তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৪

তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৪
Jannatul ferdosi rimi

অভ্রের বিয়ের দিনেই, মেহেভীন জানতে পারলো সে অভ্রের সন্তানের মা হতে চলেছে। প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্টে তা স্পষ্ট। মেহেভীন চোখে জল চলে আসলো। এই জল কী মা হওয়ার আনন্দের নাকি জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দেওয়ার কষ্টের?মেহেভীন অসহায় দৃষ্টিতে ডক্টরের দিকে তাঁকালো। মেহেভীনের প্রশ্নবোধক দৃষ্টি বুঝতে পেরে, ডক্টর বললেন,
‘দেখুন মেহেভীন। আমি আপনাকে কয়েকটা টেষ্ট করতে দিয়েছিলাম মনে আছে? তার মধ্যে প্রেগ্ন্যাসির
টেস্টও দিয়েছিলাম। আমার কেন যেনো আপনার
সিনটমস দেখে মনে হচ্ছিলো, আপনি প্রেগনেন্ট। যদিও আমি সিউর ছিলাম না। তাই আমি আপনাকে বাকিসব টেস্টের সাথে,প্রেগ্ন্যাসির টেস্টাও দিয়েছিলাম এন্ড কনগ্রাচুলেশন মিসেস আপনি মা হতে চলেছেন। ‘

মেহেভীন উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে চলে গেলো। তার মাথা কাজ করছে না। এইসব কীভাবে হলো? তখনি তার মনে পড়ে গেলো, ছয় মাস আগের কথা। ছয় মাস আগেই অভ্র তার ভালোবাসার পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে,মেহেভীনকে বিয়ে করেছিলো। বিয়ের উপলক্ষে সেদিন, অভ্র মেহেভীন নিয়ে সব বন্ধুদের দিয়ে ফাইভ স্টার হোটেলে পার্টি দিয়েছিলো। যদিও অভ্রের বন্ধুরা বিয়ের ব্যাপারটা জানতো না। তারা শুধু জানতো, অভ্র মেহেভীনের সাথে রিলেশনে আছে।
অভ্র সেদিন বন্ধুদের জন্যে পার্টিতে অনেক ড্রিংক করেছিলো। অভ্রের বন্ধুরা জোড় করে, মেহেভীনকেও ড্রিংক করতে ফোর্স করছিলো। যদিও মেহেভীন এইসব একদম পছন্দ করেনা, কিন্তু তাদের জেদের সাথে না পেরে,ড্রিংক করেই ফেলেছিলো।
অভ্রও মেহেভীন দুজনেই ড্রিংক করেছিলো, প্রচুর পরিমানে। তার মধ্যে অভ্রের বন্ধুরা মজার ছলে, মেহেভীন ও অভ্রকে রুমে আটকে দিয়েছিলো। মেহেভীন ও অভ্র এতোটাই ড্রাংক ছিলো যে, তারা নিজের অজান্তেই অনেকটা কাছে চলে এসেছিলো।
ভোর বেলায় ড্রাংক অবস্হাতেই, অভ্র বেড়িয়ে যায়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অতিরিক্ত ড্রাংক অবস্হায় থাকায়, অভ্রের সেদিনের ঘটনা কিছুই মনে নেই।
মেহেভীনের যখন জ্ঞান ফিরে, তখন সকাল ১২টা বাজে। নিজের দিকে তাঁকাতেই সে বুঝতে পারে তার সাথে ঠিক কি হয়েছে। তবুও সে চুপ হয়ে যায়। ভেবেছিলো আস্তে ধীরে এইসব বিষয়ে অভ্রের সাথে কথা বলবে কিন্তু তার আগেই মায়রার আগমন তাদের জীবনে ঘটলো।
মেহেভীন হসপিটালের করিডোরে এক কোনায় বসে রইলো।মা হওয়ার কথা জানতে পেরে যেকোন মেয়ে খুশি হবে। হয়তো খুশিতে অনেকে কেঁদেই দিবে। কিন্তু মেহেভীন খুশি হতে পারছে না। এর সবথেকে বড় কারণ হলো অভ্র। আজকে অভ্রের বিয়ে, অথচ আজকেই মেহেভীন জানতে পারলো সে অভ্রের সন্তানের মা হতে চলেছে। নিয়তি ঠিক কোন মোড়ে নিয়ে আসলো মেহেভীনকে? আচ্ছা অভ্র যদি এই সন্তানকে অস্বাকীর করে? তাহলে কি করবে মেহেভীন? সমাজের লোক তো তার সন্তানকে অবৈধ বলবে। কেউ তো সত্যিটা জানতে চাইবে না। এই সমাজের মানুষ মেয়েদের দোষী বানাতে পারলেই,তারা পরম আনন্দ পায়। মেহেভীন তার পেটে হাত বুলিয়ে বলে,

