তুমি আমি দুজনে পর্ব ১৬

তুমি আমি দুজনে পর্ব ১৬
হুমাইরা হাসান

-ভাবিজান,ভাবিজান উঠেন। আপনার কি শরীর খারাপ?
চুমকির ডাকে নড়েচড়ে উঠলো তুরা, তবুও চোখ খুলার নাম গন্ধ নেই দেখে চুমকি বেশ চেঁচিয়েই বলে উঠলো
-ও ভাবিজান,, আর কত ঘুমাবেন!
চুমকির ফ্যাসফ্যাসে গলার চেঁচামেচি শুনে ধরফরিয়ে উঠলো তুরা।
-ক কে? কি হয়েছে?
-আমি ভাবিজান,চুমকি

ঘুমের ঘোরে চুমকির চেঁচানিতে উঠে খানিকটা চমকে গেলেও অল্প কিছু সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো সামনে দাঁড়ানো হাস্যজ্বল চেহারার চুমকির দিকে
-ওহ তুমি,,কিছু হয়েছে কি?
-না ভাবিজান কি হইবো। আপনি সেই দুপুরে এসে যে ঘুম দিলেন বিকাল পেরিয়ে যাচ্ছে তাও উঠার নাম নেই দেখে আপনারে একটু ডাকতে এলাম

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এটাকে ডাকা বলে? এভাবে মাইকের মতো গলা ফাটিয়ে ডাকাকে একটু ডাকা বললে বেশি ডাকা কোনটা। মেয়েটা ভারি অদ্ভুত। তুরা সেদিকে খেয়াল না দিয়ে ছোট করে ওহ বলে ওয়াসরুমের দিকে হাঁটা ধরলো। ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় আহান বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতেই তুরা দৌড়ে ভেতরে চলে এসেছিলো সে। আর পেছনে দেখেনি। বাড়ি এসে গোসল করে না খেয়েই ঘুমিয়ে পরেছিলো।

সেই ঘুম ভাঙলো চুমকির ডাকাডাকিতে, ফ্রেশ হয়ে মুখটা মুছেই ঘর থেকে বেরোলো তুরা। চুমকি মেয়েটা ঘরে নেই, তাকে ডেকে তুলেই আবারও উধাও হয়ে গেছে, ভীষণ চটপটে মেয়ে দুদন্ড স্থির বসে নাহ। সিড়ি বেয়ে নেমে এলো তুরা ডাইনিং রুমে আপাতত কেও নেই সোফার সাইড থেকে টিভির শব্দ আসছে। সেখানে পুরোনো মিউজিক সিস্টেমের গান বাজছে ‘ও আমার বন্ধু গো চিরসাথী পথচলা’ তুরা উঁকি দিয়ে দেখলো চুমকি বত্রিশ ইঞ্চির স্ক্রিনের একদম সামনে বসে হা করে অপলক চেয়ে আছে, টিভির পর্দায় চলছে সালমান শাহ আর মৌসুমির জনপ্রিয় হিট সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। চুমকি মেয়েটা বাংলা সিনেমা প্রচুর দেখে, বাড়ির কাজের বাইরে যেটুকু সময় পাই তুরা চুমকিকে বাংলা সিনেমা নিয়েই বসে থাকতে দেখে।

সেদিকে আর মাথা দিলনা তুরা, পেটের ভেতর খিদেই ডাকাডাকি শুরু হয়েছে, সেই সকালে নাস্তা করে বেরিয়েছে। তাই চুপচাপ খাবার নিয়ে টেবিলে বসে খেয়ে নিলো। খাবার শেষে প্লেট ধুয়ে হাত মুছে বেরিয়ে দেখলো বিকেল প্রায় পাঁচটা। নিচে কেও ই নেই।

রুবি এই সময়টাতে হাঁটতে বেরোয়। মিনু ফুফুর দুপুরের খাবার খেয়ে ভাতঘুম দেওয়ার অভ্যাস আছে, দিদুন তো হাঁটুর ব্যাথার কারণে খুব বেশি বেরই ও না, আর রাইমা গিয়েছে তার কোনো এক বান্ধবীর বিয়ের দাওয়াতে। তাই আপাতদৃষ্টিতে তুরা এখন একাই। পায়চারি করতে করতে বাড়ির বাইরে বাগানের দিকটাই এলো। মাঝের কয়দিন আসা হয়নি এখানে।

