তুমি আমি দুজনে পর্ব ৩৩

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৩৩
হুমাইরা হাসান

ড্রয়িং রুমে উপস্থিত সকলের চোখে মুখে বিস্ময়। কিছুক্ষণ আগেই আসা একদম অচেনা অজানা ব্যক্তিটাকে তুরার এভাবে উদ্ভ্রান্তের মতো এসে জড়িয়ে ধরায় সকলে বিহ্বলতার চূড়ান্তে।
মাত্র কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন ভদ্রমহিলা, তাকে বসতে দিয়ে পরিচয় জানবার সময়ই তুরা ঢুকল ঘরে,কোনো দিন না দেখা এই ভদ্রমহিলা তুরার কি হন? হাজারো কৌতুহলে কপালে গভীর ভাঁজ পরল রুবি খাতুন সহ সেখানে উপস্থিত আমেনা আর চুমকির ও
তুরার মুখটা তুলে দু’হাতের আঁজলে নিয়ে কপালে গালে পরম মমতায় চুম্বন করে বলল

-তুরা মা আমার,কেমন আছিস।কত দিন পরে তোর মুখ খানা দেখলাম মা! তুই আমাকে ক্ষমা করে দে মা,তোর পাপী মামনীকে ক্ষমা করে দে,আমি জানি আমি আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছি। এতগুলো দিন তোকে একা থাকতে হয়েছে। না জানি কিভাবে পার করেছিস তুই এত কষ্টের দিন গুলো একা
তুরা নিজের গালে রাখা দুহাতের উপর নিজের দুহাত আদরের সহিত রেখে বলল

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-এভাবে বলোনা মামনী। তোমার কোনো দোষ নেই,তুমি কেনো এভাবে বলছ? আর আমিতো ভালো আছি
তবুও মমতাময়ীর মন যেনো খ্যান্ত হলো না, দুহাত তুলে তুরার হাত,মুখ, গাল ধরে হাত বুলিয়ে দিলো কপালে আরও একবার চুম্বন করে বলল
-রাজিয়াকে কতবার ফোন করেছি তোর সাথে কথা বলার জন্য ফোন ই ধরে না মাস দুই বাদে যদিও ধরে বলে তুই বাড়িতে নেই,ঘুরে বেড়াচ্ছিস নাহ তো আরও কত কি, আমার শুরু থেকেই বিশ্বাস হয়নি ওর কথা। তারপর খোঁজ লাগিয়ে জানতে পারলাম তুই ও বাড়িতে থাকিস ই না আর এ দেশে এসে আমি জানতে পারলাম তোর বিয়ে হয়ে গেছে!
পুরো কথা স্বাভাবিক ভাবে বললেই শেষের কথাটিতে যেনো একরাশ বিস্ময় আফসোস প্রকাশ পেলো। বিয়ের কথাটি শুনে তুরার মুখটাও শুকিয়ে এলো। মাথা ঝুকিয়ে নিলো

-হ্যাঁ তুরার বিয়ে হয়েছে মাস দুয়েক,আর এটাই ওর শ্বশুড়বাড়ি
সাবলীল স্বরে নারীকণ্ঠের উত্তরে ঘুরে তাকাল তুরার ফুফু, যদিও তিনি জানতেন এটা তুরার শ্বশুড়বাড়ি তবুও তার বুক ভরা হতাশা আর বিস্ময়। ভাইয়ের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে কত শত স্বপ্ন ছিল। আর তাকেই কিনা বিয়ে দিয়ে দিলো তাও কাওকে কিছু না জানিয়েই?

