ঝরা বকুলের গল্প শেষ পর্ব (ক)

ঝরা বকুলের গল্প শেষ পর্ব (ক)
মেহা মেহনাজ

বকুল মা*রা গেছে। তুষারের চাঁদ রাণী পৃথিবীর বুকে আর নেই। অন্তত দুই দিন আগে আসা চিঠিখানা তাই বলে। মোরশেদ এসেছিল, জোর করেছিল বকুলকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বকুল যেতে চায়নি। কেন যাবে না সেই বিষয়ে প্রশ্ন করতে করতে এক পর্যায়ে উঠে আসে তুষারের কথা। বকুল সবকিছু স্বীকার করে নেয়। তুষারকে ভালোবাসার কথা, তুষারের হৃদয়ের কাছে আসার কথা। লোকে শুনে হাসে। ঠাট্টা করে। কেউ কেউ ছিঃ ছিঃ দিলো।

পর পুরুষকে ভালোবাসার কথা সবার সম্মুখে বলে বেড়াচ্ছে! এ কেমন নির্লজ্জ মেয়ে গো? বকুলের মুখ থেমে থাকে না। আর পারে না নিজের ভেতর চেপে রাখতে। যা হয় হোক- যাকে ভালোবাসি তাকে ভালোবাসার কথা বলতে ভয় কী আর? বকুল বলে যায়, বারবার, বারবার- ওর মুখে একটাই শব্দ উচ্চারিত হয়, ”মেঘবালক কে ভালোবাসি!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রহার হয়, শুরু হয় গালাগালি, নির্যাতন, তবুও বকুল শোনে না। অনেকেই বলতে শুরু করে, তুষার আর আসবে না কোনোদিন। সে চলে গিয়েছে। ফুলের মধু খেয়ে ভ্রমর যেমন উড়ে চলে যায়, তুষারও চলে গিয়েছে। মাঝখান থেকে নিজের জীবন টা নষ্ট করতে চলেছে বোকা বকুল। কেউ কেউ তুষার-বকুলের সম্পর্কটাকে এতোটাই নেতিবাচক ইঙ্গিতে নিলো, বকুলের গা গুলিয়ে ওঠে সেসব শুনে। মানুষটা কোনোদিন ওকে নেতিবাচক কারণে স্পর্শ করেনি। কোনোদিন নয়! তার প্রতিটি স্পর্শে মিশে ছিল স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা – এমনকি সম্মানও! সেসব কথা মূর্খ গ্রামবাসীকে বোঝানোর সাধ্যি ওর নেই।

মকবুল আদেশ করলেন, মোরশেদের সাথেই পুনরায় সংসার করার জন্য, বকুল ঠিক তখন আর সইতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়ে দিলো। কেউ আঁটকাতে পারল না। দেখলোই না কেউ। সবাই যখন নানান আলোচনা বাহিরের উঠোনে মত্ত, বকুল তখন দৌড়ে পেছনের পুকুর পাড় হয়ে চলে গেছে পেয়ারা গাছের কাছে। সেই ডালেই গায়ের ওড়না পেঁচিয়ে…..
সবকিছু বিস্তারিত লিখে ফিরতি চিঠি পাঠিয়েছিল গতর তুষারের কাছে। ভাগ্য বুঝি একেই বলে!

শেষতক মন টানেনি বলে এয়ারপোর্ট অবধি গিয়েও তুষার ফিরে এসেছিল। ভারতে জানিয়ে দিয়েছে, সে এই মুহূর্তে মানসিক ভাবে প্রচন্ড বিক্ষিপ্ত মেজাজে রয়েছে। তাই কোনো ভাবেই কোনো কাজে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। এবং এই কারণে সে ভারত যাওয়া স্থগিত করছে। এরপর প্রায় সারা রাত ঢাকা শহরের বিভিন্ন অলিগলি ভূতের মতো ঘুরে বেরিয়েছে সে। একা একা…চাঁদ রাণীর রুহটাকে সঙ্গে নিয়ে।

ভোর বেলায় বাসায় ফিরতেই পরিবারের বাকিদের চক্ষু চড়কগাছ। কিছু প্রশ্ন করার আগেই চেতনা হারিয়ে মেঝেতেই লুটিয়ে পড়ল ও। সেই জ্বর ছাড়লো চারদিন পর। সুস্থ স্বাভাবিক হতেই বাড়ির দারোয়ান একটি চিঠি তুলে দিলো তুষারের হাতে। চিঠির উপরে ঠিকানা দেখে তুষার প্রায় ঝাপিয়ে পড়ে চিঠিটির উপর। মনপুরা থেকে এসেছে। তার চাঁদ রাণীর গ্রাম। নিশ্চয়ই তার চাঁদ রাণী পাঠিয়েছে! কিন্তু চিঠিটি খুলতেই….

