রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ২

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ২
এম এ নিশী

আকাশ ফুঁড়ে বৃষ্টি নেমেছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ঝরছে। টিনের চালের ওপর পড়া বৃষ্টির রুমঝুম শব্দ এক আলাদা মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে বৃষ্টি বর্ষণ দেখছে অরুনিকা।
বৃষ্টি পছন্দ নয় এমন মেয়ে বোধহয় বিরল। অরুনিকা সেই বিরল মেয়েদের মধ্যেই একজন। বৃষ্টি দেখলেই তার মন খারাপ হয়। বিষন্নতায় ভরে যায় ভেতরটা। হু হু করে কান্না পায়। কিন্তু সে কাঁদতে পারেনা। হয়তো কঠোর হয়ে গিয়েছে তার মন। এক হাত বাড়িয়ে টিনের চাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দেখে অরুনিকা। সেই পানি হাতে নিতেই দু ফোঁটা অশ্রুবিসর্জন হয়ে যায় তার।

এমনই এক বর্ষা বাদলের দিনে তার সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, তার বাবা হারিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন ছিলো তুমুল বর্ষনের দিন। ব্যবসার সুবাদে গ্রাম ছেড়ে শহরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন জামিল হক। ছাতা মাথায় নিয়ে বাড়ির সদর দরজা পেরোতে গিয়ে কি ভেবে যেন পেছনে ফিরে তাকান। অরুনিকা সেদিন ঠিক এভাবেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছলছল নয়নে বাবার চলে যাওয়া দেখছিলো। জামিল সাহেব মুচকি হেসে ফিরে আসেন। অরুনিকার মাথায় স্নেহের স্পর্শ বুলিয়ে বলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–মন খারাপ করিস না অরুমা। আমি শীঘ্রই ফিরে আসবো। শুধু ব্যবসাটা একটু গোছানো হলেই ছুট্টে চলে আসবো। তুই নিজের খেয়াল রাখিস মা।
অশ্রুসজল চোখে বাবার দিকে চেয়ে হালকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় অরুনিকা। জামিল সাহেব আর দাঁড়ান না। ছাতাটি দিয়ে মাথটুকু বৃষ্টির ছাঁটা থেকে বাঁচানোর প্রয়াস চালিয়ে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করেন। জামিল সাহেব বলেছিলেন তিনি দ্রুত ফিরে আসবেন। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। সেদিন হতে প্রায় ৪ বছর হতে চললো জামিল সাহেবের কোনো খোঁজ নেই। অরুনিকার দাদা আর চাচা মিলে অনেক অনেক খোঁজ লাগিয়েছেন। কোনো লাভ হয়নি। অরুনিকা জানে না তার বাবা কোথায় আছে? কিভাবে আছে? বেঁচে আছে তো….?

সেদিনের পর থেকে বৃষ্টি দেখলেই তীব্রভাবে তার বাবার কথা মনে পড়ে। বাবার জন্য মন কেমন করে। বুক ফেটে কান্না আসে। এই যেমন এখন… নিঃশব্দে অশ্রুর ঝর্ণা বয়ে যাচ্ছে তার দু চোখ বেয়ে। বেখেয়ালি অরুনিকা বাবার চিন্তায় এতোটাই মগ্ন যে বৃষ্টির ছাঁট লেগে ভিজে একসার হয়ে গিয়েছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। আদ্রিকা হেঁচকা টানে সরিয়ে আনতে আনতে বলে উঠে,

–বুবু, এই বৃষ্টিতে ভিজে কি অবস্থা হয়েছে তোমার, ঠান্ডা লেগে যাবে…
বোনের আড়ালে সন্তর্পণে চোখের জল মুছে নেয় অরুনিকা। টলমল পায়ে বোনের সাথে হেঁটে চলে যায়।