হেলে যাওয়া সূর্যমুখীর গাছগুলো বেশ তাজা হয়েছে, ফুল ও ফুটেছে বেশ অনেক গুলো। তুরা হাঁটতে হাঁটতে আরও ভেতরে ঢুকলো বাগানটার,ফুলগাছ গুলোতে হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলো। চোখ আটকে গেলো সামনের গাছটাতে, বেশি বড় না তবে ছোটও না, মাঝারি সাইজের একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ, লাল টকটকে ফুলগুলোতে ভর্তি ডালপালা গুলো ছড়িয়ে আছে, আহানের রুমের বারান্দার একদম সামনে হওয়ায় বেশ কয়েকবার দেখেছিলো এই গাছটা। তবে কাছে এসে দেখা হয়নি

-ভাবিজান আপনি এখানে কি করেন?
পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে পেছনে তাকালো তুরা, সামান্য হেসে বললো
-কিছু না চুমকি এমনেই গাছ গুলো দেখছিলাম।
-এই বাগানটা ভাইজানের খুব শখের জানেন, অল্প কয়েকটা গাছ রাইমা আপা লাগাইলেও বেশিরভাগ ই ভাইজানের লাগানো। উনি নিজে হাতে পরিচর্যা করে এগুলোর।

আপনমনেই বলতে শুরু করলো, চুমকি। কৃষ্ণচূড়া গাছের পেছনের দিকে দেখিয়ে বললো
-এই যে এই গোলাপ গুলোও ভাইজান লাগিয়েছে, লাল গোলাপ ভাইজানের অনেক পছন্দের।
তুরা চুপচাপ হেসে চুমকির কথা গুলো শুনছে, চুমকি এবার তুরার কাছে এসে বললো
-আপনার আর ভাইজানের বিয়েটা তো এমন হুট করেই হয়েছে, তা ভাইজান আপনারে নিশ্চয় অনেক ভালোবাসে? অবশ্য বাসবেই না কেনো,আপনে যেই সুন্দরী আমারই তো তাকাই থাকতে মন চাই
একদমেও হড়বড়িয়ে বললো চুমকি। তুরা চুমকির এতগুলো কথায় বিরক্ত হয়নি তবে কেনো যানি হাসি পেলো খুব। মৃদু হেসে জবাব দিলো

-আমি এত সুন্দর কই,আর পাঁচটা মেয়ের মতই তো আমার চেহারা
-এমা কি কন,আপনি জানেন আপনারে কত সুন্দর লাগে, ভাইজান যেমন নায়কের মতো আপনিও দেখতে একদম নায়িকা,এক্কেরে সালমান শাহ আর মৌসুমির জুটি।
বলেই গা দুলিয়ে হেসে উঠলো। তুরাও হেসে দিলো চুমকির কথা বলার ভঙ্গি দেখে। চুমকির এটা ওটা বলার মাঝেই তুরা পেছন ঘুরে বললো

-চুমকি তুমি একটা মোটা দড়ি আর কাঠের তক্তা বা এইরকম কিছু এনে দিতে পারবে?
-কেনো পারবো না ভাবিজান, আপনে দাঁড়ান এক্ষুনি আনতাছি
বলেই দুলতে দুলতে চলে গেলো। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই একটা দড়ি আর কাঠের তক্তা এনে হাজির হলো।
-এই নেন ভাবিজান, কিন্তু এইগুলা দিয়ে আপনি করবেন কি?
-দোলনা বাধবো

বলেই গাছটার নিচে এসে একদম নিচু হওয়া ডালটার সাথে দড়িটা বাধানোর চেষ্টা করল,কিন্তু ডালটা তুলনামূলক নিচু হলেও তার উচ্চতা অনুযায়ী বেশ উঁচু, তাই বারবার লাফিয়েও নাগাল পেলো না তুরা।
-ভাবিজান আপনে এক মিনিট খাড়ান আমি এক্ষুনি রান্নাঘর থেইকা টুল আনতাছি
বলেই আবারও গা দুলিয়ে চলে গেলো চুমকি,তুরা ঘাড় উচু করে তাকিয়ে আছে গাছটার দিকে, তার উচ্চতা যে বেশিনা সেটা সেও জানে, কিন্তু এখন নিজেকে একটু বেশিই খাটো মনে হচ্ছে। বেশ বিরক্ত হলো তুরা, জল্লাদ লোকটার গাছ জল্লাদটার মতোই খাম্বা হয়েছে, বলে আবার লাফঝাপ দিয়ে ডাল অব্দি পৌঁছানোর চেষ্টা করলো।

