ডার্কসাইড পর্ব ২২ (২)
জাবিন ফোরকান
– পুরুষ যদি কোনো নারীর মাঝে নিজের মায়ের প্রতিচ্ছবি অনুভব করে তাহলে সে নিশ্চিতভাবে সেই রমণীর প্রতি আকৃষ্ট হবে।
– আজেবাজে কথা।
– সত্যি বলছি আসমান ভাই।আমার কথা নয় এটা, দর্শন এবং মনোবিজ্ঞানের কথা।
– পড়াশুনা করে খুব বুঝদার হয়েছ তুমি?
– তা একটু তো হয়েছিই বলো?হাহা…তুমি এখন বুঝবে না, কারো প্রতি তোমার অনুভূতি নেই তো তাই।কিন্তু আমার কথা মিলিয়ে নিও,একদিন তোমার জীবনেও অনুভূতির আগমন ঘটবে,তোমার হৃদয়ে আবেগের জলোচ্ছ্বাস তুলে আবির্ভূত হবে কোনো অপরিচিতা—
নিহাদের অদূর অতীতের বক্তব্যটি বেপরোয়াভাবে এড়িয়ে গিয়েছিল পাথর অন্তর।কিন্তু সেই পাথরের ফলকে চির ধরিয়ে যেন বর্তমান প্রমাণ করছে জগৎ কতই না বিচিত্রময় হওয়া সম্ভব!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইটালিয়ান ভাষার কথোপকথন এবং ক্রকারিজের টুংটাং ধ্বনিতে পরিপূর্ণ সম্পূর্ণ ক্যাফে। ওয়েটাররা দ্রুতপায়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে কাস্টমারদের অর্ডার পরিবেশনে।হরেক রকম খাবার এবং পানীয়ের মিষ্টি সুগন্ধীতে ভরপুর অঙ্গন।সবকিছুর মাঝে জানালার সঙ্গে লাগোয়া টেবিলে বসে একমনে কিছুক্ষণ আগে পরিবেশন করা কারবোনারা- এর প্লেটের দিকে দৃষ্টিপাত করে রয়েছে আসমান।স্প্যাগেটি, ক্রিমি সস এবং হটডগ দিয়ে প্রস্তুতকৃত জনপ্রিয় ইটালিয়ান ডিশটি ট্যুরিস্ট মাত্রই পছন্দের তালিকার শীর্ষে।
– এত কি দেখছেন? খাবার শুধুমাত্র দেখতে নয় খেতেও হয়।
কন্ঠটি কর্ণগোচর হতেই আসমান দৃষ্টি তুলে বিপরীত প্রান্তে তাকালো।হাসিমাখা অধরে তার উদ্দেশ্যে চেয়ে রয়েছে অপরিচিতা।তার পরিধানের শাড়িটি আশেপাশের টেবিলে বসে থাকা অন্যান্য কাস্টমারদের দৃষ্টি বেশ আকর্ষণ করছে।আসমান একনজর আশেপাশে দৃষ্টি বিলিয়ে পরক্ষণে কাঁটাচামচ তুলে নিলো।মুখে পুরলো বিখ্যাত কারবোনারা।তার অভিব্যক্তিতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন লক্ষ্য না করে রমণীর হাসি বিস্তৃত হলো।
– আপনি বেশ অদ্ভুত মানুষ দেখছি।অদ্ভুত শব্দটি খারাপ নয় বরং ভালো অর্থেই ব্যবহার করেছি।
তার কথায় আসমানের ওষ্ঠজোড়া কিঞ্চিৎ বিস্তৃতিলাভ করলো।রমণী কোনো রাখঢাক রাখছেনা, একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে তার অবয়বে।তাতে অন্তরে কেমন ধুকধুক আবেগের উৎপত্তি ঘটেছে।নিজেকে প্রশান্ত রাখতে কোনোকালেই সংগ্রাম করতে হয়নি আসমানকে।যেকোনো প্রকার ঘটনায় সে সর্বদা অবিচল,কিছুই অনুভূত হয়না।কিন্তু আজ প্রথমবারের মতন এক রমণীর সামনে বসে সে অস্বস্তিবোধ করছে।ঠিক অস্বস্তিবোধ নয়,লজ্জাবোধ!
