তুমি আমি দুজনে পর্ব ৩২

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৩২
হুমাইরা হাসান

ভীষণ ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তুরার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল আহান, তুরা ভয়ার্ত চেহারায় একবার সে পানে চেয়ে খাট থেকে নেমে যেতে লাগলেই আহান ঝড়ের বেগে এসে ঝাপটে ধরল তুরাকে,বিছানায় ফেলে আগের চেয়েও দ্বিগুণ জোরে চেপে ধরল তুরার দুবাহু। দৃঢ় বন্ধনের চাপে তুরা ব্যথায় মৃদু শব্দ করার আগেই ক্ষিপ্ত নজরের চোখটা খুব কাছে এলো, যাতে স্পষ্ট দাম্ভিক্যের আভাস, তীক্ষ্ণ চাহনি তুরাতে আবদ্ধ রেখেই বলল

-বউগিরি দেখানোর খুব তো শখ, কথায় কথায় আমাকে ইগনোর করা শিখেছ, আবার আমাকে পরপুরুষ বলে অন্য ঘরেও থাকার দুঃসাহস ও করেছ, বেশ তবে এবার আমিও স্বামীগিরি ফলাব
বলেই তুরার হাতে চেপে রাখা হাতের পুরুষালি আঙুল তুরার আঙুলের মাঝে দিয়ে চেপে ধরল, দৃঢ় হলো আরও হাতের বন্ধন, তুরার শরীরের উপর ভার ছেড়ে দিলো আহান, সমুদ্রের ন্যায় উথাল পাথাল ঘন নিঃশ্বাস আরও কাছাকাছি থেকে আছড়ে পরছে তুরার সারা মুখে। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চাইলো তুরা আহানের দিকে, লোকটা কি বলছে! স্বামীগিরি ফলাবে মানে?!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তুরার ভাবনাকে ছেদ করে আহান রাশভারি কণ্ঠে হীম হাওয়ার মতো শীতলতা ছড়িয়ে বলল
-বউ না তুমি আমার?তাহলে আমিতো তোমারই স্বামী,তাই পশুধু তোমার সাথে ঘুমাবই নাহ আজ আরও অনেক কিছুই করব যা প্রত্যেক স্বামীরাই করে তার বউয়ের সাথে,সো আর ইউ রেডি ফর ইট তুরা রাণী?
চোখে মুখে বিস্ময় আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেলো তুরার,বুকের ভেতর ধুকপুকানির ছন্দময় ক্রীয়া টার বেপরোয়াতা প্রচন্ড ভীত আর শঙ্কিত করে তুললো তুরাকে, হাতে এতো জোরে চেপে ধরেছে যে সরাতেও পারছে না আহানকে। নিজের শরীরের উপরে পুরুষালি স্পর্শের এতটা নৈকট্য তুরার অর্ধেক শক্তি খুইয়ে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে বার কয়েক ঢোক গিলল।
আহান চোখে উপহাস আর ঠোঁটে রহস্যময়ী বাঁকা হাসি দিয়ে বলল

-আমি কাছে আসলেই তো মিইয়ে যাও, ধরলে তো খুঁজেই পাওয়া যায়না, আমি স্বামীত্ব ফলালে সহ্য করতে পারবে?
চোখ খুলে তাকালো তুরা, আহান তার শরীর তার স্পর্শ আর নিখুঁত দৃষ্টি সবটাই তার নিকটে,ভীষণ নিকটে। অপলক চাইল তুরা আহানের গহীন দৃষ্টিতে, যেনো উপরে দেখানো অভিমান কপট রাগ সবটা চিড়ে ভেতরের অনুভূতি গুলো বেরিয়ে আসতে চাইলো। তবুও নিজেকে সংযত করে অন্যদিকে চাইল। নিষ্প্রভ কণ্ঠে বলল

-ছাড়ুন আমাকে
-চোখ এদিকে ফেরাও, আমার চোখের দিকে তাকাও
আহানের কথায় ও তুরা হেলদোল করল না, ঠাঁই অন্যদিকে চেয়েই থাকল। আহান ভ্রুকুটি করে তুরার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। হাতের ভাজ থেকে আঙুল ছাড়িয়ে তুরার থুতনিতে রেখে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল
-আমার পুরো কথাটা তুমি, না শুনেই ওভাবে চলে এলে,আর এখনো রাগ করে আছ, আমি বলতাম তুমি আমার ওয়াইফ তার আগেই চলে এসেছ তুমি

তুরার প্রতিক্রিয়াহীন নিস্তেজ চোখে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল, উপহাস করে বলল
-আমাকে তো আপনিই বলেছিলেন যাতে বিয়ের কথাটা কেও না জানতে পারে তাইলে আপনি কেনো পলি ম্যাডামকে বলতেন যে আমি আপনার বউ? এ কথা আপনি আমায় বিশ্বাস করতে বলছেন?

