তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ১০
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
রাতে খাওয়ার সময় বিশাল শালিস বসেছে বাসায়। বিচার এসেছে অনুর ভার্সিটি থেকে রায়ানের বিরুদ্ধে। রমিজ চৌধুরী ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। রায়ান ভাবলেশহীন হয়ে বসে আছে। তার ভেতর কোনো ভয়-ডর নেই। তবে ভয় পাচ্ছে অনু। বাবা, চাচারা ভীষণ রেগে আছে! বেশি রেগে আছেন রমিজ চৌধুরী।
“কেন করেছ এটা?” রমিজ চৌধুরীর কণ্ঠে রাগের বহিঃপ্রকাশ।
রায়ান নিশ্চুপ। চুপচাপ খাচ্ছে সে। রমিজ চৌধুরী ফের জিজ্ঞেস করলেন,
“কথা বলছ না কেন? কেন করেছ এই কাজ?”
“কী করেছি?”
“কী করেছ তুমি জানো না? অনুর ভার্সিটিতে আজ যাওনি তুমি? সবার সামনে লাঠি নিয়ে ওকে দৌঁড়ানি দাওনি?”
“হ্যাঁ।”
রমিজ চৌধুরীর রাগ বাড়ছে। ছেলের এমন উদাসীনতা তার পছন্দ হচ্ছে না। তিনি বললেন,
“কেন? কেন করবে তুমি এমন? অনু কী করবে না করবে সেটা ওর ব্যাপার। ওর জীবনে অধিকার খাটানোর জন্য ওর বাবা-মা আছে, ভাই আছে। তোমাকে কে বলেছে মাতব্বরি করতে?”
তমাল ইতস্তত করে বলল,
“চাচ্চু, আসলে রায়ান ভাই আমাকে কল করেছিল তখন। আমিই রাগে বলেছিলাম…”
রমিজ চৌধুরী দ্বিগুণ ক্ষেপে গিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ তুমি বললে আর ও সিরিয়াসলি কাজটা করে ফেলল? ওর জায়গায় তুমি থাকলে কি সবার সামনে অনুকে মা’র’তে যেতে?”
তমাল নিশ্চুপ। তিনি ফের বললেন,
“ওখানে শুধু স্টুডেন্টসরাই ছিল না। টিচার্সরা ছিল, বাইরের গেস্ট ছিল। সবার সামনে অনুর বা চৌধুরী বাড়ির মান-সম্মানটা কোথায় থাকল?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অনু ভয়ে ভয়ে বলল,
“কেউ হয়তো ঐভাবে ভাবেনি কিছু…”
তাহমিনা বেগম ধমক দিয়ে বললেন,
“তুই চুপ থাক। এখানে বড়োরা কথা বলছে।”
রমিজ চৌধুরী রায়ানের উদ্দেশে বললেন,
“আগামীকাল অনুকে সাথে নিয়ে ভার্সিটিতে গিয়ে প্রিন্সিপালকে সরি বলে আসবে।”
রায়ান কোনো জবাব দিল না। খাবারও শেষ করল না। হাত ধুয়ে নিরবে উঠে চলে গেল।
অনুর নিজের কাছেই এখন বিষয়টা খারাপ লাগছে। সে যদি প্রোগ্রামে নাচ না দিত, তাহলে এমন কিছুই হতো না। বাড়িতে বিচারও আসতো না, রায়ান ভাইকেও এতগুলো কথা শুনতে হতো না।
রাতে আর রায়ান ভাইয়ের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়নি। দেখা হলো একদম সকালে। লিলি খালা এসে অনুকে ডেকে ওঠালেন। অনু ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে দেখে রায়ান ভাই গম্ভীর হয়ে বসে আছে খাওয়ার টেবিলে। কথা বলার সাহস হলো না অনুর। সে চুপচাপ নাস্তা খেয়ে রায়ানের সাথে বেরিয়ে গেল ভার্সিটির জন্য। পথে সে বলল,
“সরি।”