– আমাকে চিনলেন কি করে?
অতর্কিতে আসমান প্রশ্ন ছুঁড়ে বসলো।নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা অতীব জরুরী। রমণীকে তার ন্যায় বিচলিত মনে হচ্ছেনা।সে নিজেই অজানা অনুভূতির জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে যেন!
– হুম।একই প্রশ্ন আমিও করতে পারি।আপনি কিভাবে চিনলেন?
– আপনার কন্ঠ শুনে ধারণা করেছিলাম, নিশ্চিত না হওয়ায় জিজ্ঞেস করেছি।
– আমার কণ্ঠকে স্মরণে রেখেছেন মিস্টার?
ভ্রু উঁচু করে রমণী উৎসাহী ভঙ্গিতে চাইতেই আসমান নিজের দৃষ্টি হরণ করে চট করে মুখে খাবার ঠুসলো, যেন কিছু উচ্চারণ করতে না হয়।তাতে খিলখিল করে হাসলো রমণী।
– হাহাহা,আপনি দেখছি অল্পতেই লজ্জা পেয়ে যান!
বিব্রতবোধ করলো আসমান।এতটাই প্রদর্শন ঘটছে তার অনুভূতির?কি অদ্ভুত!
– আপনি যে পরিমাণে সুদর্শন,তাতে লালিমায় আপনার কান টকটকে হয়ে এসেছে।
ধক করে উঠলো বক্ষপিঞ্জরের হৃদযন্ত্র।উন্মাতাল মস্তিষ্ক। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে আসমান জানালো,
– সুদর্শন নয়,অস্বাভাবিক। ডক্টর জানিয়েছেন, মেলানিনের অভাব রয়েছে শরীরে।চুল,চোখের পাতাও সাদা হওয়ার কথা কিন্তু স্রষ্টার রহমতে হয়নি,শুধুমাত্র শারীরিক বর্ণ….
– তাতে কি?তাই বলে কি আপনি সুদর্শন নন?আপনাকে সৃষ্টিকর্তা যেমন সৃষ্টি করেছেন আপনি তেমনি সুন্দর।খোদার সৃষ্টি কখনো অস্বাভাবিক হতে পারেনা।
একদৃষ্টে রমণীর মায়াবিনী মুখপানে চেয়ে থাকল আসমান, খানিক বেপরোয়াভাবেই।দৃষ্টি সরাতে ইচ্ছা হচ্ছে না ওই কাজলকালো আঁখিজুড়ে।তার এমন নিগূঢ় দৃষ্টিপাতে এবার উচ্ছল রমণীও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল যেন।
– আপনিও আমার কন্ঠ মনে রেখেছেন।
– হুম?অবশ্যই।এত চমৎকার কন্ঠ ভুলে যাওয়ার বাসনা হয়নি অন্তরে।স্মরণে রেখেছে,যদি কখনো রেডিওতে শুনতে পাই?
এখানে আদতে কে কাকে কিভাবে অপ্রস্তুত করতে চাইছে তা উভয়ের কেউই বুঝে উঠতে পারছেনা।যেমন বুঝতে পারছেনা আজকের এই সংলাপের অর্থ।বন্ধু বান্ধবদের দলের সঙ্গে চলে যেতে পারতো রমণী, যায়নি।একসাথে কোথাও বসে খুচরো আলাপের প্রস্তাব দিয়েছে আসমানকে। স্বভাববিরুদ্ধ হয়ে তা গ্রহণও করেছে কি*লিং মেশিন।অতঃপর, এই অদ্ভুত অথচ ভালোলাগাপূর্ণ এক মুহূর্তের সূত্রপাত।
আসমানের ঠোঁটজুড়ে এক হাসির উদগীরণ ঘটলো, আপন হৃদয় যেন উৎফুল্ল নৃত্যে মেতেছে।
– আপনি খুব সুন্দর গান করেন।গানের কন্ঠ অতি চমৎকার।
– ধন্যবাদ মিস্টার।আপনার প্রশংসায় এই সন্ন্যাসিনী ধন্য।
– হাহা… জ্বি মাতা হরহরিণী।
– আপনি গান পছন্দ করেন?