তুরার তাচ্ছিল্য ভরা কথায় আহান খানিকটা ভড়কে গেলো, ভাবাবেগে বিব্রত হয়ে গেলো। যেনো জড়তায় আটকে গেলো শব্দ। আহানের অপ্রস্তুত চাহনিটা তুরার দৃষ্টিগোচর হলো নাহ, অবজ্ঞা সূচক হাসি দিয়ে বলল
-থাক, আপনাকে কিছু এক্সপ্লেইন করতে হবে না। আমি কে যে আমায় কৈফিয়ত দিতে হবে। ওই যে বললাম দয়া করে রেখেছেন নিজের ঘরে। আমায় যে বউ হিসেবে মানেন না এ কথাটা কম হলেও আমার মাথায় গেঁথে দেওয়ার মতো বারবার বলেছেন। তাই না আমি আর বউ হতে চাই আর নাইবা কোনো অধিকার বা স্বীকৃতি চাই
কাঠ কাঠ গলায় বলা তুরার কঠিন শব্দগুলো আহান নিঃশব্দে কোনো প্রতিক্রিয়াহীন শুনে নিজের ভার সরিয়ে নিলো। হাতের ভাজ খানিকটা আলগা করে বলল

-তুমি কি চাও বা না চাও সেসব আমি জানতে চাইনা। রাতে তুমি অন্য কোথাও ঘুমাতে পারবে নাহ৷ যদি আমাকে পরপুরুষই মনে হয় তবে পরপুরুষের সাথে থাকার মতো পাপ টাই তোমায় করতে হবে।
নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর আহানের, তুরাকে ছেড়ে ওর গা ঘেঁষে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পরল। এ পর্যায়ে তুরার ভীষণ রাগ হলো,এমন কেনো লোকটা? চটে গিয়ে বলল
-কেনো শুনব আমি আপনার কথা, মানব না

ঘাড় কাত করে তাকাল তুরার দিকে, আবারও স্কুলের পেট মোটা হেডমাস্টারের মতো কপালে ভাজ গাঢ় করে তুরাকে কাঠখোট্টা ভাষায় বলল
-কারণ আমি তোমার হাসব্যান্ড, আর এটা ওয়ার্ণিং আমার, না মানলে কি করে মানিয়ে নিতে হয় তা আমি বেশ ভালো মতই জানি।
বলে তুরাকে উত্তর করার সুযোগ না দিয়েই আবারও বলল

-ব্যাপারটা যেরকম ভাবছ আদও তেমন নাহ।এখনো বাচ্চা আছ তাই আবেগে পরে হুটহাট বাঁদরামি করবে এটাই তোমার স্বভাব। কিন্তু যা করবে আমার সীমানার মাঝেই,এর বাইরে নাহ। পড়াশোনায় মনোযোগ দাও, আমার সব আচরণ ধরে বসে থাকতে হবে নাহ। নিজেকে স্ট্রং করো। আমি চাই তুমি আমার না নিজের পরিচয় গড়ে তোলো। তোমার বাবা তোমাকে যেমন করে দেখতে চেয়েছিলেন ঠিক তেমন হও। বউ হওয়ার সময় এখনো অনেক আছে।আমি যদি এখনি স্বামীত্ব দেখাই তাহলে তোমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে নাহ। আমি ঠিক কি চাই,আমার কে হও তুমি এটা আমি খুব ভালো মতোই জানি। তাই আবারও বলছি সেসব নিয়ে তোমাকে বেশি ভাবতে হবে নাহ। এবার চুপচাপ ঘুমাও, নাকি চাচ্ছ আমি স্বামিগিরি ফলাই?