রায়ান ভাই কোনো জবাব দিল না। ফিরেও তাকাল না। অন্য কোনো বিষয় নিয়েও কথা বলল না। ভার্সিটিতে পৌঁছে সোজা প্রিন্সিপালের রুমে গেল। সেখানে তাকে খুব স্বাভাবিক এবং বিনয়ী দেখা হলো। অনুশোচনা হচ্ছে তার এভাবেই সে মাফ চাইল প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে। স্যারও তখন বিনয়ী হয়ে বললেন,
“বাড়ির বিষয়গুলো বাড়িতেই মেটাতে হয় রায়ান। হতেই পারে, তোমরা নাচ পছন্দ করো না। তার মানে তো এই না ভরা ক্যাম্পাসে তুমি লাঠি নিয়ে দৌঁড়াবে। এটা নরমালি মাঠে হলেও হতো। বিষয়টা গতকাল সম্পূর্ণ অন্যরকম ছিল। একটা প্রোগ্রাম ছিল, টিচাররা ছিল, গেস্ট ছিল। বুঝতেই পারছ? এখানে ভার্সিটিরও একটা রেপুটেশনের ব্যাপার আছে।”
“আমি বুঝতে পেরেছি স্যার। আমার কৃতকর্মের জন্য আমি দুঃখিত। আর কখনো এমন হবে না।”
প্রিন্সিপাল স্যার রায়ানকে চা অফার করলেন। রায়ান ভাই অবশ্য চা খেলেন না। কথা শেষ করে বেরিয়ে গিয়েছে। অনুও এসেছে পেছন পেছন। রায়ান ভাইয়ের সাথে যাবে নাকি ক্লাসে চলে যাবে বুঝতে পারছে না। ক্লাস শুরু হতে দেরি আছে বলে সে রায়ান ভাইয়ের সাথেই হাঁটা শুরু করেছে। পথিমধ্যে মানুষজন কম এমন এক জায়গায় গিয়ে রায়ান ভাই দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার চোখে-মুখে ভীষণ রাগ। তবুও নিজেকে সংযত করে অনুকে বলল,
“অনু, তুই নিজেকে দয়া করে আমার থেকে দূরে রাখ!”
অনু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে কী করেছে? রায়ান ভাই বলল,
“তোর বাবা-মা, ভাই আছে। তোর জীবন নিয়ে আমার মাথা-ব্যথা করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তবুও করেছি। তুই সবার সামনে নাচছিস এটা আমার ভালো লাগেনি। তাই রিয়াক্ট করে ফেলেছি। কিন্তু এটাও আমার মাথায় রাখা উচিত ছিল যে, তোর লাইফে ইন্টারফেয়ার করার কোনো রাইট আমার নেই। তোকে আরো একটা বিষয় আমি আজ ক্লিয়ার করে দিচ্ছি। আশা করছি এরপর থেকে তুই নিজেই সরে যাবি। তুই যে আমাকে পছন্দ করিস, এটা আমি খুব ভালো করেই বুঝি। জেনেছিও। এতদিন তোকে বুঝতে দেইনি। কিন্তু আমার উচিত ছিল তোকে বুঝিয়ে বলা এবং নিষেধ করা। তুই আমার থেকে যথেষ্ট ছোটো, আর তাই চাইনি তোর সাথে এসব নিয়ে সরাসরি কথা বলতে। তোর আবেগ হয়তো দুদিন পর এমনিও থাকবে না।
কিন্তু তাই বলে তোর আবেগকে আমি প্রশ্রয়ও দিতে পারব না। আমার মনে তোর জন্য কোনো রকম অনুভূতি নেই। ইতি, কল্পনা, আরিফারা আমার কাছে যেমন, তুইও তেমন। আলাদা করে তোদের দেখি না আমি। তুই সারাক্ষণ আমার সাথে আঠার মতো লেগে থাকিস, কারণে অকারণে কথা বলতে চাস এসব আমার পছন্দ না। এসব আর করিসও না। বাড়ির কেউ জানতে পারলে তখনো আল্টিমেটলি দোষ আমার ঘাড়েই আসবে। তুই যে গলা ফাটিয়ে গানগুলো গাস এবং সেগুলো যে আমাকেই ডেডিকেটেড করে গাস আমি বুঝি সব। এসব আর করার প্রয়োজন নেই। তোর সাথে আমার কিছুই হবে না। কখনোই হবে না। তোকে আমি কখনোই ভালোবাসব না। বিয়েও করব না। তাই সময় থাকতে নিজের ভালো বুঝতে শেখ আর আমার পিছু ছেড়ে দে। তোর আচরণে তোর প্রতি আমি ভীষণ বিরক্ত ভীষণ!”
