তুমি আছো তুমি রবে পর্ব ১৩

তুমি আছো তুমি রবে পর্ব ১৩
রেহানা পুতুল

ঝিনুক এলোমেলো ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। নিজেকেই প্রস্ন করলো। হঠাৎ তার এত পরিবর্তিত নমনীয় আচরণ? এত নিবেদিত প্রণয়? সত্যি? নাকি উদ্দেশ্যপ্রাণিত?
শেষ বিকেলে ঝিনুকের বড়বোন জিনিয়া এলো। সাথে স্বামী রাকিব ও তাদের একমাত্র মেয়ে রুশদী।
প্রিয়জনদের মুখ দর্শনেই ঝিনুক চঞ্চল চড়ুইয়ের মতো লম্পঝম্প শুরু করে দিলো। আদরের ভাগনিকে কোল থেকে কিছুতেই ছাড়ছেনা।

ঝিনুক ভেংচি কেটে রাকিবকে জিজ্ঞেস করলো ,
কি হে মিয়াভাই। আজ চাঁদ কোন গগনে উঠলো?
জিনিয়া উওর দিলো। চাঁদ আজও উঠেনিরে ঝিনু। আব্বু খবর দিয়েছে সবাই আসার জন্য। কি আলাপ আছে নাকি আমাদের সাথে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আব্বু কেন খবর দিলো তোদের হঠাৎ?
আমরা কি জানি?
এমন কথাবার্তার মাঝেই সন্ধ্যা মিলিয়ে গেলে তার বাবা এলো বাইরে থেকে। নাস্তা খাওয়া শেষে সবাইকে নিয়ে খাটে বসলো। জমি বিক্রি করা, চাকরি ছেড়ে দেয়া, জামান খানের সাথে আলোচনা হওয়া বিস্তারিত সবাইকে খোলাসা করে জানালো।

রাকিব,জিনিয়া,তাদের মা পারুল পূর্ণ সহমত দিলো বিনাবাক্যব্যায়ে।
ঝিনুক অবাক হয়ে গেলো শুনে। বললো , আমিতো এর কিছুই জানিনা আব্বু। আজ না এলেতো জানতামওনা। যাই হোক তবে এটা একবার আমিও ভেবেছি। কিন্তু তোমাদের বলার সাহস পাইনি। উনি আমাদের জমি কিনে কি করবে? এটাই তো মাথায় ধরলোনা আমার।

কারণটা নাকি উনি কেনার সময় জানাবে। আমাদের এলাকা উন্নত। গ্রামেই ভাড়া চলে। সম্ভবত উনি বাড়ি করে ফ্যামেলি ভাড়া দিবে। বলল তার বাবা।
আমার ও এমনটাই মনে হচ্ছে বাবা। বেশ চিন্তা করে বলল রাকিব।
ঝিনুকের অভিমানী চিত্ত প্রসন্ন হয়ে গেলো আরশাদের প্রতি । মন বাগিচার ফুলেরা দুলে দুলে তার অনুভূতিকে দোল দিতে লাগলো। অনেক রাত জেগে বোনের সাথে গলাগলি করে নানান গল্প করলো।

এদিকে আরশাদ ফোনের স্কিনে বারবার খেয়াল করছে মেসেজের রিপ্লাই এলো কিনা। নাহ। ঝিনুক তাকে না ফোন করলো। না রিপ্লাই দিলো। দপ করে নিভে যাওয়া আগুনের মতো তার আগ্রহ অনাগ্রহে রূপ নিলো। নয়তো একটু আগেও ভেবেছে ঝিনুককে কাল বিকেলে গিয়ে নিয়ে আসবে। এখন আর যাবেনা। ড্রাইভার পাঠিয়ে দিবে চলে আসার জন্য।

কি ভাবো তুমি নিজেকে? সব জানিয়ে দিলাম। তারপরেও ভুল বুঝে আছো? তোমার মনে সন্দেহ দানা বেঁধে আছে এখনো? এতটাও ঠিকনা ঝিনুক। নিজেকে আর কত অসহায় করে তুলবো তোমাকে পাওয়ার জন্য। আমি পুরুষ। আমার পার্সোনালিটি নেই? তাও বির্সজন দিচ্ছি। তবুও তুমি টলছোনা। জাস্ট আর একবার শেষবারের মতো চেষ্টা করবো। আগে বাসায় আসো তারপর। ব্যাস । এরপর তুমিও আর আমার নাগাল পাবেনা।