সবটা কথা তুরা মনোযোগ দিয়ে শুনলেও শেষের কথাটা শুনে তুরার কান গরম হয়ে গেলো, একটা মানুষ কতটা বেয়াক্কেল হলে এধরণের কথা বলতে পারে
-অসভ্য একটা
-অসভ্য কেমন,কতখানি, আর ঠিক কতটা এটা সময় হলেই বুঝে যাবে নাও স্লিপ
তুরার ফিসফিসিয়ে বলা কথাটাও আহান শুনে আবারও দায়সারা উত্তর দিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে পরল। মাথার ভেতর সবটা কেমন গুলিয়ে গেছে তুরার, লোকটা আদও কি বোঝাতে চাই? গভীর ভাবনায় মত্ত্ব হয়ে কখন তুরা ঘুমে বুদ হয়ে গেলো টের ও পাইনি

সকালের রোদ চোখে পরতেই চোখ মুখ ধরে এলো। টিপটিপ করে নেত্রদ্বয় খুলে তাকাল তুরা। আধবোজা চোখেই নড়চড় করতে গেলেই নিজেকে শক্ত কোনো বন্ধনে আবিষ্কার করল, চোখ দু’টো সম্পূর্ণ প্রসারিত করে তাকাতেই আহানের ঘুমন্ত চেহারা টা দেখতেই অধরে অদ্ভুত হাসির রেখা বয়ে গেলো।

লোকটা ঘুমের মাঝেই দু’হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে রেখেছে তুরার, এতটা শক্ত করে ধরেছে যেনো ছাড়লেই পালিয়ে যাবে। আনমনেই হেসে মাথার চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে দিলো তুরা। কি করে বুঝাবে সে কেনো এতটা মান অভিমান হয় তার। কেনো ছোট ছোট আচরণেও এতটা বুক ভার হয়ে আসে তুরার। স্বামী নামক গম্ভীর মানুষটাকে সে তো একটু একটু করে ভালোবেসে ফেলেছে। লোকটার গোমড়া করে রাখা মুখ, গমগমে গলার ধমক সবটা সহ্য হলেও তার পাশে অন্যকাওকে বা তার ছোট ছোট আচরণ ও তাকে ভীষণ পীড়া দেয় আজকাল।

ঘুমের মাঝেও কিঞ্চিৎ নড়ে উঠল আহান, তুরা আহানের হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলেও পারল না দৃঢ় হাতের বন্ধন আলগা করতে। ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিতেই নড়েচড়ে উঠে বসল আহান, ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল

-এত উতপাত করো কেনো বলোতো, উঠে দু মিনিট ও কি স্থির থাকা যায় না? এক তো রাতভর আমাকে জ্বালিয়ে মারো আবার এখন একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দিবে না
বলেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে তুরা কটমট করে বলল
-তো আপনি আমাকে কেনো ধরেছেন,এভাবে সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরলে তো উতপাত করবই,আপনি নিজের বালিশ ছেড়ে আমার জাগায় এসেছেন কেনো?
-ওহ তাই? আর নিজে যে সারারাত আমার গায়ে হাত পা তুলে ছোড়াছুড়ি করো তার বেলায়! তাকিয়ে দেখো তো কার জাগায় কে আছে

আহানের কথামতো নিজের অবস্থান দেখেই তুরার মুখটা চুপসে গেলো, তার মাথার নিচের বালিশ ফ্লোরে গড়াগড়ি করছে,সে নিজেই বরং আহানের বালিশে শুয়ে ছিলো, বেচারা জায়গা না পেয়ে বালিশের নিচে একটুখানি জাগায় শুয়ে ছিলো। দোষটা নিজের জেনেও তুরা খটমট বাক্যে বলল
-আমি আপনার জাগায় যায়নি আপনি ইচ্ছে করে এমনটা করেছেন। আর মাঝখানের বালিশ কই হ্যাঁ আপনি ওটা সরিয়েছেন বলেই তো