রায়ান ভাই নিজের কথাগুলো বলে একটু থামল। অনুর চোখ টলমল করছে। কিন্তু এতে তার কিছু যায় আসে না। সে সানগ্লাসটা চোখে পরে বলল,
“এখন ক্লাসে যা। আসছি আমি।”
রায়ান ভাই চলে গেল। কিন্তু অনু ফিরে তাকাল না। অপমানে কান্নাগুলো গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। রায়ান ভাই তাকে কখনোই ভালোবাসবে না? বেশ তো! প্রয়োজন নেই তার ভালোবাসার। অনু তো আর ফেলনা নয়, সস্তা নয়। অনু ভালোবাসতো বলেই তো রায়ান ভাইয়ের সাথে সহজ হয়ে ছিল। কিন্তু রায়ান ভাই অনুর সহজ হওয়াকে সস্তা ভেবে বসে আছে। বেশ! এতদিন সে অনুর ভালোবাসা দেখেছে, প্রত্যাশা দেখেছে, প্রবল আকাঙ্ক্ষা দেখেছে। এখন থেকে দেখবে প্রবল অনিহা ও অনাগ্রহ!
অনু অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। চোখের পানি আটকে রাখতে পারছে না। সবাই পাশ দিয়ে যাতায়াত করছে। সে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। তার দুর্বলতা সে কাউকে দেখাতে চায় না। বেশ কিছুক্ষণ কান্না করে সে নিজেকে হালকা করল। চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে সোজা চলে গেল ভার্সিটির লাইব্রেরিতে। আজ আর সে ক্লাস করবে না। ক্লাসে মনও দিতে পারবে না। বান্ধবীরা ওকে দেখলেই বুঝে ফেলবে কিছু একটা হয়েছে। একটা বই খুলে সে বসে রইল চুপচাপ। বারবার রায়ান ভাইয়ের বলা কথাগুলো কানে বাজছে। অপমানগুলো বুকে বিঁধছে তীরের মতো। নিজের প্রতি তার প্রবল রাগ হচ্ছে। কাউকে ভালোবাসার শাস্তি বুঝি এমন হতে পারে?
ছুটি হওয়ার মিনিট দশেক আগেই অনু ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে গেল। বাসায় ঢুকতেই দৌঁড়ে এলো রোমিও। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল অনু। এরপর চলে গেল নিজের রুমে। কোনো কিছুই তার ভালো লাগছে না। সবকিছু বি’ষের মতো লাগছে। দম আটকে আসছে তার। কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে গোসল করে অনু ঘুমাল। লিলি খালা কয়েকবার এসে খাওয়ার জন্য ডেকে গিয়েছেন। অনু ওঠেনি। ঘুম ভেঙেছে সাতটার পর। মন-মেজাজ ভালো হওয়ার বদলে আরো বেশি বিরক্ত লাগছে অনুর। সে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসল। লিলি খালা এসে চা দিয়ে গিয়েছেন। অনু ঘড়িতে সময় দেখল। কিছুক্ষণ খাতায় আঁকিবুঁকি করে সাড়ে আটটার দিকে নিচে নেমে লিলি খালাকে ডেকে বলল,
“খালা রান্না হয়েছে? তাহলে খেতে দাও।”
“হ, হইছে। এখনই খাইবা?” জানতে চাইলেন লিলি খালা।
অনু বলল,
“হুম। দুপুরে তো খাইনি। ক্ষুধা লেগেছে।”
“আচ্ছা বহো। খাওন আনতাছি।”
তাহমিনা বেগম ভাত নিয়ে এলেন অনুর জন্য। মেয়ের শুকনো মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন মন খারাপ হয়তো। মাথায় হাত রেখে অনুকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হয়েছে?”