‘আমার সোনা। তুই একটুও চিন্তা করিস না। তুই তো পবিত্র রে। তুই আমার এবং অভ্রের বৈধ সন্তান। কেউ তোর দিকে যেনো আঙ্গুল না তুলতে পারে। আমি সেইটাই করবো। আমি এইবার খালাকে পুরো বিষয়টা খুলে বলবো। ‘
মেহেভীন জীবনের এমন একটা পর্যায়ে এসে, তার জীবনের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে একপ্রকার অক্ষম হয়ে উঠেছে। তাই সে ইশরা বেগমের দারস্থ হয়।
ছেলের বিয়েতে যেন কোন প্রকার ত্রুটি না থাকে,তাই ইশরা বেগম নিজে দাঁড়িয়ে সকল আয়োজন করছেন। মেহেভীন বাড়িতে ঢুকেই দেখে, ইশরা বেগম বাকিদের সাথে মিলে আয়োজন করছেন।

বাড়িটাও বিয়ের সজ্জায় সজ্জিত হয়ে উঠেছে চারিদিকে। এইসব কিছু দেখে মেহেভীনের বুক ফেটে কান্না আসছে। মেহেভীন দ্রুত তার খালা ইশরা বেগমের কাছে গিয়ে বললো,
‘খালা আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে? তুমি আমার সাথে একটু ঘরে আসো। ‘
‘আমার তো একটু কাজ আছে। পরে গেলে হবেনা?’
‘না। আমার খুব জরুরী কথা আছে। যা এখুনি তোমাকে বলতে চাই আমি। ‘
‘আচ্ছা বাবা যাবো,কিন্তু আগে বল। তুই এতোক্ষন
কোথায় ছিলিস? ‘
‘সব বলবো। আগে তুমি আমার সাথে ঘরে চলো। ‘

মাথা ঠেকিয়ে বসে আছেন ইশরা বেগম। মেহেভীন ইশরা বেগমকে আকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।
ইশরা বেগমকে ইতিমধ্যে শুরু থেকে সবকিছুই খুলে বলেছে মেহেভীন। রুমে পিনপিন জুড়ে নিরবতা পালন হচ্ছে। নিরবতা থামিয়ে, ইশরা বেগম বললেন,
‘এতোকিছু হয়ে গেলো? অথচ আমি জানি না? আমাকে তো একটিবার নিজের কষ্টগুলো বলতে পারতি মেহু? ‘
মেহেভীন কাঁদতে কাঁদতে কথাটাও বলতে পারছে না। কোনরকম কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,
‘আমি সত্যি বুঝতে পারেনি খালা। অভ্র এইভাবে আমাকে ঠকাবে। এখন আমি কি করবো বলো? আমার এই সন্তানকে নিয়ে কোথায় যাবো? ‘
ইশরা বেগম গভীর চিন্তায় ঢুবে গেলেন, এই মূহুর্তে তার ঠিক কি করা উচিৎ তিনি বুঝতে পারছেন না।

ইশরা বেগম কিছু একটা ভেবে, বললেন,
‘আমার উপর ভরসা করিস মেহু? ‘
‘সবথেকে বেশি খালা। ‘
‘তাহলে এখানে চুপটি মেরে বসে থাক। আমি আসছি। ‘
ইশরা বেগমের কথা অনুসারে মেহেভীন চুপ হয়ে বসে থাকে।
কিছুক্ষন পরেই অভ্রের বিয়ে শুরু হবে, । অভ্রদের বাড়ির পাশেই একটা ফাইভ স্টার পার্টি সেন্টার আছে। মায়রার বাবা নিজের মেয়ের বিয়ে, বড় করেই দিবেন। একমাত্র আদরের মেয়ে বলে কথা। শহরের অনেক সুনামধন্য ব্যক্তিবর্গরাও থাকবে।কিন্তু বিয়ে নিয়ে তেমন একটা আনন্দ অভ্রের মাঝে দেখা যাচ্ছে না।
কেমন যেন একটা শূন্যতা কাজ করছে তার মধ্যে। সিগারেট টা ধরে একটা টান দেয় অভ্র। কালকে মেহুর বলার প্রতিটা কথা শুনে অভ্রের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করছে অভ্রের। আচ্ছা অভ্র কী একটু বেশিই অন্যায় করে ফেলেছে? কিন্তু অভ্র কী করবে? তখনি অভ্রের বন্ধু আশফুল, অভ্রের কাঁধে হাত রেখে বলে,

‘কি ভাবছিস অভ্র? ‘
‘তেমন কিছু না। ‘
‘অভ্র আমি আমি জানি তুই মেহুর কথা ভাবছিস।
দেখ অভ্র এখনো সময় আছে। মেয়েটা তোকে কিন্তু সত্যি ভালোবাসতো। আমি জানি তুইও মেহুর জন্যে কিছু না কিছু ফিল করিস। তাই বলছি যা করবি ভেবে চিন্তে করবি। ‘
আশফুল কথাটি বলেই বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। অভ্র আবারো গভীর ভাবনায় ঢুব দিলো।