-আমি তহমিনা । তুরার বড় ফুফু
চোখের পানি শাড়ির আঁচলে মুছে বলল তিনি। রুবি খাতুন এগিয়ে এসে নরম হাতে ধরল তহমিনার হাত, মমতাময়ী মনের উৎকণ্ঠা ব্যকুলতা সবটাই তিনি বোঝেন, তাই উনার এমন অভিব্যক্তি অস্বাভাবিক যে নয় সেটা সেও মানের। সুমিষ্ট স্বরে বললেন

-আপা, আমার সাথে আসুন। বসুন তো এখানে। এতটা ব্যতিব্যস্ত হবেন না তো।আপনি কান্নাকাটি করলে তুরার কেমন লাগবে বলুন তো। ও তো বাচ্চা মেয়ে
তহমিনার মনে প্রশান্তির মেঘ ভেসে উঠল যেনো। রুবি খাতুনের নম্রভাষি শান্তনায় তার মনক্ষুন্নতা কমে এলো। মানুষটির সভ্যতা দেখে মনে হচ্ছে না তুরা কোনো অসুবিধায় আছে এখানে। রুবি খাতুন গ্লাস ভর্তি পানি এগিয়ে দিলেন তহমিনার সামনে। তহমিনা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি খেয়ে গ্লাসটা রাখলে, আমেনা বেগম বললেন

-দেখো তুরার আর আমার দাদুভাইয়ের বিয়েটা যে স্বাভাবিক ভাবে হয়নি তা নিশ্চয় তুমি জানো? তোমার ছোট ভাই ইমতিয়াজ আর তার স্ত্রী রাজিয়া তুরার বিয়ে একটা লম্পট, বেয়ারা, রাস্তার ছেলের সাথে ঠিক করেছিল যাকে বিয়ের দিনই পুলিশ গ্রেফতার করেছে জু’য়া আর মেয়েবা’জির কারণে, তাই মান সম্মান বাঁচাতে ইনসাফ বাধ্য হয়ে তুরার সাথে দাদুভাইয়ের বিয়েটা দিয়েছে
বলে খানিকটা থেমে,কণ্ঠের খাদ ভীষণ শীতল স্থির করে মৃদু স্বরে বলল

-আর বিয়েটা বাধ্য হয়ে দিলেও এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিলো, ইনসাফ আর তোফায়েল যে একে অপরকে কথা দিয়েছিল সেটা নিশ্চয় মনে আছে তোমার?
এ পর্যায়ে কপালের অজস্র ভাঁজ টান হলো তহমিনার, চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে উঠল,যেনো কিছু একটা দুষ্কর মনে পরেছে, যা তার চিন্তার ভাঁজ কর্পূরের মতো উবিয়ে দিলো।
কিন্তু এ পর্যায়ে তুরার চোখে মুখে উপচে এলো কৌতুহলের ইন্ধন। কিসের কথা বলছে দিদুন? তার বাবা আর ইনসাফ কি কথা দিয়েছিল?

-আপা, আমিও তুরার মায়ের মতই। শাশুড়ি হয়েছি বলে কি ওকে নিজ সন্তানের মতো ভালোবাসতে পারব না বলুন? বিয়েটা ওদের জন্যে আর পরিস্থিতি সাপেক্ষে অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও আমরা তো জানি পুরোটাই।
তহমিনা নিজের মনে উপচে পরা চিন্তার জোয়ার সামাল দিয়ে বলল
-রাজিয়া আর ইমতিয়াজের ভরসায় রেখে গেলাম ওকে,আর ওরাই কি না তুরাকে একটা অ মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছিল? রক্ষক ই যদি ভক্ষক হয় তবে আর কি ই বা বলার থাকতে পারে। টাকা আর সম্পত্তির লোভে যে ওরা সন্তান সমতুল্য তুরার সাথেও এমনটা করবে তা আমি কল্পনাতেও ভাবিনি
চুমকি এসে চা নাস্তার ট্রে সামনে রেখে সরে গেলো৷ তহমিনা তুরার দিকে চেয়ে বললেন

-তুরা মা তুই কেনো আমাকে বলিস নি? এত বড় অন্যায় টা তুই কি করে মেনে নিচ্ছিলি এসব। তোর বাবার টাকায় খেয়ে পরে তোর উপরেই এত বড় অন্যায় করার দুঃসাহস ওদের?
তুরা এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসল তহমিনার সামনে দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বলল