আহ্লাদ হোক কিংবা আস্কারা, অনুর চোখ আবার টলমল করছে। কিন্তু সে মায়ের সামনে কাঁদতে চাইছে না। মাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বলল,
“শরীরটা ভালো লাগছে না, মা। ভীষণ মাথা-ব্যথা করছে।”
“ঘুমিয়েছিস তো আজ কম না। এত ঘুমায় কেউ? খেয়ে একটা ওষুধ খেয়ে নিস।”
“আচ্ছা।”
তাহমিনা বেগম নিজেই অনুকে খাইয়ে দিলেন। রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ অনুর মাথা টিপে দিলেন। শাসনের সুরে বললেন,
“খবরদার রাত জেগে ফোন চাপবি না।”
“আচ্ছা।”
“আমি কিন্তু এসে দেখে যাব।”
অনু মলিন হেসে বলল,
“ঠিক আছে।”
“এখন শুয়ে থাক। পরে আসব আমি।”
“ঠিক আছে।”
তাহমিনা বেগম দরজা পর্যন্ত যাওয়ার পর অনু পিছু ডেকে বলল,
“মা, রোমিওকে খাইয়ে ওর ঘরে রেখে দিও।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। ওকে নিয়ে তোর এত চিন্তা করতে হবে না। ওর কথা আমার মাথায় আছে।”
তাহমিনা বেগম লাইট নিভিয়ে দিয়ে, দরজা চাপিয়ে চলে গেলেন। অনু আকাশমুখি হয়ে শুয়ে আসছে। ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। সে আসলে রায়ানের সামনে আর পড়তে চায় না। রায়ান ভাই চেয়েছে অনু তার থেকে দূরে থাকুক, তা-ই হবে। অনুর এই পালিয়ে বেড়ানোটা চলতে থাকল দিনের পর দিন। প্রথমদিন রায়ান বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিলেও পরের দিনগুলো থেকে বুঝতে পেরেছে, অনু এসব ইচ্ছে করেই করছে। সকালের নাস্তা করে অনু সবার শেষে। সবাই চলে যাওয়ার পর। এর মাঝে একদিন পড়ার খুব তাড়া দেখিয়ে লিলি খালাকে দিয়ে নাস্তা ঘরে এনে খেয়েছে। দুপুরে এমনিও সবার একসাথে খাওয়া হয় না। একদিন রায়ান বাড়িতেই ছিল। দাদুর ঘরের দরজার সামনে চেয়ার নিয়ে বসে ছিল সে। কথা বলছিল দাদার সাথে। অনু ভার্সিটি থেকে ফিরে বাসায় ঢোকার সাথে সাথে রোমিও দৌঁড়ে গিয়েছে অনুর কাছে। এতক্ষণ রায়ানের সাথেই ছিল রোমিও। অনু হাঁটু মুড়ে বসে হাত বুলিয়ে দিল রোমিওর মাথায়, গায়ে। হেসে হেসে কথাও বলল। কিন্তু একটাবারের জন্যও সে রায়ানের দিকে ফিরে তাকায়নি। দাদু তখন বলেছিল,
“আসার সাথে সাথে ওকে নিয়ে বসে পড়িস কেন অনু? আগে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে।”
এমনকি অনু দাদুর কথার জবাবও দিয়েছে রোমিওকে আদর করতে করতে। তখনো সে দাদুর দিকে তাকায়নি। কারণ দাদুর দিকে তাকালে সে রায়ানকেও দেখতে পারত। এমন না যে, সে জানে না এখানে রায়ান আছে। সে জানে আর জানে বলেই তাকায়নি। রায়ান খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকিয়ে ছিল এবং বুঝতেও পেরেছিল, অনু তাকে সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে চলছে। সেদিন