জঠর পর্ব ২৩ || লেখনীতে তাজরিয়ান খান তানভি

জঠর পর্ব ২৩
লেখনীতে তাজরিয়ান খান তানভি

একটা ছোট্ট গাড়ি নিয়ে খেলছে পিউলী। নিজের হাত দিয়েই সেটাকে মেঝের বুকে ভ্রমন করাচ্ছে। অর্হিতার হাতে পিউলীর শ্রেণি পরীক্ষার পেপার। সেগুলো মনোযোগ সহকারে দেখছে সে। পিউলী হঠাৎ থমকে গিয়ে থমথমে গলায় বলল—
“মামুনি, আমি সুহাস আঙ্কলের কাছে যাই?”
ব্যস্ত থাকায় পিউলীর কথায় ততটা অভিনিবেশ ছিল না অর্হিতার। সে আনমনেই বলল—
“যাও।”
পিউলী হাতে চাঁদ পেল। ব্যস্তসমস্ত হয়ে দরজা খুলেই ছুট লাগালো।

প্রভাতের একনিষ্ঠ বেলা। পূর্বাকাশে উদিত সূর্যের ঝলমলে মিঠে রোদে তপ্ত হচ্ছে ধরণী। সোনাঝরা রোদ নীলাভ আকাশ ছাড়িয়ে মৃত্তিকার বুকে দোল খেলছে। কোলাহল শুরু হয়েছে পরিবেশে। পাশের নারকেল গাছটায় দুটো কাক বসে আছে। তাদের কর্কশ স্বর ভেসে আসছে জানালা ভেদ করে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে চোখের কোণ সংকুচন করে নায়েল। বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে কিছু একটা দেখছে অর্হিতা। ঘড়ির কাটা ছুঁইছে আটটার ঘর। নায়েল তৈরি হচ্ছে অফিসের জন্য। জলপাই রঙা শার্টটা পরে ভ্রূ নাচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে নায়েল—

” এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছেন?”
অর্হিতা চমকে তাকায়। অধর বিস্তৃত হয়। তপ্ত মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টির হাসি। বিছানা থেকে ওঠে আসে। নায়েলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল—
“দেখুন, পিউর ক্লাস টেস্টের খাতা দিয়েছে।”
নায়েল পেপারগুলো হাতে নিল। পেপারের কোণায় মার্কের জায়গাটা চক্ষুগোচর হতেই ফিক করে হেসে ফেলে। অর্হিতা রাগ হয়। নাক ফুলিয়ে বলল—
“হাসছেন কেন?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নায়েল অতি কষ্টে হাসি রোধ করে। তবুও পুরু অধর ভেদ করে হাসির ফোয়ারা যেন সবকিছু বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসবে!
অধরের কোণ চেপে ধরে অর্হিতা। পেপারগুলো খপ করে নিয়ে বলল—
“হাসছেন কেন আপনি?”
“পনেরো নম্বরে পরীক্ষা। একটাতে সাত, একটাতে ছয় আর বাংলাতে পাঁচ! এইগুলো কোনো নাম্বার হলো?”
অর্হিতা প্রতিবাদ করে বলল—
“হবে না কেন? ভালোই করেছে আমার মেয়ে।”
“তাই বলে বাংলায় পাঁচ?”
“তো! ইংলিশ মিডিমায়ে ‘ও’ লেবেলের বাচ্চারাও বাংলা বারো মাসের নাম পারে না। সেখানে আমার মেয়ে ভালোই পেয়েছে।”

নায়েল চোরা হাসে। অর্হিতাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল—
“তাই বলেন। নিহিতা অঙ্কে হান্ড্রেডে এইটি নিয়ে আসত।”
স্বামীর দিকে হেয়ালি দৃষ্টিতে তাকিয়ে অর্হিতার স্বত:স্ফূর্ত উত্তর—
“নির্ঘাত আপনি লাড্ডু নিয়ে আসতেন। বাবার ধারা পেয়েছে মেয়ে।”
নায়েল হাতের বাঁধন শক্ত করে। গেথে যায় তার বক্ষ:স্থলে অর্হিতা। অর্হিতার কপালে নায়েলের উষ্ণ শ্বাসের পতন হচ্ছে। নায়েল হেসে হেসে বলল—

