তুমি আমি দুজনে পর্ব ৩৪

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৩৪
হুমাইরা হাসান

-আমাকে ছাড়ুন প্লিজ
অস্বস্তি আর বিরক্তিতে তুরা বলল, লোকটাকে সে যতটা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে ততটাই পাগল করে তুলছে তাকে। কিন্তু এবার আহান সরে গেলো। কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত স্বরে বলল
-দিস ওয়াজ দ্যা লাস্ট টাইম,ফারদার আমাকে ইগনোর করা তো দূর ইগনোর করার চেষ্টা করলেও তার ফল খুব খারাপ হবে।
বলে ঘুরে দাঁড়াল,পা বাড়িয়ে ঘরের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল

-আইপিএসটার কি হয়েছে, এখনো চালু হলো না কেনো?
বিরক্তিতে আহানের মেজাজ খারাপ অবস্থা। একে তো ভ্যাপসা গরম তার উপর অসময়ে কারেন্ট আইপিএস একসাথে যেতে হলো!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মোবাইলের ফ্লাশলাইট অন করে এগোতে লাগল আহান। আর তুরা চুপচাপ ওর পিছু পিছু হাঁটতে থাকল। ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ির দিকে যেতে লাগলেই তুরার পায়ের সাথে নরম কিছু লাগতেই ও চেঁচিয়ে উঠল। আহান তুরার আকস্মিক চিৎকার শুনে ঘুরে তাকাতেই ধাক্কা লাগল দুজনের, আহান নিজেকে ধাতস্ত করার আগেই তুরা এক লাফ দিয়ে আহানের গলা জড়িয়ে ঝুলে পরল

-বাঁচাও বাঁচাও আয়ায়া,,ভূত,, ভূত আমার পা ধরেছে
দু চোখ বন্ধ করে আহানের গলা ধরে ঝুলে পা ছোড়াছুড়ি শুরু করল তুরা, এহেন কান্ডে আহানের অবস্থা কাহিল, হতবিহ্বল হয়ে বিমূর্ত চোখে এদিক ওদিক বোঝার চেষ্টা করে গলা থেকে তুরার হাত সরানোর চেষ্টা করে বলল
-কি করছ তুরা, ছাড়ো। কিসের ভূত!
আহান ছাড়ানোর চেষ্টা করলে তুরা আরও জোরে খামচে ধরল আহানের টি-শার্ট, দু পা তুলে আহানের কোমর পেঁচিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে বলল

-না না,কিছুতেই ছাড়ব না , ভূত আমার পা খেতে এসেছে, আমার পা খেয়ে ফেলবে
-আরে কিসের ভূত ছাড়ো বলছি
ধমকে উঠল আহান, তুরা অতর্কিতভাবে ঝাপিয়ে ধরায় ফোনটাও আহানের হাত থেকে ছিটকে পরেছে, উলটো হয়ে পরায় লাইটের আলোটাও বন্ধ হয়ে আছে। এহেন অবস্থায় তুরা না ছাড়লে অন্ধকারে নিশ্চিত কোথাও মুখ থুবড়ে পরবে,ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। কণ্ঠের খাদ নরম করে বলল

-তুরা শান্ত হও,এখানে কোনো ভূত নেই। দেখি নামো তো
-না না,প্লিজ আমাকে ছাড়বেন নাহ। ভূতে আমার পায়ের কাছে এসেছিল। প্লিজ ছাড়বেন নাহ। আপনি যা বলবেন আমি তাই শুনব, একটা কথারও অবাধ্য হবো না
এ পর্যায়ে আহানের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি জেঁকে ধরল,অন্ধকারেই পুরু ঠোঁট এলিয়ে মৃদু হাসল,তবে নিঃশব্দে। ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকে গলা খাকারি দিলো। প্রচন্ড রাশভারি কণ্ঠে বলল
-ভেবে বলছ তো? যা বলব শুনবে?

