তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ৫

তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ৫
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

রায়ান ভাইয়ের হঠাৎ এমন রাগের সম্মুখীন হয়ে অনু ভয়ে কান্না করে দিল। রায়ান কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ হয়ে অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে ওকে ছেড়ে দিল। জবাবের অপেক্ষা না করে সে নিজেই নেমে গেল নিচে। অনু চোখের পানি মুছে শাড়িটা খুলে দড়িতে রাখল। নিজেকে ধাতস্থ করার জন্য রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ানোর পর মাথায় সুবুদ্ধি এলো যে, কেন সে রায়ান ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিল না! এটাই তো সুযোগ ছিল মনের কথা জানিয়ে দেওয়ার। অথচ ও কিনা ভয় পেয়ে কান্না করে ফেলল! অনুর এখন এত আফসোস হতে লাগল!

দীর্ঘশ্বাস নিয়ে অনু নিচে নামতে যাবে তখন দেখতে পেল ছাদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে জুঁই আর আয়ান ফিসফিস করে কথা বলছে। বারান্দার আলো কিছুটা সিঁড়িতে পড়ে। অনু কথা না শুনতে পারলেও ওদের দেখে এতটুকু বুঝতে পারছে যে, আয়ান জুঁইয়ের রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে। জুঁই দুহাত বগলদাবা করে দাঁড়িয়ে মুখ গোমড়া করে রেখেছে। আয়ান হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কী যেন বোঝাচ্ছে। কিন্তু জুঁই বুঝতে চাচ্ছে না। অনু রেলিঙ ধরে বসে পড়ল অন্ধকারে। খুব কৌতুহলী হয়ে সে বোঝার চেষ্টা করছে আসলে হচ্ছেটা কী এখানে! সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দুজনকে দেখছে। আয়ান যখন কোনোভাবেই জুঁইকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছিল না, তখন আয়ান আচমকা জুঁইকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেল। এই দৃশ্য দেখে অনু চিৎকার করতে গিয়েও দুহাতে নিজের মুখ চেপে ধরল। নিজের চোখকেই সে বিশ্বাস করতে পারছে না! এই পর্যায়ে জুঁইয়ের রাগ গলে পানি হয়ে গেছে। সে এখন আয়ানের বুকে মাথা রেখে কাঁদছে আর কী যেন বলছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অনুর মাথা কাজ করছে না। এই মাত্র সে যা দেখল, এতে অন্তত এটুকু তো পরিষ্কার যে তার ভাইয়ের সাথে রায়ান ভাইয়ের বোনের একটা সম্পর্ক চলছে। কিন্তু কেন? রায়ান ভাইয়ের বোনের সাথেই কেন? এই কথা যদি কোনোভাবে রায়ান ভাইয়ের কানে যায় তাহলে বাড়িতে তো কুরুক্ষেত্র ঘটে যাবে। অনুর এবার সত্যি সত্যিই ভীষণ কান্না পাচ্ছে। নিজে জুঁইয়ের ভাবি হতে গিয়ে এখন জুঁইকেই ওর ভাবি বানাতে হবে। এবং এর বিনিময়ে হারাতে হবে রায়ান ভাইকে। এমনিতেই তো সে অনুকে বিশেষ পাত্তা দেয় না, সবসময় রুড আচরণ করে। আর এখন যদি জানতে পারে আয়ান ওরই বোনের সাথে প্রেম করছে তাহলে কী যে হবে অনু তা কল্পনাও করতে পারছে না!
আয়ান এবং জুঁই চলে না যাওয়া পর্যন্ত অনু ছাদে অপেক্ষা করতে গেল। উঁকি দিয়ে দেখল ওরা আর এখন নেই। সে উদাস মনে নিচে নামার সময় বারান্দায় সূর্যর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সূর্য ওর এমন মুখাবয়ব দেখে জিজ্ঞেস করল,

“কী হয়েছে?”
অনু উদাস হয়েই উত্তর দিল,
“কিছু না, ভাই। সর এখন। ভালো লাগছে না।”
‘ভাই’ ডাক শুনে সূর্য তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলল,
“এখন তোমাকেও আমার ভালো লাগছে না! যাচ্ছি আমি।”
অনুর মেজাজ চটে গেল। সে ধমক দিয়ে বলল,
“অ’সভ্য, বেয়া’দব যেন কোথাকার!”
ততক্ষণে সূর্য রুমে ঢুকে গেছে। সামনে এসে পড়েছে রায়ান ভাই। অনু থতমত খেয়ে বলল,
“আপনাকে বলিনি, আপনাকে বলিনি! সূর্যকে বলেছি।”
রায়ান স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠে বলল,
“ব্যবহার ভালো কর।”
অনু নরমসুরে বলল,
“আচ্ছা।”