“মোটেও না। ম্যাথে অলওয়েজ টপ করেছি আমি। মাধ্যমিকে পুরো স্কুলে হায়ার ম্যাথে পাঁচ বছরের রেকর্ড ভেঙেছিলাম। পিউর কপাল ভালো না। সম্ভবত তার অরি মামুনির রেকর্ড ভালো না।”
“জি না মি. গিরগিরি। রেকর্ড না করি। তবে পাশ করেছি সবসময়।”
“তাই বলুন। টিটিপি টিচার হলে স্টুডেন্টকে তো ভুগতেই হবে।”
অর্হিতা জিজ্ঞাসু গলায় বলল—
“টিটিপি কী?”
“টেনেটুনে পাশ!
“দুর! ছাড়েন তো।”

অর্হিতার গলদেশে ডুবে যায় নায়েল। ভুলে যাচ্ছে তার অফিসের কথা। দরজায় কড়াঘাত পড়তেই সরব হয় দুজন। নায়েল ধাতস্থ হয়ে ভেজানো দরজা ফাঁক করে চাইতেই কলরবকে দেখল। কলরব কপাল কুঞ্চি করে বলল—
“স্যার, দুইজন লোক এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে।”
নায়েলের মসৃণ চেহারায় চিন্তার ভাবাবেশ ঘটে। কুঞ্চিত ভ্রূজোড়া টানটান করে বলল—
“তুমি তাদের বসতে বলো আমি আসছি।”
“জি, স্যার।”

বসার ঘরের কাউচে বসে আছে সুহাস। তার এক উরুর উপর পা ঝুলিয়ে বসেছে পিউলী। মোবাইলের গেমে নিমগ্ন দৃষ্টি পিউলীর। চাপা উচ্ছ্বাসের সাথে বলল—
” এটাকে মারো আঙ্কল, এটাকে মারো।”
গেমের সাউন্ডের সাথে পিউলীর হাতের তালির সংমিশ্রণ চলছে। দুজন ভদ্রলোক একে অপরের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে আছে। সেদিকে পাত্তা নেই সুহাসের। নায়েল নিচে নেমে আসে। লোকদুটোকে সে আগে কখনো দেখেনি। গোল গোল আঁখিতে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ চলছে আগন্তুক দুজনের। নায়েল সরব গলায় বলল—
“আপনারা কারা?”

তাদের মধ্যে একজন উষ্ণ আলিঙ্গন করল নায়েলকে। ভদ্রলোক অমায়িক হেসে বললেন—
“আমি অ্যাডভোকেট জামিল। আমাকে বিশিষ্ট সমাজসেবী মাহিম হাওলাদার পাঠিয়েছেন।”
পাশের লোকটি মুচকি হেসে বললেন—
“আসসালামু আলাইকুম! আমি মাহিম স্যারের পি.এ।”
অনুপলেই চোয়াল ভারী হলো নায়েলের। বিক্ষিপ্ত গলায় বলল—
” এখানে কেন এসেছেন? মাহিম হাওলাদারকে আমি অফিসে আসতে বলেছি।”
পি.এ সজীব স্মিত হেসে বললেন—

“এইটা তো পারিবারিক ম্যাটার। অফিসে হবে না। উকিল সাহেব, পেপারটা মি. নায়েলকে দেখান।”
নায়েল উদ্বিগ্নতা আর ভয় মিশ্রিত গলায় বলল—
“কীসের পেপার?”
জামিল একটা রিপোর্ট এগিয়ে দিলেন। চট করে ভাবাবেশ ছাড়া তা হাতে নেয় নায়েল। ক্ষণপলেই তড়াক করে ওঠে তার মস্তিষ্ক। শিড়দাঁড়া বেয়ে নেমে যায় এক শীতল স্রোত। গর্জে ওঠে নায়েল।
“এসবের মানে কী? পিউ আমার মেয়ে।”