-মামনী! তুমি এতটা অস্থির কেনো হচ্ছ বলোতো? এখন তো এসে গেছ তুমি। সব ঠিক হয়ে যাবে, আর তুমি ছিলে না তো কি হয়েছে বাবা আর তোমাদের দোয়ায় আমিতো একটা পরিবার পেয়েছি, বাবা মা বোন দিদুন সব পেয়েছি যারা আমাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই তো, নাহলে এতো সৌভাগ্য আমি কোথায় পেতাম বলো তো।
তুরার শান্তসুলভ কথায় তহমিনার মনের অস্থিরতা প্রশান্ত হয়ে গেলো। রুবি আমেনা গাল প্রসারিত করে হাসল। তুরা আবারও বলল

-আর ফুফা কেমন আছে সেটা বলোতো? তুমি এসে থেকে আমাকে নিয়েই কেঁদে যাচ্ছ, দেখছ না দিব্যি আছি আমি। ফুফা কেমন আছে? ইয়াজ ভাই কোথায় তুমি একা এসেছ?
ইয়াজের নাম করে মুখ ছোট করে ফেলল তুরা, তুরার একদমে করা প্রশ্নে তহমিনা মুচকি হেসে বললেন
-তোর ফুফার জন্যেই তো আমি আসতে পারিনি দেশে, এই কতগুলো মাস যে কি অবস্থার মধ্যে ছিলাম তা আমরা বাদে কেও যানে নাহ। দিনদিন তোর ফুফার অসুস্থতা এতো বেড়ে যাচ্ছিল সে না যাওয়া সত্ত্বেও জোর করে হসপিটাল নিয়ে যাই। ডক্টর চেকাপ করে জানায় তার হার্টে ছিদ্র দেখা গেছে এবং যত দ্রুত সম্ভব অপারেশন করাতে হবে। তার অপারেশন, সেবা,সুস্থতা নিয়ে এতগুলো মাস চোখের পলকে কেটে গেছে যে বাইরের কিছুর খোঁজ খবর ই রাখতে পারিনি

-ফুফা এখন কেমন আছে মামনী, উনিও কি এসেছেন?
-না রে মা, উনি আসেননি। তবে সৃষ্টিকর্তার অশেষ ক্রিপা উনি এখন সুস্থ, অফিস ব্যবসা সামলে আসার সময় করে উঠতে পারেনি
-আর ইয়াজ ভাই কোথায় মামনী? ইয়াজ ভাইকে আমার মনে পরে যানো? শেষ কবে দেখেছি সেটাই মনে নাই,আমিতো ভাইয়ার চেহারাটাও ভুলে গেছি
শেষের কথাটা বলে মুখ ছোট করে নিলো তুরা, ইয়াজ তার ফুফাতো ভাই। ছোট বেলায় ইয়াজ নামটা তার অসম্ভব প্রিয় ছিলো। সারাদিন তার পিছু পিছুই ঘুরত তুরা, আর ইয়াজ তুরাকে নিয়ে পাগল। নিজের ভাইয়ের চেয়েও বেশি কিছু যেনো। কিন্তু তহমিনা বিদেশে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমে আসে ইয়াজের সাথে,বড় হওয়ার সাথে সাথে তো তুরা ভুলে গেছে সাত বছর আগে দেখা ইয়াজের চেহারাটা।

-সেটা এখনি বলব নাহ, তোর জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে কিন্তু তুরা
তহমিনার কথায় তুরা কপাল জড়ো করে তাকালো। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দিয়ে বলল
-সারপ্রাইজ? কেমন সারপ্রাইজ মামনী!
-হেয়ার ইজ ইউর সারপ্রাইজ মাই ডল!
চেনা জানা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে তুরা ফট করে ঘুরে দাঁড়াল, সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটির হাস্যজ্বল চেহারা দেখে তুরা প্রচন্ড চমকপ্রদ ভাবে তাকাল। এটা কি দেখছে সে? তার সামনে তো,,ইনি এখানে?