-আমি সরিয়েছি? বাহ, রোজ রাতে ইচ্ছে করে আমার গায়ের মধ্যে সরে এসে আবার আমারই দোষ দিচ্ছ। রাতভর আমার ফায়দা নিয়ে আবার সকাল হলে আমার উপরই দোষ চাপিয়ে দেবে, বাহ ইন্টারেস্টিং প্রক্রিয়া তো!
লোকটা আসলেই ব’জ্জাত। একেবারে ব’জ্জাতের ব’জ্জাত এর সাথে মুখ লাগানো মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা। তুরা চুপচাপ মুখ কালো করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ওর যাওয়ার পানে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে ওয়াসরুমে ঢুকে গেলো আহান।

সকালের নাস্তা শেষ করে মা দিদুনকে বিদায় জানিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে তুরা, আপাতত রিকশার অপেক্ষা করছে। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থেকেও রিকশা পাচ্ছে না। এবার দূর থেকে একটা রিকশা আসতে দেখে তুরার মুখে হাসি ফুটে উঠল তবে রিকশার আগেই সফেদ কার গাড়িটা সামনে এসে দাঁড়াতেই ভ্রু জড়ো হলো।
-গাড়িতে ওঠো
-দরকার নেই

তুরার এমন শান্ত ভঙ্গিমায় প্রত্যাখ্যান করায় আহান বেশ চমকিত হলো। তুরার এমন কঠোর ভাবে বেশ অবাক হলেও প্রকাশ করল না আহান,আবারও আগের স্বরেই বলল
-গাড়িতে উঠতে বলেছি
-বললাম তো লাগবে না,আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না আপনাকে
বলেই কাছে এগিয়ে আসা রিকশা টাকে থামিয়ে উঠে বসল। রিকশা টা এগোতেই আহান রাগে স্টিয়ারিংয়ে রাখা হাত ঝামটা দিলো। মেয়েটার ইগনোরেন্স একেবারেই সহ্য হচ্ছে নাহ ওর, আর এটা জেনেই আরও বেশি ইগনোর করছে ওকে।
‘ড্যাম ইট’ বলেই আবারও গাড়ি টেনে বেরিয়ে গেলো।

-পেত্নীর দলগুলো এভাবে কেনো তাকায় বল তো
ফারিহার প্রশ্নে তুরা কলম থামিয়ে সামনের বেঞ্চিতে তাকাল,, রিফা অরিন আর মারিয়া নামের মেয়েগুলো ওর দিকে কিভাবে তাকাচ্ছে বারবার। মেয়েগুলোর সমস্যা কি তুরা আদও ভেবে পাই না। সেদিন থেকে পিছে পরে আছে
-আমার কি মনে হয় জানিস, দুলাভাই স্যারকে তোর সাথে দেখে ওদের খুব জ্বলে তাই এমন করছে। তুই উনার বউ জানলে যে কি করবে

-চুপ, কিসব বলছিস। কেও শুনবে তো
-শুনুক। ওই পেত্নী গুলো বেশি করে শুনুক যে তুই দুলাভাই স্যারের বউ
চোখ কুচকে তাকাল তুরা ফারিহার দিকে। মেয়েটা ভিষণ ভাবলেশহীন। এসে থেকেই অরিন রিফা কেমন ক্রুর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল তুরার দিকে। তুরা বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করলেও অসবে গা করেনি
-ইয়ার চুপ কর দুজন। মাহিদ স্যার দেখছে

পেছন থেকে সাদমানের কথায় তুরা আর ফারিহা সরে বসল। মাহিদ স্যারের খুব ইম্পর্ট্যান্ট লেকচার চলছে তার মাঝে দুজন গল্প করছে দেখলে ঠাস করে রুম থেকে বের করে দেবে। লোকটা হাসি খুশি স্বভাবের হলেও রেগে গেলে আর তাকানো যায়না।
মাহিদ হেঁটে হেঁটে লেকচার দিচ্ছে আর তুরার দিকে তাকাচ্ছে, রহস্যময়ী ভাবে চাইলেও চোখে মুখে কেমন খুশির আভাস। যা সকলের অগোচরেই রেখেছে।

ক্লাস শেষে ফারিহার সাথে বেরচ্ছিলো তুরা। সাদমান ওদের সামনেই হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে করতে এগোচ্ছিল দুজন। সিড়ির দিয়ে নামার সময় হুট করেই পেছন থেকে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা লাগলেই তাল সামলাতে না পেরে মুখ থুবড়ে পরে গেলো সিড়ির উপর। আকস্মিক ঘটনার অপ্রস্তুততায় সাদমান ফারিহা দুজনই বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইল। তুরাকে পরতে দেখে হাত বাড়িয়ে ধরতে নিলেও শুরু হাতের ব্যাগ টাই ধরতে পেরেছে। ছুটে গিয়ে তুরাকে এক হাতে ধরে তুলে দাঁড় করাল

