রূপবানের শ্যামবতী গল্পের লিংক || এম এ নিশী

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ১
এম এ নিশী

বরাবরের মতোই অরুনিকাকে দেখতে এসে আদ্রিকাকে পছন্দ করলো পাত্রপক্ষ। করবে না-ই বা কেন? অরুনিকা যেখানে শ্যামবর্ণের অধিকারী সেখানে আদ্রিকা শ্বেতবর্ণী সেই সাথে অসম্ভব রূপবতী। যে কেউই প্রথম দর্শনে তাকে পছন্দ করতে বাধ্য। অরুনিকা ও আদ্রিকার মধ্যে রূপ সৌন্দর্যের বিস্তর ফারাক। একই মায়ের পেটের দুই বোন হওয়া সত্বেও একজন অপরজনের বিপরীত।

বসার ঘরে থমথমে পরিবেশ বিরাজমান। এতোদিন পর্যন্ত যত পাত্রপক্ষ অরুনিকাকে দেখতে এসে আদ্রিকাকে পছন্দ করেছে তারা কেউই সেটা সরাসরি প্রকাশ করেনি। হয় ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে নয়তো অন্য কাওকে দিয়ে বলিয়েছে। কিন্তু এবারের পাত্রপক্ষ ব্যতিক্রম। তারা সরাসরিই আদ্রিকার জন্য প্রস্তাব দিয়ে বসলো।
বেশ কিছু সময় নীরবতা পালন করে অরুনিকার মা আরজু বেগম ধীরেসুস্থে নম্র স্বরে জবাব দেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–বড় জনের বিয়ে না দিয়ে ছোটটাকে নিয়ে আমরা চিন্তা করতে আগ্রহী নয়।
আরজু বেগমের কথা শুনে পাত্রের মা ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলে উঠেন,
–এই মেয়ের এতো সহজে বিয়ে দিতে পারবেন বলে তো মনে হয় না। যা গায়ের রং। ছোটোটার রূপের দৌলতে তাও ভালো ভালো প্রস্তাব পাবেন কিন্তু এভাবে অযুহাত দিয়ে কাটিয়ে দিলে ছোটোটাকেও আর গছাতে পারবেন না কোথাও।
বলতে বলতেই বিচ্ছিরিভাবে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে ওঠেন মহিলা।
আরজু বেগমের মস্তিষ্কে অগ্নিকুণ্ডের লাভা ছড়িয়ে পড়লেও নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখেন তিনি। মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখেই পুনরায় জবাব দেন,

–আমার মেয়েদের ব্যাপার আমার চেয়ে ভালো তো কেউ বুঝবে না নিশ্চয়ই। আমি দেখে নিবো। আপনারা এবার আসতে পারেন।
পাত্রের মায়ের বোধহয় এবার আঁতে ঘাঁ লাগলো। মুখ চোখ বিকৃত করে সকলকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। পাত্রপক্ষের লোকজন বিদায় নিতেই ছ্যাঁত করে ওঠে আদ্রিকা,

–এতো ভদ্রভাষায় ওই মহিলাকে বিদায় করলে কেন মা? আরো দুটো কড়া কথা শুনানো উচিত ছিলো।
বাড়ির এই ছোটো মেয়েটি একটু রগচটা স্বভাবের হয়েছে। অল্পতেই রেগে যায়। এদিকে এতোকিছুর মধ্যেও আসল মানুষটি চুপচাপ। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রয়েছে অরুনিকা। এসব পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত সে এখন যেন আর কিছুতেই কিছু যায় আসে না। আদ্রিকার কথার প্রেক্ষিতে আরজু বেগম কঠোর স্বরে জবাব দেন,

–আদ্রিকা, এমন অভদ্র ব্যবহারের শিক্ষা আমি তোমাদের দেইনি। তাই কথাবার্তা সংযত করে বলবে।
অরুনিকার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কোমল স্বরে পুনরায় বলে উঠেন,
–মা অরুনিকা যা ভেতরে যা। মন খারাপ করিস না। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। এমন পরিবারে তোর বিয়ে হলে তুই সুখী হতি না।
অরুনিকা চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকায়। বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে মাকে। মিষ্টি হেসে সে জবাব দেয়,