ঘরে ঢুকেই খাটের উপর ব্যাগটা থপ করে রাখলো আহান, শার্টের উপরের বোতাম গুলো খুলতে খুলতে এসির পাওয়ার বাড়ালো। কাজের প্রেশারে বেশ ক্লান্ত সে, তার উপর তখন ওভাবে হাইপার হয়েও আউট অফ মাইন্ড হয়ে গেছিলো। পরে নিজেরই মনে হয়েছে যে তুরার উপর ওভাবে চেঁচানো উচিত হয়নি। ও যার খুশি তার সাথে গল্প করুক ঢলে পরুক তার কি, সে তো আর তাকে বউ মেনে বসে নেই। কিন্তু পরক্ষনেই আবার মনে হলো বউ মানে না তো কি বউ তো, তুরাকে তো আহান বিয়ে করেছে, সে কি করে অন্য একটা ছেলের উপর পরে গেলো,কিসের কথা মাহিদের সাথে এতো?

উফ মেজাজ টা আবারও বিগড়ে গেলো আহানের। নিজের উপর ই বিরক্ত সে,ইদানীং নিজের সাথে কি হয় ও নিজেই বুঝে উঠতে পারে নাহ। শার্টের বোতাম গুলো খুলতে খুলতে টাওয়াল টা হাতে নিতেই বারান্দার সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে চোখ যেতেই দেখলো একটা দড়ি মতো কিছু একটু পরপর উপরে উঠে আবারও পরে যাচ্ছে।

কৌতুহল বশে কপালে ভাজ পরলো আহানের, ভ্রুকুটি করেই পা বাড়ালো বারান্দার দিকে, গিয়ে নিচে তাকাতেই অবাকের সীমায় পৌঁছে গেলো আহান,তুরা দড়িটা হাতে নিয়ে লাফাচ্ছে গাছের ডাল অব্দি পৌঁছাতে, তুরা দড়ি দিয়ে কি করবে, হুট করেই আহানের বুকটা চরম ভাবে কেঁপে উঠলো, তখন ওভাবে বকার জন্য তুরা সুই’সাইড? নাহ,,আর ভাবতে পারলো না আহান। এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে নাহ। হাতের টাওয়াল টা ফেলে এক ছুটে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে, দ্রুতপায়ে সিড়ি বেয়ে নেমে বাগানের দিকে ছুটলো।

দড়িটা হাতে নিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুরা,এতবার চেষ্টা করেও পারলো না সে,আর চুমকি টাও যে টুল আনতে গেলো এখনো আসার নাম নেই। চরম বিরক্ত হয়ে এক হাত তুলে আবার দড়িটা উপরে উঠাতে নিলেই কেও হাত থেকে দড়িটা এক টানে নিয়ে ফেলে দিলো। আকস্মিক ঘটনায় তুরা অপ্রতিভ হয়ে তাকাতে নিলেই আবারও হ্যাচকা টানে কেও তুরাকে নিজের খুব কাছাকাছি টেনে নিলো।

বাকরুদ্ধ তুরা বিহ্বলিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে,,নাকে খুব কড়া একটা পুরুষালি গন্ধ আসছে, যেনো পারফিউম আর ঘামে মিশ্রিত ঘ্রাণ। কানের কাছে প্রচন্ড ভাবে ঢিপঢিপ শব্দ বাজছে, নিজের অবস্থান পুরোপুরি বোঝার আগেই চড়া ধমকে কেঁপে উঠলো তুরা

-কি করতে যাচ্ছিলে তুমি। তোমার সাহস কি করে হলো এই ধরনের দুঃসাহসিক কাজ করার, মাথা ঠিক আছে?
চিরচেনা ধমকে ঘামড়ে গেলেও তুলনামূলক অবাক বেশিই হয়েছে তুরা, মুখ তুলে সুদর্শন চেহারায় ঘর্মাক্ত ক্রুদ্ধ ভাব দেখেই সরে এলো। আহান আবারও গলা শক্ত করে বললো

