তুমিময় আসক্তি পর্ব ১৪ || Writer Mahfuza Akter

তুমিময় আসক্তি পর্ব ১৪
Writer Mahfuza Akter

?রহস্যভেদ-০১?
-শুভ্রব আফনাদ!!!
বিস্মিত চোখে সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটার দিকে তাকালাম। সে ক্রুর হাসি দিয়ে বললো,
-ইয়েস! আমিই শুভ্রব। চিনতে পেরেছো নিশ্চয়ই!
এটা তো সেদিন ভার্সিটিতে দেখা সেই ছেলেটা! এনার নাম শুভ্রব! ইনি আমাকে এভাবে ধরে এনেছেন কেন? আমি তো ওকে চিনি না। অবাক হয়ে বললাম,

-আপনি আমাকে এখানে কিডন্যাপ করে এনেছেন?
শুভ্রব মুখের হাসিটা আরো প্রসারিত করে বললো,
-ডু ইউ হ্যাভ এনি কনফিউশান?
রাগ লাগছে প্রচুর। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললাম,
-কেন এনেছেন এখানে? আজ তো নির্জনের সাথে আ…….
বলার আগেই শুভ্রব ডান হাত দিয়ে আমার গাল চেপে ধরলো। তার মুখের হাসি মুহূর্তেই পরিবর্তিত হয়ে হিংস্রতা ফুটে উঠলো। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললাম। শুভ্রব অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-তুমি ভাবলে কী করে আমি বেঁচে থাকতে ঐ নির্জনের সাথে তোমার বিয়ে হতে দেব? একবার গোপনে বিয়েটা হয়েছিল বলে কিছু করতে পারিনি। এবারও গোপনে হলেও সবটা আমি জানতাম! তাই তোমার আর নির্জনের মিলন এ জীবনে আমি হতে দেব না।

শুভ্রব সামনে থেকে সরে গেল। হতভম্ব হয়ে বললাম,
-গোপনে বিয়ে হয়েছিল মানে? কার বিয়ে হয়েছিল? কীসব আজেবাজে কথা বলছেন আপনি?
আমার এহেন কথায় শুভ্রব যেন গর্জে উঠলো। রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
-নাটক করছো আমার সাথে? যতই এক্টিং করো না কেন, তোমাকে আমি ছাড়ছি না! আর এতো অকওয়ার্ড প্রশ্ন করে আমার রাগ বাড়াচ্ছ কেন? এমন বিহভ করছো যেন আমায় কখনো দেখোইনি! আমায় চেনো না তুমি?
ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বললাম,

-আপনাকে আমি সত্যিই চিনি না। কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না!
-এগেইন! এগেইন ড্রামা!! নির্জনকে এতো ভালো করে মনে রেখেছো আর আমাকে ভুলে গেছো! ঠাট্টা করছো আমার সাথে? তিন বছর আগে যখন তোমায় ‘ভালোবাসি’ বলেছিলাম, তখন নির্জনের জন্য তুমি আমায় রিজেক্ট করে দিয়েছিলে। ভুলে গেছো? তুমি বলেছিলে নির্জনের সাথে তোমার পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি বিবাহিত!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়লো! তিন বছর আগে নির্জনের সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল? শুভ্রব আমায় প্রপোজ করেছিলো? তার মানে সেই বিয়েটা আমার আর নির্জনের মধ্যে হয়েছিল! আর আমি এতোদিন বোকার মতো ওকে কষ্ট দিয়ে এসেছি। নির্জন এজন্যই প্রথম থেকেই আমায় বউ বলে সম্বোধন করতো। আমাকে উনি আগে থেকে চিনতো! হয়তো শুভ্রবের কথাই সত্যি। নয়তো নির্জনের ঘরের ঐসব ছবির মানে কী? কিন্তু কীভাবে কী হয়েছে? আমার কিছু মনে পড়ছে না কেন?
শুভ্রব এগিয়ে এসে দিকে খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়ালো। অনেকটা শান্ত গলায় বললো,

-তুমি জানো, সেদিন আমার মনের অবস্থা কী হয়েছিল? বারবার মনে হচ্ছিল, আমারই প্রাণের বন্ধু আমারই প্রাণভোমরাটাকে কেঁড়ে নিলো! কীভাবে পারলো ও এতো স্বার্থপর হতে?
শুভ্রবের কন্ঠে আকুতি! কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, মনের ভেতর কষ্টের পাহাড় জমিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমার মাথায় যে এসব কথা কিছুই ঢুকছে না! কিছুই উপলব্ধি করতে পারছি না আমি।
শুভ্রব পিছিয়ে গেল। উল্টো ঘুরে হাত দিয়ে চোখ চেপে ধরলো। চোখের জল আড়াল করছেন! শুভ্রব কাঁদছে! বাবা সবসময় বলতেন, ছেলেদের মন পাথর দিয়ে তৈরি করে নিতে হয়। মেয়েরা যেমন একটু কষ্টেই ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে থাকে, ছেলেরা তেমনটা পারে না। ছেলেদের কাঁদার অধিকারটাই নাকি সীমিত!
শুভ্রব ভাঙা গলায় বললো,