এরপর সবকিছু ঝড়ের গতিতে ঘটে গেছে। তুষার তাৎক্ষণিক মনপুরায় আসার জন্য বের হতে চাইলে সেলিনা বেগম ছেলের পথ আঁটকান। কোথায় যাচ্ছে এই অবস্থায় জিজ্ঞেস করলে তুষার জবাবে শুধু বলল, ‘মনপুরায় মা। আমাকে আঁটকে রেখো না। আমি হারিয়ে যাবো।’

সেলিনা অবাক চোখ মেলে ছেলেকে দেখেন। এরকম উদ্ভ্রান্ত এর আগে কক্ষনো হয়নি ও! পেছন থেকে আফজাল হোসেন যখন বললেন, ‘যেতে দাও ওকে..’ এরপর আর আঁটকালেন না তিনি। ছেড়ে দিলেন। যেতে দিলেন। অনেক গুলো প্রশ্ন মনের মধ্যে চেপে রেখে তিনি ছেলের দৌড়ে যাওয়া দেখলেন। কিসের তাড়নায় ছেলে তার এমন পাগল হলো?

গায়ে হাওয়া লাগল। শহরে এখন আর শীত নেই। কিন্তু গ্রামে এসে এই হাওয়ায় শরীর কেমন শিরশির করে ওঠে। তুষার ঈষৎ কেঁপে উঠল। আশেপাশে কোথাও কেউ নেই। সময়টা ঠিক সন্ধ্যের মুখে। সূর্যমামা ডুবি ডুবি। তুষার দাঁড়িয়ে আছে পূবের বিলে। ও পেছন ফিরে তাকাল। ওই যে আম গাছটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। ওর পাশ দিয়ে তৈরি হওয়া সরু রাস্তাটা ধরে গেলেই চাঁদ রাণীর গন্তব্য। এতদূর আসতে গিয়ে যত তাড়াহুড়ো ওর ছিল, এই এখানে এসে সব তাড়াহুড়ো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। আর সামনে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। গিয়ে কি দেখবে? চাঁদ রাণীর সমাধি? তুষার চোখ বন্ধ করে শিউরে উঠল। ওর হাঁটু জোড়া কাঁপে। ঠোঁট ছিঁটকে বেরিয়ে এলো শব্দটা, ‘চাঁদ.. আমার চাঁদ!’

দু’হাতে তড়িঘড়ি করে মুখ ঢাকলো। এতবড় ছেলে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে! লোকে দেখলে কি বলবে? দ্রুততার সঙ্গে চোখ মুছে নেয় ও। সামনে তাকাল। ঝাপসা চোখে চেয়ে রইলো নির্নিমেষ। কি দেখল, কোন দিকে তাকাল, ওর খেয়াল নেই। মস্তিষ্কে তখন স্মৃতির দহন। চাঁদ রাণী প্রথম এ জায়গায় নিয়ে এসেছিল। সেই প্রথম মেয়েটার কাছে যাওয়া, কত গল্প করা, কত কথা বলা! কয়েক মাস ঘুরতে না ঘুরতেই…এই জন্যেই বুঝি মন বড় উচাটন ছিল? চাঁদের রূহই বুঝি আঁটকে ধরেছিল তুষারকে? শেষ দেখা দেখতে চেয়েছিল মেয়েটা? কপালে ওইটুকু…অতটুকুও রইলো না? এতই পোড়া কপালি?

তুষারের চোখের জল চিবুক স্পর্শ করে। কলিজাটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যায়। কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বুকটার ভেতর। চাঁদের আলো ছাড়া এবার কেমন করে মেঘ উড়বে?

