ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২২

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২২
সাইয়্যারা খান

আদ্রিয়ানের গাড়ি এসে থামলো রোদের বাড়ীর সামনে। অবাক রোদ আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই আদ্রিয়ান কোন ব্যাস্ততা না দেখিয়ে পেছন থেকে একটা ব্যাগ নিজের কাছে নিয়ে ড্রাইভারকে ইশারায় বের হতে বললো।ড্রাইভার বের হতেই আদ্রিয়ান ব্যাগ থেকে ওয়েট টিস্যু নিয়ে রোদের মুখ মুছে দিচ্ছে। কেঁদে কেঁদে মুখ লাল হয়ে হয়েছে। রোদ তখনও বুঝতে অক্ষম আসলে হচ্ছেটা কি। আদ্রিয়ান রোদের চেহারা মুছতে মুছতে বললো,

— মানুষ বাপের বাড়ী থেকে শশুর বাড়ী গেলে কাঁদে আর আমার বউ শশুর বাড়ী থেকে বাপের বাড়ী এলে।
রোদ আদ্রিয়ানের হাত সরিয়ে দিলো। আদ্রিয়ানও বাক্য ব্যায় না করে ব্যাগ থেকে নেড়েচেড়ে কিছু বের করছে। রোদ তাকাতেই আদ্রিয়ান ফেস পাউডার বের করে সুন্দর করে রোদের চেহারায় লাগিয়ে দিলো। রোদ এবার হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— করছেন টা কি?
— করতে তো দাও আগে।
বলেই রোদের ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে দিলো। লাগিয়ে আদ্রিয়ান নিজের দুই ঠোঁট এমন ভাবে মিলালো যেন ও নিজে লিপস্টিক দিয়ে সেটা সেট করছে। রোদ বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে এবার বললো,
— কি করছেন?
— আমি যেমন করলাম এমন করো।

অবুঝের মতো রোদ তাই করলো। রোদের অগোছালো চুলগুলো গুছিয়ে আদ্রিয়ান রোদকে সুন্দর করে ঘোমটা দিয়ে দিলো। রোদ আদ্রিয়ানের ঐ দিনের কিনে দেয়া একসেট লং সুতির লং গাউনই পড়ে ছিলো। এতে আদ্রিয়ানের সুবিধা হলো নাহলে সবাই এখানে সন্দেহ করতো। রোদকে হাতে, গলায়, আঙুলে স্বর্নের কিছু হালকা গয়না পড়িয়ে পরিপাটি করে আদ্রিয়ান বললো,

— পারফেক্ট। একদম নতুন বউ আমার।
— বাহ্ পার্লার খুলেছেন নাকি?
— হুম শুধু মাত্র আপনার জন্য আমার ভালোবাসা।
রোদ অল্পস্বল্প লজ্জা পেল। আদ্রিয়ান মৃদু হেসে বললো,
— চলো ভেতরে।
— আমার কথা শুনলেন না।
— সব শুনবো।

বলে মিশিকে নিয়ে নেমে গেল আদ্রিয়ান। অপরপাশ থেকে রোদ বের হতেই আদ্রিয়ান ওর হাত ধরে ভেতরে ডুকলো। কলিং বেল বাজানোর আগেই রোদ খেয়াল করলো দরজা খোলা। হঠাৎ রুদ্র চিৎকার করে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। বাকিরাও হৈ চৈ শুরু করে দিলো রিতীমত। এদের আচরণ এমন যে ওদের আসারই কথা ছিলো। রোদ এবার ভালোমতো তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে। এই লোক একদম ফিটফাট সদরঘাট হয়ে এসেছে। পাঞ্জাবি পরে একদম নতুন জামাই সেজে এসেছে সাথে মেয়েকেও গুছিয়ে নতুন জামা পড়িয়ে এনেছে। রোদ এবার নিজের দিকে তাকালো। আদ্রিয়ানের বাহুতে খোঁচা দিয়ে বললো,

— এই আপনি আমাকে আগে বলবেন না? নিজে জামাই সেজে দাঁড়িয়ে আছে।
— অনেক বলেছি যে বউ সুন্দর করে রেডি হও কিন্তু তুমি তো শাশুড়ীর আঁচল ধরে বসে ছিলা। তাও তো আমি সাজিয়ে দিলাম কত সুন্দর করে।