কথা শেষ করেই ডি.এন. এ. রিপোর্টটা ছিড়ে ছুড়ে ফেলে নায়েল। সুহাসের উরুর উপর থেকে নেমে দাঁড়ায় পিউলী। বাবার উচ্চ কণ্ঠে ভেতর কেঁপে ওঠে তার। ছুটে আসেন নওশাদ সাহেব আর সায়েরা। অর্হিতার কানেও পৌঁছাল সেই রুক্ষ স্বর। তড়িঘড়ি নেমে আসে সে।
সজীব মুক্ত গলায় বলল—
“দেখুন মি. নায়েল, স্যার এমনিতেও প্রচুর ক্ষেপে আছেন আপনার ওপর। তিনি কোনো ঝামেলা করতে চাচ্ছেন না। আপনি রিপোর্ট দেখেছেন, যদিও তার প্রয়োজন নেই। আপনি সত্য জানেন। তাই…।”
নায়েল খপ করে গলা চেপে ধরে সজীবের। দগদগে গলায় বলল—

“তাই কী? তাই কী? পিউ আমার মেয়ে। ওর দিকে হাত বাড়াতে নিষেধ করবি তোর স্যারকে। আমার বোনের মৃত্যুর সাথে ওর সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ। বের হ আমার বাড়ি থেকে। ”
“দেখুন মি. আপনি কিন্তু ভুভভভল করছেন। আমার গায়ে হাত দিয়ে একদম ঠিক করছেন না।”
নায়েল সদর্পে এক চড় বসায় সজীবের গালে। আঁতকে ওঠে উপস্থিত সকলে। পিউলী ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে অর্হিতাকে। সুহাস এগিয়ে এসে ছাড়িয়ে নেয় নায়েলকে। শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলল—

“আরে মিয়া যান তো এখান থেকে। কী না কী নিয়ে এসে বলছে পিউ তার মেয়ে! যা হবে আদালতে হবে। যান এখন এখান থেকে। ও মি. অ্যাডভোকেট, আপনাকে কী আলাদা করে বলতে হবে? না কি বড়ো ভাইয়ের দাবাং চড় একটা আপনার গালও খাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করছে!”
জামিল থতমত গলায় বলল—
“কাজটা একদম ঠিক করেননি আপনারা। মাহিম হাওলাদার কোনো ঝামেলা করতে চাননি। তাই শুধু আমাকে পাঠিয়েছেন সমঝোতার জন্য। কিন্তু আপনারা যে ব্যবহার করেছেন এইবার কেস কোর্টে উঠবে। মনে রাখবেন।”
“আরে ভাই যান তো। এইরকম কোর্ট অনেক দেখেছি।”
নায়েল কোনো কথা বলল না। দপদপিয়ে যাচ্ছে তার মস্তিষ্ক।

নায়েলের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় রক্তের বদলে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুটছে রকেট বেগে। দাঁতে দাঁত নিষ্পেষন করে ভেবে চলছে, কী হয়েছে আর কী হতে চলেছে। নায়েল ঝাঁঝিয়ে উঠে—
“ওর সাহস কী করে হলো? উকিল পাঠিয়েছে! আমার পিউকে কেড়ে নিতে এসেছে! আমি আমার মেয়েকে কোথাও যেতে দেবো না।”

নায়েলের ঘাড়ের রগ বারংবার ফুলে উঠছে তার কণ্ঠস্বর হতে নির্গত উচ্চ বাক্যে। নওশাদ সাহেব ম্লান চোখে চেয়ে আছেন। এ বয়সে এর বেশি তিনি কিছু করতে পারবেন না। সায়েরা স্বামীর পাশে বসে পাংশুটে চেহারায় নায়েলকে দেখছে। অর্হিতা বিচলিত, উদ্বেলিত। দরজার সাথে ঠেস দিয়ে ভাবনাহীন চোখে চেয়ে আছে সুহাস। পকেটে দু’হাত গুঁজে রেখেছে। তার চিত্তে শীতল হাওয়া বইছে। এটাই তো সে চেয়েছে। নায়েলের ঘুম উবে যাবে এবার মাহিমের ভয়ে। মাহিম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত রাজনীতির সাথে। নায়েলকে টক্কর দেওয়া তার চুটকির ব্যাপার।
অর্হিতার ভাবুক মনে এক প্রশ্নের উদয় হয়। পরিস্থিতির কাষ্ঠ অবস্থায় বেখেয়ালি মনেই বলে ফেলে—

