তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৪৭

তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৪৭
Jannatul ferdosi rimi

আরহাম মেহেভীনের দিকে দৌড়াতে নিলে,মেহেভীন থেমে যায়। মেহেভীনকে থেমে যেতে দেখে আরহাম ও থেমে যায়। মেহেভীন হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে, আরহাম এসে মেহেভীনকে আকড়ে ধরে। আরহাম মেহেভীনের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় মেহেভীনের সিজার করা জায়গা থেকে রক্ত বের হচ্ছে। আরহাম ঘাবড়ে গিয়ে মেহেভীনকে পাজকোলে তুলে দ্রুত হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়। ডক্টর জেসমিন মেহেভীনের সিজার করা জায়গাটাকে পুনরায় বেন্ডিজ লাগিয়ে দিয়ে, বাইরে বেড়িয়ে আসে। ডক্টরকে দেখেই আরহাম বলে উঠে,

‘ মেহেভীন ঠিক আছে তো ডক্টর? ‘
‘ জ্বী আপাতত ঠিক আছে। আরেকটু হলেই সিলিটা
ছিড়ে যেতো। যেভাবে এই অবস্হায় মেহেভীন দৌড়াচ্ছিলো। আমি বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মেহেভীন এখন নিজের মধ্যে নেই।
মেহেভীন প্রচন্ড রকমের শোকের মধ্যে আছে। তাইতো সবেমাত্র সিজার করা অবস্হায় যেখানে অন্য মেয়েরা নড়তে পারেনা,সেখানে মেহেভীন দৌড় দিয়ে ফেলেছিলো। আসলে আমিও বুঝতে পারি একজন মা যখন শুনে তখন তার সন্তান বেঁচে নেই তখন সেই মা কি আর ঠিক থাকে? তখন সে নিজের মধ্যে একেবারেই থাকে না। ‘
ডক্টরের জেসমিনের কথায় সায় দিয়ে আরিয়ান ও বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ তা ঠিক। প্রচন্ড রকমের শোকের মধ্যে থাকলে মানুষ তখন নিজের ব্যাথা -যন্ত্রনা সব ভূল গিয়ে অন্য একটা জগতে চলে যায় । যেমনটা মেহেভীনও করেছিলো। ‘
আরহাম নিজের চোখের কোণে থাকা জলটুকু মুছে
থমথমে গলায় বলে,
‘ মেহেভীনকে আমরা কবে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো?’
‘ তা ঠিক বলতে পারবো না। মেহেভীনের মানষিক অবস্হার উপর দিয়ে যা যাচ্ছে। তাতে কখন মেহেভীন সুস্হ হয়ে উঠবে তা বলা যাচ্ছে না। ‘

অভ্রের এক পলক কাচের জানালা দিয়ে তার মেহুকে দেখে নেয়। আজ তারই করা এক ভুলের জন্যে মেয়েটাকে এতোটা শাস্তি পেতে হচ্ছে। নিজেকে নিজের সন্তানের খুনি মনে হচ্ছে। মেহেভীন তখন নিজের মতো না থাকলেও, সে ঠিকই বলেছে। আজ অভ্রের জন্যেই তাদের সন্তান তাদের ছেড়ে চলে গেলো। তার ভুলের মাশুল গুনতে হলো ছোট্ট শিশুটাকে। অভ্র আর এক মিনিট ও দাঁড়ায় না বেড়িয়ে যায়। অভ্রকে বেড়িয়ে যেতে দেখে মায়রাও বেড়িয়ে যায়।

আরহাম মেহেভীনের পাশে বসে আছে। মেহেভীনের মায়াবী মুখখানা কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। মেহেভীনের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আরহামের ভিতরেও দহন হচ্ছে, যা সে তা চাইলেও প্রকাশ করতে পারছে না। আরিয়ান আরহামের অবস্হা দেখে লম্বা নিঃশ্বাস নেয়। তার ভাই এবং তার বন্ধু মেহু দুজনেই যেই কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাতে সে তার ভিতরটাও জ্বলে যাচ্ছে। সব তো ঠিকই ছিলো, তাহলে হঠাৎ সব এলোমেলো হয়ে গেলো কেন? আরহামের মুখের দিকে আরিয়ান চাইলেও তাকাতে পারছে না। অতিরিক্ত কষ্ট বুকে চেপে রাখলে মানুষকে একটা পাথর মনে হয়, আরিয়ানের কাছে আরহামকে বর্তমানে সেই পাথর মনে হচ্ছে। আরিয়ান এগিয়ে গিয়ে, আরহামের কাঁধে হাত রেখে বলে,

