ইট পাটকেল পর্ব ৮

ইট পাটকেল পর্ব ৮
সানজিদা বিনতে সফি

আব্বুর গাড়ির ড্রাইভারের খোঁজ পেয়েছো অমি?
— পাইনি ম্যাম।লোকটা হয়তো দেশে নেই।তার গ্রামের বাড়িতে খোজ নিয়ে জানতে পারলাম তার পুরো পরিবার ওইদিনের পর থেকে নিখোঁজ। কোথাও তাদের পাওয়া যায় নি।
— মন্ত্রী সাহেব এসেছেন?
— না ম্যাম।তবে রাস্তায় আছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।
— ঠিক আছে। তুমি এখন যাও।
অমি নামের ছেলেটা নূরের পার্সোনাল সেক্রেটারি। তার এক কথায় সে জীবন দিয়ে দিতে প্রস্তুত। প্রচুর বিশ্বাসী হওয়ায় নূর তাকে সব সময় কাছে কাছেই রাখে।

এতক্ষণ নিজের রুমেই কথা বলছিল তারা।অমি বেরিয়ে যেতেই নূর সোফা ছেড়ে জানালার কাছে গিয়ে দাড়ালো। আজ আকাশে চাঁদ নেই।মেঘের কবলে পুরো আকাশ।খনে খনে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আকাশের থেকে চোখ সরিয়ে নিচে তাকাতেই আশমিনের গাড়ি ঢুকতে দেখলো নূর। কালো দশটা গাড়ির দ্বিতীয় গাড়ি টা আশমিনের। সেদিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসলো নূর।
— আপনি আমাকে নিয়ে আসেন নি মন্ত্রী সাহেব। আমি চেয়েছি তাই আজ আমি এখানে।শত্রুকে কখনো চোখের আড়াল করতে নেই।তাকে সব সময় রাখতে হয় চোখের সামনে।আপনি আমার শত্রু নন।আপনি আমার জয়। আপনাকে হারিয়েই তো আমি বার বার জয়ের স্বাদ গ্রহণ করবো।তাই আপনি থাকবেন আমার চোখের সামনে।যতটা সামনে থাকলে আপনার প্রতিটি লোমকুপের খবর ও আমি জানবো ঠিক ততটা কাছে।রাফসান শিকদারের মেয়ে আমি।তার রক্ত।আপনি যা এতো বছর শিখেছেন তা আমার জন্ম থেকেই শেখা।আমার রক্তে রাজনীতি। তাহলে এখন না হয় সমানে সমানে টক্কর টা হয়েই যাক। প্রতি মুহূর্ত আপনি ভয় পাবেন।আমাকে হারানোর ভয়।আর আমি আপনাকে সেই পরিস্থিতিতে এনে দাড় করিয়ে দিবো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কথা গুলো বলে হাসলো নূর।সাদা গ্রাউনের সাথে হালকা গোলাপি ওড়না টা গলায় পেচিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল নূর।ততক্ষণে আশমিন বাসায় এসে ঢুকেছে।ড্রয়িং রুমে সানভির সাথে দাঁড়িয়ে কোন বিষয় নিয়ে কথা বলছে হয়তো। নূর সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সরাসরি গিয়ে তার বাবার জন্য বরাদ্দকৃত কাউচে গিয়ে বসে পরলো। রাফসান শিকদার মারা যাওয়ার পর থেকে এখানে আর কেউ বসে নি।সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। আশমিন স্বাভাবিক ভাবে একপলক তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিলো। সানভি কাপা কাপা গলায় বলল,
— স স্যার।
আশমিন বিরক্ত চোখে তাকালো সানভির দিকে।আশমিনের দৃষ্টি দেখে সানভি আর কিছু বললো না।কামিনী চৌধুরী রুমেই ছিল।নূর অমি কে বললো সবাই কে ডেকে নিয়ে আসতে।অমি মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো সবাই কে ডাকতে।

