তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৩৬

তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৩৬
Jannatul ferdosi rimi

মেহেভীনের মুখের ভাষা যেন হারিয়ে গেছে,সে কখনোই আশা করেনি তাকে পাঠানো অচেনা চিঠি প্রেরক আর কেউ নয় আরহাম হাসান তালুকদার। আরহাম মেহেভীনের সামনে চমৎকার হাসি ঠোটে ঝুলিয়ে রেখেছে। পরণে তার ফরমাল ড্রেসাপ। আরহাম এমন হাসিতে যেকোন মেয়ে অতলে ঢুবে যেতে পারে। মেহেভীনের অবস্হাটা বুঝতে পেরে, আরহাম মেহেভীনের সেই অসম্পুর্ন ছবিখানা আঁকতে শুরু করে দেয় এবং বলে, ‘ জানো প্রেয়সী?
ছোটবেলা থেকেই আমার ছবি আঁকার বড্ড শখ ছিলো। অত্যন্ত সুন্দর কিছু দেখলেই, তা না একেঁ আমি থাকতে পারি। আমার কাছে এখন আঁকা যত ছবি আছে। সবকয়টিই তোমার। কেননা তুমি সবথেকে সুন্দর। ‘

‘ আমি তো অতো সুন্দর নই। ‘
মেহেভীনের এমন কথায় আরহাম না হেসে থাকতে পারেনা। মন মাতানো হাঁসি দিয়ে বলে,
‘আমার কাছে আমার দেখা এই পর্যন্ত সবথেকে সুন্দর তুমি ছাড়া আর কেউ নয়। কেননা আমার চোখেই আমার ভালোবাসার মানুষটিই সেরা।তুমি যেন অন্যন্যা সুন্দর। এই সৌন্দর্য়ের বর্ননা কি শুধুমাত্র কয়েকটা শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায়? ‘
মেহেভীন কিছু বললো না।তার চোখ-মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, তার মনে অনেক প্রশ্ন লুকিয়ে আছে। মেহেভীন এইবার আরহামের কাছে গিয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বললো,
‘ তার মানে এতোদিন আপনি আমার সাথে এই লুকোচুরি খেলা খেলেছেন? কিন্তু কেন? ওইদিন রং খেলার দিন ও আপনি ছিলেন তাইনা? এমনকি আমাকে পাঠানো প্রতিটা ম্যাসেজও আপনি পাঠাতেন? এইসব খেলার মানে কি মিঃ আরহাম হাসান তালুকদার? আর আপনার সাথে আমার যে মিথ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিলো, সেইটাও পূর্ব পরিকল্পনা তাইতো? কি হলো বলুন? ‘

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আরহাম কিছু বলার আগেই,মেহেভীন আরহামের শার্টের কলার চেপে, কান্নামিশ্রিত গলায় বললো,
‘ আমি আপনাকে সম্মান করতাম আরহাম সাহেব,কিন্তু আপনিও এতোদিন আমার বিশ্বাস নিয়ে খেললেন? আমার সাথে এতো বড় গেম খেললেন?ছিহ! আমিও বা কার থেকে এইসব আশা করছি? যার ভাই এতোটা খারাপ হতে পারে,সে নিশ্চয় সাধু হবে না।আসলে রক্ত বলে কথা। রক্ত তো আপনাদের এক। আপনিও আজ প্রমাণ করে দিলেন, আপনিও অভ্রের মতো প্রতারক! ‘
মেহেভীনের এমন কথায় আরহামের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেলো। আরহাম মেহেভীনের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
‘ কি বললে আমি প্রতারক? কি প্রতারণা করেছি আমি। ‘
‘ আমার বিশ্বাস নিয়ে এতোদিন ধরে খেলেছেন, তা প্রতারণা নয়? ‘
আরহাম মেহেভীনকে ছেড়ে দিয়ে, নিম্ন স্বরে বলে,
‘ আমি ভালোবেসেছি তোমায় মেহেভীন,যদি বলো তোমাকে ভালোবাসাটা প্রতারণা। তাহলে হ্যা আমি প্রতারক। কিন্তু বিশ্বাস কর এতোদিন আমি যা কিছুই করেছি,তাতে খারাপ কোন উদ্দেশ্য ছিলো না। আমি শুধুই তোমাকে ভালোবেসে গিয়েছি। ব্যাস এইটুকুই।’
মেহেভীন কিছু বলার আগেই, আরহাম মেহেভীনকে থামিয়ে বললো, ‘ তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি আজ দিবো। ‘
আরহাম মেহেভীনের হাত ধরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায়। এই গেস্ট হাউজটা সম্পুর্নটাই আরহামের। আরহাম কিনে রেখেছিলো তার ভালোবাসার মানুষটার জন্যে। নিজের হাতে বাড়িটির প্রতিটা কোনা সে সাঁজিয়ে তুলেছিলো,শুধুমাত্র তার প্রেয়সী তার মেহেভীনের জন্যে। আরহাম মেহেভীনকে বাড়ির ড্রইং রুমটায় নিয়ে গিয়ে, দেয়ালের এক কর্নারের ছবিটার দিকে ইশারা করে বলে,