এরপর রায়ান চলে যাওয়ার পর ভেংচি কেটে বলল,
“ব্যবহার ভালো কর! আসছে আমার উপদেশওয়ালা। নিজের যা ব্যবহার হুহ্!”
রাতে সবার সঙ্গে খেতে বসার পর অনুর আলাদা দৃষ্টি পড়েছে আয়ান এবং জুঁইয়ের দিকে। দুজন, দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসছে মিটিমিটি, চোখে চোখে কথা বলছে। এদিকে অনুর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। একবার সে অসহায়ভাবে রায়ান ভাইয়ের দিকেও তাকাল। চোখাচোখিও হয়ে গেল দুজনের। ভাত মুখে তুলতে গিয়ে বিষম খেয়ে গেল। রিয়াদ অনুর পাশে ছিল। ও দ্রুত পানির গ্লাস এগিয়ে গেল অনুকে। মাথায় হালকা চাপড় দিতে লাগল। রায়ান ভাবলেশহীনভাবে চুপচাপ খাচ্ছে। অনু কিছুটা শান্ত হলে রিয়াদ জিজ্ঞেস করল,

“এখন ঠিক আছিস?”
অনু মাথা নাড়াল। মাঝে মাঝে তার এটা ভেবে খুব চিন্তা হয় যে, রায়ান ভাই কেন রিয়াদ ভাইয়ের মতো নরম মনের মানুষ হলো না?
খাওয়ার পর অনু আজ নিজেই রায়ানের জন্য কফি নিয়ে গেল। সরি বলার এটাই সুযোগ। যদিও সরি বলার মতো সে কোনো কাজ করেনি। কিন্তু তবুও রায়ান ভাইকে দেখে মনে হয়েছে সে খুব রেগে আছে অনুর ওপর। হয়তো ছাদের ঐ ঘটনার জন্য। সে যাই হোক, অনু সবসময় তার নিজের দিক থেকে ক্লিয়ার থাকতে চায়। নিজের সম্পূর্ণ এফোর্ট সে রায়ান ভাইয়ের জন্য দেবে। ব্যাটার মন না গলে যাবে কোথায় সেও দেখে ছাড়বে।

“রায়ান ভাই, আসব?”
রায়ান একবার চোখ তুলে দেখল অনুকে। বলল,
“আয়।”
অনু কফির মগ টেবিলের ওপর রেখে বলল,
“সরি, ছাদে বেয়া’দবি করার জন্য। আমার উচিত ছিল আপনার কথা শুনে তখনই নিচে চলে আসা। আর কখনো কথার অবাধ্য হবো না।”
রায়ান এসব কথার ধারে-কাছেও গেল না। সে ল্যাপটপে টাইপিং করতে করতে বলল,
“খাওয়ার সময় ঐরকম ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবি না। বিরক্ত লাগে!”
অনুর মুখটা হা হয়ে গেল। অপমানবোধ এবং লজ্জা দুটোই লাগছে। মুখের ওপর এভাবে বলে কেউ? বলে তো! এইযে উনি বলে। মাত্রই বলল। অনু আর কোনো কথা বলতে পারল না। চুপচাপ নিজের রুমে চলে এলো।

সকালে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে অনু। আজ দুটো ক্লাস টেস্ট আছে। এই মার্কস যোগ হবে ফাইনাল সেমিস্টারে। এমনিতেই তো সে পড়ালেখায় লাড্ডু, তারওপর যদি পড়তে না বসে তাহলে তো সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই সকালে উঠেই পড়তে বসেছে। এই ফাঁকে একবার জানালা দিয়ে দেখল রায়ান ভাই জগিং করতে বের হয়েছে। পরীক্ষাটা না থাকলে অনুও সাথে যেতে পারত।
ক্লাস টেস্ট আছে বলে আজ সবার আগেই নাস্তা করে নিয়েছে অনু। আয়ানেরও আজ ভার্সিটিতে কাজ আছে। তাই সে অনুকে নামিয়ে দিয়ে নিজের ভার্সিটিতে যাবে। বাইকে উঠে অনু ভাবতে লাগল জুঁইয়ের বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবে কিনা। দোনোমনা করে কৌশলে প্রশ্ন করল,