‘ মানুষ কষ্ট বুকে পুষে রাখতে রাখতে একসময় সেই কষ্টগুলো পাহাড়ের সমতল্য হয়ে যায়। তখন তা চাইলেও বুক থেকে সরানো যায়না। কষ্ট বুকে পুষে রাখলে যে শুধু কষ্টই বাড়ে ভাই। তার থেকে বরং তুই একটু কেঁদে নিজেকে হাল্কা কর না ভাই। ‘
আরহাম কথা বলেনা চুপ হয়ে থাকে। আরহামের নিরবতা আরিয়ানের ভিতরটাকে আরো পুড়িয়ে তুলছে। আরিয়ানের এই পরিবেশে থাকতে দমবন্ধ লাগছে। এই পরিস্হিতে কেউ কি নেই তাকে একটু শান্তি দিতে পারবে?সে কিছু একটা ভেবে দ্রুত পায়ে
বেড়িয়ে গেলো কেবিন থেকে।

ফারিয়া নিজের রুমে শুয়ে কার্টুন দেখছিলো আর বসে বসে চিপ্স খাচ্ছিলো। যদিও তার মা তাকে পড়তে বলেছে, কিন্তু ফারিয়া কি আদোও পড়ার মেয়ে? পড়া ছাড়া সবকিছুই সে করতে পারবে। তখনি তার ফোনে মেসেজ আসে। ফারিয়া তাকিয়ে দেখে আরিয়ানের মেসেজ তাতে লিখা,
‘ আমি তোমার বাসার নীচেই রয়েছি। একটু আসবে প্লিয নীচে। শুধু একটা মিনিট দেখা করেই চলে যাবো। ‘
এতো রাতে আরিয়ানের এমন মেসেজে যথেষ্ট চম্কিত হয় ফারিয়া। সে সঙ্গে সঙ্গে মেসেজের রিপ্লাই দিয়ে বলে,
‘ আপনি আমার সাথে মজা করছেন তাইনা ডাক্তার সাহেব? দূর এতো রাতে প্র্যাংক করছেন কেন?’

‘ আমি কোন মজা করছি না। চাইলে তুমি বারান্দায় এসে দেখে যেতে পারো। ‘
ফারিয়া মেসেজ টি পেয়েই বারান্দায় গিয়ে চমকে গেলো। সত্যি আরিয়ান এসেছে। আরিয়ান সঙ্গে সঙ্গে আবারোও মেসেজ দিয়ে বলে,
‘ নীচে আসবে প্লিয? কিছুক্ষন এর জন্যে হলেও প্লিয এসো। জানি এতো রাতে হয়তো তোমাকে খুব বিরক্ত করছি,কিন্তু বিশ্বাস করো এই মুহুর্তে তোমাকে আমার বড্ড প্রয়োজন। ‘
ফারিয়া এই আকুতি ভরা মেসেজ পড়ে নিজেকে দমিয়ে রাখতো পারলো না। তার মাকে কিছু একটা বুঝিয়ে সে নীচে চলে আসতেই, সে দেখতে পেলো গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে আরিয়ান। ফারিয়া দেখেই, সে এগিয়ে এলো। আরিয়ানের চেহারা দেখেই ফারিয়ার কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ পড়ে গেলো। কেননা আরিয়ানের চোখ ছলছল হয়ে রয়েছে।

‘ কি হয়েছে ডাক্তার সাহেব? সব ঠিক আছো তো? ‘
ফারিয়ার প্রশ্নে আরিয়ান উত্তর দিয়ে বললো,
‘ কিচ্ছু ঠিক নেই ফারিয়। কিচ্ছু ঠিক নেই। ভাই মেহু কেউ ঠিক নেই। সবাই খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমি আর পারছি না ফারিয়া। আমারোও যে বড্ড কষ্ট হচ্ছে।’
কথাটি বলেই আরিয়ান ফারিয়াকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কান্নার সুরে বলে,
‘ সব এতোটা এলোমেলো হয়ে গেলো কেন ফারিয়া?
আমি যে নিজেকেই সামলাতে পারছি না। তাহলে ভাই এবং মেহুকে কীভাবে সামলাবো? ‘
আরিয়ান ফারিয়াকে জড়িয়ে ধরায় ফারিয়া স্হগিত হয়ে গেলো একপ্রকার। প্রথম কোন পুরুষ তাকে এইভাবে জড়িয়ে ধরেছে।

