ডার্কসাইড পর্ব ২২
জাবিন ফোরকান
ইতালির লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি— ফ্লুমিচিনো বিমানবন্দর। টার্মিনাল পেরিয়ে ঐতিহাসিক রোমের সড়কে পা রাখতেই দুপাশে দুহাত ছড়িয়ে মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় দীর্ঘ প্রশ্বাস গ্রহণ করলো নিহাদ। ঘাড়ে হাত জড়িয়ে একবার এদিক আরেকবার ওদিক ঘুরিয়ে প্রায় ১২ ঘণ্টা লম্বা ফ্লাইটের ধকল নিয়ন্ত্রণ করলো।গা হাত পা ঝাড়া দিয়েই হাসিমুখে পিছন ঘুরলো।ধীরে ধীরে হেঁটে এগিয়ে আসছে আসমান।হাতে একটি লেদারের হ্যান্ডব্যাগ।নিহাদের লাগেজটাও সেই টেনে আনছে।সম্পূর্ণ অবয়ব আবৃত কালো জ্যাকেট এবং গাবার্ডিনে।
উৎফুল্ল হয়ে ছুটলো নিহাদ।বিস্তৃত হাসি তার ছাড়িয়েছে দুই চোয়াল।শক্তিশালী পুরুষালি দেহের অধিকারী এক সুদর্শন ব্যক্তিকে রীতিমত শিশুর মতন লাফিয়ে লাফিয়ে অপর এক ব্যক্তির নিকট এগোতে দেখে আশেপাশের কিছু মানুষ আপনমনে হাসলো।নাহ,তাদের বিষয়টি হাস্যকর নয় বরং মনোমুগ্ধকর লাগছে।
– আসমান ভাই!
– পরিকে দেখেছ?
আসমানের সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যে নিহাদ থতমত খেয়ে গেল। পরি?ওহ, পুরান ঢাকার এক রাস্তার নেড়ি কুকুরের নাম।মিশনে গিয়ে তাকে দুই বছর আগে ডোবা থেকে উদ্ধার করেছিল আসমান।বর্তমানে এক পশুআবাস কেন্দ্রে রয়েছে।সবার অগোচরে তাকে দেখতে যায় এই অনুভূতিহীন পুরুষটি, আর কেউ অবহিত না হলেও নিহাদ বরাবরই তার জন্য ব্যতিক্রম।পরিকে কয়েকবার দেখেছে সে,গত দুমাস আগে তিনটে বাচ্চাও নাকি দিয়েছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– হঠাৎ পরির কথা কেনো জিজ্ঞেস করছো?
– তোমাকে পরির দুই নম্বর বাচ্চার মতন দেখতে লাগছে তাই।
ফিক করে হেসে উঠে মাথার ধূসররঙা চুলে আঙুল চালালো নিহাদ।আসমানের অপমান তার শরীরের মোটা চামড়ায় গোত্তা খেয়ে ফিরে যায় সর্বদা।বিস্তর হেসে সে শুধালো,
– এইসব হলো স্টাইল ভাই,তুমি বুঝবেনা।
– বুড়ো মানুষের মতন লাগছে।
– উফ্!তুমি আমাকে এত জ্বালাতন করো কেনো?শান্তিতে চুলে একটু কালারও করতে পারবোনা?ইতালি এসেছি,যদি একটা ইটালিয়ান পটিয়ে একলা থেকে দোকলা না হই সমাজে আমার মানসম্মান কিছু থাকবে?
– সম্মানটা ছিল কবে?
– ভাই!