বলেই ভেতরে ডুকলো আদ্রিয়ান। রোদ খেয়াল করলো ওরা ডুকার পরপরই দুই জন লোক এতো এতো ফল, মিষ্টি, বাজার ওদের বাসায় ডুকাচ্ছে। এগুলো যে আদ্রিয়ানই এনেছে তা বুঝতে আর বাকি নেই রোদের। কি সাংঘাতিক লোক!এতকিছু করে রোদকে জানানোর ও প্রয়োজন বোধ করে নি।

রোদ মাকে দেখেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। আজ কতদিন পর মাকে কাছে পেয়েছে। আবেগে আপ্লুত হয়ে কেঁদেও ফেললো। মায়ের কান্না দেখে মা পাগল মিশিও কেঁদে উঠলো। রোদের মা ওকে ছেড়ে তারাতাড়ি মিশিকে কোলে তুলে নিলো। আদরে আদরে ভরিয়ে তুললো নাতনিকে। আদ্রিয়ানকে সম্মানের সহিত ভেতরে নেয়া হলো। চাচতো ভাই-বোনরাও হাজির সব। রাদ এসে আদ্রিয়ানের সাথে কোলাকুলি করে বললো,

— আব্বু তো বাসায় নেই আসছে একটু পরই।
— কথা বলেছো ঐ ব্যাপারে?
— এখন না বলাই বেটার মনে করছি।
— আচ্ছা দেখো যেটা ভালো হয়।
ওদের কথার মাঝেই রোদ ভাইয়ের বুলে ঝাপিয়ে পরলো। রাদ পড়ে যেতে নিয়েও সামলে নিলো নিজেকে। দুই হাতে বোনকে জড়িয়ে নিলো। রোদ কিছু বলার আগেই রাদ বললো,
— জানি কি বলবি। এখন শান্ত থাক। পরে কথা হবে এ নিয়ে। মিশি কই?
— আম্মুর কাছে।
রাদ দেখলো ওর মা এখানে নেই। মিশি যে কতজনের কোলে বদলা বদলি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সুন্দর ছিমছাম ছোট্ট পরীটাকে নিয়ে সবাই টানাটানি করছে। রাদ এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে আদর করলো ভাগনীকে। মিশি রাদ আর রুদ্র বাদে এ বাড়ীর কাউকে চিনে না। রাদ ওকে ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখাচ্ছে। রুদ্র পেছনে ঘুরঘুর করছে একবার নেয়ার জন্য। আদ্রিয়ান বেচারাও ভালো নেই। একগাদা শালা-শালী ওকে ঘিরে ধরেছে। ছোট, বড়, মাঝারি,পিচ্চি সব বয়সেরই আছে। এদের দল থেমে নেই একে একে আরো আসছে।
.
বাড়ীতে জামাই এসেছে শুনার পর থেকেই এলাকার লোকজনও আসা শুরু করলো। আদ্রিয়ান পড়লো চরম বিপাকে। এখন ও হারে হারে টের পাচ্ছে রোদের অবস্থা। রোদ ও কেমন আসার পর থেকে কোন পাত্তা নেই এই মেয়ের। কোথায় ডুকে আছে আল্লাহ জানে। অসহায় আদ্রিয়ান ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে সবাইকে সালাম দিয়ে কথা বলছে। এত অস্বস্তি আর কোন দিন হয়েছে কি না সন্দেহ। এই বিপদে আদ্রিয়ানের নিজের বউ এগিয়ে না আসলেও এগিয়ে এলো ওর শাশুড়ী। সবার সাথে ছুটিয়ে নিতে নিতে বললো,

— জামাইয়ের খাবার রেডি। আয় সবাই।
রোদের সব ভাই-বোনরা মিলে দুলাভাইকে জমিয়ে, ডাবিয়ে খাওয়ালো। আদ্রিয়ান অস্থির হয়ে গিয়ে শাশুড়ীকে ডেকে বললো,
— আম্মু আর পারছি না। রোদ আর মিশি কোথায়?
— ওরা রাদের রুমে। খেয়েছে। আচ্ছা তুমি উঠো। রেস্ট নিবে এখন।
বলে সবাইকে তাড়িয়ে দিলো। বললো,
— এখন রেস্ট নিতে দে জামাইকে।
দিশাকে ডেকে বললো,