সে জানে আরিয়ান তাকে আবেগপ্রবণ হয়েই তাকে জড়িয়ে ধরেছে। হয়তো বড্ড কষ্টে আছে আরিয়ান। আরিয়ানের কান্নার সুরে বলা প্রতিটি কথা ফারিয়ার বুকে গিয়ে লাগে। সেও আরিয়ানের পিঠে হাত রেখে, আরিয়ানকে শান্ত করার প্রচেস্টা থাকে। সে আরিয়ানের কাছে কারণ জানতে চাইলে আরিয়ান সব খুলে বলে তাকে। সব শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় ফারিয়া।চোখে তার জল এসে জমা হয়ে থাকে।

আরহাম পানি খেতে গিয়েছিলো,কেবিনে এসেই দেখে মেহেভীনের জ্ঞান ফিরেছে। সে তার পাশে থাকা সব জিনিস ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে এবং চিৎকার করে বলছে,’তোমরা সবাই আমাকে মিথ্যে বলছো। আমি জানি তো আমার বেবীর কিচ্ছু হয়নি। তোমরা আমার বেবীকে লুকিয়ে রেখেছো। এনে দাও না আমার বেবীকে। ‘
তখনি মেহেভীনের চোখ যায় আরহামের কাছে। সে আরহামের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ আরহাম সাহেব! আপনিও কিন্তু কিচ্ছু বলছেন না। আমার বেবীকে এখুনি এনে দিন। ‘
আরহাম এগিয়ে মেহেভীনের গালে হাত রেখে ভেজা গলায় বলে,
‘ মেহেভীন প্লিয তুমি নিজেকে সামলাও। ‘
মেহেভীন তৎক্ষনাক আরহাম হাত সরিয়ে বলে,
‘ ছেড়ে দিবো মানে? আপনিও আমার সাথে মিথ্যে কথা বলছেন। আচ্ছা আমি নিজেই আমার বেবীকে খুঁজতো যাবো।’
মেহেভীন একপ্রকার পাগল হয়েই নিজের হাতের ক্যানেলা খুলতে চাইলে ডক্টর জেসমিন দ্রুত মেহেভীনকে অজ্ঞান করার ইঞ্জেকশন পুশ করে দেয়,কেননা এখন মেহেভীনকে অজ্ঞান না করলে আটকানো যাবে না। আরহামও যেন এইবার ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। প্রেয়সী এমন করুন দশা দেখাটা সত্যি বড্ড কষ্টকর।

আরহাম না পেরেই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যায়। আরহামের গাড়ি নদীর পাড়ে গাড়িটি রেখে বেড়িয়ে আসে। নদীর কিনারা বসে চিৎকার করে কেঁদে উঠে।
যেই বাচ্চাটাকে নিয়ে তার এতো স্বপ্ন ছিলো সে তো চলে গেলোই তার মধ্যে মেহেভীনের এই করুন দশা। সবমিলিয়ে আরহাম ও নিজেকে সামলাতে পারছে না। চিৎকার করে কেঁদে সে তার কষ্টগুলো একটু কমানোর প্রচেস্টায় থাকে। আজ যদি বেবীটা তাদের সাথে থাকতো তাহলে কি খুব ক্ষতি হতো? এতোদিন নিজের সন্তানের মতো ভালোবেসে ফেলেছিলো বেবীটাকে।

তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৪৬

সারারাত আরহাম হাসপাতালে ফিরেনি। সকালেই সে ফিরে আসে হাসপাতালে। মেহেভীন জ্ঞান ফিরার পর একদম চুপচাপ হয়ে যায়। কোন কথা বলেনি কারো সাথে। এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আরহাম আসতেই সে মুখ খুলে বলে,
‘ আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবেন আরহাম সাহেব?’
মেহেভীন এই অবস্হায়….

তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৪৮

1 COMMENT

Comments are closed.