তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৪৮

তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৪৮
Jannatul ferdosi rimi

মেহেভীনের এই অবস্হায় আরহামের কাছে ছোট্ট একটা আবদার নিবেদন করেছে। সেই আবদার নাখোঁচ করার ক্ষমতা কি আরহামের আদোও আছে? আরহামের কিছুক্ষন ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো সে মেহেভীনের আবদার পূরণ করবে। আরহাম হাল্কা গলায় বললো, ‘ কোথায় যেতে চাও তুমি? ‘

‘ আপনার বাসায় নিয়ে যাবেন আমায়? আমাকে দ্রুত হসপিটাল থেকে ডিস্টার্চ করার ব্যবস্হা করুন আরহাম সাহেব। ‘
মেহেভীন নিজ ইচ্ছেয় আরহামের বাসায় যেতে চাইছে, যার ফলে কিছুটা অবাক হলেও মেহেভীনের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে বড় বড় পা ফেলে ডক্টরের সাথে কথা বলতে চলে যায়। ডক্টর জেসমিন মেহেভীন এতো তাড়তাড়ি হসপিটাল থেকে ছাড়তে না চাইলেও,আরহাম তাকে বুঝিয়ে মেহেভীনকে ডিস্টার্চ করিয়ে, বাড়িতে নিয়ে আসে। আরিয়ান ও সারারাত বাড়ির বাইরে ছিলো মধ্যরাতে সে হসপিটালে চলে গিয়েছিলো। এখন তার হসপিটালে ডিউটি রয়েছে,তাই আরহামই মেহেভীনকে বাড়িতে নিয়ে আসে। তারা বাড়িতে আসতেই,মেহেভীনের বাবা-মা মেহেভীনের মুখশ্রীকে দেখে আঁতকে উঠে। মেয়েটার মায়াবী মুখশ্রী একদিনই কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। আরহামের চোখ-মুখের অবস্হাও স্বাভাবিক নয়। আখিজোড়া কেমন করে ফুলে রয়েছে। ছেলের চোখ-মুখের অবস্হা দেখে আরহামের মায়ের বুঝতে বাকি রইলো তার ছেলেটি নিশ্চই খুব কেঁদেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আরহামের বাবা-মা মেহেভীনকে শান্তনা দিতে প্রস্তুত হলে আরহাম তাদের চোখের পলক ফেলে ইশারা করে যেন, আপাতত মেহেভীনকে কিছু যেন না বলে। মেহেভীন আস্তে আস্তে সিড়ি বেয়ে উঠতে চাইলেও পারেনা।
পেটের সিলিতে টান পড়ে। ব্যাথায় মুখ থেকে আলতো ব্যথার সুর বের করে। সেই ব্যাথার সুরের রেশ ধরে আরহাম দ্রুত মেহেভীনের হাতটাকে নিজের কাঁধে রেখে,মেহেভীনের সমস্ত ভার তার উপর নিয়ে নেয়। অতঃপর আস্তে ধীরে ধীরে আরহাম মেহেভীনের রুমে নিয়ে যায়। উপরেই উঠেই মেহেভীন সর্বপ্রথম আরহামের ঘরের সামনে মৃদ্যু ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলে। আরহামের ঘর-জুড়ে বাচ্চাদের বিভিন্ন ছবি দেয়াল জুড়ে রয়েছে। বাচ্চাদের খেলনাও চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আরহাম কিনে রেখেছিলো বেবীর জন্যে। মেহেভীন এক পা এগিয়ে ছোট্ট কাবার্ড বের করে বাচ্চাদের সব জামা-কাপড় বের করে নিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। এইসব কাপড় সে এবং আরহাম একসাথে কিনিছিলো বেবীর জন্যে। মেহেভীন চোখটা বন্ধ করে, সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে ঠোটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে বলে,

‘ আরহাম সাহেব! আপনারা সবাই মিথ্যে বলেছেন।
আমার বেবী তো বেঁচে আছেই। এই ঘরে প্রতিটি কোণায় কোণায় তার জিনিস-পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তার মানে সে বেঁচে আছে। এই ঘরেই আছে সে। শুধুমাত্র আমার থেকে লুকিয়ে আছে। বড্ড দুষ্টু তো আমার মেয়েটা। ‘
মেহেভীন বাচ্চার জন্যে নিয়ে আসা ছোট্ট বেডে মাথা ঠেকিয়ে,বিড়বিড় করে বলে,
‘ আমার বেবীর কিচ্ছু হয়নি। সে বেঁচে আছে। আমি তো মা। আমি জানবো না তো কে জানবে? আমার বাচ্চা বেঁচে আছে। আমি খুব ভালো করেই অনুভব করতে পারি সে আছে। আমার খুব কাছেই আছে সে।’