-হ্যাঁ হ্যাঁ, যা বলবেন তাই শুনব। তবুও আপনি ভূত টাকে চলে যেতে বলুন প্লিজ!
আহান ঠোঁট কামড়ে ধরেই নিজের হাসি আটকাল। প্রচন্ড ভীতু তুরা,অন্ধকারে পায়ে কি না কি লেগেছে ওটাকে ভূত ভেবে এমন চুইংগামের মতো চিপকে আছে
-আচ্ছা এবার নামো
-এই নাহ নাহ, আমি তো বললাম সব কথা শুনব তবুও কেনো নামতে বলছেন,আমি কিছুতেই নামব না!

বলে আরও জোরে দু’হাতে আহানের গলা জড়িয়ে ধরল,আহান বিরক্ত হয়ে বলল
-আর কতক্ষণ গলা ধরে ঝুলবে তুমি? না নামলে আমি ফোনটা তুলব কি করে
এ পর্যায়ে এসে তুরা খানিকটা দমল,ধাতস্থ হয়ে নিজের অবস্থান টা উপলব্ধি করেই আহানের গলা ছেড়ে কোমর থেকে এক ঝটকায় আহানের হাত ছাড়িয়ে সরে দাঁড়াল।
আহান নিশ্চল দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে সিড়ির উপর থেকে ফোনটা তুলে আলো জ্বেলে সামনের দিকে ধরতেই ‘ম্যাও’ করে ডেকে উঠল, আহান ধারাল চোখে চেয়ে বলল
-এই যে তোমার পা খেকো ভূত, দুইটাই ষ্টুপিড!

বলেই সিড়ি বেয়ে নামতে লাগল। তুরা আহানের যাওয়ার পানে চেয়ে টুনিকে ছোঁ মেরে কোলে তুলে আহানের পিছু পিছু আবারও চলতে ধরল। অনেকক্ষণ ধরে কারেন্ট না থাকায় অন্ধকার দেখে তুরার বিড়ালটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, ওকে রাইমার ঘরের বারান্দা টাতেই রেখে দেয় তুরা। পায়ের কাছে টুনির লোমশ স্পর্শ পেয়েই তুরা চমকে গেছিল৷ এখন নিজের কপাল ই নিজের চাপরাতে মন চাচ্ছে।

-এই টুনির বাচ্চি, তোর জন্য কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম জানিস। ভয় তো দূর লোকটার গলায় পর্যন্ত ঝুলে পরেছিলাম! সব তোর দোষ,একটা বার বললে কি হত যে তুই,বলতে না পারিস ম্যাও করে ডাকতে তো অবশ্যই পারতিস
আহান পিছু ঘুরে তাকাতেই তুরা বিড়বিড়ানি থামিয়ে চুপ করে গেলো, সিড়ি বেয়ে নেমে আহানের পিছু পিছু রান্নাঘর পর্যন্ত চলে এসেছে।কিন্তু আহান খুঁজছে টা কি

-এভাবে হাঁসের মতো একা একাই পকপক না করে মোমবাতি টা খুঁজে দিলেই তো পারো
তুরা হ্যাবলাকান্তের মতো মুখ করে তাকিয়ে রইল,মোমবাতি? সে মোমবাতি খুঁজছে এটা তুরা কি করে জানবে। মুখ টা তো ফুলিয়ে রেখে কখন থেকে একা একাই খুঁজে যাচ্ছে, ভ্রুকুটি করে হেঁটে অন্যত্র সরে ড্রয়িং রুমে রাখা টেবিলটার উপর থেকে মোমবাতি এনে আহানের সামনে ধরল।
আহান মোমবাতি টা হাত বাড়িয়ে নিয়ে পকেট থেকে গ্যাসলাইট বের করে মোমবাতি টা জ্বালিয়ে আবারও উপরের দিকে গটগট করে হাঁটা ধরল

-ব’জ্জাত উগান্ডা
ফিসফিসিয়ে বলে টুনিকে কোলে করেই আবার আহানের পিছু পিছু ঘরের ভেতর ঢুকল। আহান ড্রেসিং টেবিলের উপরে মোমবাতি টা রেখে থপ করে খাটের উপরে বসে ফোন ঘাটা শুরু করল। তুরা সেদিকে চেয়ে নিজে গিয়ে বসল সোফার উপরে। বসে বসে টুনির গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ভাবছে কি করা যায়। একে তো গরম তার উপরে কারেন্ট ও নাই ভীষণ একঘেয়ে লাগছে, আর সামনে বসা উগান্ডা থাকা না থাকা একই কথা সেই তো হোপ মার্কা মুখ করেই রাখবে!
-আমার চুলগুলো টেনে দাও তো