মেহেভীনের খালা একজন ডক্টর আনিয়েছেন মেহেভীনের জন্যে। মেহেভীন তার খালার দিকে তাঁকিয়ে বললো,
‘উনি আবার কি করবেন? ‘
‘উনি তোর আবারো চেকাপ করবে। ‘
‘আবার কিসের চেকাপ করবে ? ‘
‘মেহু তুই আমাকে প্রশ্ন করছিস? এই তোর আমার প্রতি ভরসা? ‘
খানিক্টা কাঠকাঠ গলায় কথাটি বললেন ইশরা বেগম। মেহু তার খালার হাত ধরে বললো,
‘তোমার প্রতি তো সব থেকে বেশি ভরসা আছে খালা। তাইতো সবার আগে তোমার কাছে ছুটে এসেছি আমি। ‘
ইশরা বেগম মেহেভীনের মাথায় হাত বুলিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যান। ইশরা বেগম চলে যেতেই, ডক্টর মহিলাটি একটা ইঞ্জেকশন বের করে মেহুর দিকে এগিয়ে আসতে নিলে, ইশরা বেগম পিছন থেকে ডক্টরকে ডেকে বাইরের দিকে নিয়ে যায়। ডক্টর চলে যেতেই,মেহেভীন উঠে দাঁড়িয়ে ইঞ্জেকশন হাতে নিয়ে দেখে, এইটা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ইঞ্জেকশন। ডক্টর তো তাকে শুধু চেকাপ করতে এসেছিলো। তাহলে অজ্ঞান করতে চাইছিলো কেন? মেহেভীন দরজার কাছে যেতেই শুনতে পায়, মেহেভীনের খালা এবং ডক্টরের কথপকথন।
ইশরা বেগম বললেন,

‘সব হয়ে যাবে তো ডক্টর? ‘
‘আপনি কোন চিন্তা করবেন না। মেহেভীনকে ইঞ্জেকশন দিয়ে, আমি অজ্ঞান করে হসপিটালে নিয়ে যাবো। তারপর এবরশন করে ফেলবো। বেশি দিন হয়নি মেহেভীনের প্রেগনেন্সির। মাত্র ২ মাস চলছে। এই সময়ে সহজেই এবরশন করিয়ে ফেলা যায়।’
‘আপনি আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন। দেখুন না আমার ছেলেটা কি কান্ড করে বসলো। আজকে তার বিয়ে।
আমি চাই না। আমার ছেলের নতুন জীবনে মেহেভীন কিংবা তার সন্তান কোনপ্রকার বাঁধা হয়ে দাঁড়াক।অভ্র এবং মায়রা একে-অপরকে ভালোবাসে। অভ্র তো মেহেভীনকে ভালোবাসে না। তাহলে আমি কেন মেহেভীনকে ঘরের বউয়ের মর্যাদা দিবো? আজ অভ্রের বিয়ে অথচ আজ যদি অভ্র এবং মেহেভীনের কথা সমাজের মানুষ জানে,তাহলে তো আমার মান-সম্মান নিয়েও টানাটানি পড়ে যাবে। আমার ছেলেকেও অসম্মানিত হতে হবে। মা হিসেবে আমি কী করে তা সহ্য করবো? আমি জানি আমি অন্যায় করছি, কিন্তু ছেলের জন্যে এইটুকু স্বার্থপর আমাকে হতেই হবে। ‘

খালামনির কথা শুনে মেহোভীনের চোখ থেকে টুপটুপ জল গড়িয়ে পড়লো। তার খালাও কিনা তার সাথে ছলনা করলো। যাকে সে মায়ের মতো ভালোবাসে। মেহেভীন কিছু একটা ভেবে পিছনের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলো, অভ্রের ঘরের উদ্দেশ্য।
এইসময় তার মাথায় চলছে, শুধুমাত্র তার সন্তানকে বাঁচানোর প্রচেস্টা। মেহেভীনের এইটুকু বিশ্বাস আছে,অভ্র যদি তাদের সন্তানের কথা জানতে পারে তাহলে ঠিক অভ্র তাদের সন্তানকে কোনপ্রকার ক্ষতি হতে দিবে না।
এই মুহুর্তে অভ্রই পারে তাদের সন্তানকে বাঁচাতে।

অভ্রের ভাবনার মাঝেই কেউ একজন অভ্রকে জড়িয়ে ধরে। অভ্র খানিকটা চমকে পিছনে ঘুড়ে দেখে মায়রা দাঁড়িয়ে আছে তাও বিয়ের পোষাকে।
অভ্র বলে উঠলো,
‘তুমি এখানে কেন মায়রা? ‘
‘আমি আমার বউ সাজ তোমাকে আগে দেখাতে চাই। তাই আমি আগে তোমার কাছে আগে এসেছি। কিন্তু এসেই যা শুনলাম। আচ্ছা আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে? ‘
‘কি বলো? ‘
‘তোমার মনে কী মেহেভীনের জন্যে কোনো ফিলিংস আছে? ‘

মেহেভীন অভ্রের ঘরে এসে, এমন কিছু শুনে, যা শুনে মুহুর্তেই তার আশা-ভরসা সবকিছু শেষ হয়ে যায়।

তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৩

গল্পটার বেশিরভাগ অংশেই থাকবে কাল্পনিক। তাই কেউ দয়া করে বাস্তবের সাথে গল্পের মিল খুঁজতে যাবেন না। ?

তুমি আছো মনের গহীনে পর্ব ৫