-তুই ঠিক আছিস তুরা। কোথায় লেগেছে দেখি?
ব্যতিব্যস্ত করে বলল ফারিহা,সাদমানের হাতে তুরার ব্যাগটা ধরিয়ে তুরার গায়ের ময়লা ঝেড়ে দিতে লাগল। কনুই এর ব্যথায় অসহনীয় জ্বলন শুরু হয়েছে তুরার,হুট করে কি হলো এখনো বুঝতে পারছে নাহ। তবে হাঁটু আর কনুইয়ে লেগেছে বেশ জোরেই

-তুমি পরলে কি করে তুরা। পা ফসকালো কিভাবে
সাদমানের প্রশ্নে তুরা নিজের বিব্রতি ছাড়িয়ে উত্তর করতে পারল না৷ সে তো নিজেও বুঝতে পারছে নাহ।
-মনে হলো পেছন থেকে কেও ধাক্কা দিয়েছে
ধীরে সুস্থে বলে সিড়ির উপরের দিকে তাকাতেই তুরার জড়ো হওয়া ভ্রু প্রসারিত হয়ে গেলো। এবার ব্যাপারটা একদম পরিষ্কার। ফারিহা তুরার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালেই চোখ মুখ শক্ত করে এগোতে নিতেই তুরা হাত ধরে আটকে দিলো। চোখের ইশারায় নিষেধ করে বলল

-নিচে চল
ক্লাস শেষে সবাই একসাথেই নামছিল। সবার মাঝে তুরার এভাবে মুখ থুবড়ে পরায় বেশ চমকিত হয়ে চেয়ে ছিল সবাই, কিন্ত বাকি সকলের মাঝ থেকে একদম উপরে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনের মুখের শয়তানি হাসি দেখে আর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে কাজটা নিশ্চিন্তে ওদেরই

-আমাকে আটকালি কেনো তুই। বুঝিয়ে দিতাম আজ ওদের ধাক্কা কাকে বলে। তিনতালার উপর থেকে পশ্চাত দেশে এমন লাত্থি দিয়ে ফেলব যে শাকচুন্নির মতো চিল্লানোর সুযোগ টাও পাবে না ফেচুন্নির দল
কিটমিটিয়ে বলল ফারিহা, তখন তুরা না আটকালে গিয়ে মুখের উপর বসাতো তিনটাকেই। এই রিফা অরিন আর মারিয়া তিনজনকেই ওর এমনিতেই সহ্য হয়না তার উপর কত্ত বড় সাহস হয় যে তুরাকে ধাক্কা দিলো

-তুমি আর যাই বলো,ওদের এভাবে মোটেও ছাড় দেওয়া যায়না। কি করে পারল ওরা তোমাকে ধাক্কা দিতে
তুলাতে স্যাভলন লাগিয়ে বলল সাদমান। ওর হাত থেকে তুলা টা নিয়ে ফারিহা তুরার কনুইয়ে লাগাতেই কেঁপে উঠল তুরা। কনুইয়ের চামড়া ছিলে টকটকে লাল স্তর বেরিয়ে গেছে, তাতে ক্যামিক্যালের ছোঁয়া লাগটেই টনটনে জাগায় জ্বালাপোড়া ধরল।

-অনেক খানি লেগেছে, এতে হবে নাহ৷ ডক্টরের কাছে চলো
সাদমানকে থামিয়ে দিয়ে তুরা ব্যস্ত স্বরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল
-আরে না না তেমন কিছুই হয়নি। ব্যস্ত হওয়ার কারণ নেই
-ব্যস্ত হওয়ার কারণ নেই মানে। তুই এভাবে ফিরবি কি করে
-আরে চিন্তা করিস নাহ, আমি যেতে পারব।এইটুকুই লেগেছে তো শুধু, আর তেমন হলে বাড়ি গিয়ে আমি নাহয় ওষুধ লাগিয়ে নিব