ভ্রু কুঁচকে মুখ বাঁকিয়ে অভিমানের ভঙ ধরলো নিহাদ।তাতে মৃদু হাসির রেখায় আবর্তিত হলো আসমানের অধরজোড়া।মুহূর্তেই গোস্বা ভেঙে তার হাতে নিজের মোবাইল ধরিয়ে নিহাদ ছুটলো, সড়কের প্রান্তে।
– জলদি, ভিডিওটা করে দাও।
অপ্রস্তুত হয়ে পড়া আসমান এক মুহূর্ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে দেখলো স্ক্রিনে কাউন্ট ডাউন চলছে।তাই জলদি ব্যাগ রেখে ফোন ধরলো,ইশারায় নিহাদকে জানালো যে ভিডিও অন হয়েছে।
~সানডে দিলাম শিলাকে, মানডে দিলাম মোনাকে
টুয়েসডে ডেটিং টিনাকে, ওয়েডনেসডে ঐন্দ্রিলাকে
থার্সডে দিলাম রিয়াকে, ফ্রাইডে দিলাম দিয়াকে
স্যাটারডে-টা প্রিয়াকে, দিল তো দিইনি কারওকে~
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ফেললো আসমান।যদিও প্রকাশ হতে দিচ্ছেনা কিন্তু নীরব হাসির দমকে তার হাত মৃদু কাপছে।গানের সঙ্গে নিহাদের নাচটা দেখার মতন।শাহরুখ খানের মতন পোজ দিয়ে এগিয়ে আসছে।
~আমি হলাম রোমিও, লেডিকি*লার রোমিও
পাক্কা প্লেবয় রোমিও, হা ~
অভাবনীয় ঘটনাটি ঘটলো অন্তিম মুহূর্তে।পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ইটালিয়ান তরুণী হঠাৎই ভিডিওর ফ্রেমে ঢুকে পড়ল,নিহাদ বাঁধা তো দিলোই না বরং মেয়েটির হাত চেপে ধরে কাছে টেনে ঘুরিয়ে দিলো।এক হাত কোমরে রেখে ঝুঁকিয়ে শেষ করলো সে ভিডিও।মেয়েটিও যেন বিষয়টিতে ভীষণ মজা পেয়েছে, উৎফুল্ল হয়ে হাসলো।গানের অর্থ সে বুঝেনি তবুও এই কাকতালীয় ঘটনায় অংশগ্রহণ করে তার চেহারায় চাঁদের হাট খুলেছে যেন।
– এই বেলা! [ হেই সুন্দরী ]
– ছাও বেলো! [ হাই হ্যান্ডসাম ]
উভয়ের ইটালিয়ান বাক্য বিনিময়ে জগতের সবথেকে নির্বোধ অভিব্যক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকলো আসমান।দুই আঙ্গুলে ঠোঁট ছুঁয়ে ফ্লাইং কিস উড়িয়ে ফিরে এলো নিহাদ, রমণীও একগাল হেসে ধরলো ভিন্নপথ।আসমানের কাছে পৌঁছে বাঁকা হাসি হাসলো সন্তুষ্ট নিহাদ।
– হাহা, দেখলে এই রোমিওর ক্যালমা? রোমে পা রেখেই ওয়ান উইকেট ডাউন,একেবারে বোল্ড আউট!
– ভারতীয় বাংলা সিনেমা দেখা বন্ধ করো।
– ইশ!কেনো?তোমার বদলে কাউকে গুরু মানি বলে জ্বলে নাকি?শিরায় শিরায় র*ক্ত, নিহাদ দেবের ভক্ত!শেষ থেকে শুরু, দেব নিহাদের গুরু!
– গুরু গেলো পালিয়ে, নিহাদ চড় খেলো ঠাটিয়ে!