কামিনী চৌধুরী এসে নূর কে রাফসান শিকদারের কাউচে দেখে ক্ষেপে গেলো।তেড়ে তার দিকে যেতে নিতেই নূর বিরক্ত চোখে তাকালো। পাশে থাকা মেয়ে গার্ড টা আটকে দিলো তাকে।কামিনী চৌধুরী সেদিকে তোয়াক্কা না করে চিৎকার করে বললো,
— এখানে বসেছিস কোন সাহসে?বেহায় মেয়ে, লজ্জা করলো নাএ বাড়িতে এসে আবার নিজের কলংকিত মুখ সবাকে দেখাতে?আজকেই বেড়িয়ে যাবি এখান থেকে।
আশমিন ক্লান্ত চোখে সবকিছু দেখছে।বিরক্তি আর রাগ তরতর করে বেড়ে চলেছে তার।কামিনী চৌধুরীর পিছনেই আমজাদ চৌধুরী এসেছিলেন। তিনি এতক্ষণে বসে পড়েছেন সোফায়।আশমিন ও গিয়ে বাবার পাশে বসে পড়লো।

নূর কামিনী চৌধুরীর দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে। মেয়ে গার্ড টা কে উদ্দেশ্য করে বললো,
— আগামী দশ মিনিট আমি কোন রকম ডিস্টার্বেন্স চাই না।তাই এই মহিলার মুখটা বন্ধ করে দাও।এতে যদি অন্য কারোর সমস্যা হয় তাহলে তাদের ক্ষেত্রে ও এপ্লাই করতে পারো।
আশমিন সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে।মাথা ব্যথায় দপদপ করছে।চোখ খুলে রাখা ও দায়।তবুও সে এখানে বসে আছে। মেয়ে গার্ড টা ততক্ষণে কামিনী চৌধুরীর মুখে টেপ লাগিয়ে দিয়েছে। হাত দুটো ধরে থাকায় কামিনী চৌধুরী কিছু করতে পারছে না। শুধু আগুন চোখে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। আমজাদ চৌধুরীর খারাপ লাগলেও সে চুপ করে আছে।কামিনী চৌধুরীর অন্যায়ের কাছে এটুকু কিছুই না।

— আপনাদের এখানে ডাকার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমার কিছু সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া।যাতে পরবর্তীতে আমার কোন সমস্যা ফেস করতে না হয়। যেহেতু এতো দিন আপনারা সব কিছু সামলেছেন সেহেতু কোন কিছু করার আগে আমার আপনাদের জানাতেই হতো। (হালকা নিশ্বাস নিয়ে)কাল থেকে আমি অফিস জয়েন করবো। আগের এমপ্লোয়ি কে এক মাসের নোটিশে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হবে।আমার টিম আমার সাথে কাজ করবে।তারা কালকেই বাংলাদেশে এসে পৌছাবে।অফিসের দায়িত্বে যে আছে তাকে বলে দিবেন আব্বু মারা যাওয়ার পর থেকে সমস্ত হিসেব এই একমাসে আমার টিম কে বুঝিয়ে দিতে।যাদের যাদের চাকরি যাবে তাদের মধ্যে পুরোনো যারা আছে তারা আংকেলের কোম্পানি তে জয়েন করবে।আর হিসাবে যত পরিমাণ টাকা ঘাটতি থাকবে তা মিসেস চৌধুরীর একাউন্ট থেকে পুরোন করা হবে।কারন নূরানী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির একাউন্ট তিনি হ্যান্ডেল করতেন।কারোর কোন প্রশ্ন থাকলে ও করার অনুমতি নেই।আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি।কোম্পানি যেহেতু আমার তাই আমার সিদ্ধান্ত ই শেষ কথা।