মারিয়া চলে গেলো আরশাদের উপর পুঞ্জীভূত ক্রোধ নিয়ে। আরিশাও ঝিনুকের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। তার প্রণয়ের সুরাহা করার বুদ্ধি দেওয়ার জন্যে।
ঝিনুক ও চায়না আরশাদ তাকে আনতে যাক তাদের বাসায়। কারণ সে জানে কাউকে কিছু না দিয়, তার থেকে কিছু প্রত্যাশা করাটা স্বার্থপরতা আর বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। পড়াশোনার বারোটা বেজে যাচ্ছে। দুদিন শেষ হয়ে আজ তিনদিন হলো। বিকেলে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। সি এন জি করে চলে যাবে।

এমন সময় ড্রাইভার গিয়ে জানালো, ভাইজান বলছে আপনাকে নিয়ে যেতাম। ঝিনুক সাতপাঁচ না ভেবেই প্রিয়জনদের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলো। ড্রাইভারকে কিছুই বুঝতে দিলোনা।
নিজেদের সমস্যার কথা তৃতীয় ব্যক্তির কানে যাওয়া মানেই বহুজনের কানে পৌঁছে যাওয়া।

নিজের দূর্বলতার সুযোগ কখনোই তৃতীয় ব্যক্তিকে জানাতে নেই। এতে নিজেরই ক্ষতি হয় সবার চেয়ে অধিক।
ঝিনুক বাসায় পৌঁছে গেলো। শ্বশুর শাশুড়ীর সাথে দেখা করলো। তার মা কিছু হাতের রান্না খাবার দিয়েছে তাদের জন্য। আরিশা চার বাটির টিপিন বক্সটি খুলেই মুখে এটা ওটা পুরে দিলো। মজা করে খেলো। ঝিনুক পরিতৃপ্তির হাসি হাসলো।
এই মেয়েটাকে পুত্রবধূ করে আমরা কোনভাবেই ঠকেনি। বরং বহুভাবে জিতেছি। জোবেদা বেগম ও জামান খান দুজনেই আরেকটিবার একথা স্বীকার করতে বাধ্য হলো।

আরিশা ঝিনুককে বারান্দায় নিয়ে গেলো। নাক কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
কিরে ঝিনুক,আছোতো নিজেদের রসায়ন নিয়ে। আমারটার কি হবে। ভাবছো?
নিজেরটার খবর নেই আবার তোমারটা। নাকিসুরে বলল ঝিনুক।
তোমারটা ঠিক নেই মানে? ক্লিয়ার করতো বেবি?
ঝিনুক নিজেই বেকুব বনে গেলো নিজের বলা বাক্যে। কথা ঘুরিয়ে নিলো।
আরেহ উনি কই? এটা মিন করছি।

ওহ তাই বলো। তোমার নাগর বাসায় নেই। এখনো আসেনি। দেখনা ব্যস্ততার জন্য তোমাকেও আনতে যেতে পারেনি।
ঝিনুক আরিশার হাত ধরে বললো ,
শুনো, নিলম হলো তোমার ক্যাম্পাসের এক বড় ভাই। তোমাদের প্রেমলীলা চলছে। দুজনে দুজনকে বিয়ে করতে রাজী। কিন্তু তোমার পরিবার থেকে বাধা আসবে নিলম বেকার পাত্র বলে।

এইতো?
একজেক্টলি ভাবি।
আর নিলমের পরিবার থেকে মেনে নিবে?
না নেয়ার কোন কারন আছে ভাবি?
তা হয়তো নেই। আচ্ছা আমি সবাইকে আস্তে আস্তে ম্যানেজ করার চেষ্টা করবো। আর সময়তো আছেই। তুমি মাত্র সেকেন্ড ইয়ারে উঠলে।

আরেহ ভাবি বাবা তার একমাত্র মেয়ের জামাই দেখতে চায়। তাই মাঝে মাঝে পাত্র দেখা শুরু করে। ঘটককে আমার বায়োডাটা দিয়ে রাখছে বাসা থেকে।
আর ভাবি আরেকটি কথা। মানে আমাদের বিয়ে তো হবেই। নিলম একটু একান্তে পেতে চায় আমাকে। বাইরে তো চুমু খাওয়া ও নিষেধ। সব স্থানেই পুলিশ ব্যাটারা টহল দিতে থাকে। দু বছর ধরে প্রেম করছি। আজ অবধি হাত ধরা ছাড়া আর কোন স্বাদই পাওয়া যায়নি প্রণয়ের।
এ ব্যাপারে আমি কিভাবে হেল্প করবো ননদী?