-মাহিদ স্যার,আপনি?
অস্ফুটস্বরে বলল তুরা, তার ঠিক সামনে বরাবর দরজার মুখে দাঁড়িয়ে নীল রঙের শার্ট পরিহিত সুদর্শন চেহারার লোকটা, যার চোখে মুখে উপচে পরা রহস্যময়ী হাসি তুরার মাথাটা আরও গুলিয়ে দিচ্ছে, বিহ্বলিত দৃষ্টিতে তাকাল তহমিনার দিকে, তার চোখে মুখে চিকচিক করছে হাসির ফালি। গাল প্রসারিত করে বলল
-ইয়াজ ভাই ইয়াজ ভাই করে এতটা পাগল ছিলি,অথচ তাকে এত কাছ থেকে দেখেও একবারের জন্য মনে করতে পারলি না?

কথার সাথে রসিকতা মিশ্রিত স্বরে বলল তহমিনা। তুরা ছলছল আঁখিতে তাকাল মাহিদের দিকে, এই জন্যেই! এই জন্যেই তার বারবার মনে হতো মাহিদের হাসিটা তার খুব চেনা,মাহিদের চেহারাটা তার খুব দেখা কিন্ত সাত বছর আগের দেখা চেহারা টা কিছুতেই মনে করতে পারছিল নাহ। গাল ভর্তি চাপ দাঁড়ি আর চোখের চশমাতে যেনো চেহারাটা পুরোদমে পালটে গেছে। তুরা তাকিয়ে থাকতেই মাহিদ এগিয়ে আসল কয়েক কদম, চোখ ভর্তি উৎফুল্লতা আর কন্ঠে কপট অভিমান জুড়ে দিয়ে বলল

-এতবার আমাকে দেখেও চিনতে পারলি নাহ? নিজের ইয়াজ ভাইকে এতটা ভুলে গেছিস তুই?
মাহিদের কথা শেষ করবার মুহূর্ত না পেরতেই তুরা এক ছুটে গিয়ে ঝাপটে ধরল মাহিদকে, দু’হাতে শক্ত করে ধরে সশব্দে কেঁদে দিল। মাহিদ এক হাতে তুরাকে আগলে আরেক হাত তুরার মাথায় রেখে আলতো ভাবে বুলিয়ে দিয়ে বলল
-আরে বাবা, এভাবে কাঁদলে হয়? তুই কি এখনো বাচ্চা আছিস যে একটা কিছু না হতেই ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে দিবি বল তো?
বলে তুরার মুখ তুলে দু’হাতে ধরে বলল

-আমার ডল তো অনেক স্ট্রং, তাই না? এভাবে কাঁদলে কিন্তু আমি ছিচকাঁদুনে বলব তোকে
মাহিদের কথায় তুরা হাসার পরিবর্তে আরও জোরে কেঁদে উঠল,আবারও মাহিদকে ঝাপটে ধরে বলল
-তুমি আগে কেনো আমাকে বললে না ইয়াজ ভাই,আমি নাহয় তোমাকে চিনতে পারিনি তুমি কি করে চুপ থাকলে। তোমার কি একবারও আমার কথা মনে হয়নি? নিজের ডলকে এভাবে ভুলে গেলে? আমি আর তোমার সাথে কখনো কথা বলব না ভাই
তুরার বাচ্চাদের মতো বিলাপ করে কান্না দেখে মাহিদ হাহা করে হেসে উঠে বলল
-নিজেই এসে গায়ের সাথে চিপকে নিজের আবার ‘আমি তোমার সাথে কথা বলব না’ বলার অভ্যাস টা তোর গেলো না তাই না রে?
মাহিদের খোঁচা দেওয়া কথা শুনে তুরা ওকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। তহমিনার দিকে তাকিয়ে বলল

-তোমার ছেলেকে চলে যেতে বলো মামনী, কোনো ববহুরূপীর সাথে আমি কথা বলতে চাইনা
তুরার গাল ফুলানো দেখে তহমিনা হেসে দিয়ে বলল
-আরে তুই যেমন ওকে এত বছর পরে দেখছিস ওউ তো তোকে তত বছর পরেই দেখছে, আর ও কিন্তু আগে চিনেছে তোকে। তোর খোঁজ তো আমি ওর মাধ্যমেই পেয়েছি
তবুও খ্যান্ত হলো না তুরার মন ঠাঁই গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, মাহিদ মৃদু হেসে এগিয়ে এসে বলল