এক ধাক্কায় তাকে সামনে থেকে সরিয়ে হনহন করে এগোলো আসমান,নিজেকে তার হাসির পাত্র অনুভূত হচ্ছে।পিছনে নিহাদ উচ্চশব্দে খিলখিল করে হাসতে হাসতে পিছু নিলো তার।গাড়ি বাইরে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো। উভয়ে চড়ে বসতেই পাড়ি জমালো আস্তানার উদ্দেশ্যে।
বিছানায় পরে পরে ম*রার মতন ঘুমুচ্ছে নিহাদ।জেট ল্যাগের ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।তার নিদ্রাভঙ্গ করার প্রচেষ্টা চালালোনা আসমান।একটি ধবধবে সাদা টি শার্ট গায়ে জড়িয়ে তার উপর লেদার জ্যাকেট টেনে চুপচাপ বাইরে বেরিয়ে পড়লো।রোমের দক্ষিণ প্রান্তে তুলনামূলক নির্জন এক স্থানে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে তাদের।একটি ছোট একতলা বাড়ি।আশেপাশে হাত ত্রিশেক দূরে আরো কিছু এমন বাড়ি রয়েছে যার বেশিরভাগই বর্তমানে ফাঁকা পরে আছে।প্রায় শূন্য সড়ক ধরে ধীরে ধীরে এগোতে থাকলো আসমান।নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই, শুধুমাত্র নিজের মস্তিষ্কে ধার দিয়ে চিন্তার জগৎকে পরিব্যাপ্ত করার উদ্দেশ্যে এই গন্তব্যহীন যাত্রা।
অবশেষে মাস পেরিয়ে সে ইতালিতে পৌঁছেই গিয়েছে।এই ঐতিহাসিক খ্যাতিসম্পন্ন রোমের বুকেই অবস্থান করছে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিশনের টার্গেট বিলাল রেমান।নেহায়েত হেলাফেলা করার ব্যক্তিত্ব নয় সে।যথেষ্ট প্রতিপত্তি রয়েছে ইতালি কিংবা বাংলাদেশ জুড়েও।হাতে তথ্য থাকলেও তা যথেষ্ট নয়।আসমানকে নিজে পরিকল্পনা করেই এগোতে হবে, একটু একটু করে। নিহাদকে এই মিশনে যুক্ত করার ইচ্ছা না থাকলেও শেষমেষ ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।ছেলেটির পরীক্ষা শেষ হয়েছে মাত্র দুইদিন আগেই।ভার্সিটির লম্বা ছুটি মিশনের পিছনে ব্যয় করা সম্ভব অনায়াসে।একেবারে একলা আঁধারে হাতড়ে সময় নষ্টের তুলনায় সহযোগিতা গ্রহণ শ্রেয়।নিহাদ অবশ্য সম্পূর্ণ মিশন সম্পর্কে এখনো ভালোমত কিছুই জানেনা।তাকে তার কাজ আসমান বুঝিয়ে দেবে নিজের পরিকল্পনা পোক্ত করার পর।
আবহাওয়া আজ মৃদু মেঘাচ্ছন্ন।বিকালের মুহূর্ত।দিবাকর ধীরে ধীরে হেলে পড়ছে পশ্চিম প্রান্তে।এক গুমোটমাখানো ধূসর আভায় সে সিক্ত করে চলেছে ধরিত্রীকে।নির্জন প্রান্ত পেরিয়ে শহুরে এলাকায় প্রবেশ করায় আশেপাশের বহু প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী নজরে পড়ছে।এই শহরজুড়ে রয়েছে ঐতিহ্য, ইতিহাস, স্থাপত্য, চিত্রকর্ম এবং জাদুঘর।লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির মতন জগৎবিখ্যাত কিংবদন্তির জন্মস্থান যে ইতালি তাকে কিছুটা ঐতিহ্যবাহী বৈচিত্র্যপূর্ণ তো হতেই হয়।আশেপাশে মানুষজন হাঁটছে, একা কিংবা সঙ্গীসমেত। কেউ আপন নীড়ে ফিরছে, কেউ বা শখের পোষাপ্রাণীকে নিয়ে বেরিয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বাদ আস্বাদনে।আসমান নির্বিকার দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখলো সবই।তার মস্তিষ্কজুড়ে বইতে থাকলো চিন্তার ধরপাকড়। বিলাল রেমান পর্যন্ত কিভাবে পৌঁছানো সম্ভব হতে পারে?নিশ্চয়ই নিজেকে এতটাও অনিরাপদ রাখবেন না।কে বি গ্রুপের সঙ্গে পাঙ্গা নিয়েছেন তার অর্থ ভবিষ্যতের ঘটনাবলী নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন।সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতভাবে কিভাবে তার অফিস কিংবা বাড়ি পর্যন্ত…..
“ আপনার কন্ঠস্বর কিন্তু চমৎকার……”
সহসাই থমকে গেলো আসমানের পদক্ষেপ।নিজের জায়গায় বরফখন্ড হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো সে।এটা কি হলো?এত গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার সময় এই কণ্ঠস্বরের অতর্কিত হস্তক্ষেপ মস্তিষ্কে কেনো ঘটলো?অজান্তেই নিজের কান চেপে ধরলো আসমান।কি হয়েছে তার? কবে থেকে এতটা অবাধ্য হলো তার অন্তর?