– উহুম,আগ্রহ নেই।কিন্তু আপনার গান ভালো লেগেছে কেনো জানিনা।
– মাঝে মাঝে গান শুনতে পারেন কিন্তু, এতে দুশ্চিন্তা দূর হয়,হৃদয় প্রশান্ত হয়।
– আর কোনো উপদেশ মাতা?
– শিখবেন গান?
– আপনি শেখাবেন?
– যদি বলি হ্যাঁ? রাজী আছেন?
থমকে পড়লো আসমান।পানির গ্লাসে চুমুক দিলো অজান্তে।রমণী তখনো চেয়ে আছে।পরমুহুর্তেই অবশ্য বিস্তর হেসে জানালো,
– ডোন্ট ওয়ারি, আই ওয়ায জাস্ট জোক….
– রাজী আছি।
বাক্য সমাপ্ত হওয়ার আগেই আসমানের অতর্কিত সম্মতিতে রমণী দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো।ফ্যালফ্যাল করে তাকালো।তারপর হাসি ধরে রেখে নিজের দীঘল চুলে আঙুল চালালো।
– আপনি আসলে একটা রহস্য মিস্টার।
নিজের কাছেই নিজেকে প্রথমবারের মতন রহস্যময় ঠেকছে আসমানের। এত কথা বলা সে কবে থেকে শিখলো?নিহাদের সঙ্গেও এমন তাল মিলিয়ে কথোপকথন হয় কিনা সন্দেহ।কিন্তু এই অচেনা হয়েও বড্ড চেনা রমণী যেন তার মাঝে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন বৈশিষ্টের উদ্ভব ঘটাচ্ছে।বড্ড সহজাত তার সঙ্গে সময় কাটানো।
ক্যাফে থেকে যখন বেরোনো হলো তখন আসমান এবং অপরিচিতার সম্পর্ক গিয়ে ঠেকেছে রীতিমত বন্ধুত্ব পর্যন্ত।তার নিকট দুই লাইন নজরুলগীতির হাতেখড়ি ঘটেছে পাথরমানবের। ক্যাফের বিপরীত প্রান্তের সড়কে দাঁড়িয়ে শাড়ী পরিহিতা নিজের গাড়ির অপেক্ষা করতে করতে তাকে অন্তিম কিছু মুহূর্তের সঙ্গ দিলো আসমান।অতি বেহায়া এই হৃদয় কিছুতেই এমন মধুর সময়ের সমাপ্তি ঘটাতে রাজী নয়।
সড়ক বেয়ে একটি কালো গাড়ি এসে থামতেই আসমানের দিকে ফিরলো রমণী।হেসে জিজ্ঞেস করলো,
– এবার তাহলে বিদায়ের পালা।
– হুম।ভালো থাকবেন।
– আপনার নামটা জানতে পারি কি মিস্টার ব্রোকেন হার্ট?
এক সেকেন্ড সময় নিলো আসমান উত্তর করতে।
– আ…আসমান।
– আসমান?আকাশ….আমার অতি পছন্দ।আর কত মুগ্ধ করবেন আমায়?