-এভাবে গাল ফুলানো বন্ধ কর৷ আমারই দোষ প্রত্যেকবার সিডরের মতো ধুপধাপ কোত্থেকে এসে ধাক্কা মুক্কা দেওয়া মেয়েটা যে তুই ছাড়া আর কেও হতেই পারেনা এটা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো।
মাহিদের কথায় তুরা চোখ ছোট ছোট করে নিয়ে বলল

-আমারও আগেই বোঝা উচিত ছিলো যে আমার ধাক্কা মুক্কা খাওয়ার জন্য প্রত্যেকবার উড়ে এসে জুড়ে বসা লোকটা তুমি ছাড়া কেও হতে পারেনা ইয়াজ ভাই
তুরার আর ইয়াজের কথায় উপস্থিত সকলে হেসে উঠল। তুরা উপরে রাগ দেখালেও ভেতরে তার প্রশান্তিতে ভরে গেলো,কত দিন ঠিক কত মাস পর তার এতটা আনন্দ লাগল বলার মতো নাহ। এই বাড়ির সকলের মতো অমায়িক মানুষ গুলো পাওয়ার পর নিজের ভাই আর ফুফুকে পেয়ে যেনো ওর আনন্দের ষোলো কলা পূর্ণ হলো এবার, আর কিচ্ছু চাইনা তার, এই মানুষ গুলো সারাটা সময় তার পাশে থাকুক,সাথে থাকুক। আর কিচ্ছুটি চাইনা তার

মুখ ভরা অস্বস্তি আর ভয় নিয়ে তাকিয়ে আছে তুরা, অভিব্যক্তিটা ঠিক চুরি করে ধরা পরার মতন। দুই হাত জড়ো করে কচলে যাচ্ছে রীতিমতো। আর টিপটিপ করে দরজার দিকে তাকাচ্ছে একটু পরপর, মনে মনে আল্লাহর নামের ঝড় বইয়ে দিচ্ছে ‘ইয়া খোদা, এ যাত্রা বাঁচিয়ে দাও, আমি দুইদিন কোনো ইতিরামি করব নাহ’
-তোমার উলটা পালটা চিন্তাভাবনা বন্ধ হলে আমাকে বলো এসব কি করে হলো
তবুও মুখটা আসামীর মতো করে রেখেছে তুরা। যেটার ভয় পাচ্ছিল সেটাই হলো। তুরা কোনো ভাবেই চাইনি আহান তার পরে যাওয়ার ঘটনা টা যানুক। তবুও ভার্সিটির কে বা কাদের মাধ্যমে ব্যাপার টা উনার কানেও চলে গেছে। তুরা বুঝল না ভার্সিটিতে নিত্যদিন হওয়া এতসব ঘটনা রেখে মাস্টার টার কানে ওর পরে যাওয়ার খবর টা কে দিলো!

-উত্তর দিচ্ছ না কেনো ষ্টুপিড!
মৃদু ধমকে তুরা বিব্রত হয়ে তাকাল। সে কি বলবে পরে গেছিল সব তো জানেই লোকটা। তুরা ভালো করেই জানত সব দোষ ওর উপর চাপিয়ে ওকেই শ’খানেক কথা শোনাবে তাই তো বলতে চাইনি
-পরে গেছি এতে আমার কি দোষ আমিতো ইচ্ছে করে পরিনি। পরে যাওয়া তো আমার হাতে ছিলো না