‘ ছবিটা দেখতে পারছো? ‘
ছবিটার দিকে তাকিয়ে মেহেভীন অবাক হয়ে যায়। কেননা ছবিটার দুইবছর আগের। আরিয়ানদের সাথে মেহেভীনের যখন বন্ধুত্ব হয়, তখন মেহেভীন আরিয়ানের সাথে আরিয়ানদের কলেজের প্রোগামে গিয়েছিলো, তাও আবার লাল রংয়র টকটকে শাড়ি পড়ে। শাড়িটা পড়ে, মেহেভীনকে একেবারে মায়াবতী লাগছিলো, তার রুপের প্রতিটা ঝলক যেন জানিয়ে দিচ্ছিলো, এই রমনীর প্রেমে না পড়ে কি থাকা যায়না। সেই প্রোগামে আরহাম ও গিয়েছিলো। বলতে গেলে আরিয়ানের সাথেই দেখা করতে সে গিয়েছিলো, তখনি তার চোখ আটকে যায় মায়াবী এক রমনীর দিকে। আরহাম অদ্ভুদভাবে যেন প্রথম দেখাতেই মেহেভীনের প্রেমে পড়ে গেলো। তার রাত দিন যেন কেটে যেত মেহেভীনের প্রতি ভাবনায়।
আরহাম মেহেভীনের দিকে ঝুঁকে বলে,

‘ ছবিটা দেখতে পারছো? ছবির মেয়েটার কি প্রানবন্ত হাঁসি তাইনা? মুখটায় কী অজস্র মায়া। এই মায়ার দিকে তাকিয়ে প্রেমে না পড়ে কি থাকা যায়? সেই হাসির মায়ায় আমিও মোহিত হয়ে ভালোবেসেছিলাম তোমাকে প্রেয়সী। ‘
মেহেভীনের বুকটা কেঁপে উঠে। আরহামের মুখে ‘ ভালোবাসার ‘ শব্দটি যেন তার ভিতরে তোলপাড় সৃষ্টি করে দিচ্ছে।
আরহাম এইবার মেহেভীনকে, পাশের ছবিটার দিকে তাকাতে বলে, মেহেভীন তাকিয়ে দেখে তার পাশেই আরহামের ছবিখানা সেই ছবিটা মেহেভীন আরহামের বাড়িতেও দেখেছিলো। ছবিটাতে আরহাম মুগ্ধ হয়ে কারো দিকে তাকিয়ে ছিলো।
আরহাম ছবিটার দিকে মুচকি হেসে বলে,
‘ ছবিটা দেখতে পারছো মেহু? আরিয়ান তুলেছিলো। সেই অনুষ্টানের দিনে। আমি তোমার হাঁসিমাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। বিশ্বাস করো এতোটা মুগ্ধতা নিয়ে আমি কারো দিকে তাকয়নি প্রেয়সী। এতোটাই মায়াবী তুমি।তোমার প্রতিটা হাসি আমাকে প্রতিবার ঘায়েল করতে যথেষ্ট।’
মেহেভীন এইবার মুখ খুলে শক্ত গলায় বললো,
‘ আপনি যে এতো ভালোবাসার কথা বলছেন! আপনি আদোও জানেন অতীতে আমার সাথে কি হয়েছিলো?৷ কি আমার আসল পরিচয়? ‘