সেই দিনের ঘটনা-
মোরশেদের মুখ থেকে এহেন একটি কথা শুনে শাহজাদি এত প্রহারের মাঝেও বিস্ময় নয়ন জোড়া মেলতে সময় নিলো না। সে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে একা একাই আওড়ালো,
“বকুল ম*ইরা গেছে!”
মোরশেদ শাহজাদিকে লাথি মে*রে দূরে ছুঁড়ে ফেলেন। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,

“তুই আমার সাজানো গোছানো জীবনডা তছনছ কইরা দিছোস। তোর কারণে আমার সুন্দর সংসার টা শেষ হইয়া গেছে। তোর কারণে আমার বকুল আর আমার নাই। ওর মনের মধ্যে অন্য জনার বাস। ও খোদা…আমি মনে হয় অনেক বড় পাপ কইরা ফেলছি। এই পাপের কুনু ক্ষমা কি নাই?”

ফোলা মুখ নিয়ে উঠে বসে ও। নিজের ভেতরে থাকা কৌতুহল আঁটকে রাখতে পারে না ও। শারীরিক যন্ত্রণা মাথায় কাজ করে না। মস্তিষ্কে হাজারও প্রশ্নের ভীড়। সেসব জানা যে বড্ড প্রয়োজন!
শাহজাদি ভয় পাশে সরিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে তাই।
“আপনে কি কইতাছেন? আমি বকুলের কিচ্ছু করি নাই। আপনে আমারে একটু খুইলা কন।”
মোরশেদ দাঁতে দাঁত পিষলেন।

“তোর লিগা সব হইছে কুত্তার বাচ্চা। তুই আমার জীবনে আইসা আউল লাগাইছোস। আমার সব তছনছ কইরা দিছোস। তুই আমার চোক্ষের সামনে থেইকা যা। তুই ম*রতে পারোস না?”
“ম*ইরা যামু। এমুন জীবন দিয়া আর করমুই বা কি! কিন্তু আপনে আমারে কন…বকুলের কি হইছে? আল্লাহর দোহাই লাগে..কন..”
“ওরে চুতমা**…”

মোরশেদ ফের একটি লাথিতে শাহজাদিকে উলটে ফেলেন। শাহজাদি দম ছেড়ে দিলো। ওর মুখের ভেতর থেকে র*ক্ত বেরিয়ে আসে। প্রাণ প্রদীপ নিভু নিভু করছে। মিনিট দশেক পর আস্তে আস্তে দম স্বাভাবিক হয়। মোরশেদ ফিরেও তাকান না। আছে না গেছে- সেসবে তিনি ভ্রক্ষেপহীন। তাঁর মনে চলছে বকুলের বলা প্রতিটি কথা এবং প্রতিটি আচরণ! জীবনেও মোরশেদের মুখে তর্ক না করা মেয়েটা হঠাৎ করে কেমন পরিবর্তন হলো। মোরশেদের সামনে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি চিৎকার করে বারবার বলল,

“ভালোবাসি, আমি তারে ভালোবাসি। সে ছাড়া এই বকুলের উপর কারো অধিকার নাই। কেউ হাত ও ছোঁয়াইতে পারবো না। সে আইবো। আইতেই হইবো তার। আমি নাকি হের চাঁদ রাণী। চাঁদ ছাড়া তো রাইত অন্ধকার আর হেয় অন্ধকার ভয় পায়। আমার কাছে আহন ছাড়া তার কুনু উপায় নাই। আর কুনু রাস্তা নাই। তার আইতেই হইবো। আমারে ভাইঙ্গা চুইরা ভালোবাসা শিখাইছে। আমারে ভালোবাসার আগুনে ফালাইয়া হেয় কতদিন থাকব? মনের সুতায় টান লাগব না? লাগলেই আইবো। আমি জানি, হেয় আইবোই…”