“ভাইয়া একটা প্রশ্ন করব?”
আয়ান ভিউ মিররে অনুর মুখটা দেখে বলল,
“বল।”
“তুমি কি কাউকে ভালোবাসো?”
অনুর হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে আয়ান বেশ অবাক হয়েছে। সে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”
“এমনিই জানতে ইচ্ছে করল।”
“তুই তো এমনি এমনি প্রশ্ন করার মেয়ে না, অনু। তোকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। সত্যিটা দ্রুত বল।”
অনু মুখটা কাচুমুচু করে বলল,

“গতকাল রাতে তোমাকে আর জুঁই আপুকে আমি একসাথে দেখেছি কথা বলতে। সব দেখেছি।”
সঙ্গে সঙ্গে আয়ান ব্রেক কষল। অনু পড়তে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আয়ানকে। ভয় ও বিরক্ত মেশানো ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
“ভাইয়া! আস্তে ব্রেক করবে তো! এখনো বিয়ে হয়নি আমার।”
আয়ান বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলল,
“কী বললি?”
“বললাম যে, এখনো তোমাদের বিয়ে খাইনি তো।”

“অনু, খবরদার এসব কথা যেন কারো কানে না যায় এখন। আমার লক্ষ্মী, সোনা, কলিজা বোন। তুই যা খেতে চাইবি আমি তা-ই খাওয়াবো।”
আয়ান বড়ো ভাই হয়েও ওকে ভয় পাচ্ছে বিষয়টা অনুর খুব মজা লাগছে। সে ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
“আমি কিছু খেতে চাই না। তবে অন্য কিছু চাই। দেবে?”
“অবশ্যই। তুই শুধু বল কী চাস?”
“উমম! এখন না। সময় হলে চেয়ে নেব। তখন কিন্তু আমাকে ফিরিয়ে দিলে হবে না। যা চাইব এনে দিতেই হবে। মনে থাকবে?”

“থাকবে রে আমার জান। শুধু তুই আমাদের বিষয়টা কাউকে বলিস না।”
“ওকে ডিল ডান। কাউকে বলব না নিশ্চিন্তে থাকো। আর এখন চলো। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
যেতে যেতে অনু ভাবতে লাগল, সময় হলে সে রায়ান ভাইকে চাইবে। রায়ান ভাই অন্তত আয়ান ভাইয়ার অনুরোধ তো রাখবে। দেখাই যাক, সামনে কী হয় এখন। ততদিন পর্যন্ত পেটের কথা পেটেই রাখতে হবে।
ক্লাস টেস্ট দিয়ে, পরের একটা ক্লাস আর করেনি অনু। ভালো লাগছিল না। তাই ক্লাস মিস দিয়ে চলে এসেছে। পথে সেই কুকুর ছানাটির সাথে আবার দেখা। অনুর জন্যই যেন এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। অনুকে দেখে লেজ নাড়াতে নাড়াতে কাছে এগিয়ে গেল। ওকে দোকানে নিয়ে রুটি কিনে দিল অনু। কুকুরটি পূর্বের মতো লেজ নাড়িয়ে অনুর চারপাশে একটা ঘুরানি দিয়ে রুটিটা খেতে লাগল। দোকানদার এই দৃশ্য দেখে হেসে বলে,

“বাচ্চাটা তো তোমার ভক্ত হইয়্যা গেছে।”
অনুও জবাবে হেসে বলে,
“তাই তো দেখছি! আচ্ছা চাচা ওর মাকে দেখি না কেন?”
“ওর মা তো ম’ই’রা গেছে গাড়ির নিচে পইড়া।”
অনু আহত হয় কথাটি শুনে। মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকায় বাচ্চাটির দিকে। জিজ্ঞেস করে,
“ওর আর ভাই-বোনকে দেখেছেন?”
“আছিল আরো তিনডা। কই জানি গেছেগা। এইডাই রইয়্যা গেছে।”
বাচ্চাটির খাওয়া শেষ হলে অনু এবার ওকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। প্রতিদিন বাড়ির কিছু আগে এসে বাচ্চাটিকে অনু পাঠিয়ে দিত। বাচ্চাটিও অনু যা বলতো তাই শুনত। আজ একদম সাথে করে বাড়িতে নিয়েই হাজির হয়েছে। মা আর চাচিরা তখন উঠানে বসে শাক বাছছিলেন। ছোটো চাচি বাচ্চাটিকে অনুর পেছনে দেখে মৃদু চিৎকারের সুরে বললেন,