দু মাস ধরে চেষ্টায় থাকা এক চায়না ডেকোর কোম্পানির সাথে দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টার মিটিং সেরে নিজের কেবিনে এসে বসেছে আহরার খান। তখনই মুষলধারে বৃষ্টির শব্দ কানে বাজতেই ঝট করে উঠে দাঁড়ায় সে। জানালার বাইরে টুপটাপ ছন্দমুখর বৃষ্টিবর্ষণ দেখতে থাকে একদৃষ্টে।

কিছু সময় পর গায়ের ব্লেজারটি খুলে রেখে, মাস্ক দিয়ে মুখটি ঢেকে নিলো আহরার। শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ে। আহরারকে দেখার সাথে সাথে অফিসে কর্মরত সকলে উঠে দাঁড়ায়। সেই সাথে অবাকও হয়। আহরার কখনো কেবিন থেকে বেরোয় না। অফিসে এসে কেবিনে ঢোকে, মিটিং এটেন্ড করা, ফাইল চেক করা, কাজের তদারকি সবটাই নিজের গন্ডির ভেতরেই করে।

কেবল অফিস শেষে বের হয়ে সোজা বাড়ি ফিরে। সে হঠাৎ এসময়ে এভাবে বেরিয়ে আসায় সকলের চক্ষু চড়কগাছ। মেয়ে এমপ্লয়িদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। আহরারের মুখ দেখতে না পাওয়া সত্ত্বেও তাদের দৃষ্টি স্থির। কেউ কেউ আহরারের মুখটুকু দেখার জন্য ছটফট করছে, কেউ বা এটুকু দর্শনেই অস্থির হয়ে যাচ্ছে।ছেলেরাও সকলে দেখছে মন দিয়ে। তাদের ভেতরে ঈর্ষার দাবানল চলছে। পুরুষ মানুষ হয়ে একটা মানুষ এতোটা সুন্দর কেন হবে? সবদিক দিয়ে এতোটা পারফেক্ট কেউ হতে পারে? ম্যানেজার নিহাল আবরার ধমকে উঠে সকলকে নিজের কাজ করার তাগিদ দিতেই সকলের ধ্যান ভাঙ্গে। যে যার যার ডেস্কে বসে পুনরায় কাজে মন দেয়। ততক্ষণে আহরার লিফ্টে উঠে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।

লিফটে উঠে সোজা ছাদে চলে যায় আহরার। ছাদে ঢুকতেই বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ তীব্র আকারে শুনতে পেলো। ধীর পায়ে হেঁটে একেবারে ছাদের মাঝখানে চলে যায় সে। মুখ থেকে মাস্কটি খুলে ছাদের দরজার বাইরে রেখে এসেছে। দুহাত মেলে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়ায় সে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা মুখে আছড়ে পড়ছে। চোখ বুঝে তা গভীরভাবে অনুভব করছে আহরার। মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেছে তার। এক অদ্ভুত শান্তি, অদ্ভুত শীতলতায় তার ভেতরটুকু চনমনে হয়ে উঠেছে বেশ।

–ভাইয়া….?
ছোটো ভাই আয়াজের ডাক শুনে চোখ খোলে আহরার। ঘাড় বাঁকিয়ে চায় ভাইয়ের দিকে। আহরারকে দেখে আয়াজেরই চোখ আটকে যায়। হলদে ফর্সা মুখখানি বৃষ্টিতে ভিজে কি সুন্দর এক হলুদ আভা ছড়িয়ে দিয়েছে পুরো মুখ জুড়ে। আহরার চোখের ইশারায় জানতে চায়, “কি হয়েছে?”
কিন্তু আয়াজের ধ্যান নেই দেখে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ায়। আয়াজের কাছে এসে হালকা ধাক্কা দিতেই ধ্যান ভাঙে তার। আহরার প্রশ্ন করে,