বি*স্ফা*রিত হলো আসমানের নয়নজোড়া।রমণী হাত বাড়িয়ে ধরলো, স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাতের ফোন তাকে সোপর্দ করলো অজানায় বিলীন পুরুষ।ফোন থেকে নিজের ফোনে নাম্বার টুকে তা ফেরত দিলো রমণী।গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে আসমানের ফোন অচেনা ইটালিয়ান নাম্বারে ভাইব্রেট করে উঠলো।মুচকি হেসে অপরিচিতা জানালো,
– পরিণীতা রেমান চিত্রলেখা, ডাকনাম চিত্র। প্রয়োজন বোধ করলে সেভ করে নেবেন নাহয়।
এটুকুই।গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেলো,রোমের সড়কে অদূরে অদৃশ্য হলো রমণী,পুনরায় পিছনে ফেলে গেলো নিজের অস্তিত্বের উষ্ণতা। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলো আসমান,ব*জ্রাহ*ত ব্যক্তির ন্যায়।আশপাশ দিয়ে হেঁটে চলা ব্যক্তিরা বোধ করি ভাবলো অতি যত্নে তৈরিকৃত কোনো ভাস্কর্য সজ্জিত করে রাখা হয়েছে সড়কের ধারে।
ডুপ্লেক্স বাড়িটির ভেতরে পা রাখতেই সিঁড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শার্ট প্যান্ট পরিহিত মেয়েটির দিকে দৃষ্টিপাত হলো চিত্রলেখার।এক মুহুর্ত থমকালো তার পদক্ষেপ।ব্যাপার কি?চেহারা দেখে তো সুবিধার মনে হচ্ছেনা।এমন ক্ষেপে আছে কেনো?মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কন্ঠ পরিষ্কার করলো সে।তাতে মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে ওই একই বিরক্তিখচিত দৃষ্টিতে তাকালো তার উদ্দেশ্যে।
– প্রেম করছিস তুই?
– কিঃ!
– আমি দেখেছি।একটা ফার্মের মুরগীর সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলাচ্ছিলি।
– ফার্মের মুরগী?
রেগেমেগে অগ্রসর হলো মেয়েটি।কোমরে দুহাত রেখে গাল ফুলিয়ে জানালো।
– তো কি বলবো?ওটাকে ধবধবে ব্রয়লার মুরগী ছাড়া আর কিছু তো মনে হয়নি আমার!তুই কি পেয়েছিস?আবার শখ করে শেখাচ্ছিস, আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন?ওই বাঁধন যদি আমি টেনে ছিঁড়ে না দিয়েছি আমার নাম চারুলতা নয়!
এতক্ষণে বোধগম্য হলো বোনের এমন রুদ্রমূর্তি ধারণের কারণ।হাসতে থাকলো চিত্র।তাতে দ্বিগুণ মাত্রায় ক্ষেপে গেল সহোদর।
– কি?খুব হাসি পাচ্ছে?এদিকে আমি এক বাইকওয়ালার সঙ্গে রীতিমত হাডুডু খেলে এসে দেখি তুই বসে বসে দিব্যি গল্প চালাচ্ছিস!গা জ্বলে যাচ্ছে আমার!
– বাইকওয়ালা?
– মিউজিয়ামের সামনে, বাপের সম্পত্তি মনে করে তো ইতালির রাস্তা!ভেবেছে এটা ওনার সোনার বাংলাদেশ?দিয়েছি একটা ঠাটিয়ে গালে,বাঙালি ছেলে পুরোই অষ্টরম্ভা!বেশ হয়েছে!ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল।
– চারু!হাহা… তুই আসলেই একটা জিনিস জানিস?
– হ্যাঁ হ্যাঁ,এমনি এমনি তো বিচ বলে ডাকেনা বুলিগুলো।
দুহাতে চুল উড়িয়ে ভাব নিলো।তাতে চিত্র তার কাঁধে হাত রেখে কাছে টেনে নিয়ে জানালো,
– তা আমার উপর এত রাগ কিসের?ফার্মের মুরগীকে কি ভালো লাগতে পারেনা?
– কি বলছিস তুই?এটা কি তোর ওই গুলশানের পাবলিক টয়লেটের সেই ব্রোকেন হার্ট নাকি যে….
বিড়বিড় করতে করতে থেমে পড়লো চারুলতা।দৃষ্টি বিস্তৃত করে চাইলো বড়োবোনের দিকে। হাসিমুখে নিঃশব্দে সম্মতি জানালো চিত্র।দুহাতে মুখ চেপে ধরে রীতিমত লাফিয়ে উঠলো কনিষ্ঠা।
– ওহ মাই গুডনেস!রিয়েলী? ইটস…হিম?
পুনরায় সায় জানিয়ে চারুলতার কাঁধে মাথা ঠেকালো চিত্র।
– এই জগত বড়ই রহস্যময়,তাইনা চারু?
