্ডু দেখতে মাতব্বর ঠায় বসা। মুখে নেই কথা , চোখ জোড়া লাল ।বাপের চোখের সামনে ছেলের কাটা মন্ডু পড়ে রয়েছে। জনে জনে কানাকানি করছে কিছু একটা
রাইসা এসেছে মায়ের সঙ্গে দেখতে। তার মুখেও নিয়েই ভয়ের ছাপ , চোখে মুখে অদ্ভুত এক তৃপ্তি ,ভয়ংকর প্রশান্তি। দুনিয়ার বুক হতে এক জানোয়ার বিদায় নিয়েছে ভাবতেই শুকরিয়া করছে। তবে ব্যতিত হয় নুরজাহানের কষ্টে মায়ের মন। জহুরা বেগম এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াতে চেঁচিয়ে ওঠেন নুরজাহান –
-ও জহুরা , জহুরা , জহুরা রে আমার মানিক নেই। কেডা আমার মানিকরে কাইরা নিল, কেডা আমার বুক খালি করল। আল্লাহ , ওরে আল্লাহ এত নিষ্ঠুর কেন তুমি ? আল্লাহ জানোয়ারের দল আমার মানিকের দেহ কি করছে ও জহুরা।

জহুরা বেগম হু হু করে কাঁদছেন। রাইসার কান্না পায় না , এত আহাজারি যেন মনে ধরে না তার। কিছু সময়ের মধ্যে পুলিশ আসে সকল কে কিছুটা দূরে যেতে বলে। সিল করে দেয় জায়গা তাদের তদন্তের সুবিধার্থে‌। কানে ফোন, চোখে কালো চশমা , পরনে সাদা শার্ট ,কালো প্যান্ট পরা। ফর্সা গড়নের কাব্যের চেহারায় চোখ আটকে যায় রাইসা। লোকটা মাত্রাধিক সুন্দর ! কাটামুণ্ডুর একদম কাছে এসে ‌ ফোন নামায় কাব্য, চোখের কালো চশমা খুলে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে গ্লাভস হাতে মন্ডু নেড়ে ছেড়ে দেখে মাতব্বরের কাছে এসে দাঁড়ায়
মাতব্বর ঠিয় বসা কাব্য বললো-

ছায়াস্পর্শ পর্ব ২৩

-শরীফ জোয়াদ্দার
মাতব্বর দৃষ্টি উচিয়ে তাকালেন , কাব্য ঠোট কামড়ে নিজেকে শান্ত করে নেয় –
আপাতত আমরা “সামিউল জোয়াদ্দার চয়নের” লা শ আই মিন মুন্ডু নিয়ে যাচ্ছি! অবশ্যই সময় করে থানায় আসবেন
মাতব্বর কথা বলে না , কাব্য বুঝে লোকটা শোকাহত সে কথা না বাড়িয়ে ‌লাশের অংশবিশেষ গাড়িতে তুলতে বলে।

ছায়াস্পর্শ পর্ব ২৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here