“অনু, অনু তোমার পেছনে কুকুরের বাচ্চা! তাড়িয়ে দাও, তাড়িয়ে দাও। বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছে।”
হঠাৎ চিৎকারে কুকুরের বাচ্চাটি ভয় পেয়ে অনুর পেছনে লুকিয়ে পড়েছে। অনু তখন লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,
“চাচিমনি, আমি নিজেই ওকে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। ও এখন থেকে এই বাড়িতেই থাকবে।”
তাহমিনা বেগম তখন রাগে হইহই করে উঠলেন। চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,
“এই বাড়িতেই থাকবে মানে কী? মগের মুল্লুক পেয়েছিস নাকি তুই? এক্ষুনী এটাকে বের কর!”
অনু জেদি কণ্ঠে বলল,

“বললাম তো ও এই বাড়িতেই থাকবে। আমি ওকে পালব।”
“শখের তো শেষ নাই তোর! বাড়িতে কুকুর, বিড়াল পালা আমার পছন্দ না, অনু। তুই এটা খুব ভালো করেই জানিস। ও এই বাড়িতে থাকবে না। এটাই আমার শেষ কথা।”
“ও থাকলে কী সমস্যা?”
“অনেক সমস্যা। কখন কার ঘরে ঢুকে যাবে, খাবারে মুখ দেবে কোনো ঠিক নেই।”
“ও কিচ্ছু করবে না। কারো ঘরে যাবে না, রান্নাঘরেও যাবে না। কারো কোনো ক্ষতিও করবে না। আমি ওকে চোখে চোখে রাখব।”

তাহমিনা বেগম এবার ক্ষেপে গিয়ে বললেন,
“মুখে মুখে তর্ক কিন্তু ভালো লাগছে না, অনু। একটা থা’প্প’ড় দেবো এখন!”
বড়ো চাচি তাহমিনা বেগমকে থামিয়ে বললেন,
“আহা! এভাবে ধমকাচ্ছ কেন?”
“আপা, ভালোই ভালো ওকে বলেন কুকুরের বাচ্চাটিকে বাইরে রেখে আসতে।”
চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে দাদা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হয়েছে? এত হট্টগোল কেন?”
অনু এবার দাদুর কাছে ছুটে গেল। ক্রন্দনরত স্বরে বলল,

“দেখো না দাদু, আমি বাড়িতে একটা কুকুরের ছানা এনেছি বলে মা আমার সাথে কেমন রাগারাগি করছে!”
“কোথায়?” দাদু কৌতুহল প্রকাশ করলেন বাচ্চা কুকুরটিকে দেখার জন্য।
অনু আঙুল দিয়ে উঠানের দিকে দেখাল। কুকুর ছানাটি কাচুমুচু হয়ে মাথা নত করে বসে আছে। দাদা চোখের চশমাটি ঠিক করে পরে উঠানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ছানাটি সুন্দর! কিন্তু বাড়িতে কেন এনেছ দাদু?”
অনু আহ্লাদী হয়ে বলল,
“আমি ওকে পালব।”
“বাড়িতে?”

“হ্যাঁ। ও কারো কোনো ক্ষতি করবে না প্রমিস। আমাকে বিশ্বাস করো। প্লিজ দাদু!”
দাদা চুপ করে আছেন। অনু এবার আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
“ওর মা রোড এ’ক্সি’ডে’ন্টে মা’রা গেছে দাদু। ওর ভাই-বোনগুলোও যেন কোথায় চলে গেছে। ও একা। আমার খুব মায়া লাগছে ওর জন্য। তাই নিয়ে এসেছি। তুমি ওকে থাকার একটু জায়গা দেবে না?”
দাদু গলে গেলেন। নাতনির পরোপকারি মনোভাব দেখে খুশি হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“বেশ! ও এই বাড়িতেই থাকবে। কিন্তু শর্ত একটাই কাউকে যেন জ্বালাতন না করে। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে দাদাজান। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।”

তাহমিনা বেগম রাগে ফুঁসছেন। কিন্তু যেখানে তার শ্বশুর নিজেই অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন, সেখানে অন্য কারো আর দ্বিমত থাকার কথা নয়। বাড়ির বাকি বড়োরা বিষয়টি পছন্দ না করলেও ছোটোরা ভীষণ পছন্দ করেছে। কুকুর ছানাটিকে পেয়ে ওরা সবাই ভীষণ খুশি। সবাই মিলে ওকে ঘিরে বসেছে। খুব অল্প সময়ে বাচ্চা কুকুরটি একদম ছোটোদের মন জয় করে ফেলেছে। বন্ধু হয়ে গেছে সবার। ছোটোরা সবাই ওকে এত পছন্দ করে ফেলেছে যে ওর কী নাম রাখা যায় সেটি ভাবছে এখন। অনেক ভেবে-চিন্তে, সবাই মিলে সুন্দর একটা নাম বাছাই করেছে। রোমিও। এখন থেকে বাচ্চা কুকুরটির নাম রোমিও।