ফোন টিপতে টিপতে কাৎ হয়ে শুয়ে পরল আহান। ওর কথায় তুরা ভ্রু কুচকে বলল
-আমাকে বলছেন?
-এখানে তুমি ছাড়া আর কে আছে? ওই আপদ টাকে তো বলিনি নিশ্চয়
-ওকে আপদ বলবেন নাহ,ওর নাম টুনি
-তোমার আজাইরা বিড়াল টার নাম কি সে নিয়ে আ’ম নট ইন্টারেস্টেড, ওটাকে আমার থেকে দূরে রাখো,আর এদিকে এসে আমার চুলগুলো টেনে দাও

আহানের চুল টেনে দিবে? শুনতেই কেমন তিরতির করে উঠল শরীরটা, তবুও কপট দাম্ভিক্য দেখিয়ে তুরা বলল
-আমি কেনো আপনার চুল টানতে যাবো। পরপুরুষের কাছে আমি যাবো না
-একটু আগে যে পরপুরুষের কোলে উঠে গলা জড়িয়ে চুইংগামের মতো চিপকে ছিলে তখন মনে হয়নি সে কথা?
আহানের ঠোঁট কাটা কথায় তুরা বিভ্রান্ত বোধ করল,আমতাআমতা করে কিছু বলতে নিলেও জড়তা ঘিরে ধরল। তুরার উত্তরের আগেই আহান পুনরায় বলল

-আর তুমি না বলেছিলে আমি যা বলব তাই শুনবে? তো এখন কি হলো, অকৃতজ্ঞের মতো আচরণ বন্ধ করে এদিকে এসে চুল টেনে দাও,নাকি চাচ্ছ আমি কোলে তুলে আনি তোমাকে?
বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চোখ ফুরে তাকাল তুরা, ছিহ লোকটার মুখের কথার কি ছিরি হচ্ছে দিনদিন!
-মুখের কি ভাষা! নির্লজ্জ

-ওহ তুমি যখন নিজেই এসে ঝাপটে ধরবে গলা ধরে ঝুলবে তখন কিছুই না,আর আমি বললেই নির্লজ্জ?
তুরা বেশ বুঝতে পারছে যে তার ওই কথাটা বলায় ভুল হয়েছে, আর তার চেয়েও বড় ভুল হয়েছে লোকটার সাথে কথা লাগাতে যাওয়া।তাই আহানকে আর কথা বাড়াতে না দিয়ে উঠে গিয়ে খাটের এক কোণায় বসল আহানের মাথার কাছে
কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে চুলগুলো স্পর্শ করল। চিকন আঙুল গলিয়ে দিলো চুলের মাঝে।
আহান চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, মোমবাতির আবছা আলোতে গৌড় বর্ণের সুদর্শন চেহারা টা স্পষ্ট। ইস চেহারা জুড়ে কি দারুণ মায়া!

দেখলেই প্রেমে পরতে মন চাই। কে বলবে এই লোকটাই এমন ব’জ্জাত স্বভাবের? উষ্ণ শ্বাস ফেলে নিঃশব্দে চুলগুলো টানতে থাকল তুরা।
তুরার বেখেয়ালির মাঝেই আচম্বিত আহান এগিয়ে এসে তুরার কোলের উপর মাথা রেখে কোমর জড়িয়ে ধরল, বিস্ময়ে তুরার ভ্রু কুচকে গেলো, ঠোঁট টানটান হয়ে এলো বিমূঢ়তায়।
সরে যেতে নিলেই আহান বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলল
-আহ্,সরছ কেনো। চুপচাপ চুল টানো। তোমার পকপকানির জন্যেই মাথা ধরেছে