বকুল হাত-পা ছড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদে আর একা একা বিড়বিড় করে চলে। উপস্থিত জনস্রোত বিস্ময় নিয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। এই প্রথম একটি মেয়েকে ভালোবাসার জন্য এহেন পাগলামি করতে দেখছে সকলেই। মেয়েটি লাজলজ্জা সব ফেলে অবিবাহিত এক যুবকের জন্য অস্থিরতা প্রকাশ করছে। এহেন দৃশ্য এই জামানায় বিরল। কেউ কেউ তো বলেই বসল, ‘কিয়ামত আইয়া পড়ছে। এডি সব কিয়ামতের লক্ষণ।’
এ কথা শুনে বকুল বিড়বিড় করে আওড়ালো,

“হ, কিয়ামতের লক্ষণ। আমার রুহ টাইনা নিয়া গেছে। রুহ ছাড়া মানুষ বাঁচে না। আমিও বাঁচুম না। তারে আইতে কও তোমরা। নাইলে সত্যি সত্যি কিয়ামত হইয়া যাইবো।”
বকুল কেমন পাগলের মতো আচরণ শুরু করল। তার অদ্ভুত কথাবার্তা অসংলগ্ন আচরণ দেখে কেউ কেউ বলল, ‘মাইয়ারে জ্বিনে ধরছে।’

কেউ কেউ বলল, ‘ওরে ঘরে নিয়া যাও। মাতা আউলাইয়া গেছে। একটু ঘুমাইলে..’
মোরশেদ বকুলকে ধরে মাটি থেকে উঠানোর জন্য এগোলে বকুল সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে উঠে। বলে,
“খবরদার! তুই আমারে ছুঁবি না। একদম ছুঁবি না। তোর আমারে ধরার কুনু অধিকার নাই। যখন তোর ছিলাম তখন খালি মনে কষ্ট দিছোস। শরীরে ব্যথা দিছোস। ভালোবাসার নাম কইরা আমারে ছিঁড়া খাইছোস।

আমার দেহডাই তোর কাছে সব ছিল, আমি কিচ্ছু ছিলাম না। হেয় দেহ দিয়াও তোরে রাখতে পারি নাই। শত জায়গায় মুখ দিয়া বেড়াইছোস। শেষে আরেকটারে ঘরেই তুইলা আনছোস। আমার চোখের সামনে আমার বিছানায় আরেক মাইয়া তোর আদরের ভাগ পায়। তুই কি মনে করছোস, আমি সব ভুইলা গেছি? এডি সহ্য করা খুব সোজা? তাইলে সহ্য কর। আমি আরেক বেডার লগে সংসার করমু, আর তুই দেখবি। আমি মইরা যামু তাও তোর লগে যামু না। তুই আমার কিচ্ছু না। তোরে আমি ভালোবাসি না। যে শিখাইছে, ভালোবাসা কি- আমার তারে লাগব। সে আইলে বাঁচুম, নাইলে মইরা যামু। তারে ছাড়া মরতে আমার প্রাণ কাঁপবো না তয় তারে ছাড়া বাঁচতে আমার দম আঁটকায় যাইবো। আমি…আমি তারে…”

বকুলের কথা জড়িয়ে যায়। সে ধপ করে মাটির উপর লুটিয়ে পড়ে। চেতনা শক্তি হারালো। কয়েক জন ছুটে এসে বকুলকে কোলে তুলে নিলো। মকবুলের আদেশে ঘরের ভেতর নিয়ে যাওয়া হলো ওকে। বাকিরা সব স্তব্ধ, চুপ! বিশেষ করে মোরশেদ। বকুলের এত জেদ! ও আগে কক্ষনো দেখেনি। ভালোবাসা- এই জিনিসটা আসলে কি? কী এমন বস্তু যার কারণে শান্ত নদীও ভেঙেচুরে দেওয়া জলোচ্ছ্বাস হয়ে উঠে? কি এমন জিনিস যার টানে ভীত মানুষও সাহসী হয়ে উঠে?

কি এমন জিনিস যাকে আঁকড়ে ধরে মানুষ মৃত্যুকেও গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করে না। ভালোবাসা- তুমি আসলেই এক সাংঘাতিক জিনিস, সাংঘাতিক নেশার নাম। পৃথিবীর সব নেশা ছাড়ানোর ওষুধ রয়েছে,তোমায় ছাড়ানোর ওষুধ বুঝি তুমি নিজেই!