-আমার তো তোকে একদম বিশ্বাস হচ্ছে না, দুলাভাই স্যার কোথায়? উনাকে বল তোকে নিয়ে যেতে
-এই না না,,এসব দেখলে আমার পিঠ ফা’টাবে ওই লোক। প্লিজ না,আমার কথা বিশ্বাস কর আমি চোখ ছুঁয়ে বলছি বাড়ি গিয়ে ওষুধ লাগাব
ফারিহা কিছুক্ষণ আড়চোখে চেয়ে বলল
-সিউর?
-পাক্কা!
-আচ্ছা চল

বলে তিনজন মিলে বেরিয়ে গেইটে আসল। তুরাকে রিকশা ঠিক করে দিয়ে সাদমান আর ফারিহাও চলে গেলো। রিকশা ঠিক করলেও ওতে উঠে বসতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে, তখন পরে গিয়ে কনুই এর সাথে হাঁটুতেও বেশ জোরে লেগেছে। কিন্তু ওরা অনেক ব্যস্ত হয়ে পরবে বলেই জানায়নি। কিন্তু এখন একটু বেশিই অসুবিধা হচ্ছে মনে হয়
-সুইটি?

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে তুরা পিছু ফিরে তাকাতেই সিফাতের হাস্যজ্বল চেহারায় কৌতুহলের ছাপ দেখতে পেলো। তুরা সিফাতকে দেখে কিছু বলতে নিবে তার আগেই ও এগিয়ে এসে বলল
-কি হয়েছে তুরা, তুমি পরে গেছিলে? কি করে হলো এসব। তোমাদের ক্লাসের দিকেই যাচ্ছিলাম কয়েকজনের কথা শুনে যা বুঝলাম তুমি নাকি সিড়ি থেকে পরে গেছ?
বলেই তুরার কাছে এগিয়ে আসল। তুরা সিফাতকে ব্যস্ত হতে না করে সাবলীল স্বরেই বলল
-হ্যাঁ পা ফসকে গেছিল একটু। তেমন কিছু না
-কোথাও লেগেছে তোমার?

-না না আমি ঠিক আছি, আপনাকে ধন্যবাদ
সিফাতের যেনো বিশ্বাস হলো না তুরার কথা তবুও ভাবনা ছেড়ে তুরার আশেপাশে তাকিয়ে বলল
-তুমি একাই যাচ্ছ? আমিও তোমার বাড়ির রাস্তা ধরেই যাব,আমার সাথেই চলো
-না না ঠিকাছে, আমি রিকশা করেই যেতে পারব
-আমি থাকতে তুমি রিকশা নিয়ে কেনো যাবে। অ্যাট লিস্ট ভাবির দেবর হিসেবে এটুকু তো আমার দ্বায়িত্ব। প্লিজ ডোন্ট সেই নো!

বলেই তুরাকে নিয়ে গাড়ির সামনে গেলো। তুরাও আর তেমন অমত করেনি। সিফাতের গাড়িতে করেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালে তুরা বলল
-ভেতরে আসুন না, আপনাকে দেখলে খুশি হবে সবাই
-আসব তো, তবে আজ না সুইটি আজ কাজ আছে একটা
সৌজন্য সূচক বলেছিল তুরা, সিফাত মানা করায় দ্বিতীয় বার পুনরাবৃত্তি করল নাহ। গাড়ি থেকে বেরিয়ে বলল
-থ্যাংকিউ
-মাই প্লেজার

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৩১

বুকে হাত দিয়ে মাথা ঝুকিয়ে বলল সিফাত। পরক্ষণে নিজেই হেসে দিলো এরূপ কাজে। তুরাও সামান্য হেসে সিফাতকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির ভেতর আসলে বসার ঘরে ঢুকতেই থমকে গেলো। প্রচন্ড বিহ্বলতায় পা দুটো আর এগোচ্ছে না যেনো। ক্রমেই চোখ দু’টো ভরে এলো সামনের ব্যক্তিটাকে দেখে, কাকে দেখছে সে? এত বছর পর! আনন্দে আবেগে তুরার চোখের পানিধারা টুপটাপ করে ঝরে পরল। হাতের ব্যাগ টা ছিটকে ফেলে এক ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল সামনে থাকা ব্যক্তিকে

তুমি আমি দুজনে পর্ব ৩৩