-পরে যাওয়া তোমার হাতে ছিলো না কিন্তু আমাকে জানানো টা তো তোমার হাতে ছিলো। সব জাগায় নিজে পাকনামি করার বাজে অভ্যাস আছে তোমার। কি মনে করো তুমি কারো চিন্তা হয়না? আমি যে তোমার জন্যে ভার্সিটির পেছনে ঘন্টা খানেক দাঁড়িয়ে ছিলাম সে খেয়াল হলো না তোমার? চলে আসবে তো অন্তত আমাকে জানিয়ে তো আসতে পারতে না কি?
এ পর্যায়ে এসে তুরা নিশ্চুপ রইল। দোষটা তারই,আহান বলেছিল তাকে আজ তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তাই ক্লাস শেষ করে যেনো দেরি না করে, তুরাকে বাড়িতে রেখেই সে কাজে যাবে। কিন্তু তুরা আহানকে ইগনোর করতে গিয়ে ইচ্ছে করেই যায়নি

আহান তুরার উত্তরহীনা চেহারাতে এক বার দৃষ্টিপাত করে সরে গেলো। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে ফার্স্ট এইড বক্স টা বের করে খাটের উপর রাখল তুরার হাত ধরে ঠাস করে খাটের উপর বসাল
তুরাও ভদ্র মেয়ের মতো চুপ করেই বসে রইল। দোষটা যেহেতু তার এক্ষেত্রে তার চুপচাপ থাকাটাই শ্রেয়। আহান স্যাভলনে তুলা ভিজিয়ে তুরার হাতটা আলতো ভাবে ধরে ভীষণ সাবধানি হাতে আস্তে আস্তে ছোঁয়াল কনুইয়ের ক্ষতটাতে
কড়া ক্যামিক্যালের স্পর্শে জ্বলন ধরতেই চোখ মুখ খিঁচিয়ে নিলো তুরা, আহান তুরার কুচকে যাওয়া মুখটা লক্ষ্য করেই নিজের ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে ফুঁ দিতে লাগল।

আস্তেধীরে স্যাভলন চেপে তার উপর অ্যান্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিলো। তুরা অপলক চেয়ে আছে আহানের দিকে, এই যে তুরার ব্যাথায় আহানের কপালে চিন্তার প্রগাঢ় ভাঁজ পরে, বারবার ভীত হয় তুরার আঘাতে এতে তুরার ভীষণ ভালো লাগে, আঘাত লাগাতে যদি সুপুরুষের মুখে নিজের জন্য চিন্তা উদ্বিগ্নতার ছাপ দেখনার সৌভাগ্য হয় তবে এমন আঘাত আবার লাগুক,বারবার লাগুক।
ভাবতেই আনমনে হেসে উঠল তুরা। আহান চোখ তুলে তাকাতেই গম্ভীর গলায় বলল

-এভাবে শুধু শুধু হাসছ কেনো তুমি
-কই না হাসছি না তো
তুরা হাসি থামিয়ে ভাবহীন চেহারা করে বললে আহান ভ্রুকুটি করে বলল
-আমাকে কি তোমার অন্ধ মনে হয়, নাকি পাগল কোনটা?
-এমা ছি ছি, আপনাকে আমি কেনোই বা অন্ধ বা পাগল মনে করব, আপনি হলেন দ্য গ্রেট মাস্টার মশাই, আপনাকে পাগল ভাবার মতো দুঃসাহস আমি স্বপ্নেও করিনা।

তুরা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল আহানের দিকে চেয়ে, চোখে মুখে বিস্ময় আর গুরুতর ভঙ্গি ধরে রেখেছে, আহান তুরার দিকে চোখ মুখ শক্ত করে দেখল।আবারও মেয়েটা নাটক শুরু করল, কিন্তু এসব আবার কেমন ভাষা!
-মাস্টার মশাই?কি বললে তুমি? মাস্টার মশাই কাকে বলছ তুমি
ধমকে উঠে দাঁড়িয়ে পরল আহান, তুরা মুখটা অসহায়ের মতো করে বলল
-আপনাকে, আপনি ছাড়া কাকে বলব। আপনি হলেন দ্যা গ্রেট মাস্টার মশাই
-সাট আপ, যাস্ট সাট আপ! আরেকবার যাদি এই ডিসগাস্টিং ওয়ার্ড টা ইউস করেছ তাহলে আজ তোমার একদিন কি আমার
তুরা উঠে দাঁড়িয়ে আহানের হাত ধরে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে বলল