দুপুরেও অনু খায়নি। ইচ্ছে করেই খায়নি। ফ্রেশ হয়ে নিচে নামার সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছে দাদা-দাদির সাথে রায়ান ভাইও খেতে বসেছে। তাই আর সে নিচে নামেনি। ঘুমের অজুহাত দিয়ে শুয়ে ছিল। রায়ান ভাই বাইরে যাওয়ার পর অনু উঠে খেয়েছে। আজকাল অনু রাতেও সবার সাথে খায় না। নয়টার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে। এজন্য অবশ্য সে দাদার থেকে পারমিশন নিয়ে নিয়েছে। আদরের নাতনির আবদার তো না রেখে পারেন না দাদু। এমনকি রায়ান ভাই খেয়াল করেছে, রোমিওকে অনু রাতে আটকে রাখে ঘরে। রায়ানের কাছে তেমন আসতে দেয় না। অনুর এত পরিবর্তন সত্যিই চোখে লাগার মতো ছিল।
এত কিছুর ভিড়ে অনুর ঠিকই কষ্ট হতো। না চাইতেও রায়ান ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে যায় তার। একই বাড়িতে থেকে আর কতটুকুই বা এড়িয়ে চলা সম্ভব? রায়ান ভাইকে দেখলেই তার কষ্ট বাড়ে। কিন্তু সেদিনের বলা কথাগুলো যখনই তার মনে পড়ে সে সতর্ক হয়ে যায়। নিজেকে আরো গুটিয়ে নেয় সবার থেকে। সবকিছু থেকে।
আজ অনেকদিন বাদে রাতে অনু সবার সাথে খেতে বসেছে। রায়ান খেতে এসে অনুকে দেখে সবচেয়ে বেশি অবাক হলো। তবে কাউকে কিছু বুঝতে দিল না। অনুকে আজ একসাথে পেয়ে বাচ্চা পার্টিরা ভীষণ খুশি। বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার শরীরটা ভালো?”
অনু মাথা ঝাঁকাল। বড়ো চাচ্চু বললেন,
“আজকাল আর তুমি রাতে আমাদের সাথে খাচ্ছ না। ব্যাপার কী?”
“আসলে চাচ্চু সবকিছু একটু টাইমলি করার চেষ্টা করছি। আর ইদানীং এত বেশি ক্ষুধা লাগে যে, তোমাদের জন্য অপেক্ষা করতে পারি না।”
রায়ান ভাই চুপচাপ অনুর মিথ্যা কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। বড়ো চাচ্চু হাসলেন। বললেন,
“সমস্যা নেই। তোমার যখনই ক্ষুধা লাগবে তুমি খেয়ে নেবে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।”
“আমি দাদুর থেকে অনুমতি নিয়ে নিয়েছি। আর সরি যে, দাদুর ইচ্ছে রাখতে পারছি না।”
দাদু হেসে বললেন,
“ইট’স ওকে ডার্লিং। আমার নায়িকাদের জন্য ছাড় আছে সবসময়।”
অনু মৃদু হাসল। সে আসলে আজ সবার সাথে খেতে বসেছে বিশেষ এক কারণে। কথাটা কীভাবে বলবে আর বললেও সবাই রাজি হবে কিনা সেটাও এক বিশাল চিন্তার বিষয়। অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে সে বাবার উদ্দেশে বলল,
“আব্বু, একটা কথা বলতে চাই।”
আলমগীর চৌধুরী বললেন,
“বলো।”
“আব্বু, আমি হোস্টেলে থাকতে চাই।”
উপস্থিত সবাই খাওয়া বাদ দিয়ে অনুর দিকে তাকাল। তাহমিনা বেগম ধমকের সুরে বললেন,
“হোস্টেলে থাকবে মানে? কোন সুখে? এখান থেকে এখানে ভার্সিটি তোমার!”