— যা জামাইকে রোদের রুমে দিয়ে আয়।
দিশা একগাল হেসে বললো,
— চলুন দুলাভাই। এগিয়ে দিয়ে আসি।
আদ্রিয়ান হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দিশার পেছনে হাটা দিলো। রাদের রুম পেড়িয়ে রোদের রুম।পাশাপাশি একদম। দিশা শয়তানি করে রাদের দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। আদ্রিয়ানের নজরে এলো সুন্দর একটা দৃশ্য। রাদের বুকে রোদ মাথা দিয়ে হেলান দিয়ে আছে আর রোদের কোলে রুদ্র মাথা দিয়ে ফুপিয়ে যাচ্ছে। পাশে মিশি রোদের বুকে হেলান দিয়ে বসা। রাদের নাক টানার আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো আদ্রিয়ানের। মিশি মা’য়ের বুকে আরেকটু লেগে বললো,

— মাম্মা মামা কেন কাঁদে?
রুদ্র লজ্জা পেল। বড় হচ্ছে এখন একটু একটু। বোনকে অসম্ভব ভালোবাসে সে। বোনের পিছনে সারাদিন ঘুরা ওর নৈতিক দায়িত্ব ছিলো এতদিন। কতদিন পর আজ বোনের কোলে মাথা রেখেছে। রুদ্র উল্টো হয়ে রোদের কোলে মুখ দিয়ে রাখলো।রোদ হেসে মিশিকে বললো,
— আমার মা যেমন আলিফ ভাইকে মিস করছে তেমনই তোমার মামা মাম্মাকে মিস করে। তাই ভ্যাবাচ্ছে।
রুদ্র মুখ উঁচু করে প্রতিবাদী কন্ঠে বললো,

— আপি আমি ভ্যাবাই না।
— চুপ থাক গাধা। উঠ তো। যা একটা আইসক্রিম খাওয়া।অনেক দিন খাই না।
রুদ্র দৌড়ে বেরিয়ে গেল। বোন এতদিন খাবে বলে কথা। রাদ হেসে কিছু বলবে তখনই দেখলো দিশা আর আদ্রিয়ান দাঁড়িয়ে দরজায়। রাদ হেসে বললো,
— ওখানে কেন ভেতরে আসুন।
আদ্রিয়ান রোদের দিকে তাকিয়ে বললো,

— রোদ একটু রুমে আসলে ভালো হতো রাদ। আসলে আমি চেঞ্জ করব। অসস্তি লাগছে।
রাদ কিছু বলার সুযোগ না দিতেই রোদ ভাইয়ের বুকে লেগে বললো,
— আমি কি অসস্তি কমাতে পারি নাকি?দিশা আপি রুম দেখিয়ে দিবে।
আদ্রিয়ান শক্ত চোখে তাকালো। রাদ জানে রোদ কেন জোয়ালামুখী হয়ে আছে। তাই বোনকে বুক থেকে তুলে বললো,
— এখন যা। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।
রোদ মিশিকে কোলে তুলে বেরিয়ে গেল। দিশা রাদের দিকে শয়তানি হাসি দিয়ে এগুতেই রাদ ওয়ালেট পকেটে ভরতে ভরতে বললো,

— এখন ফাইজলামি দেখার সময় নেই। যাওয়ার আগে আমার বিছানাটা ঝেরে দিয়ে যাস।
বলেই সাইড কেটে চলে গেল রাদ। দিশা চিৎ হয়ে রাদের বিছানায় শুয়ে পরলো। এই ব্যাটা রাদ জানে যে দিশা এখানে শুয়ে পরবে তাই তো আগেই বললো ঝেরে যেতে।

আদ্রিয়ান চেঞ্জ করে রুমে ডুকে বেডে হেলান দিলো। এখন একটু স্বস্তি লাগছে ওর। যেই খাওয়াটা খেলো আজ। মিশিকে তখন তিশা এসে নিয়ে গিয়েছে। রোদ নিজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মন ভরে শ্বাস টেনে নিলো। বারান্দায় লাগানো গাছগুলো পুরো সতেজ। এটা রাদের কাজ রোদ জানে৷ গাছ লাগানো রোদের সখ হলেও গাছে পানি দিতে ওর যত আলসেমি। রাদই ওর লাগানো সব গাছের যত্ন নেয়। রোদের ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে কেউ আলতো করে জড়িয়ে ধরলো রোদকে। শিউরে উঠলো রোদ। আদ্রিয়ান সাওয়ার নিয়ে এসেছে। ঠান্ডা শরীরের সাথে রোদের শরীরটা জড়িয়ে নিতেই ঠান্ডা লাগলো রোদের। পেছনে না ঘুরেই বললো,