– শুধু কি রহস্যময় নাকি?রীতিমত মিরাকেলীয়!কিভাবে ঘটলো এমন একটা ঘটনা?সেই কবে না কবে কারো কন্ঠস্বর শুনে তুই বিলীন হয়েছিলি, সে কিনা স্বশরীরে উপস্থিত এই ইতালির ভূমিতে!ইজ ইট ডেসটিনি?
একটি নিঃশ্বাস ফেললো চিত্র।তারপর অনুভূতিহীন মাথা নেড়ে জানালো,
– আই ডোন্ট নো।
তাকে হঠাৎ মুষড়ে পড়তে দেখে চারুলতা নিশ্চুপ থাকলো কয়েক মুহূর্ত।নিজের উত্তেজনা দমন করে শান্তি দৃষ্টিতে তাকালো।
– আপু।কি ব্যাপার?কি ভাবছিস?
– ভাবছি যে ব্রোকেন হার্ট বুঝি সত্যিই ব্রোকেন হার্ট।
– মানে?
কাধ তুলে ঠোঁট উল্টালো চিত্র।বাড়ির ভেতর এগোতে এগোতে জানালো,
– অতি গভীর ওই দৃষ্টিজুড়ে অদ্ভুত এক শূন্যতা দেখেছি চারু,এক মরমজ্বা*লা। জীবন্মৃত হয়ে এই পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্বের ভার বহন করে চলেছে যেন।
মাথা চুলকালো চারুলতা।তার বোনের এই কাব্যিক কথাবার্তা তার মাথায় একটু কমই ঢোকে।যমজ হলেও বৈশিষ্ট্যে একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত তারা।তিন মিনিটের বড়ো সহোদর ভালোবাসে সাহিত্য,সঙ্গীত, চিত্রকর্ম,স্নিগ্ধতা এবং আপন দেশের সংস্কৃতি।অপরদিকে চারুলতা কঠোর,মারকাটারি, ক্যারাটে শিক্ষার্থী এবং সকলের উপর ছড়ি ঘোরানো ব্যক্তিত্ব।আধুনিক সংস্কৃতিতে তার বেড়ে ওঠা।চিত্রের মতন মায়াবী আবহ আয়ত্তে আনতে পারেনি সে।তবে তাতে কোনো আফসোস নেই।কঠোর হতে চায় সে,যেন নিজের পরিবারকে সর্বদা রক্ষা করে যেতে পারে।
চিত্রকে কিছু জিজ্ঞেস করবে ভেবে উল্টো ঘুরলেও তা আর জিজ্ঞেস করা হলোনা তার।মেয়েটি ইতোমধ্যেই তার দৃষ্টির আড়াল হয়েছে,চলে গিয়েছে নিজের রুমে।কপালে হাত ঠেকিয়ে তাই দীর্ঘশ্বাস ফেললো চারু।আজ থেকে প্রায় একমাস আগে তার বোন বাংলাদেশে গিয়েছিল,একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে।সেখানেই অদ্ভুত এক আলাপ কোনো অজানা ব্যক্তির সঙ্গে,যার নাম পর্যন্ত জানা হয়নি তার।তবুও সহোদরের সঙ্গে সেই ঘটনার প্রতিটি আবেগ অনুভূতি পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছিল চিত্র।জীবনে প্রথম তাকে কোনো অদেখা পুরুষকে নিয়ে এত কথা বলতে শুনেছিল চারুলতা। স্বভাবতই কৌতূহল জাগ্রত হয়েছিল তার।কিন্তু এক সাক্ষাতের মৃদু আলোড়ন ভেবে ভুলে যাওয়ার আগেই যেন এক নতুন রূপে সেই অনুভূতিখচিত অতীত পদার্পণ করেছে তার বোনের জীবনে।
এই অজানা অনুভূতির পরিণতি কি হতে পারে?আপাতত জানা নেই চারুলতার।তবে সহোদরের জন্য সে সর্বোচ্চ ভালোটাই সর্বদা প্রার্থনা করে।
ভ্রু কুঁচকে চির ধরা হেলমেট হাতে হনহন করে ভেতরে ঢুকেই একটি গানের সুর কানে গেলো নিহাদের।বাংলা গান,আগে কখনো শোনা হয়নি তার।কিন্তু এই অসময়ে গান বাজিয়ে কে তার কান ঝালাপালা করার দুঃসাহস করছে?এমনিতেও মেজাজ হাই ভোল্টেজ হয়ে আছে এক বাঙালি মেয়ের সাথে মাঝরাস্তায় ঝগড়া করে,তাও ইতালির মতন একটা দেশে। একটুর জন্য পুলিশ ফাইনের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে।কিন্তু বিসর্জন দিতে হয়েছে নিজের নতুন হেলমে*টটাকে।এই বিদেশে ব্যবহারের জন্য ভাড়ায় নিয়েছিল যদিও, তবুও এতই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল যে ভেবেছিল যাওয়ার সময় সঙ্গে করে দেশে নিয়ে যাবে। তা আর হল কই?