“ডি.এন. এ. টেস্টের জন্য তো স্যাম্পলের প্রয়োজন হয়। পিউ তো বাইরে কোথাও যায় না। তাহলে মাহিম হাওলাদার পিউর স্যাম্পল পেল কোথায়?”
চকিতে সকলের বিস্ফোরিত নেত্র নিবদ্ধ হয় অর্হিতার দিকে। সুহাস শঠ হাসে। সে নিরুদ্বেগ। নায়েল হুট করেই বলে উঠে—
“জানি না। আর জানতেও চাই না। আমার মেয়ে কোথাও যাবে না। ও যা করেছে আমার বোনের সাথে তারপরে ও ভাবে কী করে আমি পিউকে ওকে দেবো!
পিউ কোথায়?”
অর্হিতা শান্ত সুরে বলল—

জঠর পর্ব ২২

“ও হৃতির ঘরে। ঘুমিয়ে পড়েছে। আপনাকে চিৎকার করতে দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছে।”
নায়েল কোনো কথা ছাড়াই ওঠে দাঁড়ায়। সুহাস দরজা থেকে আলগা হয়ে বলল—
“আপনি বসুন বড়ো ভাই। আমি পিউকে নিয়ে আসছি। আমার ঘরের অবস্থা দেখে আবার আপনার মাথা না বিগড়ে যায়!”
এই মুহুর্তে এই ধরনের রসিকতা মোটেও পছন্দ হলো না কারো। সুহাস সিঁড়ি বেয়ে নামছে। অসীম খুশি নিয়ে পা ফেলছে মেপে মেপে। সচেতন মনে বিড়বিড় করে বলল—

“তোর কারণে আমি আমার অনাগত সন্তানকে হারিয়েছি। এইবার তুই বুঝবি সন্তান হারানোর দগ্ধ হৃদয়ের জ্বালা। ”
তাচ্ছিল্য হাসে সুহাস। স্বগতোক্তি করে বলল—
“মাহিম হাওলাদার কোনো চুনোপুঁটি নয় আমার মতো যে টাকায় তাকে হারিয়ে দিবি। তোর কলিজায় টান পড়েছে নায়েল আনসারী। এইবার দেখ আসল খেল।”
পিউলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে হৃতি। সুহাস এসেই ব্যস্ত হাতে পিউলীকে উঠিয়ে কাঁধের দিকে মাথা দিয়ে বুকের সাথে ধরে। হৃতি ত্রস্ত গলায় বলল—
“ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”
“পালিয়ে যাচ্ছি না। নায়েল নিতে বলেছে।”
হৃতি শান্ত হয়। অসহায় মুখ করে বলল—

“এ কেমন অশান্তি বলো তো! আজ এত বছর নিজের সন্তানের খোঁজ নিল না। আর এখন এসেই ঝামেলা শুরু করে দিলো? পিউ নায়েলের হৃৎপিন্ড। ওর কিছু হলে নায়েল মরেই যাবে।”
“আমিও তাই চাই।”
চকিতে প্রশস্ত হয় হৃতির চোখ। জোর গলায় বলল—
“কী বললে তুমি?”
“কিছু না।”
হৃতির মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। বেশ কয়েকদিন ধরে সুহাসের ব্যবহার তাকে ভাবাচ্ছে। দিনের বেশিরভাগ সময় বাইরে কাটায়। চলছে কী ওর মাথায়?

জঠর পর্ব ২৪