-শান্ত হন,আপনি শান্ত হন মাস্টার মশাই। এভাবে রেগে গেলে প্রেসার হাই হয়ে যাবে তো
আহানের মেজাজ সপ্ত আসমানে চড়ে যাচ্ছে, এই ওয়ার্ড টাকে সে রীতিমতো ঘৃণা করে, মাস্টার মশাই!? তাকে কি দেখতে টাকলা পেট মোটা স্কুলের মাস্টার মনে হয় যে এসব নাম বলবে। এই মেয়েটা যে তাকে ইচ্ছে করে হেনস্তা করছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে। কাল থেকে শুরু করেছে মেয়েটা, এক তো তাকে ইগনোর করছে তার উপর এধরণের বিরক্তিকর কথা বার্তা।এর সামনেই থাকা যাবে নাহ
-স্টুপিড, বাঁদর কোথাকার

চোখ রাঙিয়ে বলেই গটগট করে বারান্দার দিকে গেলো আহান। তুরা ওর দিকে চেয়ে মুখে হাত চেপে হাসল। ঘড়িতে প্রায় রাত এগারোটা। ফুফু আর মাহিদ বিকেলেই চলে গেছে, ইনসাফ বা আহান কারো সাথেই দেখা হয়নি তাদের। রুবি আমেনা বেশ কয়েকবার বললেও মাহিদের কোনো কাজ থাকায় তারা থাকেনি।তাই আর জোর করেনি কেও, তবে ফুফু আর মাহিদের কথাটা আহান একেবারেই জানে নাহ। বেশ রাত করে ফিরেছে আজ সে, আহান বাড়ি ফেরার আগেই সকলে ঘরে ঢুকে পরেছে। তাই আর জানানো হয়নি। তুরা তো একটা কথায় বারবার ভাবছে যে আহান যখন যানতে পারবে মাহিদ তুরারই ভাই তখন তার প্রতিক্রিয়া টা কেমন হবে!

ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানা ঠিক করে শুতে গেলে দেখল আহান এখনো ঘরে আসেনি। এর মাঝেই হুট করে কারেন্ট চলে গেলো। তুরা বিছানাই বসতেই থমকে গেল, এভাবে কারেন্ট তো যাই না,আজ হঠাৎ কি হলো? অন্ধকারে তুরার জান বের হওয়ার উপক্রম। কোনো মতে উঠে হাতরে হাতরে বারান্দায় এসে আহানকে ডাকল
-শুনুন? আপনি কোথায়?
তবুও কোনো উত্তর পেলো নাহ। তুরার ভীষণ রাগ হলো এই লোকটাকে ভালো করে ডাকলে কিছুতেই উত্তর দিতে চাইনা। অসহ্য!

-আপনি কথা বলছেন নাহ কেনো? আমার ভয় করে অন্ধকারে!
হুট করেই তুরাকে বারান্দার রেলিঙের সাথে চেপে ধরলো আহান, অন্ধকারে এমন আকস্মিক আক্রমণে তুরা প্রথমে চমকে গেলেও আহানের স্পর্শে শান্ত বনে যায়।
আহান নিঃশব্দে কোনো কথা ছাড়ায় চেপে ধরে রেখেছে ওকে, প্রগাঢ় নিঃশ্বাস তুরার ঘাড়ে মুখে উপচে পরছে ক্রমান্বয়ে।
-ছ’ছাড়ুন আমাকে
কণ্ঠে মৃদু কম্পন ধরে বলল তুরা। কিন্ত আহান ছাড়ার পরিবর্তে আরও জোরে চেপে ধরল। শরীরের কাছে আরও ঘেঁষে দাঁড়াল।

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৩২

-আ আমাকে ছাড়ুন,এমন কেনো করছেন
-খুব তো ইগনোর করছিলে আমায় কাল থেকে, খুব শখ না আমার থেকে দূরে থাকার? এবার থাকো অন্ধকারে সারারাত আমার সাথে চিপকে,এক চুল নড়ছি না আমি

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৩৪