আলমগীর চৌধুরী স্ত্রীকে থামিয়ে বললেন,
“কেন? তোমার এখানে কী সমস্যা হচ্ছে?”
“কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু আমার ইচ্ছে আরকি!”
তাহমিনা বেগমের মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। অনুর এমন ইচ্ছে ভাইদেরও পছন্দ হলো না। তমাল সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে বলল,
“একদম না। কোনো হোস্টেলে-ফোস্টেলে থাকা হবে না। এখানেই থাকতে হবে।”
আয়ান বলল,
“তোর সমস্যা কী? রিকশায় যেতে কষ্ট হয়? আচ্ছা এখন থেকে আমি তোকে বাইকে করে দিয়ে আসব আবার আসার সময় নিয়ে আসব।”
অনু বুঝতে পারছে, সবাইকে রাজি করানো কতটা কষ্টকর হয়ে যাবে তার জন্য। কিন্তু সে হাল ছাড়ল না। মুখটা মলিন করে বলল,
“আমার ইচ্ছের কোনো দাম নেই তোমাদের কাছে?”
তাহমিনা বেগম রাগে গজগজ করে বললেন,
“না, নেই। এমন অদ্ভুত ইচ্ছের কোনো দাম নেই।”
বড়ো চাচি বললেন,
“হোস্টেলের খাবার ভালো হয় না, মা। তুই ওসব খেতে পারবি না। তোর কষ্ট হয়ে যাবে।”
বাড়ির কেউ চাচ্ছে না, অনু হোস্টেলে থাকুক। সবাই অনুকে বোঝাতে লাগল। কেবল রায়ান-ই চুপ আছে। অনু এবার কেঁদে ফেলল। কেঁদে কেঁদে বলল,
“এমন কী চেয়েছি যে তোমরা আমার আবদার রাখতে পারছ না?”
তাহমিনা বেগম বললেন,
“কান্না করবি না। কান্না করে লাভ নেই। কোথাও যেতে দেবো না তোকে।”
মেয়ের কান্না দেখে আলমগীর চৌধুরী গলে গেলেন। সবার বিরুদ্ধে গিয়ে বললেন,
“আচ্ছা বেশ! তোমার যখন খুব ইচ্ছে হোস্টেলে থাকার, তাহলে থাকো। কিন্তু খুব বেশিদিনের জন্য নয়।”
অনু রাজি হয়ে গেল। আপাতত সে বাড়ি থেকে বের হোক। পরেরটা পরে দেখা যাবে। অনুর মা, দুই ভাই ভীষণ ক্ষিপ্ত হলেন আলমগীর চৌধুরীর ওপর। অনুকে ছাড়া তারা থাকার কথা কল্পনাও করতে পারে না। আলমগীর চৌধুরীরও কষ্ট হবে। কিন্তু তিনি চান না, মেয়ের কোনো ইচ্ছে অপূরণ রাখতে। তিনি তার মেয়েকে চেনেন এবং জানেনও যে, তার মেয়ে বেশিদিন সবাইকে রেখে দূরে থাকতে পারবে না। কিন্তু তিনি এটা তো জানেন না, অনুর বুকের ভেতর এক প্রবল জেদ দানা বেঁধেছে। এই জেদের কাছে তার বাকিসব কষ্ট কিছুই না।
তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ৯
এতক্ষণ ধরে যে এত কথা হলো, বাকবিতণ্ডা হলো, আলোচনা হলো অথচ রায়ান ভাই একটা টু-শব্দও পর্যন্ত করেনি। আর না সে খেয়েছে! শুধু চুপচাপ ভাতগুলো নাড়াচাড়া করছিল। এবার সে সবার আলোচনার মধ্য থেকেই হাত ধুয়ে উঠে চলে গেল নিজের রুমে।