-তোমায় সবটা খুলে বলবো। কিছু হয়তো তুমি জানো! কিন্তু অনেক কিছুই জানো না। তোমায় জানতে হবে। শুনবে?
আমি যে কিছুই জানি না, সেটা তো আর শুভ্রব জানে না! ও মনে করছে আমি নাটক করছি। কিন্তু আমার তো সত্যিই কিছু মনে পড়ছে না! কেন যেন মনে হচ্ছে, এক বিশাল রহস্য আছে যা আমার অজানা। কিন্তু আমি তো জানতে চাই। আমায় জানতে হবেই।
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই শুভ্রব বলা শুরু করলো,

-আমি আর নির্জন সেই স্কুল লাইফ থেকেই বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম। সেইম ক্লাসে পড়লেও নির্জন আমার থেকে তিন-চার মাসের বড় ছিল। তবুও আমাদের মধ্যে অনেক গভীর সম্পর্ক ছিল। কিন্তু আমরা শুধু একে অপরকেই চিনতাম। পারিবারিক ভাবে কোনো চেনা-জানা ছিল না। সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষার পর আমার ড্যাড আমাকে না জানিয়েই ইউকে তে স্কলারশিপের জন্য এপ্লাই করে বসেন। কিন্তু সেজন্য আমায় একটা পরীক্ষায় বসতে হবে। আমি এটা শুনতেই না বলে দেই। একে তো নির্জনকে ছাড়া বাইরের দেশে যাওয়া আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তার ওপর আমি অতো ভালো স্টুডেন্টও ছিলাম না!

নির্জনকে জানাতেই ও আমায় অনেক বুঝিয়েছিল। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার এসব গড়তে হলে সেক্রিফাইজ করতে হবেই। ওর কথায় রাজি হয়েছিলাম। নির্জনকেও আমার সাথে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু ও রাজী হলো না! ও নাকি দেশেই কিছু একটা করতে চায়। পলিটিক্স ওর কাছে একটা প্যাশন ছিল। আর স্টুডেন্ট লাইফ থেকেই সেটা শুরু করতে চায়। তাই দেশ ছাড়া সম্ভব নয়। আমি অনেক বললেও শোনেনি। কিন্তু ও আমায় পড়াশোনায় অনেক সাহায্য করেছিল। ওর জন্যই আমি স্কলারশিপটা পেয়েছিলাম। আমি এর জন্য ওর কাছে ঋণী। তারপর চলে গেলাম ইউকে মেডিক্যালে পড়ার জন্য, আর নির্জন এখানেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শুরু করলো।

টানা ছয় বছর পর দেশে ফিরে এলাম একজন এস্টেবলিশড্ প্যাথলজিস্ট হিসেবে। সেদিন প্রথমেই নির্জনের সাথে দেখা করেছিলাম। অনেক কেঁদেছিলাম দুজন। আবার দুজনেই নিজেদের কান্না দেখে হেসেছিলাম।
শুভ্রব খানিকটা হাসলো। এতো আবেগিক ছিল দুজন দুজনের প্রতি! এমন বন্ধুত্বের সম্পর্ক সত্যিই বিরল।
শুভ্রব আবার বলতে লাগলো,
-অনেক বছর দূরে দূরে থাকায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম চিটাগং এ একটা ট্যুরে যাবো আমরা। যেই ভাবা, সেই কাজ। দুদিন পরেই চিটাগং রওনা দিলাম দুজনে। কিন্তু সেই ট্যুরটা-ই আমাদের জীবনের কাল হলো! নির্জন আমার সবটা কেড়ে নিলো। আর আমি দুই টুকরো একটা মন নিয়ে ফিরে এসেছিলাম।
ভ্রু কুঁচকে বললাম,
-কীভাবে?