গুলশানের পাবলিক রেস্টরুমের ঘটনাটির এক মাসেরও অধিক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে।জাপানিজ রিপোর্টার কাইতো হ*ত্যাকা*ণ্ড দেশের অঙ্গনে তোলপাড় চালিয়েছিল,যার ভুক্তভোগী হিসাবে কে বি গ্রুপের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে প্রায় দেউলিয়ার পথে।সবকিছুই চিত্রের মতন স্পষ্ট,কোথাও কোনো ফাঁক ফোকর রাখেনি আসমান।কিন্তু এত যথার্থতার ভিড়েও তার হৃদয়ে অবাঞ্ছিত দাগের ন্যায় রয়ে গিয়েছে এক অপ্রত্যাশিত কথোপকথন।কখনো স্বপ্ন হয়ে,কখনো না অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজের মাঝে, ওই মধুর কন্ঠস্বর বারংবার তাড়িয়ে বেরিয়েছে আসমানকে।আপন চিত্তকে নিয়ে নিজেই প্রশ্ন ছুঁড়েছে সে।এক নারীকন্ঠের প্রতি প্রগাঢ় অনুভূতির পরিণতি কখনোই সুখকর হতে পারেনা।
এক অদেখা অপরিচিতা।শুধুমাত্র কণ্ঠস্বরের জাদুতে কিভাবে সে আচ্ছন্ন করতে পারে পাথর এই হৃদয়কে?এ কেমন অনুভূতি?আসমান তো ভেবেছিল কারো প্রতিই কোনোদিন অনুভূতি সৃষ্টি করা তার অন্তরের পক্ষে সম্ভব নয়।ভাগ্য তাকে এক অনিশ্চিত দোটানায় কেনো ফেললো?
—বেশি ভাবছো আসমান,অতিরিক্ত চিন্তা করছো।অনুভূতি অপ্রয়োজনীয়,দুইদিনের উত্তেজনা।অতঃপর ধ্বংস।
অন্তরের বাণী প্রতিধ্বনিত হয়ে চললো মস্তিষ্কজুড়ে।এসব ভাবার সময় কিংবা প্রয়োজন কোনোটাই নেই তার জীবনে।কয়েক মিনিটের কথোপকথন কখনোই পুনরায় কাকতালীয় সাক্ষাতের উদ্ভব ঘটাতে পারেনা।বাস্তব জীবন এটি, শেক্সপিয়ারের লিখিত ড্রামার প্লট নয়।মাথা ঝেড়ে কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে পুনরায় হাঁটতে থাকলো আসমান।পাশেই একটি পার্ক।ওপাশে একটি মাঝারি আকৃতির লেক প্রবাহমান।হাঁটতে হাঁটতে সরু পথের একদিকে দন্ডায়মান অচেনা প্রজাতির উদ্ভিদ এবং কালো পাথরে তৈরী গ্রীক দেব দেবীদের মূর্তিগুলো নজরে পড়ল তার।মৃদু এক শীতল বায়ু খেলে কিঞ্চিৎ শিহরণ তুললো তার শরীরজুড়ে।
ভাগ্য যেন ভ্রুকুটি করলো আসমানকে।বাস্তব জীবন ড্রামার প্লট নয়,তবে কি ড্রামা বাস্তবতা হতে উৎসাহী নয়?এই জগত বড়ই রহস্যময়।সর্বোচ্চ অসম্ভব ঘটনা এই জগতে অহরহ ঘটে।যার কারণে মানবজাতি এর একটি নাম সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়েছে—কাকতালীয়।
অতর্কিতে কর্ণকুঠরে ভেসে এলো গিটার এবং তালে তালে করতালির মূর্ছনা।অতঃপর,অসম্ভব এক সুরেলা কন্ঠস্বর,
~আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন
দিল ওহি মেরা ফঁস্ গেয়ি
বিনোদ বেণীর জরীন ফিতায়
আন্ধা ইশক্ মেরা কস্ গেয়ি~