কথার সহিত আহানের উষ্ণ শ্বাস আছড়ে পরলো তুরার উদরে, বাক্যের সাথে ছন্দিত ঠোঁট আর খোঁচা খোঁচা দাড়ির স্পর্শ কাঁটার মতো বিঁধে গেলো তুরার নরম পেটে। বৈদ্যুতিক ঝলকানির মতো তরঙ্গিত হয়ে কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ। মুচড়ামুচড়ি করে সরার চেষ্টা করলেও এক চুল নড়াতে পারল না আহানকে। সে নির্লিপ্ত ভাবে দৃঢ় বাহুবেষ্টিনিতে আবদ্ধ রাখল তুরাকে যেনো নিতান্তই স্বাভাবিক কিছু। কিন্তু আহানের এরূপ কাজে সে শান্ত প্রতিক্রিয়ায় থাকলেও তুরার হাড় কাঁপানোর মতো শিরশিরানি প্রবাহিত হচ্ছে ছোট্ট নরম দেহটাতে!
আহানের সুগভীরতার সাথে তার পেটে মুখ ডুবিয়ে রাখাতে তীব্রভাবে খামচে ধরল বিছানার চাদর, অস্থিতিশীল অবস্থাটা প্রাণপণে আঁটকে নিল শুকনো ঢক গিলে।

সকাল বেলা উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেছে আজ, তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে বেরোলো তুরা, ড্রয়িং রুম পেরোতে নিলেই রুবির ডাক পরল
-তুরা না খেয়ে যাচ্ছ কেনো?
-আজকে দেরি হয়ে গেছে মা, এসে খাবো
-তা বললে কি করে হয়,এভাবে না খেয়ে এক পা বাইরে রাখবে না।দেরি হলে হোক। চুপচাপ টেবিলে গিয়ে বসো
কড়াকড়ি আদেশে তুরা আর না খেয়ে বেরোনোর সাহস করল নাহ, বাধ্য বাচ্চার মতো টেবিলে গিয়ে বসতেই ভ্রু কুচকে এলো, এই পেত্নীটা আবারও উদয় হলো! চোখাচোখি হতেই ক্রুর হয়ে আসা দৃষ্টি প্রসারিত করে মেকি হেসে বলল

-গুড মর্নিং আপু?
-মর্নিং। ভার্সিটি যাচ্ছ?
-জ্বি আপু
-বাহ, তার তোমার হাসব্যান্ড আজ তোমাকে রেখেই চলে গেলো দেখছি
কটুক্তির স্বরে বলল প্রেমা। তুরা বিভ্রান্ত হলো না, বিনিময়ে হাসিটা আরও প্রজ্জ্বলিত করে উত্তর করল
-আসলে উনার আজ সকালে ক্লাস আছে, আর আমার ক্লাস তো ১০ টাই শুরু হবে তাই না চাইতেও উনাকে একাই যেতে হলো। উনিতো আবার আমায় ছেড়ে একদম যাওয়া আসা করতে পারেন না

কপট উপহাসের হাসি তৎক্ষনাৎ মিলিয়ে গেলো প্রেমার, তুরার আদিক্ষেতা করে বলা কথায় জ্বলে উঠল শরীর। তাই উত্তরহীনা জুসের গ্লাস টা তুলে ঢকঢক করে গিলল। কিন্তু তুরার শয়তানি মন তো এটুকুতেই দমবার নয়! প্রেমার হিংসাত্মক তৎপরতাকে আরেক ধাপ বাড়িয়ে বলল
-আমারই দোষ, উনি আমাকে যাওয়ার আগে কত করে ডাকলেন আমিই উঠলাম নাহ। এভাবে রোজ একসাথে গেলে লোকে কি বলে বলো তোহ! আমারতো চক্ষু লজ্জা বলে কিছু আছে নাকি
বলেই লজ্জা লজ্জা ভাব ধরল। প্রেমা আর কিছু না বলে টেবিল ছেড়ে উঠে গটগট করে হাঁটা ধরল।

-বেশ হয়েছে, পেত্নী আস্ত!
বলেই খিলখিল করে হেসে দিলো তুরা, না জানি পেত্নীটা কোত্থেকে এসে জুড়ে বসে, কোন ফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করতে যাবে বলে দুদিন উধাও হয়ে ছিলো আবারও উদয় হলো কোন দুঃখে তুরা বুঝে পাইনা।