–কি রে, মেয়ে মানুষের মতো এভাবে হা করে তাকিয়ে আছিস কেন?
–কি যে বলো ভাইয়া। ছেলে, মেয়ে, বাচ্চা, বুড়ো যে কেউই এই মুহুর্তে তোমার এই বৃষ্টিভেজা রূপ দেখলে আমার মতোই তাকিয়ে থাকতে বাধ্য।

আয়াজের কথা শুনে মৃদ শব্দে হেসে ওঠে আহরার। যার ফলে একপাশের গেঁজদাঁতটির ঝলক দেখা যায়, তাতে তার সৌন্দর্য যেন আরো একরাশ বেড়ে গেলো। আলতো করে মাথায় চাটি মেরে বলে,
–হয়েছে এতো তেল দিতে হবে না। কিজন্য এসেছিস বল তো। এতো সুন্দর মোমেন্টটা নষ্ট করে দিলি।
–ওহহ হ্যা, যা বলতে এসেছি। তোমার টিম এসেছে বাড়িতে। তোমাকে জলদি বাড়ি ফিরতে বলেছে।
–আমার টিম? মানে দাইয়ান, রাদিফ আর ঈশান।
–হ্যা ওরা অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।

আহরার চিন্তিত ভঙ্গিতে ভাবতে লাগলো, ওরা হঠাৎ অসময়ে এভাবে ডেকে পাঠালো কেন? তাও আবার বাড়িতে এসে। চিন্তা বাদ দিয়ে আয়াজের উদ্দেশ্যে বলে,
–তুই এক কাজ কর আমার কেবিন থেকে সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি ফের। আমি আর অফিস যাচ্ছি না। এখান থেকেই নিচে গিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ছি। ওকে?

–ওকে ভাইয়া, এদিকটা আমি সামলে নিচ্ছি। তুমি যাও।
নিজের মাস্কটি দিয়ে পুনরায় মুখ ঢেকে অফিস থেকে সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে আহরার।
বাড়িতে ঢুকতেই সে অবাক হয়ে যায়। কেমন যেন থমথমে পরিবেশ। কারো কোনো শব্দ নেই। এতোটা নিঃশ্চুপ কেন? এদিক ওদিক তাকিয়ে কাওকে না দেখতে পেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় সে। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েও দেখে একই অবস্থা।

–আশ্চর্য! সকলে গেলোটা কোথায়? আয়াজ বললো দাইয়ানরা এসেছে। ওদেরও কোনো সাড়াশব্দ নেই।
আচমকা পিঠে দুম করে কিল পড়তেই পেছনে ফিরে দেখে ঈশান।
–শা লা, এতোক্ষণে তোর আসার সময় হলো?
–ব দ মা ই শের দল! কোথায় ঘাপটি মেরে ছিলি?
দাইয়ান এসে জবাব দেয়,

–লুকিয়ে ছিলাম। দেখছিলাম তুই কি করিস।
এ পর্যায়ে রাদিফেরও আগমন ঘটে। তড়িঘড়ি এসে বলতে থাকে সে,
–চল, চল, চল বেরিয়ে পড়তে হবে এখুনি। নইলে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে আহরার,
–বেরোতে হবে? কোথায় বেরোতে হবে?
আহরারের কাঁধে চাপড় মেরে জবাব দেয় ঈশান,

–আরেহহ বন্ধু, দাইয়ানের বোনের বিয়ে ওদের গ্রামের বাড়ি থেকে হবে। আমরা সবাই এখন ওদের গ্রামের বাড়িতেই যাবো। সেইজন্য তোকে নিতে এসেছি।
আহরারের জবাব,
–আর সেটা আমাকে এখন জানাচ্ছিস?
দাইয়ান কৈফিয়তের সুরে বলে উঠে,
–আহা দোস্ত, কালকেই ফাইনাল হলো কথাবার্তা। যেহেতু গ্রামে বিয়ে হবে তাই আগে গিয়েই সেখানকার কাজকর্ম সারতে হবে।