-বলছি। একমাসের জন্য চিটাগং গিয়েছিলাম। এর মধ্যেই একদিন নেমাক্রিতে ঘুরতে বেরিয়ে ছিলাম। সেদিনই তোমায় প্রথম দেখি আমি। ঝরনায় বর্ষণবিলাসী সেই মেয়েটাকে দেখে থমকে গিয়েছিলাম বিশ্বাস করো। সেদিনই জীবনে প্রথম কোনো মেয়েকে দেখে শুভ্রব আফনাদের দৃষ্টি স্থির হয়ে গিয়েছিল। দূর থেকে তোমায় দেখছিলাম। তোমার কথা বার্তায় বুঝেছিলাম তুমি বান্দরবানেই থাকো আর প্রায় প্রতিদিন এখানে আসো।

হোটেলে ফিরে নির্জনকে সবটা জানালাম। ও অনেক হাসলো আমায় নিয়ে। আর জানালো কালকে ওর বাবা-মা আসবেন। ওর বাবার বন্ধুর মেয়েকে ও অনেক আগে থেকেই ভালোবাসতো। তার সাথে নির্জনের ঘরোয়াভাবেই রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হবে কাল।
বিয়েতে আমি যাইনি। কারণ আমায় যে আমার সেই বর্ষণবিলাসীর কাছে যেতে হবে! কিন্তু সেদিন সে এলো না। টানা তিনদিন পর তার দেখা মিললো। দেখার সাথে সাথেই তার সামনে গিয়ে প্রেম নিবেদন করেছিলাম। কিন্তু সে বললো তার বিয়ে হয়ে গেছে। কষ্টদায়ক হলেও মেনে নিয়েছিলাম। এরকমটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সন্ধ্যায় হোটেলে রওনা হওয়ার সময় সমুদ্র তীরে আমার সেই বর্ষণবিলাসীকে দেখলাম। একা নয়। আমারই প্রাণপ্রিয় বন্ধুর সাথে। নির্জন তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে দুই হাত ভর্তি ঝিনুক ও কড়ি দিয়ে প্রেমনিবেদন করছিলো। সেও হাসিমুখে সেগুলো নিলো। নির্জন উঠে দাঁড়াতেই ওকে জড়িয়ে ধরলো। সেই মেয়েটা তুমি ছিলে, গুঞ্জন।

তুমিময় আসক্তি পর্ব ১৩

চকিত দৃষ্টিতে তাকালাম। আমি ছিলাম? আমি কীভাবে ছিলাম? মাথায় প্রেশার দিলাম। মনে করার চেষ্টা করলাম। চোখের সামনে ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে সবটা। হ্যাঁ, মনে পড়ছে আমার! নির্জনের সাথে আমার বিয়ে, কাটানো মুহূর্ত গুলো স্মৃতির পটে ভেসে উঠছে! শুভ্রব সত্যি বলছে।
শুভ্রব আবার বললো,

-যা বোঝার, বুঝে গিয়েছিলাম। দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে ভেতরে তুমুল ঝড় উঠে গিয়েছিল। নিজের কষ্টগুলো যদি ভেতর থেকে বের করে আনতে পারতাম, তাহলে হয়তো সেটা ঐ সমুদ্রের পানির পরিমাণকেও হার মানাতো!
কিন্তু তবুও নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে সবটা মেনে নিয়েছিলাম। নির্জনের সুখের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাইনি। দুদিন পর ড্যাড ফোন দিয়েছিলো। কেমন আছো জিজ্ঞেস করতেই বাচ্চাদের মতো কেদেছিলাম। একটা কথাও বলতে পারিনি। ড্যাড আর মম দুজনেই সেদিন রাতেই সব ফেলে চিটাগং এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সেদিন রাতে নির্জনও তোমায় নিয়ে লং ড্রাইভে বেরিয়ে ছিল।

কিন্তু চিটাগং টাউনে ক্রস করে নিরিবিলি রাস্তায় আসতেই তোমাদের গাড়ির সাথে ড্যাড আর মমের গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। মমের স্পট ডেথ হয়, কিন্তু ড্যাড নিখোঁজ হয়ে যায়। ভেবে নিয়েছিলাম, পাশের খাদে হয়তো ড্যাড পড়ে গিয়েছিল।
নির্জনের তেমন একটা ক্ষতি হয়নি! কিন্তু তুমি নাকি অনেক ইনজিউরড্ হয়েছিলে। নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। বাবা, মা, ভালোবাসা সবকিছু কেড়ে নিয়েছিল নির্জন আমার থেকে। ড্যাডকে পরে ফিরে পেয়েছি, তবে মমকে তো চিরতরে হারিয়ে ফেললাম। শায়ন্তী আপি বলেছে, নির্জন নাকি ইচ্ছে করে ড্যাডকে মেরেছে। শায়ন্তী আপির কথার সত্যতা পরে বুঝতে পেরেছিলাম।

তুমিময় আসক্তি পর্ব ১৫