তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ১২
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
ভারি বর্ষণে চোখ মেলে তাকানো যাচ্ছে না। তবুও একাধারে হোস্টেলের দিকে তাকিয়ে আছে রায়ান। পুরো পৃথিবী যেন অন্ধকারে ডুবে গিয়েছে। বিদ্যুৎ-ও নেই। অন্ধকারেই বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ফোনে সময় দেখল। এখনো অনুর সাথে দেখা করার সুযোগ আছে। নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল নাম্বারটির দিকে। তবে ডায়াল করল না। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে আবার ফিরে এলো বাড়িতে। তার অদম্য ইগোর কাছে ইচ্ছেকে হার মানতে হয়েছে।
রুমের ভেতর ছোট্ট মোমবাতিটি নিভু নিভু আলো ছড়াচ্ছে। এতক্ষণ অনু এবং শাপলা দুজনই পড়ছিল। এখন দুজনই বসে আছে দুজনের বিছানায়। মোমবাতিটি আর কিছুক্ষণ জ্বলবে। এরপর শেষ হয়ে নিভে যাবে। দুজনেই মোমবাতি শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছে। এরপর ঘুমিয়ে পড়বে। যদিও অনুর চোখে ঘুম নেই। শাপলা ইতোমধ্যে ঘুমে ঢুলছে। সে হাই তুলে বলল,
“আপু, তোমার বৃষ্টি কেমন লাগে?”
“ভালোই।” অনুর সংক্ষিপ্ত জবাব।
“দেখতে ভালো লাগে নাকি ভিজতে?”
“দুটোই।”
“আমারও।”
একটু থেমে শাপলা ফের বলল,
“আপু?”
অনু ভ্রু উঁচিয়ে বলল
“হু?”
“চলো বৃষ্টিতে ভিজি!”
শাপলার চোখে-মুখে একরাশ উচ্ছাস। অনু বিস্মিত হয়ে বলল,
“পাগল নাকি! এই রাতের বেলায় বৃষ্টিতে ভিজব?”
“হ্যাঁ, কিচ্ছু হবে না। চুপি চুপি ছাদে গিয়ে ভিজে আসব। কেউ জানবে না।”
“না, না শাপলা বাদ দাও। দিনে বৃষ্টি এলে তখন ভিজব।”
“প্লিজ আপু! প্লিজ! আমার জন্য? চলো না!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শাপলা এতবার করে অনুরোধ করছিল যে, অবশেষে অনুর রাজি না হয়ে আর উপায় ছিল না। সে আর শাপলা লুকিয়ে লুকিয়ে ছাদের দরজার কাছে চলে এসেছে। দরজা খোলা আছে কিনা কে জানে! শাপলা মনে মনে দোয়া করছিল দরজা যেন খোলা থাকে। তার দোয়া আল্লাহ্ কবুল করেছেন। দরজা খোলাই আছে। শাপলা খুশি হয়ে দৌঁড়ে চলে গেল ছাদে। এরপর আচমকা ভয়ে চিৎকার করে মুখ চেপে ধরল। অনু তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গিয়ে দেখল ছাদে আরো মেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজছে। সবাই এসেছে লুকিয়ে। প্রথম প্রথম প্রত্যেকে ভয় পেয়ে গেলেও পরক্ষণে আবার সবাই হেসে ফেলেছে। অনুর খুব করে বাড়ির কথা মনে পড়ছে। এরকম যে কত কাজিনদের সাথে লুকিয়ে ভিজেছে! সব এখন স্মৃতি। সবার সাথে আজকের বৃষ্টিতে ভেজাও অনুর জীবনে স্মরণীয় থাকবে। এত আনন্দ ও ঝলমলে হাসির মাঝেও কেউ টের পেল না যে, অনুর দুচোখ বেয়ে কোনো একজনের জন্য নোনাজল গড়িয়ে পড়েছে!
সকাল হতে হতেই বাড়িতে আজ ছোটো ফুপি এসেছেন। এসেছেন অবশ্য বিশেষ একটা কারণেই। কিন্তু সকালে এসে সবাইকে পাওয়া গেল না। দুপুরেও না। তাই তাকে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। খুব ভালো একটা মেয়ের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। তারই এক বান্ধবীর ভাগ্নি হয়। ছোটো ফুপির ভাষ্যমতে, মেয়েটা ভীষণ সুন্দরী, রূপবতী এবং গুণবতীও। সবে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। রিয়াদের সঙ্গে দারুণ মানাবে। প্রস্তাব শোনা মাত্রই রিয়াদ বেঁকে বসেছে। সে তার পূর্বের জেদেই অটল থেকে বলল,
“আমি তো কতবার বলেছি, বিয়ে করব না। তাও কেন তোমরা আমার পেছনেই পড়ে থাকো?”
দাদা বললেন,
“তুই বংশের বড়ো নাতি। তোর বিয়ে না করিয়ে বাকিদের করাব কীভাবে?”
“এই মডার্ন যুগে এসেও কি কেউ ছোটো, বড়ো মানে দাদু? আমি আসলে নিজেই চাচ্ছি না বিয়েশাদি করতে। তোমরা রায়ানের জন্য মেয়ে দেখো। ওকে দিয়েই বিয়ে শুরু করো।”
রায়ান কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,
“মাঝখানে আমাকে কেন টানছিস?”