মেয়েলী মাধুর্যপূর্ণ কণ্ঠটি যেন সমগ্র অঙ্গজুড়ে প্রশান্তির আবহ ছড়িয়ে দিলো।ইতালির প্রান্তরে নজরুলগীতি,এক নারী গায়িকা,সঙ্গীতের প্রবাহ যেন আসমানের পাথর অন্তরে জোরপূর্বক চির ধরিয়ে প্রবেশ করলো অভ্যন্তরে।অদ্ভুত পরিচিত ঠেকছে এই কন্ঠ।এমন সুধাবর্ষণ আসমানের কর্ণগহ্বরে ওই একবারই হয়েছিল।
ঝট করে ঘুরে গেলো সে। সয়ংক্রিয়ভাবে পদযুগল তাকে নিয়ে চললো সঙ্গীতের উৎসের সন্নিকটে।বিকালের আভায় পার্কের বেঞ্চের আশেপাশে ঘাসে বিছানো ভূমিতে বসে তরঙ্গখেলায় মেতেছে একদল তরুণ তরুণী।সকলের মাঝে নজরকাড়া ঠেকলো একমাত্র বাঙালি রমণীকে।শুভ্র বর্ণের এক শাড়ী পরিহিত অবস্থায় ভূমিতে আঁচল এলিয়ে সঙ্গীতের সুর সৃষ্টিতে মগ্ন সে।দীঘল কুচবরণ কেশ তার পিঠ ছাড়িয়ে ঊর্মিমালার ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে ভূমির আঁচলের উপর। কানে গুঁজে রাখা শুভ্র গোলাপের অংশখানি পিছন থেকেও স্পষ্ট প্রদর্শিত হচ্ছে।দিবাকরের দীপ্তি ছুঁয়ে গিয়েছে তার সর্বাঙ্গ। বায়ু প্রবাহে দুলে চলেছে তার দীঘল কেশরাশি,তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে কণ্ঠের নজরুলগীতির সঙ্গীতশৈলী।
~তোমার কেশের গন্ধে কখন
লুকায়ে আসিলো লোভী আমার মন
বেহুঁশ হো কার্ গিরি পাড়ি হাথ মে
বাজু বন্দ মে বাস্ গেয়ি~
আপন সত্তা সম্পূর্ণ বিলীন হয়েছে আসমানের।পৃথিবীর বুকে যেন এক টুকরো স্বর্গ আপতিত হয়েছে তার।গানের প্রতি কোনো টান তার কোনোকালেই ছিলোনা,কিন্ত এই সঙ্গীত তাকে আবেশিত করে তুলছে প্রচণ্ডভাবে।হৃদয় সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয়েছে এক অনুভূতিপূর্ণ অভিপ্রায়ে।এই কন্ঠস্বর এবং সেই অপরিচিতা…..কেনো বারবার দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে চলেছে তার বেহায়া অন্তর?
শুধুমাত্র আসমানই নয়,বরং পার্কে উপস্থিত অন্যান্য ইটালিয়ান নাগরিকগণও নিজেদের বিলিয়েছে এক বাঙালি রমণীর সুরের মূর্ছনায়।কয়েকজন ভিডিও ধারণ করছে ব্যক্তিগত ফোনে,এক সুখকর মুহূর্তের স্মৃতি হিসাবে।
একটা সময়ে সঙ্গীতের সমাপ্তি ঘটলো,তবুও দূরীভুত হলোনা অন্তরের আবেশ।কয়েক মুহূর্ত নীরবতা।দূরে উড়ন্ত পাখির ঝাঁকের কিচিরমিচির কলকাকলি কানে এলো।অতঃপর করতালিতে উদ্ভাসিত হলো প্রাঙ্গণ।
– স্ত্রাব্রিলিয়ান্তো! [ অসাধারণ ]
সমস্বরে উচ্চারিত হলো ইটালিয়ান শব্দটি।রীতিমত শ্বাসরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো আসমান।বাঙালি রমণী ঘুরে বসেছে।তীব্র বায়ুপ্রবাহ তার কেশ এলোমেলো করে দিলো,হাত দিয়ে তা গুছিয়ে নিতেই চেহারা প্রদর্শিত হলো।তাতে আসমানের হৃদস্পন্দন এক মুহূর্তের জন্য সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়ল।যেন রমণী নয় কোনো স্বর্গীয় দেবীর প্রতি দৃষ্টিপাত করেছে তার নয়নযুগল।