–অরুনিকার এতো সহজে মন খারাপ হয় না মা। বরং তুমি কষ্ট পেও না। আমি একদম ঠিক আছি।
এই বলে উঠে দাঁড়ায় সে। আরো একবার মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে ধীর পায়ে প্রস্থান করে সেখান থেকে। আদ্রিকাও পিছু পিছু হাটা ধরে। আরজু বেগম মাথা নিচু করে বসে থাকেন। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। তখনই সেখানে তার ছোটো জা সেলিনা এসে বসে পড়ে। বুলেটের গতিতে মুখ চলতে শুরু করে তার,

–ভাবি, বলেছিলাম তোমাকে বারবার। অরুকে দেখতে এলে আদ্রিকে সেখানে আসতে দিও না। পারলে ওকে বাড়িতেই রেখো না। ওর নানাবাড়িতে রেখে এসো। কিন্তু তুমি আমার কথা শুনলে না। যতবার ছেলের বাড়ির লোক আসে তুমি আদ্রিকেও নিয়ে আসো সঙ্গে করে। এতে করে কি হয় দেখলে তো? এভাবে করলে তো অরুর বিয়েই হবে না।
–অরুর বিয়ে দেওয়ার জন্য আমার অাদ্রিকে লুকিয়ে রাখতে হবে না। যে বা যারা আদ্রিকে দেখেও অরুকে পছন্দ করবে তারাই সত্যিকারের ভালো মানুষ হবে। তাছাড়া যারা একজনকে দেখতে এসে আরেকজনকে পছন্দ করে তাদের মতো ছোটোলোক পরিবারে অরুকে বিয়ে দেওয়ার চেয়ে আমার অরু সারাজীবন কুমারীই থাকুক।

এই বলে আরজু বেগম উঠে দাঁড়ান। প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন,
–রান্নাঘরে অনেক কাজ আছে। এগুলো পরিষ্কার করে ওদিকে আয়।
কথা শেষ করে সোজা রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে চলে যান তিনি। এদিকে সেলিনা আপনমনে আওড়াতে থাকে,
–ওমন পরিবার কোনোদিনও পাবে না তুমি তোমার ওই কালো মেয়ের জন্য।

আকাশে মেঘ করেছে। তবে কালো মেঘ নয়, ধূসর মেঘে ছেয়ে আছে পুরো আকাশ। কেমন যেন মলিনতার ছাপ ফেলে দিয়েছে চারপাশে। আচ্ছা! ওরা কি অরুর মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছে। অরুর মনের প্রতিচ্ছবি এঁকেছে প্রকৃতিতে। জানালার কার্নিশে মাথা ঠেকিয়ে আকাশপানে চেয়ে আপনমনে এসবই ভাবছিলো অরুনিকা। হুট করে অাদ্রিকার ঝাঁকুনি খেয়ে চমকে ওঠে সে।

–বুবু, ওই দুইটাকার মহিলার কথা শুনে তুমি মন খারাপ করে আছো?
–ছিহ, বোন। এভাবে বলে না। আর আমিই বা শুধুশুধু মন খারাপ করতে যাবো কেন?
–হুহ! বুঝি তো আমি। একদম ওসব ফালতু মানুষের কথা শুনে মন খারাপ করো না বুবু। এসব আলু পটলের সাথে তোমার বিয়ে হবে না বুঝেছো। তোমার বিয়ে হবে রাজপুত্রের সাথে। সে যেই সেই রাজপুত্র নয়, সে হবে অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী, অসম্ভব রুপবান রাজপুত্রের সাথেই তোমার বিয়ে হবে।
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে অরুনিকা। হাসতে হাসতে বলে,

–পাগলি। এসব দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ কর।
–এসব মোটেও দিবাস্বপ্ন নয় বুবু। এটা আমার বিশ্বাস। আমার মন বলছে অতি সুন্দর এক পুরুষ আসবে, তোমাকে তার মনের ঘরের রাণী করে নিয়ে যাবে। দেখো, সে তোমাকে কখনো অবহেলা করবে না খুব ভালোবাসবে।
–এমন অবাস্তব স্বপ্ন দেখিস না বোন। শেষে মন ভেঙে গেলে নিজেই কষ্ট পাবি।

–তুমি বিশ্বাস করছো না তো। ঠিকাছে সময়মতো মিলিয়ে নিও। আরে আমার বুবুর মতো মেয়ে এই দশগ্রামে আর একটাও পাবে না কেউ। সেই বুবুর জন্য অবশ্যই এক রূপবান আসবে রূপবান। এতোটাই রূপবান হবে যাকে দেখে সারা গ্রামের মেয়ে, মহিলা, বুড়ি সকলেই ভীমড়ি খেয়ে কাত হয়ে পড়ে থাকবে, হুহ।