শুক্রবারে আব্বু আম্মু এক আত্মীয়কে দেখতে তাদের বাসায় যাবে। সালেহাও ছুটি নিয়েছে। তুমি ভাইয়ার কাছে বায়না ধরবে বাইরে সিনেমা দেখবে। লাঞ্চ করবে। ঘুরবে। তখন নিলমকে বাসায় আনবো।
ঝিনুক বলতে বাধ্য হলো, তোমার ভাইয়াকে এটা আমি ভুলেও বলতে পারবোনা। আমাদের অনুরাগ পর্ব চলতেছে। প্লিজ আরিশা।

আরিশা একটু থেমে ইউরেকা। তুমি আর আমি শুক্রবারে কিছু একটা বলে বের হবো। আমি নিলমের সাথে যাবো। তুমি আমি আসা পর্যন্ত সময় কাটাতে পারবে বাইরে?
ঝিনুক বলল, পারবো। কিন্তু এটা কি ঠিক হবে? তোমরা কিইই..?
আরেহ ভাবি নাহ। একটু ঘনিষ্ঠ হওয়া এই। তোমাকে ছুঁয়ে প্রমিজ করছি। কিছুই হবেনা।
ওকে ডান কালননদী।

উম্মাহ সুইটহার্ট ! বলে আরিশা ঝিনুকের গালে চুমু খেয়ে নিজের রুমে দৌড়ে ঢুকে গেলো।
ঝিনুক নিজেদের রুমে গেলো। পড়ার টেবিলে বইখাতা গুছিয়ে নিচ্ছে সকালে কলেজে যাওয়ার জন্য। একটুবাদে আরশাদের উপস্থিতি টের পেয়েই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আরশাদ বেশ বিরক্ত হলো মনে মনে ঝিনুকের ছেলেমানুষী দেখে।
ফ্রেস হয়ে আরশাদ ডাইনিং টেবিলে গিয়ে ভাত খেয়ে নিলো। বাইরে কিছুই খায়নি। তাই ক্ষুধাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
কলিংবেল বেজে উঠলো। আরশাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে গেট খুললো।

অচেনা একলোক। কাকে চাচ্ছেন? আরশাদ জিজ্ঞেস করলো।
আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনার আব্বায় চিনবে। উনি আছে বাসায়?
না এখন নেই। আমাকে বলেন।
আমি ঘটক আজহারউদ্দীন। পাত্রীর সন্ধানে আসছি। আপনাদের ঘরে না বিবাবযোগ্য কন্যা রয়েছে?
হুম আছে।

ঝিনুক ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো। ঘটক লোকটি দরজা থেকেই উঁকি দিলো ভিতরে। আরিশা দরজার সামনে ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ালো।
আরশাদ বুঝে নিলো আরিশার কথা বলছে। তাই আরিশাকে দেখিয়ে ওহ হচ্ছে আমার ছোটবোন আরিশা।
ঘটক বলল ইনি না। যিনি আমাকে বলছেন, সে হিসেবে পাত্রী উনি বলেই ঝিনুককে দেখালো। ঝিনুক ও শুনতে পেলো।
আরশাদ গমগমে গলায় বলল, আপনি এক্ষুনি চলে যান বলছি।

ঘটক বললো, এই বোনকে বিয়ে দিতে চান। ওই বোনকে বিয়ে দিবেন না। গলায় ঝুলিয়ে রাখবেন নাকি। যত্তসব। ঘটক চলে গেলো। আরিশা হেসে গুঁড়ি গুঁড়ি হয়ে যাচ্ছে।
এটা হাসির মতো বিষয়? বেক্কল কোথাকার? দূর হ বলছি। চোখ পাকিয়ে বলল আরশাদ।
হাসি নিষ্পাপ। ফ্রেস। তাজা। চাঁদের মাঝেও খুঁত আছে। কিন্তু হাসির মাঝে কোন খুঁত নেই। বলে হনহন পায়ে আরিশা চলে গেলো।