মেহেভীন কথায় বিদ্রুপের হাসি দেয় আরহাম।
‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি অথচ তোমার অতীত সম্পর্কে জানবো না? ‘
কথাটি বলেই, আরহাম মেহেভীনের দিকে এগিয়ে এসে, মেহেভীনের হাতজোড়া শক্ত করে ধরে বলে,
‘ আমি সবটাই জানি মেহেভীন। ‘
মেহেভীন চমকে উঠে। আরহাম সবকিছু জানে মানে? তার মানে কি আরহাম এইটাও জানে মেহেভীম অভ্রের প্রাক্তন স্ত্রী? মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই, আরহাম বলে উঠে,
‘ আরিয়ান জানতো আমি তোমায় ভালোবাসি। তাই তোমার সব ইনফরমেশন আমায় দিতো। তুমি যখন ঢাকায় চলে এলে, তখন আমি তোমার সব খবর নিয়ে জানতে পারি তুমি তো অভ্রেরই কাজিন হয়। সবকিছু যেন আমার কাছে আরো সহজ হতে লাগলো। ভেবেছিলাম অভ্রের সাহায্য নিয়ে তোমাকে নিজের মনের কথা বলবো,কিন্তু সেদিন গাড়িতে দেখালাম ,তোমার ভার্সিটির নবীর বরনের দিনে অভ্র তোমাকে সবার সামনে নিজের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেছে,তুমি তখন সবুজ রংয়ের শাড়িটা পড়েছিলে,লজ্জায় নিজের মুখখানা ঢেকে রেখেছিলে? যার মানে তুমি সম্মতি বুঝিয়েছো। বিশ্বাস করো সেদিন মনে হচ্ছিলো, কেউ বোধহয় আমার বুকটাকে ছিড়ে ফেলেছে। বুক ফেটে কান্না আসছিলো,কিন্তু আমি যে ছেলে মানুষ। ছেলেদের তো কাঁদতে নেই তাইনা? ‘
কথাটা বলতে গিয়ে, একফোটা জল গড়িয়ে পড়লো আরহামের চোখ থেকে। মেহেভীনেরও কেন যেন বড্ড কান্না পাচ্ছে। আরহাম ভেজা গলায় বললো,

‘ আমি ভেবেছিলাম তুমি এবং অভ্র একে-অপরকে ভালোবাসো, তাই তো তোমাদের মাঝ থেকে সরে এসেছিলাম আমি। আমি তো শুধু এইটুকুই চেয়েছিলাম আমার ভালোবাসা ভালো থাকুক। সে আমার গল্পের না হোক, অন্য কারো গল্পের নায়িকা হয়েই ভালো থাকুক। ‘
আরহাম মেহেভীনের একটা ছবি বের করে, হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
‘ জানো প্রেয়সী? আমি নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি। তোমার থেকে সবসময় দূরে থাকতে চেয়েছি। এমনকি বিদেশেও চলে গিয়েছিলাম। তোমাকে আমি ভূলতে সবকিছু করেছি,কিন্তু পারেনি। তুমি হীনা আমার জীবনটা ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিলো,
আমার হৃদপাখিটা তো তোমার কাছে ছিলো। বার বার তোমাকে দেখার জন্যে ছটফট করতো। কিন্তু আফসোস তোমাকে আমি চেয়েও ভূলতে পারিনি। কেননা তুমি_আছো_মনের_গহীনে। আমার ঠিক মনের গহীনে তোমার বসবাস। তোমাকে আমি কখনো ভূলতে পারেনি, আর না কখনো ভূলতে পারবো। ‘
মেহেভীনের চোখ দিয়ে অজান্তেই জল গড়িয়ে পড়লো। মানুষটা তাকে এতোটা ভালোবাসতো? ভালোবেসে এতোটা কষ্টও পেলো। আরহাম থমথমে গলায় বললো,