এরপর মোরশেদ কে খালি হাতেই ফিরে আসতে হলো। এছাড়া আর উপায় ছিল না। সে বুঝে গিয়েছিল, মানুষ রাগ করলে সে রাগ ভাঙানো যায়, অভিমান করলেও কোথাও না কোথাও একটা সুযোগ থাকে। কিন্তু যদি কাউকে ভেঙেচুরে ভালোবাসে,তাহলে তাকে আর কোনো শিকলেই নিজের আকাশে টানা যায় না। খাঁচায় আঁটকালেও সে ছটফট করতে থাকে। হয় খাঁচা ভাঙে আর নাহয় খাঁচার ভেতর ম*রে।

যদি না শাহজাদি ওর জীবনে আসতো, এতকিছু হতোই না! শাহজাদির সাথে পরিচয় হয়েছিল বাজারের ভেতর। আগে থেকেই চিনতো, তবে জানতো কম। ভেবেছিল সাধারণ ঘরের মেয়ে। পরে জানলো, দেহ ব্যবসায় জড়িত আছে। খারাপ পাড়ায় যাতায়াত করে। একদিন মোরশেদ বিষয়টা সরাসরি ওকে জিজ্ঞেস করলে, শাহজাদি কান্নাকাটি করে বলল, ওর সব আছে। কিন্তু না থাকার মতোই। মেয়ে হয়ে জন্মেছে দেখে বাপ-ভাইয়েরা ওকে বের করে দিয়েছে।

তাদের মেয়ে পছন্দ হয়। তারা শুধু বংশের প্রদীপ বাড়াতে চায়। বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে কোথায় যাবে,কি খাবে? তাই বাধ্য হয়ে এই পথে ঢুকতে হয়েছে। যদি কেউ ওকে ভালোবাসে তাহলে সবকিছু ছেড়ে তার সঙ্গে আজীবন টা কাটিয়ে দিবে ও। শুনে মোরশেদের খারাপ লাগল। মায়া হলো। সেই থেকে শুরু…কথাবার্তা হতে হতে এক ঝড়ের রাতে কাছে আসা হলো। শাহজাদি বিছানায় চমৎকার। একজন পুরুষ কে নিজের দিকে আকর্ষণ করার সব গুণ ওর জানা আছে। তাই মোরশেদকে নিজের দেহে আঁটকাতে ওই এক রাতই যথেষ্ট ছিল। এরপর মোরশেদই আসত। বারবার….

মোরশেদের সম্পদ সম্পর্কে, বাড়িতে আর কোনো ভাই-বোন না থাকা সম্পর্কে সবই জানত ও। তাই নিজেও এগিয়ে চললো স্রোতের টানে। একসময় ধর্মের দোহাই টেনে সম্পর্কটাকে হালাল করার জন্য বলল বিয়ে করতে। মোরশেদ সাতপাঁচ না ভেবে করে ফেললেন। পরে এসে জানতে পেরেছিলেন, শাহজাদির সাতকূলে কেউ নেই। কে ওর বাবা-মা সেই পরিচয়ই ওর জানা নেই। মিথ্যে গল্প ফেঁদেছিল। ওর কাছে আসা পুরুষদের এমনই বোকা বানায় ও।

যাতে মায়ার টানে পড়ে কেউ দুটো টাকা বেশি দেয়! মোরশেদ তো টাকার চাইতেও বেশি কিছু দিয়েছে। নিজের গোটা জীবন! সব জানার পর মোরশেদ মেনে নেন। কি করবে? বিয়ে হয়ে গেছে, সংসার হচ্ছে! আর তো উপায় নেই। কিন্তু এরপর যখন জানল ওর আরেকটি রূপ রয়েছে, তিনি মানতে পারলেন না। একজন ডাইনির সঙ্গে কেইবা সংসার করতে চায়?