রাত ১০টা নাগাদ বাড়িতে ফিরেছে রায়ান। উঠানের জলচৌকিতে পা ঝুলিয়ে সে মাকে ডাকতে লাগল। হঠাৎ পায়ের কাছে কিছু নড়াচড়া করছে বুঝতে পেরে তড়িৎ গতিতে উঠে পড়ল সে। জলচৌকির নিচে উঁকি দিয়ে রোমিওকে দেখেই চিৎকার করে উঠল। ওর চিৎকার শুনে তাহমিনা বেগম, জোবেদা বেগম, অনুসহ বাকি সবাই ধড়ফড় করে নিচে নেমে এলো। ততক্ষণে রায়ান লাঠি খুঁজছে রোমিওকে ভয় দেখিয়ে বের করবে বলে। জোবেদা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

“কী খুঁজছিস?”
রায়ান ব্যস্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
“লাঠি খুঁজছি। বাড়িতে কুকুর ঢুকেছে। খেয়াল রাখো না নাকি!”
হাতের কাছে একটা কাঠ খুঁজে পেয়ে সেটি হাতে তুলে নিল রায়ান। রোমিওর কাছে এগিয়ে যেতেই সামনে এসে দাঁড়াল অনু। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
“ওকে কিছু করবেন না!”
“সামনে থেকে সর।” বিরক্ত হয়ে বলল রায়ান।
“না।”
“না মানে? এত সাহস তোর! কুকুরের জন্য এত মায়া হলে ওর সাথে বাইরে গিয়ে থাক।”
জোবেদা বেগম এসে তখন রায়ানকে থামিয়ে বললেন,
“এটা অনুর-ই কুকুর। বাড়িতে নিয়ে এসেছে আজ।”
রায়ান বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কেন?”
“পালবে।”
রায়ানের বিস্ময়ের শেষ নেই। বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলল,
“হোয়াট!”
জোবেদা বেগম বললেন,
“হুম। এটা নিয়ে রাগারাগি করিস না। তোর দাদা অনুমতি দিয়েছে।”
রায়ান শব্দ করে কাঠটি মেঝেতে ফেলে বলল,
“দাদার মাথাটা পুরো ব্রেইনওয়াশ করে খেয়ে নিয়েছে!”
তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“খেতে দাও।”
অনু এতক্ষণ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে ছিল। সবাই চলে যাওয়ার পর তাহমিনা বেগম অনুকে ধমক দিয়ে বললেন,
“দাঁড়িয়ে আছিস কেন এখনো? কুকুরের সাথে বাইরেই থাকবি? যা রুমে যা!”
ধমক খেয়ে অনু রুমে চলে গেল। রোমিওর জন্য ওর খুব মায়া হচ্ছে। কেন যে সবাই এত রেগে যাচ্ছে ওর ওপর!
ঘুমানোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় দরজায় নক করার শব্দ হলো। অনু ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করল,

“কে?”
বাইরে থেকে রায়ান ভাইয়ের গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠ ভেসে এলো,
“দরজা খোল।”
অনু দৌঁড়ে এসে দরজা খুলল। ভ্রুজোড়া কুঁচকে রায়ান বলল,
“তোর কুকুরকে বলে দিবি আমার আশেপাশে যেন ঘুরঘুর না করে। খাওয়ার সময় এমনভাবে তাকিয়ে ছিল! খাবার দিলাম। খেলোও না। তাহলে এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কী? এখন একটা কুকুরের বাচ্চার জন্য যদি আমার পেট খারাপ হয় এটা তো আমি বরদাস্ত করব না।”
অনু ভয়ে ভয়ে বলল,
“ওর একটা নাম আছে, রায়ান ভাই। ওর নাম রোমিও। দয়া করে বারবার কুকুরের বাচ্চা বলবেন না। শুনতে খুব বিশ্রী লাগে!”

তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ৪

রায়ান ভাই বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
“ঢং দেখলে আর বাঁচি না! কুত্তার আবার নাম! যাই হোক, তোর রোমিওকে মনে করে নিষেধ করবি আমার আশেপাশে না ঘুরতে।”
অনু মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আচ্ছা।”
রায়ান ভাই চলে যাওয়ার পর অনু দীর্ঘশ্বাস নিল। বুঝতে পারল, ওর না হওয়া প্রণয়ের পথে আয়ান ও জুঁইয়ের পর এবার রোমিও একটা বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। কী করে যে সে রায়ান ভাইয়ের মন গলাতে পারবে!

তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ৬