‘ বাকি রইলো তোমার অতীত? আরিয়ান তোমার অবস্হা দেখে যখন আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসে,আমার বউয়ের পরিচয়টা দিলো, তখন পর্যন্তও আমি জানতাম না অভ্রের করা অন্যায়ের কথা। বিদেশ থেকে এসে যখন শুনি তুমি প্রতারিত হয়েছো, তখন খবর নিয়ে সবটা জানতে পারি। অভ্র কীভাবে
তোমার সাথে প্রতারণা করেছে।বিশ্বাস করো আমার তখন জাস্ট অভ্রকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো। যাকে আমি এতোটা ভালোবাসি,তাকে অভ্র এতোটা কষ্ট দিলো?
আফটার অল আমার ভাই তো। আমার ভাইয়ের সন্তান তোমার গর্ভে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম তোমাকে এবং আমার ভাইয়ের সন্তানকে আমার বাড়িতে আমার পরিচয়ে রাখবো। দিনের পর দিন তোমার সব স্টুপিড কাজ হোক কিংবা যেকোন কাজ বার বার তোমার প্রতি যে আমার ভালোবাসাটা ছিলো,তাকে দ্বিগুন বাড়িয়ে তুলেছে। এমনকি তোমার গর্ভে যে সন্তান বেড়ে উঠছে, তার প্রতিও আমার অনেক মায়া হয়ে গেছে। সে পৃথিবীতে আসার আগেই, তাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি আমি। এখন তো আমি শুধু বেবীর পৃথিবীতে আসার অপেক্ষাতে থাকি। ‘
মেহেভীন সংকচ নিয়ে বললেন,
‘এতোদিন তা লুকিয়ে রাখলেন অথচ আজ বললেন যে? ‘
আরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

‘ সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। যখন তুমি অভ্রের শোখে কাতর ছিলে,তখন আমি আমার ভালোবাসার চিঠি দিয়ে তোমায় স্বরং করিয়ে দিতাম যে, তোমারও ভালোবাসার কেউ আছে। কেউ আছে যে এখনো তোমাকে প্রতিনিয়ত ভালোবেসে যাচ্ছে। আর দেখতে দেখতে সেই একই সঠিক সময় চলে এসেছে। তাই তোমাকে এই চট্টগ্রামে নিয়ে এসেছি, নিজের মনের কথা জানানোর জন্যে। বলতে গেলে কিছুটা পরিকল্পিতভাবে,কিন্তু এখানেও অভ্র চলে আসে। এমনকি তুমি অভ্রের থেকে শোধ নিতে আমার কাছে আসতে, সেইটাও আমি বুঝতাম। তুমি কষ্টে গুমরে মরতে। তাও আমি দেখতাম। শুধু অপেক্ষা করতাম সঠিক সময়ের। ‘
‘ সঠিক সময় বলতে? ‘
আরহাম এইবার মাথা মেহেভীনের দিকে ঝুঁকে যায়। মেহেভীন দূরে যেতে নিলে,মেহেভীন হাতজোড়া নিজের বুকের মাঝে সীমাবদ্ধ করে বলে,

‘ আমি দেখতে চেয়েছিলাম,আমার সাথে সাথে থাকতে থাকতে তোমারও কি আমার প্রতি কোন সুপ্ত অনুভুতি তৈরি হয় কিনা এবং সব থেকে মজার ব্যাপার হলো তুমিও আমাকে এই কয়দিনে অনেকটাই ভালোবেসে ফেলেছো। শুধুমাত্র অভ্রকে জেলাস ফিল করানোর জন্যে তুমি আমার কাছে আসতে না, আমার প্রতি তোমার মনেও অজান্তেই সুপ্ত অনুভুতি জমে রয়েছিলো,যা আজ ভালোবাসার রুপে পরিনত হয়েছে। ‘
মেহেভীন নিজের থেকে আরহামকে সরিয়ে, তোতলিয়ে বলে,
‘ আমি আপনাকে ভালোবাসি না। ‘
আরহাম এইবার অসহায় কন্ঠে বলে,

তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৩৫

‘ তুমি মিথ্যে বলছো মেহেভীন! তুমি আমায় ভালোবাসো। একটিবার শুধু বলো তুমি আমায় ভালোবাসো। কখনো তোমাকে কষ্ট পেতে দিবো না আমি। আমি তুমি এবং বেবী একসাথে বাকি জীবনটা সুন্দরভাবে কাটিয়ে দিবো প্রমিস। ‘
‘ আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আমি কখনো কাউকে ভালোবাসতো পারবো না। শুনেছেন আপনি মিঃ আরহাম হাসান তালুকদার? ‘
মেহেভীন খানিক্টা চিৎকার করে কথাটি বলে, বাড়ি থেকে বেড়োতে নিলে, তার পথ আটকে কেউ দাঁড়ায়।

তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৩৭