মোরশেদের পুনরায় রাগ চাপে। পাশে নেতিয়ে থাকা শাহজাদির শরীরটা দেখলেই ওঁর সমস্ত শরীর রি রি করে উঠে। এই শরীরের দম্ভ মেয়েটার। এই দম্ভ দেখিয়ে সে মোরশেদ কে ফাঁসিয়েছে। মোরশেদের জীবন টা শেষ করে দিয়েছে। মোরশেদ ও ওকে শেষ করে দেবে। একেবারে চিরতরে ওর সব দম্ভ কমিয়ে ছাড়বে… মোরশেদ আশেপাশে কি যেন খুঁজলেন। পেয়েও গেলেন। ঘরের ভেতর কুপি বাতি জ্বলছে। মোরশেদ উদ্ভান্ত্রের ন্যায় ছুটে গেলেন।

কুপি বাতি এবং কেরোসিন নিয়ে এলেন। একটু পরেই শাহজাদির গগণবিদারী চিৎকারে আর কেউ ঘরে টিকতে পারল না। আশেপাশের অনেক মানুষ বেরিয়ে এসে স্তব্ধ হয়ে গেল। জ্বলছে…একটা মানুষ আগুনে জ্বলছে। মানুষ টা আর কেউ নয়, শাহজাদি! ওর গায়ে কেরোসিন তেল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে মোরশেদ। তারপর পালিয়ে না গিয়ে চুপ করে এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখছেন। যেন বড় শান্তির জিনিস! শাহজাদি নিস্তেজ শরীর নিয়ে খুব বেশি নড়াচড়ারও সময় পেল না। তার আগেই ওর শরীরে দাউদাউ করে আগুন ধরল। ও বেশ কয়েকবার চিৎকার দিয়ে থেমে গেল। লুটিয়ে পড়ল উঠোনের মাটিতে। তারপর একবার নড়ল…খুব আস্তে! এরপর শেষ…..

রাত পেরোচ্ছে। চন্দ্র-তারকাহীন ম্লান আকাশ। তুষার আম গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাত দুটো ভাঁজ করা। চোখের জল শুকিয়ে মুখটা শুষ্ক হয়ে উঠেছে। সেই সন্ধ্যে এখানেই আছে ও। ওর চাঁদ রাণীর কবরটা দেখবার সাহস ওর ভেতর নেই। তাই আর আগায়নি। থেমে গিয়েছে। থমকে গিয়েছে। মনপুরায় ছুটে এসে কোনো লাভই হয়নি! না, হয়েছে। তুষারের মন বাড়ি থেকে কেউ একজন বলল, হয়েছে লাভ, একটু হলেও হয়েছে।

এই যে বাতাস…
এই বাতাসও চাঁদ রাণীকে ছুঁয়ে এসে ওকে স্পর্শ করছে। তুষার চোখ বন্ধ করে মুখটার কথা ভাবে। ছোট্ট পানপাতার মতো একটুকরো মুখ, সেই মুখে ডাগর ডাগর দুটি চোখ, সে চোখে এক সমুদ্র গভীরতা, বিষন্নতা। যখন হাসে, মনে হয় পুরো পৃথিবী ওর সাথে হাসছে। যখন কাঁদে,মনে হয় আকাশের মেঘ গুলো ঝরছে। আহ চাঁদ রাণী…শ্যামলা মেয়েটা হঠাৎ করে একজনের কাছে বিশ্ব সুন্দরী হয়ে উঠল!

তুষার বিড়বিড় করে বলল,
“আমি অন্ধকার ভয় করি। তুমি তো জানতে বলো। তবুও আমার আকাশ চির অন্ধকারে ডুবিয়ে চলে গেলে। এখন আর রাস্তা খুঁজে পাবো না পথ চলার। আচ্ছা চাঁদ রাণী, তুমি যেখানে আছো, সেখানে যেতে কত কষ্ট হয়? আমিও চলে আসি? এই পার্থিব কষ্ট সহ্য করার চেয়ে অপার্থিব পৃথিবীতে তোমার সঙ্গে থাকার আনন্দ আমার কাছে বেশি। আমি চলেই আসি?”