আজ বেশ তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ হয়েছে তুরার, বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আসার সময় গেইটের কাছে পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকাল
-বাসায় ফিরছিস বুড়ি?
মাহিদের দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসল তুরা, হাসি হাসি মুখে এগিয়ে কাছে গিয়ে বলল
-হ্যাঁ ভাইয়া
-আম্মু তোকে বাসায় নিয়ে যেতে বলেছে
-মামনী? আচ্ছা তোমরা এখানেই থাকছ এখন? বিদেশে আর ফিরবে না?

-কেনো তোর কি ভাল্লাগছে নাহ?
-আরে তা কখন বললাম। তোমরা তো অনেকদিন বিদেশে ছিলে, পড়াশোনাও তো ওখানেই করেছ। এখন এখানে কি থেকে যাওয়ার ইচ্ছে আছে?
-তুই তো জানিস নিজের দেশ নিয়ে আমার কতটা ভালোবাসা, আর বিদেশ থাকাটা আমি কখনও সাপোর্ট করিনি, সে তো আব্বুর বিজনেস পারপাসে এতদিন বাইরে থাকা, একবার যখন ফিরেছি আর যাচ্ছি না

তুরা সামান্য হাসল মাহিদের কথায়৷ দুজন বাকচারিতা করতে করতেই এগিয়ে গেলো বাইরের দিকে,মাহিদ আবারও বার কয়েক বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্যে বলল তুরাকে।
এবার তুরা ভাবল,,আজকে তো বেশ তাড়াতাড়িই ক্লাস শেষ হয়েছে এখনো অনেক সময় বাকি,মামনীকে দেখে আসলে মন্দ হয়না।
তাই ওউ আর আপত্তি করল না, মাহিদের সাথে ওর গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেলো।

অপরাহ্ণের মধ্যভাগ, মাথার উপড়ের খাড়া সূর্য টা ঠিক একটু হেলতে চলেছে, বাড়ির ফটকে প্রবেশ করে দ্রুতপায়ে ভেতরে ঢুকতে নিলেই বরফের ন্যায় শীতল কণ্ঠে পা থমকে গেলো তুরার
-দাঁড়াও!
পিছু ঘুরে তাকিয়ে আহানকে দেখেই অপ্রস্তুত হলো তুরা, বাড়ি ফিরতে একটুখানি দেরি তো সে করে ফেলেছে এটা ভালোই বুঝতে পারছে কিন্তু আহানের চেহারা টা তার অস্বস্তিকে রীতিমতো ভয়ে পরিণত করছে।
-কোথায় ছিলে?

সমুদ্রের ঢেউয়ের ন্যায় প্রশান্ত গভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল আহান, ঘর্মাক্ত শরীরে লেপ্টে থাকা শার্ট অগোছালো চুল আর ঢিলে হওয়া টাইয়ের ক্লান্ত শরীর টা নিয়ে এগিয়ে আসল তুরার সামনে। একদম নাকের ঢগা বরাবর সম্মুখে দাঁড়াল
-কিছু জিজ্ঞাসা করেছি তোমাকে?
কথার সাথে যেনো হাড় হিম করা কঠোরতা আর রাগান্বিত ভাব ছুড়ে আসল। তুরা বিব্রত হয়ে বলল
-ম..মানে আমি

-তোতলানোর মতো কিছুই জিজ্ঞাসা করিনি আমি,ছিলে কোথায় তুমি? ক্লাস কখন শেষ হয়েছে আর তুমি ফিরছ কখন?
প্রচন্ড জোরে ধমকে উঠল আহান, তুরা আশেপাশে অপ্রস্তুত ভাবে তাকাল, দারোয়ান ভীষণ কৌতূহল নিয়ে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে, আহান সেদিকে একবার লক্ষ্য করে তুরার হাতের কবজিটা নিজের মুঠোয় পুরে বিদ্যুতের বেগে হাঁটা ধরল, ঘরে ঢোকার দরজা পেরিয়ে সিড়ির দিকে আগাতে নিলেই পেছন থেকে রুবি বলল
-আহান কি হয়েছে? ওকে এভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছিস কেনো?
-প্রশ্ন করো না মা