আরে বাবা!এই গান তো বড্ড জ্বালাতন করছে!ধুপধাপ করে এগোলো নিহাদ।ঠাস করে দরজা খুলে লক্ষ্য করলো অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষে একটি আরামকেদারায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে দোল খাচ্ছে আসমান।হাতের দুই আঙ্গুলে ঝুলছে একটি আধখাওয়া সিগারেট।সাধারণত কোনো কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকলে কিংবা পরিকল্পনার সময় মনোযোগ স্থির রাখতে কদাচিৎ ধূমপান করে আসমান।তার উপর কোনোকিছুর প্রতি আগ্রহী না হওয়া সে রীতিমত উচ্চশব্দে শুনে চলেছে এক পুরোনো বাংলা সঙ্গীত।এতটাই পুরোনো টেপ যে তার সঙ্গে ঘড়ঘড় আওয়াজ হচ্ছে।
~চলার পথে,ক্ষণিক দেখা
এ কি শুধু অভিনয়
শুধু গান গেয়ে পরিচয়~
ধপাস করে পিছনের বিছানায় আছড়ে পড়লো নিহাদ, বিন্দুমাত্র টললোনা আসমান।ওই একই ভঙ্গিতে দুলছে সে।
– শাকচুন্নি! ডাইনী!তোর ভাতে গোবর পড়ুক!তুই টয়লেটে গেলে টয়লেট ভেঙে যাক!তুই বাইসাইকেল চালাতে গেলে চাকা পাংচার হয়ে যাক!তুই গোসলে গেলে ঝর্নার পানি শেষ হয়ে যাক!তোর পরীক্ষার খাতা ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে যাক!তোকে প্রেম করতে ধরে তোর আব্বাজান তোকে চাবকে পিঠের ছা*ল তুলে নিক!পেত্নী!
“ কাকে এত বদদোয়া দিচ্ছ?”— আশা করলেও প্রশ্নটি উচ্চারিত হলোনা।তাতে হতাশায় পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে ভ্যা করে উঠলো নিহাদ।ক্রুব্ধ কন্ঠে অভিযোগ করলো,
– আসমান ভাই!কি হয়েছে তোমার?দেখছ এদিকে আমি কিলবিল করছি,একটু নজর দিচ্ছনা কেনো?কি ভেড়ার মতন গান লাগিয়েছ?দেবের পরান যায় জ্বলিয়া রে ছাড়ো এক্ষুণি….
আসমানের দৃষ্টি মেললো।মাথা কাত করে সে তাকালো নিহাদের উদ্দেশ্যে।অদ্ভুত এক শূন্যতা ওই গভীর কৃষ্ণগহ্বরে।মুহূর্তের ভাবগাম্ভীর্যতা অনুভব করে নিহাদ থমকে গেলো।কণ্ঠের ধাঁচ পাল্টে চিন্তিত হয়ে শুধাল,
– কোনো সমস্যা?হঠাৎ গান শুনছো?
– ভালো লাগছে।
– গান?তোমার ভালো লাগছে?
– হুম।
– কেনো হঠাৎ?
– গান শুনলে নাকি দুশ্চিন্তা দূর হয়,হৃদয়ে প্রশান্তি আসে।
– কোন ব্যাক্কল এমন….এহেম!