উজ্জ্বল বর্ণে টানা টানা কাজলরেখা খচিত আঁখিজোড়া।ঈষৎ উঁচু নাকের প্রান্তে বক্ররেখায় উদ্ভাসিত অধরযুগল পরিপূর্ণ মুক্তোধারার হাসিতে।চুলে আচ্ছাদিত ললাটের মাঝ বরাবর ছোট্ট একটি কালচে টিপ।অতিরিক্ত কিছুই নেই।কাজল এবং অধরের চকচকে গ্লস ব্যাতিত নেই ভিন্ন কোনো প্রসাধনীর অস্তিত্ব।তবুও অদ্ভুত এক দীপ্তি চেহারাজুড়ে।অদ্ভুত সম্মোহনী ক্ষমতা বিস্তৃত হাসির ফোয়ারায়।দৃষ্টি সরাতে অস্বীকৃতি জানালো হৃদয়।
কতক্ষন চেয়ে ছিল আসমান? জানা নেই।তার সম্বিৎ ফিরলো যখন রমণী এবং তার সঙ্গীগণ ভূমি ছেড়ে উঠলো তখন।এতক্ষণ ধরে এক রমণীর পানে নির্লজ্জ্বভাবে তাকিয়েছিল অনুধাবন করে আসমান দ্রুতই উল্টো ঘুরলো,একটি হাত রাখলো বুকের পা পাশে।ধুকধুক ধ্বনি ভেসে আসছে।কি আশ্চর্য্য!এ কি হৃদস্পন্দন?তার হৃদয় আদও ছিলো কোনোদিন?
মধুর এক সুঘ্রাণ নাকে ঠেকলো।তার থেকে কয়েক হাত দূরের পথ বেয়েই এগিয়ে যাচ্ছে অপরিচিতা,সঙ্গী বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে চলমান রসিক আলাপ।আসমান এক মুহুর্ত দ্বিধা করলো।এগিয়ে অতঃপর পুনরায় পিছিয়ে পড়লো।নিজের পথ দেখার কথা ভাবলো।কিন্তু পরক্ষণেই নিজের দৃষ্টিজুড়ে ভেসে উঠলো এক বর্ণহীন সাদাকালো চিত্র।এক রমণী,তার পরিধানে শুভ্র শাড়ী এবং একই ধরনের দীঘল কালো চুল। চুরিভর্তি দুহাত মেলে কাছে ডাকছে আসমানকে,
“ আমার বাপজান…..আমার আসমান….”
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আসমানের। ঝট করে উল্টো ঘুরে হনহনিয়ে চললো বন্ধু বান্ধবদের দলের নিকট।
– এক্সকিউজ মি!
ঘুরে চাইলো সকলে।মাথা কাত করে তার অবয়বে দৃষ্টির আপতন ঘটালো শাড়ী পরিহিত সুদর্শনা।তার সুগভীর নেত্রমাঝে চেয়ে একটি শক্ত ঢোক গলাধঃকরণ করলো আসমান।স্থির কন্ঠে শুধালো,
– হ্যাভ উই….মেট বিফোর?
রমণী একমুহুর্ত তাকিয়ে থাকলো,ঢেউ খেলানো ভ্রুযুগল তার কুচকে এলো মনোযোগে।নিজের হৃদস্পন্দন নিজেই শুনতে সক্ষম আসমান বর্তমানে।রমণীর অধরে হাসির জোয়ার উঠলো ক্ষণিক বাদেই।
– আই থিঙ্ক উই ডিড।
ডার্কসাইড পর্ব ২১
এগোলো সে,কয়েক পা।আসমানের মুখোমুখি দাঁড়ালো। বায়ুও যেন উন্মাতাল হয়ে উঠলো।উড়ল তার আঁচল,এলোমেলো হলো পাথর মানবের ললাটের চুলগুচ্ছ।তবুও একে অপরের দৃষ্টিমাঝে সম্মোহিত উভয়ে।
– পৃথিবী গোলাকার।তাইনা, মিস্টার ব্রোকেন হার্ট?
মাথা ঝুলিয়ে এক নজর ভূমিতে তাকিয়ে পুনরায় চোখ তুললো আসমান।কোনো ভুল নেই।না তার,না এই রমণীর।
দরজার দুপাশে পিঠ ঠেকানো হতে আজ তাদের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে ভাগ্যদেবতা।