ভীষণ সুক্ষ্ম স্বরে বলে আবারও এগোতে নিলে আরও একবার থামতে হলো আমেনা খাতুনের কথায়
-দাঁড়াও দাদুভাই? কি হয়েছে? রেগে আছ কেনো এত, আর তুরাকেই বা এভাবে টেনে হিচড়ে কেনো নিচ্ছ, এটা কেমন ব্যবহার!
আমেনা খাতুনের শাসানির স্বরে বলা কথায় আহান আর দমাল না কিছু, এক টানে তুরাকে সামনে এনে বলল
-ওকে জিজ্ঞাসা করো কি হয়েছে?ওকে জিজ্ঞাসা করো ভার্সিটি থেকে দু ঘন্টা আগে বেরোনো সত্ত্বেও এখন ফেরার সময় কেনো হলো? ওকে জিজ্ঞাসা করো আমাকে না জানিয়ে ও কোথায় গেছিল তাও একটা ছেলের সাথে!
একদমে চেঁচিয়ে বলল আহান কথাগুলো, উপস্থিত সকলের মুখে বিস্ময়, কি বলল আহান? তুরা কার সাথে গেছিল? আর কোথায়?

-শান্ত হও আহান, তুরাকে আগে বলতে দাও,আগেই এতটা উত্তেজিত হয়ো নাহ
রুবির কথায় আহানের ক্রুদ্ধতা মাত্রা ছাড়াল, গুরুগম্ভীর কণ্ঠের জোর আরও বাড়িয়ে বলল
-আমাকে বলছ এ কথা টা? কেনো আমি কি মানুষ নাহ? আমার চিন্তা হয় না ওকে নিয়ে? ভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে দু ঘন্টা আগে অথচ বাড়ি আসতেই দারোয়ান বলল ও নাকি এখনো ফেরেনি আমার আমার কতটা চিন্তা হচ্ছিল এটা বুঝো? দু ঘন্টা ধরে ওকে আমি পাগলের মতো খুঁজেছি তখন আমার ভেতরে কি চলছিল এটা ও বোঝে? সব শেষে যখন ক্যাম্পাসের একটা ছেলে বলল ওকে মাহিদের সাথে এক গাড়িতে উঠে যেতে দেখেছে তখন আমার কেমন লেগেছে বোঝো তোমরা? নাকি ও বোঝে? কি হলো বলো? আমায় মানুষ মনে হয়না,আমার চিন্তা হলো কি আমি পাগল হয়ে গেলাম এতে কারো আসে যায়?!!

আহানের চিৎকারে তুরার সাথে যেনো কেঁপে উঠল ঘরের দেওয়াল পর্যন্ত ও। রুবি আর আমেনা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। প্রেমা এমন উচ্চস্বরের কথা শুনে ছুটে বেরিয়ে এসেছে। আহান ফোস ফোস করে শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল
-আ আসলে ইয়াজ ভাই এসেছিল। মামনী আমায় দেখতে চেয়েছিল আর আজ ক্লাস ও তাড়াতাড়ি শেষ হয়েছিল বলে আমি ভাবলাম একবার দেখা করে আসি

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৩৩

থেমে থেমে জড়তা ভরা গলায় বলল তুরা, আহানের কথাগুলো শুনে চোখ ভরে এসেছে পানিতে, সেটা ভয়ে নাকি অনুতাপে সেটা নিজেও বুঝে উঠতে পারছে নাহ!
-কাজটা তুমি একেবারেই ঠিক করোনি তুরা, তোমাকে কোথাও যেতে আমরা নিষেধ করব না তো, তা বলে এভাবে না জানিয়ে?তুমি না ফেরায় আমাদেরই তো কতটা চিন্তা হচ্ছিল
-ইয়াজ? ইয়াজ কে। কার সাথে গেছিলে তুমি? আএ মাহিদ কে হয় তোমার!

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৩৫