আসমানের ঘন ভ্রু কুঞ্চিত হতে দেখে নিহাদ নিজের শব্দগুচ্ছ মুহূর্তেই গিলে নিলো।তার গুরু নিঃশব্দে সিগারেটে ঠোঁট ছোঁয়ালো।দৃশ্যটির পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আরামকেদারার সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো নিহাদ।একটি হাত রাখলো হাঁটুতে,আলতোভাবে।জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো,
– আর ইউ অলরাইট?
– হুম।
– ইউ আর নট। আই ক্যান সি, আই অ্যাম নট ব্লাইন্ড ওকে?কি হয়েছে?
– কিছুনা।
– প্লীজ ভাই।
তবুও নিঃশব্দ আসমান।দীর্ঘ এক মুহুর্ত।মাথা নত করে যেই মুহুর্তে নিহাদ উঠে পড়তে যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তেই হঠাৎ আসমানের একটি হাত চেপে বসলো হাঁটুতে রাখা তার হাতখানার উপর।
– বিলাল রেমানের দুই মেয়ে রয়েছে জানো?
হঠাৎ এমন অপ্রাসঙ্গিক কথায় নিহাদ কিঞ্চিৎ বিচলিত হলেও প্রকাশ ঘটালোনা।
– হ্যাঁ, ফাইলে পড়েছি।শুধুমাত্র দুই মেয়ে আছে এটুকুই।অতিরিক্ত তথ্য নেই।কোনো নাম,ছবি, কিছুই না।হয়ত বিলাল রেমান সতর্কতা অবলম্বন করেছেন নয়তো মেয়েদের উপর গুরুত্বপাতের প্রয়োজন মনে করেনি কেউ।হঠাৎ এই কথা বললে যে?
– আজকে তার মেয়ের দেখা পেয়েছি। চিত্রলেখা।
চোয়াল ঝুলে পড়লো নিহাদের।স্থির তাকিয়ে থাকলো নিজের জীবনের একমাত্র আপন মানুষটির দিকে। আরামকেদারায় সোজা হয়ে বসে আসমান নিজের ফোন এগিয়ে দিলো তার কাছে।নিহাদ হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে চেয়ে রইল।একটি নাম্বার থেকে আসা মেসেজ।
“ আগামী পরশু ফ্রি আছেন?মিস্টার ব্রোকেন হার্ট?”
পুনরায় আসমানের নিকট দৃষ্টি ফেরালো।কোনো অভিব্যক্তি নেই।অশুভ এক আভা সমগ্র চেহারাজুড়ে।ঠিক যেমনটা হয়ে থাকে,খু*ন ক*রার পূর্বমুহূর্তে।আসমান নিহাদের দিকে ঝুঁকলো,ফিসফিস করে এক পরাবাস্তব কন্ঠে উচ্চারণ করলো,
– হাউ অ্যাবাউট আই মেইক হার মাই ট্রাম্প কার্ড?
যদিও মুখে সে এই বাক্য উচ্চারণ করেছে,তবুও নিগূঢ় ওই দৃষ্টি বিশ্বাসঘাতকতা করে অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা হাহাকার এবং চাপা আর্তনাদের প্রকাশ ঘটালো।ভারী চাপ জেঁকে বসলো নিহাদের বক্ষজুড়ে,আপনমনে সে নিজেকে এলালো আসমানের কোলে,মাথা ঠেকালো হাঁটুতে।
ডার্কসাইড পর্ব ২২
শুধুমাত্র কন্ঠস্বর হতে অনুভূতির সূত্রপাতের ঘটনা সম্পর্কে নিহাদ অবগত নয়।যদি হতো তাহলে কি কোনোদিন বিশ্বাস করতো যে না দেখে, না চিনে শুধুমাত্র কয়েক মুহূর্তের কথোপকথনে দুটি সত্তা দুর্বলতায় আচ্ছাদিত হতে সক্ষম?
একে কি নামে আখ্যায়িত করা যায়?লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট?নাকি উইকনেস অ্যাট ফার্স্ট হেয়ারিং?সাহিত্যের জন্য বড্ড বেমানান তা।