-তোমাকে বকেছি বলে তুমি এই ধরনের একটা কাজ করবে? মন চাচ্ছে দুটো বসাই গালে।
বলেই খানিক এগিয়ে আসলো তুরার দিকে। তুরা ভীত শঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে রইল সে এখনো বুঝতে পারছে না যে হলোটা কি? আহানের এভাবে রেগে যাওয়ার কারণ কিছুতেই তার বোধগম্য হলো না সামান্য মিনমিনিয়ে গলা নামিয়ে বলল
-কিন্তু আমি করেছি টা কি আপনি কেন এমন করছেন
আহান মাঝখানে দূরত্ব আরেকটু কমিয়ে দিয়ে এগিয়ে এসে তুরার দুবাহু ধরে বলল

-তুমি গাছে দড়ি বেধে কি করছিলে?
-আ আমিতো দোলনা বা..
-ইয়া মাবুদ,আমি কিছুই দেখিনাই কিছুই দেখিনাই
পুরোটা বলার আগেই পেছন থেকে চুমকির গলা শুনে থেমে গেলো তুরা, আহান বিস্ময়কর দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো চুমকি ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে, এক হাতে টুল নিয়ে। চুমকির দিকে তাকিয়ে, আরেকবার তুরার দিকে তাকিয়ে বাহু থেকে হাত নামিয়ে দাঁড়ালো। তুরা কাচুমাচু মুখ করে এখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে হাত ডলছে, এমন কিছু হবে তার ভাবনার বাহিরে ছিলো।

-তোরা এখানে কি করছিস চুমকি
ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে চুমকি মুখ থেকে ওড়না নামিয়ে লাজুক লাজুক মুখ করে বলল
-আসলে এই গাছটার সাথে ভাবিজান দোলনা বাধতে চেয়েছিলো, উঁচু ডালে নাগাল পাচ্ছিলো না বলে আমি টুল আনতে গেছিলাম। কিন্তু ভুল সময়ে এসে গেছি, সরি আমি কিচ্ছু দেখিনাই ভাইজান

বলেই টুলটা হাতে নিয়েই দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো, আহান কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো৷ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তুরার দিকে। এখন নিজের উপর ই রাগ হচ্ছে তার, কি হচ্ছিলো আর সে কি ভাবলো। ধ্যাত,মাথাটাই গেছে। বলে হাঁটা ধরলো সামনের দিকে।

আহান যেতেই তুরা মাথা তুলে তাকিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই আহানকে আবারও উল্টো ফিরে আসতে দেখে চুপ করে গেলো। আহান এগিয়ে এসে তুরার হাত ধরে গটগট করে ভেতরের দিকে গেলো। কোনো দিক না থেমে টেনে নিজের ঘরে এনে খাটের উপর থপ করে বসিয়ে দিলো। তুরা হাফাচ্ছে রীতিমত। এইরকম বড় বড় পা ফেলে কি সে আসতে পারে? যেভাবে ধরে টেনে আনলো তুরা তাল মিলাতে না পেরে রীতিমতো দৌড়েছে।

বসে জোরে জোরে দম ছেড়ে নিজেকে ধাতস্ত করে তাকালো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা চওড়া শরীরের লোকটার দিকে, যে আপাতত ট্রেডমিল ছাড়াই ফিক্সড ওয়াক করে চলেছে। বিরক্তিতে তুরার কপালে অসংখ্য ভাজ পরে আসে,এই লোকটা কি পাগল হয়ে গেলো নাকি! এক তো কি না কি ভেবে তার দোলনা বানানো টা ভেস্তে দিলো। এখন আবার পাগলের মতো পায়চারি করছে। তুরার এ মুহূর্তে ভীষণ ইচ্ছে হলো আহানকে দুটো শক্ত কথা শুনিয়ে দিতে, কিন্তু তারপরে তার নিজের অবস্থার কথা চিন্তা করে চুপ করেই থাকলো।