তুষার চোখ খুলে তাকাল। হ্যাঁ, এটাই করবে সে। যে জীবনে চাঁদ রাণী নেই, সেই জীবনে তার থেকেও লাভ নেই। অন্ধকারাচ্ছন্ন এক জীবনকে সে সাদরে গ্রহণ করতে পারবে না। তাই মৃত্যু ভালো। মৃত্যুকে গ্রহণ করা সহজ, চাঁদ রাণীর সঙ্গে বিচ্ছেদ কে নয়। তুষার সাতার জানে না। বিলের পানিতে ডুবে গেলেই চাঁদ রাণীকে পাওয়া যাবে। মেয়েটা বোধহয় পানিতেই ডুবে গেছে, যেভাবে আকাশের চাঁদ ডোবে।

তুষার চোখ মুছে নিজেকে শক্ত করল। এক পা দু পা করে এগিয়ে যেতে লাগল বিলের দিকে। ওর একদমই ভয় লাগল না বরং অন্য একটা ব্যাপার মাথার ভেতর কামড়ে খেতে শুরু করল। চাঁদ রাণীকে নিয়ে একটা ছোট্ট সংসার করতে পারবে তো? ওই পাড়ের হিসেবটা কী? ওর যে ভীষণ ইচ্ছে….একটা ছোট্ট সুখের সংসারের!
“আপনে কই যাইতাছেন?”

তুষার থমকে গেল। ওর হৃদপিণ্ড ছলকে ওঠে। বিদ্যুৎ গতিতে পেছন ফিরে তাকাতেই ওর সমস্ত শরীরে শীতল পরশ বয়ে যায়। অন্ধকার চারিদিকে, এতক্ষণ অন্ধকারে থাকতে থাকতে চোখে সয়ে এসেছে। তাই ও স্পষ্ট বুঝল, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি আর কেউ নয়, ওর চাঁদ রাণী…ওর হীরে, রত্ন! ওর চাঁদ!
তুষার এগোতে ভুলে গেল সামনে। দুটি চোখ ছাপিয়ে ফের জলের ফোয়ারা নামে। অস্পষ্টে দম টেনে বিড়বিড় করে, ‘চা…চাঁদ রাণী…’

মুহূর্তেই বকুল ঝাপিয়ে পড়ে। মেঘবালকের উষ্ণ বুকখানায় নিজেকে মুক্ত করে দিলো। মেঘবালক ও জড়িয়ে নিলো ওকে, সাথে সাথেই, যেভাবে চাঁদের গায়ে জড়িয়ে থাকে আকাশের মেঘ…
শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে…
দু’টি প্রাণ এক সুতোয় ফের বাঁধা পড়ল।
বকুলের হৃদয় নিংড়ে গরম জল চোখ বেয়ে নামে। সেই পরিচিত গায়ের ঘ্রাণ….
মানুষটাকে ও এত ভালো কবে বাসলো?
বকুল বলল,

“আপনে আমারে থুইয়া আর যাইয়েন না। এবার গেলে আমি সত্যি সত্যি ম*ইরা যামু।”
তুষারের ভেজা কণ্ঠে আকুতি প্রকাশ পায়,
“এমন কথা কক্ষনো বলো না বোকা মেয়ে। আমি মৃত্যুকে গ্রহণ করতে রাজী, কিন্তু তোমার আমার বিচ্ছেদকে নয়।”
“আল্লাহ সাক্ষী, আমি আপনেরে ভালোবাসি। আপনে ছাড়া পৃথিবীর সব সুখ আমার জন্য হারাম হোক।”
“বোকা মেয়ে! পাগলি মেয়ে!”

“আপনেরে দেখলে চোখে আরাম লাগে। আপনেরে পাইলে মনে হয়, পৃথিবীর সব সুখ সামনে হাজির হইছে। আপনের লগে কথা কইলে লাগে যেন, আমি আর আমার মধ্যে নাই। আপনে আমার রুহ চুরি করছেন। আপনেরে আমি ইহজীবনে ছাড়বো না।”

“পরজীবনে ছাড়বা?”
“ছাড়বো না। ওইখানেও আমি আপনের পিছু নিবো।”
“তুমি আসলেই একটা পাগলি!”
“হ, আপনের পাগলি। শুধুমাত্র আপনের পাগলি মেঘবালক।”

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ২০

[এখানেই শেষ নয়, শেষ পর্ব-খ পরশুদিন আসবে। প্রথম অংশের চিঠিটায় লেখা কথাগুলো নিয়ে আপনাদের প্রশ্ন জেগেছে। আমি পরবর্তী পর্বে সে বিষয়ে বলব।]

ঝরা বকুলের গল্প শেষ পর্ব ( খ )