“কারণ আমি বিয়ে করব না।”
“ভালো কথা। এর মানে তো এই নয় যে তোর হয়ে আমায় বিয়ে করতে হবে।”
দাদু রিয়াদের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
“রায়ানকে নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। ওর বিয়ের সময় হলে তখন আমরাই ভাবব। আগে তোর বিয়েটা হোক।”
“আমি বিয়ে করব না, দাদু!”
“আর কোনো নিষেধ শুনতে চাই না। অনেক শুনেছি। এই পর্যন্ত একটা কারণও দেখাতে পারিসনি বিয়ে না করার। আমরা এবার এই মেয়েকে দেখতে যাব। এটাই আমার শেষ কথা।”
রিয়াদ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। যেখানে বাবা, চাচারাই দাদুর মুখের ওপর কথা বলেন না, সেখানে তখন সেও এই সাহস দেখাতে পারে না। বাধ্য হয়েই তাকে চুপচাপ দাদুর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হলো। ছোটো ফুপি খুশি হয়ে বললেন,
“তাহলে আমরা কাল-ই যাই মেয়ে দেখতে?”
সবাই সম্মতি দিল ছোটো ফুপির কথায়। ছোটো ফুপি এবার অনুকে বাড়িতে আনার জন্য বললেন। গত দুদিন ধরে অনু জ্বরে ভুগছে। বাড়ির কারো সাথেই দেখা করেনি। এই অজুহাত, ওই অজুহাত দেখিয়েছে। কিন্তু আজই খবরটা জানতে পেরেছে আয়ান। সে বলল,
“অনুর জ্বর দুদিন ধরে।”
তাহমিনা বেগম আঁতকে উঠে বললেন,
“কী বলিস! আগে কেন বলিসনি?”
“আমি তো নিজেই জানতাম না। এজন্যই আমাদের কারো সাথে দেখাও করেনি। আজকে ওর রুমমেট আমাকে ফোন করে জানিয়েছে অনুকে না জানিয়ে। হোস্টেলে গিয়েছিলাম ওকে নিয়ে আসতে। আসেনি।”
তাহমিনা বেগম স্বামীকে বললেন,
“তুমি একবার যাও না। মেয়েটার এত জেদ!”
আলমগীর চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন,
“আজকে তো আর সম্ভব না। কাল সকালে গিয়ে নিয়ে আসব। তুমি চিন্তা কোরো না।”
চিন্তা কোরো না বললেই তো আর চিন্তা করা বন্ধ হয়ে যায় না। সারারাত তাহমিনা বেগম দুশ্চিন্তায় পার করলেন। আলমগীর চৌধুরীর চোখেও ঘুম নেই। কীভাবে যে মেয়েটাকে বুঝিয়ে বাড়িতে আনবেন বুঝতে পারছেন না তিনি!
অনুর আজ গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাসটেস্ট আছে। এই নাম্বার গিয়ে যোগ হবে সেমিস্টার ফাইনালে। তাই গত দুদিন না গেলেও আজ ক্লাসে যাওয়ার জন্য শাপলার সাথে বের হয়েছে। জ্বরে তার জবুথবু অবস্থা। এলোমেলো পা ফেলে গেইট থেকে বের হতেই রোমিও দৌঁড়ে এসে অনুর পেঁচিয়ে ধরল। আচানক অনু স্তব্ধ হয়ে গেছে। শাপলা ভয়ে পিছিয়ে গেছে দুই পা। অনুর হাত ধরে টানছে সে পেছনে নেওয়ার জন্য। অনু সরল না। উবু হয়ে রোমিওকে কোলে তুলে নিল। কতদিন পর দেখল রোমিওকে! অনুর দুচোখে পানি। সে কাঁদতে কাঁদতে রোমিওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ মাথায় এলো রোমিও কী করে এলো হোস্টেলের সামনে? ওর কি এখনো পথ মনে আছে? মনে থাকার তো কথা নয়! তাহলে কার সাথে এসেছে? নিশ্চয়ই ভাইয়েরা এসেছে আবার। অনু টলমল চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখল, ওর থেকে কিছুটা দূরে রায়ান ভাই দাঁড়িয়ে আছে। অনুর বিশ্বাস হচ্ছিল না। ভ্রম মনে হচ্ছিল। নিশ্চয়ই জ্বরের ঘোরে আবোল-তাবোল দেখছে। রায়ান ভাই অনুর কাছে এগিয়ে এলো। অনুর চোখের পানি মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ১১
“কাঁদছিস কেন?”
অনু তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারল না। রায়ান ভাইয়ের কাছে আসা, তার কণ্ঠ, স্পর্শ তো ভ্রম হতে পারে না। এতটা ভুল তো অনু হতে পারে না কখনো। এত অপেক্ষা, প্রতিক্ষার পর মানুষটা সত্যিই এসেছে? পরক্ষণে আবার রায়ানের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল অনুর। চোখ-মুখ শক্ত করে ফেলল সে। অস্ফুট কণ্ঠে বলল,
“আপনি!”
রায়ান ভাই জবাব দিল না। পুনরায় অনুর গালে লেপ্টে থাকা চোখের পানি মুছে দিয়ে, অনুর মাথাটি নিজের বুকে রেখে আলতো করে জড়িয়ে ধরল।