-এই তোমার জন্য, তোমার জন্য আমি কোনদিন পাগল হয়ে যাবো
নীরবতা ভেঙে আহানের এমন উদ্ভট কথায় তুরা গোলগোল চোখ করে চেয়ে রইলো, আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না সে, এখন তো নিজেকেই তার পাগল মনে হচ্ছে। ঘনঘন পলক ফেলে হা করে তাকিয়েই রইল।
তুরার এমন হ্যাবলাকান্তর মতো তাকিয়ে থাকা দেখে আহান আরও কিছু বলতে গেলেও থেমে গেলো, একে কিছু বলা আর দেওয়ালের সাথে কথা বলা সমান। নিচে পরে থাকা তোয়ালে টা হাতে নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিলো, আর তার আগে শুনিয়ে গেলো তার নামকরা ডায়লগ ‘ডিজগাস্টিং’

আহান যাওয়ার পরেও তুরা হা করে চেয়ে রইলো বাথরুমের দরজার দিকে,যেনো দরজার ওপারে কোনো রাক্ষস আছে
-রাক্ষস,আস্ত রাক্ষস লোকটা। শুধু জল্লাদ ই না, ভীষণ ব’জ্জাত আর উদ্ভট এই লোক। এর খপ্পরে থেকে কোনদিন অক্কা পেয়ে আকাশে ঝুলে যাবো আমি।
গত কিছুক্ষণের ঘটনায় কি থেকে কি হলো তা নিয়ে এখনো কনফিউজড থাকলেও এই লোকটার মাথা যে ভাগাড়ে গেছে এ নিয়ে কনফার্ম তুরা।

-নাহ এখানে আর এক মুহূর্ত নাহ,এরপর বেরিয়ে আবার কোন হম্বিতম্বি করবে আল্লাহ যানে
বলেই এক ছুটে বেরিয়ে আসলো ঘর থেকে। আপন মনেই বিড়বিড় করে আহানকে হাজারটা গালি দিতে দিতে যাচ্ছিলো তুরা, রাইমার ঘর কাটিয়ে আসার সময় পেছন থেকে আসা ডাকে পা থামিয়ে দাঁড়ালো
-বউ, এদিকে আসো তো
মিনু ফুফুর ডাকে তুরা আবারও উল্টো ফিরে রাইমার ঘরে ঢুকলো।

-কিছু বলবেন ফুফু আম্মা?
-হ্যাঁ বলব,এসো এখানে আমার কাছে বস তো দেখি
তুরা স্মিত হেসে এগিয়ে গিয়ে বসলো মিনুর পাশে। মিষ্টি মুখে বলল
-জ্বি ফুফু আম্মা, বলুন
-তোমাকে সেদিন কি কি বলেছিলাম বউ, মনে আছে তো?

মিনুর কথায় তুরার হাস্যজ্বল চেহারা মুহুর্তেই চুপসে গেলো। সেদিন রাতে তুরাকে ডেকে মিনু ফুফু আস্ত পান্ডুলিপি মাথায় ঢুকিয়েছে যেনো। কত কি শিখিয়েছিলো। আহানের সাথে সাথে থাকতে হবে, কখন কি দরকার দেখতে হবে, না চাইতেই জিনিস এগিয়ে দিতে হবে, সুন্দর করে ডাকতে হবে আরও হাবিজাবি এত্ত এত্ত কথা। কিন্তু ফুফু তো জানে না সে কোন জল্লাদের সাথে বসবাস করছে। যাই বলুক না কেনো উনার হম্বিতম্বি করতেই হবে

-আ,আম হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে আছে তো?
-শুধু মনে রাখলেই কি হবে, মানতেও হবে তো
এক হাতে রাখা পানটা মুখে পুরে বলল মিনু। তুরা এবার বেশ অসহায় মুখ করল। সে আবার কি মানবে? তাও ওইরকম একটা দস্যি লোকের সাথে। কিছু বললেই তো রেগে যায় ছুড়ে ফেলার হুমকি দেয়।
-শোনো বউ, বর হলো আদরের জিনিস। তাকে সবসময় আদর ভালোবাসা দিবে তাইলে সেও তোমায় সোহাগ করবে মাথায় তুলে রাখবে

-কিন্তু আদর ভালোবাসা কি করে দেয় ফুফু আম্মা?
নিজের কথার পৃষ্ঠে তুরার থেকে এমন বোকা বোকা প্রশ্ন যেনো নেহাৎ অপ্রত্যাশিত ছিলো মিনুর। মুখ খানায় ভীষণ অবাকের ছাপ ফেলে বলল