— দুই দিন হয় নি জ্বর ভালো হলো। এই বেটাইমে কেন গোসল করলেন?
— গরম লাগছিলো।
— রুমে এসি ছিলো।
— বাপের বাড়ী এসে সাহস বেড়ে গিয়েছে?
— কি করলাম?
— আইসক্রিম যে খেলা টনসিলে ইনফেকশন হলে দেখবা কি করি।
— সত্যিই কি বাসায় যাবেন না?
— যাব।
রোদ ঝট করে পেছনে ঘুরলো। হাত যেয়ে লাগলো আদ্রিয়ানের বুকে। আদ্রিয়ান তা নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
— আমাদের বাসায় যাব। নতুন সংসার হবে আমাদের।
— আমার চাই না নতুন সংসার।
— পরে কথা হবে এ নিয়ে।

“নিজ পায়ে কুড়াল মারা” বা “খাল কেটে কুমির আনা” দুটো কথাই যেন জাইফাকে উৎসর্গ করে বলা হয়েছে। জাইফা রাদকে সেধে সেধে বলে যে ওর মা ই রোদকে অপদস্ত করে। রাদ যেন শুনা মাত্রই রেগে সব ধ্বংস করে দিবে। সোজা সোজা জাইফাকে বলে,
— আজ থেকে কল দিবা না আমায়।
জাইফাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কল কেটে দেয় রাদ। সেই থেকে কেঁদে কেঁটে অস্থির জাইফা। না পেরে রোদকে কল করে সব বলতেই রোদ রাদকে খুঁজতে খুঁজতে ছাঁদে পেলো। ভাইকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। রাদের সমস্ত রাগ যেন নিমিষেই পানি হয়ে গেল। রোদ ভাইকে অনেক কষ্টে মানালো জাইফার ব্যাপারে। এই প্রথম না পেরে রোদের জোরাজুরিতে জাইফাকে নিজে কল করে সরি বলে রাদ।

রোদ একাই ছাদে দাঁড়িয়ে। আকাশে আজ তাঁরা নেই। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। তখনই ছাদে আদ্রিয়ান এলো সাথে নিয়ে এলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। একসময় বৃষ্টির বেগ বাড়লো। ভিজে গেলো দুই মানব-মানবীর দেহ। আদ্রিয়ান ভেজা রোদকে দেখে চরম আকর্ষণ অনুভব করলো। এক হাতে টেনে নিলো রোদকে। দুই জনই তখন গায়ে বৃষ্টির কণা লেপ্টে দাঁড়িয়ে। রোদের মুখ বেয়ে বেয়ে চুয়ে পড়া পানিগুলো আদ্রিয়ানের পৌরষচিত্ত নাড়িয়ে দিলো। সচকিত দৃষ্টি বুলালো আদ্রিয়ান চারপাশে।

আকষ্মিক আদ্রিয়ান নিজের ভেজা ওষ্ঠাধর দ্বারা আঁকড়ে ধরলো রোদের ওষ্ঠাধর। রোদ আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। কোন বাক্য ব্যায় না করে দুই নর-নারী নিজেদের ভালোবাসা বিনিময় করল।
তিন চার ছাদ পরেই রাতুলের বাসা৷ অপ্রত্যাশিত ভাবে এই দৃশ্য নজরে এলো ওর। বৃষ্টির ঠান্ডার মধ্যেও যেন বুকটা ছেত করে উঠলো। দেয়াল ঘেঁষে বসে পরলো নিচে। বৃষ্টির কনাগুলে ভিজিয়ে দিলো রাতুলকে। চোখের পানিগুলো ধুয়ে গেলো বৃষ্টির সাথে।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২১

[ অনেকে বলেন আমার গল্পে সবাই নাকি ঘুমায়। আসলে আমি নিজেই অনেক ঘুম পাগল মানুষ তাই ক্যারেক্টদেরও ঘুম পাড়াতে ভালো লাগে।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২৩