আশমিন চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে বসে আছে। ঘুমিয়ে ও পরেছে হয়তো। সেদিকে তাকিয়ে গা জ্বলে গেলো নূরের।দাতে দাত চেপে নিজেকে সামলে নিলো সে।এদিকে কামিনী চৌধুরীর অবস্থা নাজেহাল। রাগ আর ভয় দুটো ই ঘিরে ধরেছে তাকে।এতো বছরে সে কোটি কোটি টাকা সরিয়েছে কোম্পানি থেকে। আমজাদ চৌধুরী ও এ বিষয়ে কিছু জানে না। সেদিনের পর থেকে আশমিন আজ পর্যন্ত তাকে মা বলে ডাকে নি। সরাসরি কোন কথা ও বলে না তার সাথে।অনেক কষ্টে আমজাদ চৌধুরীর সাথে সম্পর্ক টা ঠিক করেছে সে।এখন এমন কিছু শুনলে সে ও না আবার মুখ ফিরিয়ে নেয় তার থেকে!ভয়ে কামিনী চৌধুরীর কলিজা লাফাচ্ছে।
নূর অমির দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস গলায় বলল,

— ঢাকার সবচেয়ে বড় বড় হসপিটাল গুলোতে খোজ লাগাও অমি।অর্গান,চোখ,লিভার এসবের কারেন্ট রেট গুলো জেনে নাও। খুব শীঘ্রই আমাদের কাজে লাগবে।
আশমিন বাদে সবাই চোখ বড় বড় করে তাকালো নূরের দিকে।সানভি শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,
— এগুলো জেনে কি হবে ম্যাম?
নূর বাকা হাসলো। কামিনী চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ক্রুর গলায় বলল,
— আপনি বড্ড অবুজ সানভি। টাকার ঘাটতি যদি একাউন্টের টাকা দিয়ে না পূরণ হয় তাহলে এগুলো কাজে লাগবে। একটাকা ও ছাড় দেয়া হবে না।
নূর মেয়ে গার্ডের দিকে তাকিয়ে বললো,
— মিসেস চৌধুরী কে ছেড়ে দাও। উনি হয়তো কিছু বলতে চায়।আর মন্ত্রী সাহেবের জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো।তার ঘুম ভাঙানো টা এই মুহুর্তে জরুরি।
— বর কে চুমু খেয়ে ঘুম থেকে তুলতে হয়।পানি মেরে নয়।বিজনেসের পাশাপাশি রোমান্স টা ও শিখে নিয়ো নূর।আমার এখনো বাসর করা বাকি।
আশমিন চোখ বন্ধ করেই বো*মা ফেললো ড্রয়িং রুমে।

আমজাদ চৌধুরী কেসে উঠলো ছেলের কথা শুনে। সে যে একটা নির্লজ্জ ছেলে পয়দা করেছে এখন সে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। নূর কটমট চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন আড়মোড়া ভেঙে সেদিকে তাকিয়ে বাকা হাসলো। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— আজ থেকে রাত তিন টা থেকে সকাল আমার কাছে রোমান্স শিখার ক্লাস করবে।সব কিছু হাতে কলমে শিখিয়ে দিবো।টানা এক সপ্তাহ ক্লাস করলে তুমি একেবারে রোমান্টিক হয়ে যাবে বুঝলে?
— বাবা মার সামনে এসব বলতে লজ্জা করছে না তোমার?অসভ্য হচ্ছো দিন দিন।
— লজ্জা করলে বাবা হবো কি করে।আমাকে অসভ্য বলার আগে নিজের দিকে তাকাও।তুমি ভালো মানুষ হলে আমি এই পৃথিবীতে আসতাম না।এতো কথা না বলে ছেলের বাসর করার ব্যবস্থা করো।নাকি দাদা হতে চাও না জীবনে?
আমজাদ চৌধুরী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ছেলের দিকে।কামিনী চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ফোসফাস করে বললো,

ইট পাটকেল পর্ব ৭

— সত্যি করে বলো কামিনী এটা কার ছেলে। সত্যি বললে ক্ষমা করে দিবো। এটা আমার ছেলে হতেই পারে না।
কামিনী চৌধুরী স্বামীর দিকে কটমট করে তাকিয়ে রুমে চলে গেলো। আশমিন তখনই চলে গেছে নিজের রুমে।থমথমে পরিবেশের রেশ কেটে এখন সবাই মুখ টিপে হাসায় ব্যস্ত।

ইট পাটকেল পর্ব ৯