-সেকি বরকে কি করে আদর ভালোবাসা দিতে হয় বিয়ের এতদিনেও যানো নি তুমি?
উত্তরে নিশ্চুপ রইলো তুরা। তুরার প্রত্যুত্তর না পেয়ে মিনু নিজেই আবারও বলল
-বরের আশেপাশে থাকবে। তার কি লাগবে কি না সেটা জানবে, তার সব কথা বাধ্য মেয়ের মতো শুনবে। সুন্দর নামে ডাকবে আরও কত কি

-কিন্তু উনাকে স্বামী ডাকলেই তো রেগে যায়,বলে এসব ডিসগাস্টিং কথা কোত্থেকে শিখেছো
-তো তুমি স্বামী বলেই কেনো ডাকবে সবসময়
-উনিতো বয়সে আমার অনেক বড় নাম ধরে তো ডাকতে পারিনা। আর তাছাড়া স্বামীকে স্বামী ই তো বলব তাইনা?
তুরা ভীষণ অসহায় মুখ করে বলল। মিনু ফুফু আরেকটু সরে এলো তুরার কাছে। এই মেয়ে যে বলদের বলদ তা তার ঢের বুঝা হয়েছে, একে সব হাতে কলমেই শেখাতে হবে

-শোনো এসব বোকা বোকা কথা বললেই তো হবে না,স্বামীকে নিজের হাতে রাখতে অনেক কিছুই করতে হয়। সেখানে আমার বাবু তো একটু চাপা স্বভাবের, ও তো বেশি কথা বলে নাহ। তোমাকেই বুঝে নিতে হবে
হুহ,আপনার বাবু চাপা স্বভাবের কম জল্লাদ, ব’জ্জাত আর দস্যি স্বভাবের বেশি, কোত্থেকে এনেছিলেন এই উগান্ডার মালটাকে?

কথাগুলো বলার ভীষণ ইচ্ছে হলো তুরার,কিন্তু মনের ইচ্ছে মনেই চাপা দিলো,কারণ ওই দস্যি লোকটা যে এনাদের আদরের দুলাল তা তুরা বেশ জানে শেষে কিছু বলে নিজেই শহীদ হবে। তাই চুপচাপ মিনু ফুফুর কথা গুলো গলাধঃকরণ করল,,যদি এই টেকনিকেই জল্লাদটাকে বাগে আনা যায় ক্ষতি কি।

দীর্ঘ বিশ মিনিট ধরে ঠান্ডা পানির শাওয়ার নিয়ে এখন বেশ হালকা লাগছে আহানের, মাথা মুছে বেরিয়ে এলো। ওয়াসরুমের দরজা টা লাগিয়ে পেছনে ঘুরতেই আবারও থেমে গেলো। বিরক্তিতে চোখ কুচকে নিলো। এই মেয়ে এমন সং হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেনো? মুখে আবারও সেই ফিক্সড স্মাইল টা, আবারও নিশ্চিত কোনো ঘাপলা করবে। তুরা যতবার এইরকম লুক দিয়ে হাসে ততবারই আহানের নাকানি চুবানি খাওয়ার মতো কান্ড হয়। একদম বিশ্বাস নেই একে দিয়ে। এর চেয়ে যত দূরে থাকা যায় তত ভালো। তাই আহান তুরার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে, আয়নার সামনে যেতেই তুরা ও এসে পেছনে দাঁড়ালো

তুমি আমি দুজনে পর্ব ১৫

-আপনার জন্য শরবত এনেছি প্রিয়
-হোয়াট,,হোয়াট ডিড ইউ সেইড?
প্রচন্ড বিরক্ত আর বিহ্বলিত হয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে কপালে আর চোখে অসংখ্য ভাজ ফেলে বলল আহান।
-আপনার জন্যে শরবত এনেছি গো,দয়া করে খেয়ে নিন
-তোমার উপর কি জ্বিন ভূতের আছড় আছে? আর তারা কি ঠিক করেই রেখেছে আমায় পাগল বানিয়ে তবেই দমবে?

তুমি আমি দুজনে পর্ব ১৭