মেহেভীনের করা এইসব কার্যকলাপগুলো আরহামের কষ্টকে আরো দ্বিগুনভাবে বাড়িয়ে তুলছে। খুব শখ করে তার ঘরটাকে সাঁজিয়েছিলো সে। ভেবেছিলো বাচ্চাটা যখন আসবে, তখন সে এই ঘরে খেলবে হাঁসবে। আরহাম অফিস শেষে বাচ্চাটাকে নিজ হাতে ঘুম পাড়িয়ে দিবে,কিন্তু নিয়তির নিষ্টুর খেলায় আজ সবকিছুই শুধুমাত্র একটা স্বপ্ন। আরহামের দরজা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মেহেভীনকে দেখতে থাকে। কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই সে দেখতে পায় তার মা দাঁড়িয়ে
আছে। মাকে দেখে সে নিজেকে সংযত করতে পারেনা বরং চোখের কোনে লেগে থাকা জলটুকু মুছে মাকে জড়িয়ে ধরে।

অভ্র ওয়াইনের বোতলটা নিয়ে তাতে চুমুক দিয়ে দেয়। চোখগুলো ঘোলা ঘোলা দেখালেও,সে স্পষ্ট দেখতে পারছে মেহেভীন তার দিকে এগোতে এগোতে বলছে সে খুনি! হ্যা অভ্র তার সন্তানের খুনি।
অভ্র আর দেখতে পেলো না। মুহুর্তেই কোথায় যেন
হারিয়ে গেলো মেহেভীন। অভ্র মুখ চেপে কাঁদছে। ইশরা বেগম ছেলেকে কাঁদতে দেখে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করে,’ অভ্র বাবা কি হয়েছে তোমার? এইভাবে কাঁদছো কেন তুমি? ‘

অভ্র তার মায়ের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে, মায়ের ডান হাতে নিজের মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ মা গো! মেহেভীন বলেছে আমি নাকি আমার সন্তানের খুনি। আচ্ছা আমি কি সত্যিই বাবা হয়ে নিজের সন্তানের খুনি হতে পারি? আমি কি এতোটাই খারাপ মা? মা গো বলো না। আমি কি এতোটাই খারাপ। ‘
সন্তানের ব্যাথায় ইশরা বেগম নিজেও ব্যাথিত হলেন। ছেলের বুক চেপে, ঠোট কামড়ে বললেন,
‘ না বাবা কে বলেছে তুমি খারাপ? আমি খারাপ। হ্যা হ্যা আমি খারাপ। ‘
অভ্র বোধহয় আর কিছু শুনতে পেলো। আখিজোড়া
বন্ধ হয়ে এলো তার। ইশরা বেগম বুঝলেন অতিরিক্ত নেশা করে অভ্র ঘুমিয়ে পড়েছে। ইশরা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে রুম ত্যাগ করলেন।

আরিয়ান নিজের চেম্বার বসে রয়েছে, তখনি কেউ তার সামনে একটা বাটি রাখে। আরিয়ান তাকিয়ে দেখে ফারিয়া। ফারিয়ার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন ফারিয়াকে সে এখানে আশাই করেনি। আরিয়ান বিস্ময় গলায় বললো,
‘ তুমি? ‘
‘ হুম আমি। আমি তো জানি আমার সাথে কথা বলে আসার পর আপনি আর বাড়ি যাননি। তাই আপনি কিছু খাননি। তাই আমি আপনার জন্যে হাল্কা নাস্তা নিয়ে আসলাম।’

আরিয়ান নিজেকে হাল্কা করার জন্যে ফারিয়ার সাথে কাল অনেকটাসময় ধরে কথা বলেছে। আরিয়ান জানে এই মেয়েটার সাথে কিছুক্ষন কথা বললে সে অনেকটাই হাল্কা হয়ে যাবে। যা সে হয়েছে ও। আরিয়ানের মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েটার মাঝে এমনকি আছে যার ফলে আরিয়ান মেয়েটার দিকে বার বার আর্কষিত হয়। আচ্ছা মেয়েটার নাম তো ফারিয়া কেন? আরিয়ানের ধারণামতে, নামটা ফারিয়া না হয়ে ‘চম্বকীয় মেয়ে’ হওয়া উচিৎ ছিলো। আরিয়ানের উদ্ভুট ভাবনার মাঝে ফোড়ন কেটে,ফারিয়া বললো,
‘ কি হলো ডাক্তার সাহেব কি এতো ভাবছেন? নাস্তাটা খেয়ে নিন। ‘
‘ জ্বী আচ্ছা। ‘

আরিয়ান সঙ্গে সঙ্গে বাটিটা হাতে নিয়ে দেখে তাতে আলু পরোটা। আরিয়ান একটা খেয়ে নেয়। অতঃপর
ফারিয়ার কথা শুনার জন্যে মনোযোগী হয়। ফারিয়া নরম গলায় বললো,
‘ দেখুন আপনি এখন খেয়ে বাড়িতে যান। আপনিও যদি এখন বাইরে বাইরে থাকেন এবং পরিস্হিতি থেকে পালানোর চেস্টা করেন তাহলে সেইটা খুব একটা ভালো হবে না।’
আরিয়ান নিম্নসুরে বললো,
‘ তাহলে আমি করবো? আমি বাড়িতে কীভাবে যাবো? ভাই এবং মেহুর কষ্ট দেখে আমার নিজের ভিতরটাও যে জ্বলে।’
‘ তাই বলে এইভাবে পালাবেন? পরিস্হিতি ফেস করতে শিখুন ডাক্তার সাহেব। কঠিন পরিস্হিতি আমাদের জীবনে বহুবার আসবে যাবে তাই বলে দমে গেলে কিছুতেই হবেনা,বরং কঠিন পরিস্হিতিতে আমাদের শক্ত থাকতে হবে। আপনি বাসায় যান। এই সময় আরহাম ভাইয়া এবং মেহেভীন আপুকে আপনার বড্ড প্রয়োজন। ‘
ফারিয়ার কথা শুনে আরিয়ান মুগ্ধ হয়। মেয়েটা কতটা সুন্দরভাবে তাকে বুঝিয়ে দিলো।