–হুম বুঝলাম। ওকে তোরা অপেক্ষা কর আমি মা আর বড়মাকে বলে আসি।
রাদিফ আটকে দেয় আহরারকে,
–তার প্রয়োজন নেই আমরা আন্টিদের পারমিশন নিয়ে নিয়েছি। তোর ব্যাগপত্রও গুছিয়ে গাড়িতে তোলা হয়ে গেছে। জাস্ট চল।
–আরে চেঞ্জটা করে নেই..
–কোনো চেঞ্জ করতে হবে না, এভাবেই চল। (ঈশান)

–এই টি-শার্ট আর ট্রাউজার পড়েই চলে যাবো?
–হ্যা যাবি কোনো সমস্যা নেই, কেউ দেখবে না চল। (দাইয়ান)
এই বলে একপ্রকার চ্যাংদোলার মতো করেই আহরারকে নিয়ে ছুটলো তিনজন।
ওরা চারজন হলো বাল্যকালের বন্ধু। স্কুল, কলেজ এমনকি ভার্সিটিতেও একসাথেই পড়েছে এই চারজন। এখন প্রফেশনাল লাইফে যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় দেখা সাক্ষাৎ কমে গিয়েছে। তবে যেকোনো আয়োজনে চারজন একসাথেই থাকবে। কেউ কাউকে ছাড়া যাবে না।

আহরারকে গাড়িতে তুলতেই সকলে যার যার জায়গায় বসে পড়ে। রাদিফ ড্রাইভ করে। গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে বিকেল গড়িয়ে গিয়েছে প্রায়। তবে মেঘলা আবহাওয়া থাকায় সেটা খুব একটা বোঝা যায় না। মনে হচ্ছে সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে।
গ্রামে প্রবেশ করতেই আহরার বলে উঠে,
–ওই আমার মাস্ক, টুপি দে।
ঈশান টিটকারি মেরে বলে,

–না দোস্ত, তোকে বরং বোরকা আর নিকাব দেই। কি বলিস।
হো হো করে হেসে ওঠে বাকিরা। আহরার ঈশানের পিঠে এক ঘুষি মেরে বলে,
–শা লা, মজা নিস।

দাইয়ান হাসতে হাসতে মাস্ক আর ক্যাপ আহরারের হাতে ধরিয়ে দেয়। আহরার সেসব দিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করে নেয়। রাদিফকে বলে গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দিতে। রাদিফ কাঁচ নামিয়ে দিতেই ঠান্ডা হাওয়া এসে হুরহুর করে ঢুকে পড়ে ভেতরে। শীতলস্পর্শে মন প্রাণ জুড়িয়ে এলো সকলের। গ্রাম্য মাটির এবরো থেবড়ো রাস্তায় ধীর গতিতে চলছে গাড়িটি। আহরার বাইরের দিকে তাকিয়ে গ্রামের নির্মল পরিবেশ দেখতে থাকে। সাদা শুভ্র রং এর একটি বাড়ি দেখে তার ভিষণ ভালো লেগে যায়। আনমনে বলে উঠে,

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ১

–ওয়াও! আমেজিং।
বাড়ির ফটক দিয়ে ভেতরে চোখ যেতেই থমকে যায় সে। বাগানের সারি সারি করে সাজানো ফুল গাছগুলোতে যত্ন সহকারে পানি ঢালছে এক কেশবতী। দীর্ঘ ঘন কালো কেশরাশি দ্বারা মুখখানি আড়াল হয়ে রয়েছে তার। আহরার নিজের মুখটি বাইরে বের করে এনে ভালো করে দেখার চেষ্টা করতেই নজরে এলো এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। গাছের আড়াল হতে একজোড়া মায়াবী চোখ। সেই চোখে চোখ পড়তেই আটকে যায় আহরারের দৃষ্টি। নেশাতুর নয়নে চেয়ে থাকে ওই অক্ষি যুগলের পানে।

রূপবানের শ্যামবতী পর্ব ৩