আরশাদ ঝিনুকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একহাতকে মুঠোবন্ধী করে টেনে হিঁচড়ে রুমে নিয়ে গেলো। দরজা বন্ধ করে দিলো। ঝিনুক ঘাবড়ে গেলো। তবে নিঃশ্চুপ হয়ে আছে।
কি ব্যাপার ঘটক তোমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে কেন? তোমাকে আনমেরিড ভাবে কেন?
ঝিনুক হালকা মেজাজ দেখিয়ে,

সো হোয়াট! এটা আমার দোষ? নাকি নিজের দোষ ঢাকতে অন্যকে দোষী করছেন? কোন রাজনৈতিক দল করেন আপনি?
আরশাদ বললো, আমি আসছি। একটুও নড়বেনা। চুপ হয়ে এখানে বসে থাকো বলছি।
আরশাদ দরজা খুলে বেরিয়ে গেলে ঝিনুক ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।
আরশাদ এসে তা বুঝতে পারলো। আধ ঘন্টা হয়ে গেলো। ঝিনুকের বের হওয়ার নাম নেই।
আরশাদ রেগে গেলো। ঝিনুককে শুনিয়ে জোরে জোরে বলছে,

কাল সকালেই মিস্ত্রি এনে ওয়াশরুম ভেঙ্গে ফেলবো। কমন ওয়াশরুম ইউজ করবে। অযথাই কারণে অকারণে ওয়াশরুমে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে চোরের মতো। যেন ওয়াশরুম তার কাছে মহামূল্যবান রত্ন।
ঝিনুক শুনে নিজের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরলো। যেন হাসির শব্দ দেয়াল ভেদ করে তার কানে না পৌঁছাতে পারে
। আপন মনে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।

সাথে সাথে এই বিশ্বাসটাও জন্ম নিলো তার হৃদয়ে। আরশাদ তার প্রতি ভীষণভাবে অনুরক্ত। সে এমনটাই চেয়েছে। কারণ সেও চুপিসারে ভালোবেসে ফেলতেছে আরশাদকে। কেবল অপেক্ষা পূর্ণতার।
ওয়াশরুমে মশা পায়ে কুটকুট করে কামড়াচ্ছে। থাকা যাচ্ছেনা আর। ঝিনুক আস্তে করে বেরিয়ে এলো। বারান্দার দিকে পা বাড়াচ্ছে। অমনি আরশাদ পিছন থেকে হাত ধরে ফেললো ঝিনুকের। দরজা বন্ধ করে দিলো। ঝিনুকের দুবাহু চেপে ধরে খাটের কিনারায় বসালো। ঝিনুক বসে আছে। যেন শান্ত দিঘির জল।

আরশাদ হাঁটু গেড়ে ঝিনুকের পায়ের সামনে বসলো। একগুচ্ছ গোলাপফুল ঝিনুকের হাতের দিকে এগিয়ে ধরলো।
আই লাভ ইউ ঝিনুক।
ঝিনুক অন্যমনস্ক হয়ে আছে।
আমার প্রপোজাল একচেপ্ট না করো। অন্তত ফুলগুলো গ্রহণ করে এটা বোঝাও আমাকে যে,
ঘৃণা করোনা তুমি আমাকে।

এসিরুমেও ঝিনুক ঘেমে যাচ্ছে অনবরত। বুকের ভিতর প্রণয়ের উথাল-পাতাল ঢেউ আছড়ে আছড়ে পড়ছে। স্তব্ধ হয়ে আছে । উম্মাতাল অনুভূতি।
আরশাদ কোন রেসপন্স পাচ্ছেনা। ঝিনুকের দুচোখে নেশালো চাহনিতে অবিকল চেয়ে আছে। ঝিনুকের পায়ের পাতার উপরে নিজের হাত বোলাতে লাগলো।

তুমি আছো তুমি রবে পর্ব ১২

তক্ষুনি এমন করছেন কেন বলেই, ঝিনুক আরশাদের হাত থেকে গোলাপের তোড়াটি দুহাত দিয়ে যত্ন করে ধরে ফেললো

তুমি আছো তুমি রবে পর্ব ১৪