দিনের পর দিন যায় মাসের পর মাস ও চলে যায়। থেকে যায় অতীতের কিছু বিশাক্ত ক্ষত। সেই ক্ষতগুলো চাইলেও মুছে ফেলা যায়না জীবন থেকে।
ক্ষতগুলো যেন আজীবন রয়ে যায়। দেখতে দেখতে
চার মাস হয়ে গেলো মেহেভীনের সন্তান মারা গিয়েছে। সবাই আগের থেকে কিছুটা স্বাভাবিক হলেও মেহেভীন হতে পারেনি। শত হলেও মা তো।
মেহেভীন এখন আরহামের ঘরেই সারাদিন বসে থেকে সারাদিন বাচ্ছার খেলনা – জামাকাপড়গুলো আগলে রাখে। আরহামের রুমের সাথেই আরহাম আরেকটা এটাচ করে রুম বানিয়ে ফেলেছে। সেখানেই বাচ্ছার সব খেলনা জামাকাপড়
বাচ্ছার ছোট্ট বিছানা সব রয়েছে। মেহেভীন সেই এটাচ করা রুমেই সারাদিন থাকে। কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। কারো পায়ের শব্দে পিছনে ঘুড়ে মেহেভীন দেখে আরহাম দাঁড়িয়ে আছে।
আরহাম ধীর পেয়ে এগিয়ে এসে, মেহেভীনের কাছে এসে শান্ত গলায় বললো,
‘ সকাল থেকে কিচ্ছু খাও নি। এইবার অন্তত টোস্ট টা খেয়ে নাও। তুমি খাওয়ার পরে আমি অফিসে যাবো। ‘
মেহেভীন নির্লিপ্ত ভাবেই জবাব দিয়ে বললো,

‘ আমি খাবো না। ‘
‘ খাবো না মানে? দেখো মেহেভীন স্টুপিডের অনেক জেদ দেখিয়েছো এতোদিন। আমি আর সহ্য করবো না। খুব বকবো আমি তোমায়। চুপচাপ খেয়ে নাও। এইভাবে অনিয়ম করতে থাকলে কিন্তু অসুস্হ হয়ে পড়বে। ‘
মেহেভীন দমে যাওয়া গলায় বললো,
‘ আমি সত্যি কিচ্ছু খেতে পারবো না আরহাম সাহেব।
আমার শুধু নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে। আমি একজন ব্যর্থ মা। যে নিজের সন্তানকে রক্ষা করতে পারেনা। সে কখনোই মা হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা। আমি জীবনের প্রতিটা মুহুর্তেই ব্যর্থ হয়েছি আরহাম সাহেব।’
আরহাম শীতল গলায় বললো,
‘ ব্যর্থতা বলে জীবনে কিছুই নি। আমরা যখন জীবনের কিছু কঠিন মুহুর্তে এসে নিজেদের পরাজিত মনে করি তখনি আমরা ব্যর্থতা নামক শব্দটা প্রয়োগ করি। জীবনে অনেক কঠিন মুহুর্ত আসবে,কিন্তু তাই বলে কি জীবন থেমে থাকে?
ব্যর্থতা থেকেই নতুন ভালো কিছু সূচনা হয়, যদি আমরা চাই। আমি জানি তুমি আপাতত যে সময়টাতে আছো তাতে ভেঙ্গে পড়াটা স্বাভাবিক। আমরাও প্রথমে অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছিলাম,কিন্তু এখন নিজেকে শক্ত করো মেহেভীন। জীবনটা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ‘
মেহেভীন আরহামের কথা শুনে প্রতিউত্তরে কিছু বললো না। নিভু নিভু দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো।

তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৪৭

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেলো। আরহাম অফিসের কাজ সেরে সবেমাত্র অফিস থেকে বেড়িয়ে আসবে তখনি বাড়ি থেকে ফোন আসে। মেহেভীন নাকি কাউকে কিছু না বলেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। কথাটি শুনেই আরহামের মাথায় রক্ত চড়ে বসে। আরহাম তার হাত দুটো টেবিলে রেখে বাড়ি দিয়ে বলে,
‘ মেহেভীন এইবার দেখবে তুমি আরহাম হাসান তালুকদার কি জিনিস। এইবার আমি সহ্য করবো না। আমার থেকে দূরে যাওয়ার স্পর্ধা কি করে মাথায় আসলো তোমার? ‘

তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৪৯

1 COMMENT

Comments are closed.