একা একা বকতে বকতেই ঘর ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো আদ্রিকা। সেদিকে তাকিয়ে ভেতর চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অরুনিকার। নিজে নিজেই জবাব দেয়,
–কোনো অসুন্দর পুরুষই আমাকে সঙ্গী হিসেবে কল্পনা করতে পারে না, সেখানে রূপবান? সে তো বিলাসি চাহিদা।

“IMAGINE WALLS OF AK”
একটি বিখ্যাত ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং কোম্পানি। দেশ বিদেশের খ্যাতি অর্জিত এই কোম্পানি তাদের ডিজাইনিং এর জন্য সেরা। চায়না, জাপান, সিঙ্গাপুর সহ বিভিন্ন দেশ থেকে বড় বড় ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং কোম্পানি এই কোম্পানির সাথে ডিল করতে আগ্রহী থাকে বরাবর। তার কারণ এই কোম্পানির আন্ডারে হওয়া সকল ইন্টেরিয়র ডিজাইন ছিলো সৌন্দর্যে ভরপুর। ঘরের দেয়াল থেকে মেঝে, আসবাবপত্র সবকিছু এতো সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে সাজানো হয় যে তা দেখে যে কেউ থমকে যেতে বাধ্য।
আর এই সবকিছুর পেছনে যেই মানুষটির অবদান, সে হলো খান পরিবারের আদর্শ ছেলে,

“আহরার খান”।
আহরার খান শুধু তার কাজের জন্যই বিখ্যাত নয়, আরো একটি কারণে সে তুমুল জনপ্রিয়। আর তা হলো, তার চোখ ধাঁধানো “রূপ”।
যাকে অনেকেই নাম দিয়েছে, “সর্বনাশা রূপ”।

অতি সুন্দরী মেয়েদের যেমন তাদের রূপের কারণে বহু কঠিন পরিস্থিতি পার করতে হয়, ছেলে হয়েও আহরারকে অনেক বড় বড় ঝড় ঝাপ্টা পাড়ি দিতে হয়েছে তার এই অতি সৌন্দর্যের কারণে।
কখনো কেউ শুনেছে এমন আশ্চর্যজনক কথা?
সকলে জানে আহরার আড়ালপ্রিয় মানুষ। সে সবসময় আড়ালে থাকতেই পছন্দ করে। তাই অনেকের কাছে “অর্ধনারী” উপাধিও পেয়েছে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। আড়ালে থাকাটা তার মায়ের আদেশ। মেয়েদের মতো তাকে সবসময় লুকিয়েই রাখতে চেয়েছেন তার মা তাসফিয়া খান।

আহরারের জন্মের সময় আত্মীয় স্বজন সহ আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশী সকলেই দলে দলে দেখতে এসেছিলো তাকে।
বিশাল বিশাল চক্ষু বানিয়ে এক একজনের মন্তব্য ছিলো,
“মা গোওও! এতো সুন্দর ছেলে?”
“এই ছেলেকে তো বাড়ির বাইরেই বের করা যাবে না। মেয়েরা হামলে পড়বে।”
“ছেলেকে বরং সিন্দুকে ভরে রাখো।”

“এ বাড়িতে আহামরি সুন্দর তো কেউ নয়। এই ছেলে এতো ভয়ংকর রূপ নিয়ে জন্মালো কিভাবে?”
“মা তো শ্যামলা, বাবাও তো মোটামুটি। এই ছেলে তোমাদেরই তো?”
সৃষ্টিকর্তা কি ভেবে এই অসম্ভব রূপবানকে এই ঘরে পাঠিয়েছিলেন তা কেবল তিনিই জানেন।
তবে রূপের জন্য খ্যাত এই আহরার খান নিজেও একজন সৌন্দর্যের পূজারী। যেমন তার সৌন্দর্য ঠিক তেমনই সুন্দর তার সকল কাজকর্ম। সবকিছুতে সৌন্দর্য ঢেলে দিয়ে যেন এক রূপময়তার জগৎ তৈরী করতে চায় সে। তবে মনের মানুষ কেমন চায় এই রূপবান?

তা সে জানেনা।
শুধু জানে যখন যেখানে যাকে দেখে তার চোখ আঁটকে যাবে সে-ই হয়ে যাবে তার জন্য নির্ধারিত।
কিন্তু কে জানতো এই ভয়ংকর সুন্দর রূপবান কোনো এক বর্ষামুখর সন্ধ্যায় তার মনটাকে দান করে আসবে এক শ্যামবতীর কাছে?

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ২