রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৩

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৩
লেখনীতে: সালসাবিল সারা

–“আমি কোনো কথায় শুনবো না।তাহুরা দুইদিন কলেজ যায়নি,আরো দুইদিন যাবে না। ঐ অতুলের কথা লুকানোর সাহস কিভাবে হলো আমার মেয়ের!আজ যদি উল্টাপাল্টা কিছু হতো?আমার মেয়েকে পেতাম?”
রুদ্ধশ্বাস মুন্সী মিয়ার।লোকটা মেয়েদের আদরে রাখলেও ব্যাপক শাসন করেন।সেদিন বাড়ি ফিরে আতঙ্কে,ভয়ে তাহুরার জ্বর আসে।

স্নেহের মেয়ের জ্বরের সময়কালীন বাবা, মা,বোন তিনজনই আগলে রেখেছিল তাহুরাকে।জ্বরের ঘোরে মেয়েটা হাটে হাঁড়ি ভাঙে।দূর্বল কণ্ঠে সবটা বলে দেয় অতুলের ব্যাপারে।চোখ বুঁজে কেঁদেছিল বাবার হাত জড়িয়ে।তার একটাই আকুতি, অতুল যেনো তাকে আর উত্যক্ত না করে।মুহূর্তে গর্জে উঠে মুন্সী মিয়া।রাত তখন এক’টা কি দুই’টা!ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে সুনেরার পানে তাকালে সে শুরু থেকে সবটা বলে। তুখোড় মেজাজে বাড়ি হতে বেরুতে নিয়ে শিউলি আটকায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে।অথচ সকাল হলে তারা শুনে অতুল নেই।দলবদ্ধ মাদক সেবনের আড্ডা হতে পুলিশ তাকে সহ অনেককে গ্রেফতার করে।
যদিও এখন অতুলের ভয় নেই,তাও মুন্সী মিয়া মেয়েকে বাড়ি হতে বেরুতে দিতে নারাজ।তবে,সুনেরার জন্যে এই নীতি নেই। দিব্যি সে ভার্সিটির শেষ বর্ষের ক্লাস করছে।যতো নীতি সব তাহুরার জন্যেই।মেয়েটা যে বড্ড নাজুক।
তাহুরা বাবার পানে চেয়ে রয়।কলেজে যায়নি দুইদিন। কতো জরুরি শিট পায়নি সে।সাথে তা বুঝে নেওয়ারও ব্যাপার আছে।তাহুরা ধীরে উঠে বিছানা হতে।বাবার হাত ধরে,

–“আমার পড়া বাদ যাচ্ছে আব্বা।”
–“যাক।আমার মেয়ের চেয়ে কি পড়ালেখা বড়?”
মুন্সী তাও রাগী।
–“উফ বাবা, ঐ অতুল জেলে।তাছাড়া সেদিন তাহুরার স্যার নাকি ওকে শাসিয়েছে।সে আর উত্যক্ত করবে বলে মনে হয় না। কাল তুমি তাহুরাকে কলেজে যেতে দিবে।”
বোনের পক্ষ হয়ে কথা বলে সুনেরা।
–“বাবা কলেজে যায়?প্লিজ?তুমি দিয়ে আসবে?”
অনুরোধ করে তাহুরা।বাবার দাড়ি ভর্তি গাল টানে।মেয়ের আদুরে ভঙ্গিতে কথা বলা দেখে হাসে মুন্সী মিয়া।মেয়ের কাঁধ জড়িয়ে বলে,

–“আচ্ছা।আমি নিয়ে যাবো।তোর ঐ স্যারকেও একটা ধন্যবাদ জানাবো।”
মুন্সী মিয়া বউকে সাথে নিয়ে বেরোয়।এইদিকে তাহুরার কান যেনো বাবার কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কার সাথে কথা বলবে বাবা?উমাইর স্যারের সাথে?কেমন প্রতিক্রিয়া দিবেন স্যার?খুব বকবে কি তাহুরাকে?বাবাকেও মানা করার জো নেই।বাবা মানবে না।
পিছ ফিরে সে সুনেরার সম্মুখে বসে। সুর টেনে বলে,

–“আপু? ও আপু?”
–“হুম বল।”
মোবাইলে মগ্ন সুনেরা।
–“বাবা যে স্যারের সাথে কথা বলবে বললো,উনি ভীষণ রাগী।আমার ভয় করছে।”
তাহুরার মুখশ্রী আতঙ্কে ছেপে যায়।
–“আজব ব্যাপার তো! অভিভাবক স্যারদের সাথে কথা বলতেই পারে।এখানে তোর ভয়ের কি?এই ভয় ভয় করে সময় অসময়ে জ্বরে ভুগিস।”
–“তাও।আমার না কেমন কেমন লাগছে।”
আহত সুর তাহুরার।

–“কেমন কেমন লাগার কোনো দরকার নেই।টিভি দেখ নাহলে মোবাইল দেখ।অযথা ভয় পাস না।”
সুনেরার বক্তব্যে তাহুরা মাথা নাড়ে।দু হাঁটু বুকে গুঁজে বসে। ঘাড়ের উপর বড় খোঁপা।উমাইর বিরক্ত হয়ে ক্লাসে সকলকে ধমক দেওয়ার দৃশ্য তার মস্তিষ্কে ঘূর্ণায়মান।কেমন ভ্রু কুঁচকে ফেলে সে সুদর্শন মানব!ভাবতেই বুকের স্পন্দন বাড়ে।বাবা যেনো মান সম্মানে বাড়ি ফিরে আসে এমনটা দোয়া করলো সে মনের গহীনে।
পরক্ষণে অন্তরের ভাবনা ছুটে।উঠে যায় সে মায়ের কক্ষে।কি যেনো ভেবে মাকে বললো,

–“একটা শাড়ি দাও?একটু পড়ি।”
–“এই সময়ে শাড়ি পড়ে?”
মা খানিকটা অবাক হয়।
–“ইচ্ছে করছে মা।”
কেমন মিনতি ভরা কণ্ঠ।শিউলি মেয়ের জন্যে আলমারি হতে জামদানি একখান শাড়ি বের করে।পুরোনো হলেও এখনো নতুনের মতো চকচকে।তাহুরার দাবি নতুন নয়,মায়ের পুরাতন শাড়ি পড়বে।
মিনিট পাঁচেক এর মাঝে শিউলি মেয়েকে শাড়ি পড়িয়ে দেয়।চিবুকে হাত রেখে বলে,

–“মেয়ে আমার বড় হয়ে গেলো।”
–“ছোট থেকে যাবো নাকি মা?”
গাল ভরে হাসে তাহুরা।মুহূর্তে ফের বলে,
–“আপুকে দেখিয়ে আসি।”
খুশিমনে সে ছুটে বোনের নিকট।সুনেরা বোনকে দেখে শোয়া থেকে উঠে।বিস্ফোরিত নজরে চেয়ে বলে,
–“বাব্বাহ,কি রূপসী!ড্রেসিং টেবিলের সামনে যা।লিপিস্টিক দিয়ে দিবো।”
–“আচ্ছা।”

মেয়েটা ব্যাপক আনন্দিত।সুনেরা তাকে লিপস্টিক লাগিয়ে চুলের খোঁপা খুলে দেয়,
–“এমন থাক।ভালো লাগছে।”
–“আচ্ছা আপু বাসায় যদি চুল খোলা রাখি বা লম্বা বেণী করে রাখি, তবে কি জ্বীন আমাকে ধরবে?”
তাহুরার বোকা প্রশ্নে সমন্তলার ভ্রু কুঁচকে আসে সুনেরার,
–“কি উদ্ভট প্রশ্ন?জ্বীন কি যেখানে সেখানে মানুষকে ধরে নাকি?”
–“ধরে না?”
আবারও প্রশ্ন করে তাহুরা।
–“নাহ ধরে না। গাঁধা একটা।”
সুনেরা আহ্লাদী কণ্ঠে বলে।
–“বুঝলাম।”

ঠোঁট উল্টে বলে তাহুরা।যদিও বোনের কথা বিশ্বাস করেছে সে।তারপরও কলেজে গেলে আর পেছনে দিবে না বেণী।উমাইর স্যার যেটা বলেছে সেটা কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো না।তাহুরার আবার ভুত,প্রেত, জ্বীনের ভীতি আছে।
–“দেখি বিছানার পাশে দাঁড়া।কয়েকটা ছবি তুলে দিচ্ছি।”
আকাশে পেখম মেলে যায় তাহুরার।চেহারায় জ্বরের ক্লান্তি।সেই সাথে হালকা সাজগোজে মলিন মুখটা কেমন মোহনীয়।তাহুরা দ্রুত তাদের কক্ষের ফেইরি লাইট জ্বালায়।রুম ঝলমলে সাথে সেখানে জ্বলজ্বল করে দূর্বলতায় তুষ্ট তাহুরার হাস্যোজ্বল চেহারা।

রাত দেড়টা।হালকা শীতের আবেশ ধরণীতে।উমাইর তার ব্যালকনিতে বসে।পড়নে হাফ হাতা টিশার্ট।ঠান্ডার প্রকোপ তাকে ছুঁতে পারছে না।মনের দহনে সারা শরীর উত্তপ্ত।উমাইরের দৃষ্টি সুদূরে খেলার মাঠে।সেই মাঠ এবং তাদের ঘরের মাঝে বিদ্যমান রাস্তায় দ্রুতগামী গাড়ির আনাগোনা।সেদিনের পর তাহুরার দেখা পায়নি উমাইর।যদিও স্বাভাবিকভাবে তাদের সাথে রোজ ক্লাস পড়ে না,তাই দেখাও সবসময় হয় না।কিন্তু,সমস্যাটা অন্যদিকে।সেই ঘটনার পর তাহুরার অবস্থা কি?মেয়েটা ঠিক আছে?আকস্মিক ভয়ে দূর্বল হয়নি তো মেয়েটা?এছাড়া আরো কিছু কথা আছে যা সেদিন উমাইর তাহুরাকে বলতে পারেনি।ভেবেছে কলেজে আসলে বলবে ছলেবলে।অথচ মেয়েটা আসলো না।

সন্ধ্যা বেলায় তাহুরার একা একা রাস্তায় বেরুনো কেমন যেনো সায় দিতে পারলো না উমাইর।সেদিন ঐ অতুল ছিল, কাল অন্যকেউ হতে পারে।এমনটা ভাবনায় গত দুইরাত ধরে সে নির্ঘুম। উমাইর অতুলকে সনাক্ত করতে পেরেছে বলে একটা গতি করেছে প্ল্যানিং করে।

তবে,সবসময় তাহুরাকে উমাইর রক্ষা করতে পারবে এর গ্যারান্টি কি?উমাইর সেদিন কাকতালীয় উপস্থিত ছিলো কেবল।তাহুরার নাম্বার আছে তার নিকট।কিন্তু,ফোন দেওয়াটা ভালো দেখায় না।নিবরাসকেও কিছু জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছে নেই তার।উমাইরের ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না,সে ছোট ভাইকে কোনো মেয়ে স্টুডেন্টের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করুক।এমন অনেক স্টুডেন্ট তো কলেজ মিস দেয়।দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে উমাইর।অন্তরে এক জ্বালা।উমাইর এবং তাহুরার, দুইজনের মাঝে বিশাল দেওয়াল।এই দেওয়াল ভাঙতে অনেকটা সময়ের দরকার।

আলগোছে উঠে উমাইর।ডিজিটাল দেওয়াল ঘড়িতে লাল রঙা সময় দেখে।সকালে আটটা থেকে কলেজ।মাথা ভর্তি চিন্তা নিয়ে বিছানায় উবুত হয়ে শোয়।পলক ঝাপটায়।ঘুম আসে না।আঁখিজোড়াও বুঁজে না।তাহুরার একেক দিনের একেক প্রতিচ্ছবি ভেসে বেড়ায় মস্তিষ্কে।মানুষের স্মৃতি বড্ড পীড়াদায়ক।অতঃপর সোজা হয় সে।কম্বল টেনে নেয়।টিশার্ট খুলে বিছানার পাশেই রাখে।কপালে একহাত বিলিয়ে আপন মনে দোয়া করে,

–“বোকাটা যেনো কাল কলেজে আসে।আমার সাথে কথা বলে।দম বন্ধ লাগে রে বোকাপাখি।”
সহসা অ্যালার্মের শব্দে সজাগ হয় উমাইরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়।এছাড়াও দরজায় এক শব্দ। খট খট।উমাইর চাদর সরায়। এতো জলদি মা ছাড়া আর কে হবে?বিনা প্রশ্নে দরজা খুললে মেজাজ বিগড়ে যায় তার।আফিয়া দাঁড়িয়ে।অদ্ভুত ভঙ্গিতে।আকৃষ্ট করার চেষ্টায়।সটান করে খুলে রাখা দরজার ফাঁক এখন বন্ধপ্রায়। হুংকারের সাথে ধমকে উঠে উমাইর,

–“কি চায়?”
–“আমাকে ভার্সিটিতে দিয়ে আসবে আজ?”
আফিয়া হেলেদুলে জবাব দেয়।
–“আমাকে ড্রাইভার লাগে?বেয়াদবের মতো আমার রুমের সামনে আসবে না।”
উমাইর প্রচুর ক্ষেপেছে।
–“একই রাস্তায় তো যাও।আমাকে ড্রপ করে দাও না।দুজনে সময় কাটালে দুরত্ব ঘুচবে।”
–” অসভ্যতামি বন্ধ করবে, আদারওয়াইজ চড় দিয়ে গাল ফাটিয়ে দিবো।বংশের কলঙ্ক একটা।”

গগণ বিদারক অপমানে দরজা বন্ধ করে উমাইর শব্দ করে।রাগে গা রি রি করছে।এটা তার ছোট বোন?কি ছিলো তার পোশাক?একবার ভুলে দৃষ্টি দিলেও সেদিকে আর ফিরে দেখেনি উমাইর।ফের যদি এই মেয়ে কিছু বলে তাকে,তোয়াক্কা করবে না।বাড়ি ভর্তি সকলের সামনে নিয়ে এক চড়ে গাল ফাটিয়ে দিবে পুনরায়।

নিবরাসকে রেখে কলেজে যায় উমাইর।তাদের ক্লাসের সময়কালে বিলম্ব আছে ঢের।সকালের সেই ঘটনায় মেজাজ এখনো চটে আছে।সে বন্ধুদের সাথে কিংবা ভাই-ব্রাদারের সাথে প্রাণপনে আড্ডায় জমলেও শোরগোল বা অহেতুক মেয়েদের সাথে মশকরাতে না থাকার চেষ্টা করে।মেয়েগুলো তার কাকাতো,মামাতো বোন হলেও তার মনোভাবে আড্ডার ভাব আসে না।তাদের দূর থেকে কুশল বিনিময় করে এটা যেনো উত্তম তার নিকট।

উপরোক্ত ভাবে উমাইর তার মেয়ে কলিগদের সাথেও তেমন খোলামেলা ব্যবহার করে না।মাঝে মাঝে লাঞ্চ টাইমে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্যে বরাদ্দ ক্যান্টিনে বসতে হয়।কিছু ফরমাল কথা শেষে একেবারে নীরব থাকে উমাইর।যত্ন সহিত নিজের খাবার খায়।
নিজের কেবিনে ব্যাগ রেখে এটেনডেন্স ফাইল হাতে বেরোয় সে।তার বিক্ষিপ্ত মেজাজে আজ অনেকেই ঝলসে কয়লা হবে।

বাবার সাথে সিএনজি সমেত কলেজে আসে তাহুরা।ক্লাস শুরুর আধা ঘণ্টা আগে এসেছে।বাবা নাছোড়বান্দা।উমাইরের সাথে তার কথা বলা ফরজ।তাহুরা আগে হাঁটছে তো বাবা পিছে।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশে পাশের পরিবেশ লক্ষ্য করছে।ইংরেজি ডিপার্টমেন্ট নিচ তলায়।সরু গলির উপরিভাগে বড় অক্ষরে “English Department” লেখা।গলির দুই ধারে একেকটা টিচারদের কেবিন।তাহুরা বাবাকে বলে,

–“তুমি দাঁড়াও।আমি দেখে আসি স্যার আছে কিনা।ক্লাস চললে আবার থাকবে না।”
–“আচ্ছা যা।”
মুন্সীর ছোট জবাব।
কেবিনের সামনে যেতে যেতেই তাহুরার বেহাল দশা।স্যার বকবে না তো আবার?বদ্ধ দরজায় টোকা দিলে ভেতর হতে শব্দ আসে,

–“কাম ইন।”(ভেতরে আসুন)।
হালকা ধাক্কায় দরজা খুলে তাহুরা।উমাইর দরজার পানে চেয়ে।দুজনের নজর মিলে।ভয়ে হতভম্ভ হয় তাহুরা।তবে,উমাইর যেনো দৃষ্টির তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। মলিন মুখশ্রী,বা দিকে লম্বা ঝুলন্ত বেণী,মাথায় কাপড় দেওয়া, ভীত চোখ জোড়ায় দ্বিধা নিয়ে তাহুরা দরজায়।উমাইরের হৃদয়ের মিছিলে অনুভূতিরা আরো প্রগাঢ় হয়।
কাঁপা ঠোঁট নাড়িয়ে তাহুরা জিজ্ঞাসা করে,

–“স্যার,আপনি কি ফ্রি আছেন?”
উমাইরের দৃষ্টি সরে সন্তর্পনে।তার কঠোর চেহারা অবলোকন করে তাহুরা একটুও বুঝলো না তার সম্মুখে বসা লোকটা ঠিক কতোটা স্নেহের,ভালোবাসার নজরে পর্যবেক্ষণ করলো তাকে।
–“বলো।”
একরোখা জবাব দেয় উমাইর।
–“বাবা…”
তাহুরা বাক্য শেষ করার পূর্বে উমাইর ফের তাকায় তার পানে।থেমে যায় তাহুরা।দু সেকেন্ড পরে আবারও বলে,

–“বাবা আপনার সাথে কথা বলতে চায়।আসতে বলবো?”
–“পাঁচ মিনিট হাতে আছে।”
উমাইর তার ল্যাপটপে মন দেয়।অনার্সের পরীক্ষার প্রশ্নের কাজ চলছে।
তাহুরা দৌড়ে বাবাকে ডেকে আনে।উমাইরের নির্দেশে মুন্সী মিয়া বসলে,তাহুরাকে উমাইর বলে,

–“ক্লাসে যান।”
–“জ্বী স্যার।”
পরপর সে আবারও বলে,
–“বাবা আমি তোমাকে ফোন দিবো ক্লাস শেষে। বাসে উঠেও ফোন দিবো।চিন্তা করো না।বাসায় একসাথে দুপুরের খাবার খাবো।তুমি বাসায় আসার সময় আমার জন্যে দুইটা আচার আনবে। ভাতে মেখে খেতে মন চায়।”
অনর্গল কথাগুলো ব্যক্ত করে তাহুরা বেরিয়ে যায়।

বিস্ফোরিত উমাইরের দৃষ্টি,স্তব্ধ হলো তার পরিবেশ। বাবাকে নিঃসংকোচ আবদারের সময় মেয়েটাকে পুতুল মনে হচ্ছিলো।জলজ্যান্ত পুতুল।উমাইর বুঝলো,তাহুরার মাঝে বাহিরের মানুষের সাথে কথা বলতে যতো জড়তা কাজ করে,আপনজনদের নিকট সে ততটাই প্রাণোচ্ছ্বল। উমাইরের হৃদয়ে লোভ জাগে।সে চায় তাহুরা তার সাথেও এমনটা খোলা মনে কথা বলুক।আর এমন দিন উমাইর ঠিকই আনবে তাদের জীবনে।
–“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ,আমার মেয়েকে বাঁচানোর জন্যে।”
মুন্সী মিয়ার সহজ স্বীকারোক্তি।

–“সেদিন আমি ছিলাম বলে রক্ষা করতে পেরেছিলাম।কিন্তু,তাহুরার এমন সন্ধ্যা বেলায় একা ঘুরাঘুরি করার ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন।সে অত্যন্ত ভীতু প্রকৃতির।”
এতদিনের জমানো কথা সোজা তাহুরার বাবাকে বলে শান্তি পাচ্ছে উমাইর।
–“ও শুধু কোচিংয়ে যায় সন্ধ্যায়।কোচিং আমাদের বাড়ির একেবারে কাছে।জামালখান তার বোনের সাথে যাওয়ার কথা।কিন্তু একটু বেশকম হয়ে গেলো।”

–“জ্বী।তবে,দেখে রাখবেন।কোচিংয়ে আসা যাওয়ার ব্যাপারে তার সাথে অন্যকেউ থাকলে ঝামেলা হবে না।”
অমায়িক হাসে উমাইর।সেই হাসিতে অন্তরে সুখ মেলে মুন্সী মিয়ার।যাক,কলেজে তার মেয়েকে নিয়ে চিন্তা নেই।নিশ্চয় এই স্যারের মতো বাকি সবাই এমন সুমিষ্টভাষী!
আর মিনিট দুয়েক আলোচনা করে বেরিয়ে আসে মুন্সী মিয়া।
নিজ ভাবনা মুন্সী মিয়াকে জানাতে পেরে উমাইরের সুখের অন্ত নেই।
–“আমার সরল রূপসী এখন নিরাপদে থাকবে।দুদিনের কষ্টে কেমন ছারখার হচ্ছিলো আমার মন।অথচ এখন আমি সুখী।কষ্টের পরে সুখের অনুভুতি কি এমন তৃপ্তিকর হয়!
প্রাণখুলে হাসে উমাইর।দুহাতে চুলগুলো পিছে ঠেলে।তার এই হাসির সাক্ষী কেবল সে একাই।

সামনে টেস্ট পরীক্ষা।কয়েকদিন পর হতে ক্লাস বন্ধ থাকবে।গত দিনের ইংরেজি ক্লাসের শিট নেই তাহুরার।এই ব্যাপারে বেখবর সে।ক্লাস শেষে সকলে চটপটির দোকানের সম্মুখে দাঁড়িয়ে। হাতে ধোঁয়া উঠা চটপটি।টক,ঝাল,মিষ্টি মিশ্রিত খাবার তাহুরার আবার বেশি প্রিয়।
নিবরাস কলেজ হতে বেরুলে চৈতালি তাকে হাতের ইশারায় ডাকে।হেয়ালি নিবরাসের দৃষ্টি মাথা নিচু করে খাওয়ায় ব্যস্ত স্বাগতার পানে।ঝালে মেয়েটা অস্থির।
চৈতালির কথা শোনার পূর্বে সে স্বাগতাকে খোঁচা মেরে বলে,

–“খেতে পারে না ঝাল,আবার দেমাগ দেখায়।এই তোরা খাচ্ছিস কি?স্বাগতাকে দেখ।নাকের পানি বাটিতে পড়ছে মনে হয়।”
স্বাগতা রেগে গেলেও হেসে উঠে তাহুরা,
–“অমৃত এটা।তুই খাবি?”
–“নাহ।আমি কেনো আমার বাড়ির কেউ খায় না এগুলো।উমাইর ভাইয়া এইসবের ঘোর বিরোধী।”
নিবরাস মুখ কুঁচকায়।
–“কেনো?চটপটি খুবই মজার খাবার।স্যার আর তোরা সবাই স্বাস্থ্য সচেতন তাই হয়তো জাঙ্ক ফুড এভয়েড করিস!”
একচমচ চটপটি গালে পুরে তাহুরা।

বাকি জনদের কিছু বলতে না দিয়ে চৈতালি বলে উঠে,
–“থাম তোরা।আমি তোকে বিশেষ কারণে ডেকেছি নিবরাস।”
–“কি দরকার?জলদি বল।আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।”
প্রশ্ন চৈতালিকে করলেও দৃষ্টি তার স্বাগতার পানে।
–“উমাইর স্যার থেকে তাহুরার জন্যে গতকালের নোট কালেক্ট করে দে।”
সোজা উত্তর চৈতালির।
নোটের কথা শুনে বিষম খায় তাহুরা।নিজেকে সামলে বলে,

–“স্যার নোট দিয়েছে? বললি না কেনো আগে?”
–“মনে ছিলো না।হঠাৎ মাইন্ডে আসলো তাই বললাম।দেখলি না,নিবরাসকে ডাকলাম।”
চৈতালি উত্তর দেয়।
–“আমি কি করবো?উমাইর স্যার কেমন জানোস না?শিট নিয়ে উনার কাছে সাইন করতে হয়।যেনো কেউ বলতে না পারে,স্যার শিট পাই নাই তাই পড়া হয় নাই।ফাউল ডিসিশন তোর!”
নিবরাস দুপকেটে হাত গুঁজে।
–“কেমন স্যারের ভাই হইলি ব্যাটা!”
ক্ষিপ্ত হয় চৈতালি।

তাহুরা দোটানায় পড়ে।কোনোভাবে চটপটির বাটি রেখে পলক ঝাপটে বলে,
–“আমার সাথে একটু ভেতরে যাবি?”
–“অবশ্যই যাবো।”
হাসিমুখ স্বাগতার।
–“ওকে তোরা যা।আমি গেলাম।”

লম্বা কদমে সম্মুখে এগোয় নিবরাস।
পুনরায় তিনজন হেঁটে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে যায়।উমাইর ভেতরে আছে তার কেবিনে।ভেতরে গেলো না স্বাগতা এবং চৈতালি।তারা উঠানে দাঁড়ায়। লনে দাঁড়িয়ে অযথা ভিড় করার নিয়ম নেই।
তাহুরা সকালের ন্যায় নক করে ভেতরে আসে উমাইরের নির্দেশনা পেয়ে।আবারও তাহুরাকে আশা করেনি উমাইর।যদিও আজ তার সাথে ক্লাস ছিল না,তাও খুব করে গতরাতে দোয়া করেছিলো সে তাহুরার দেখা পাক।হলো তা।দুই দুইবার দেখা হলো।
উমাইরের প্রশ্নাত্বক মুখশ্রী ভাবায় তাহুরাকে।সে নিজেই বলে,

–“গত ক্লাসের শিট লাগবে স্যার।”
–“আসা হয়নি কেনো?”
প্রশ্ন করে উমাইর।
তাহুরা ওড়না খিচে দাড়ায়।একটু ধুকধুক করছে তার বুক।উমাইর হঠাৎ প্রশ্ন করছে কেনো?বকবে!
সরল ভঙ্গিতে সে বললো,
–“জ্বর ছিলো স্যার।”
উমাইর আলগোছে তাকায় মেয়েটার পানে।তার ধারণা সঠিক ছিলো।তার চেহারার ক্লান্তি,জ্বরের ক্লান্তি।
–“ঐদিনের ঘটনার ভয়ে জ্বর এসেছিলো?”

উমাইরের প্রশ্নে উপর নিচ মাথা নাড়ায় তাহুরা।
–“এখন থেকে সন্ধ্যায় একা বের হবে না।যদি কখনো কেউ ফলো করে বা বিরক্ত করে বাসায় জানাবে।বাসায় জানাতে সমস্যা হলে আমাকে বলবে।”
উমাইরের উত্তর অপ্রত্যাশিত।তাহুরা ভাবুক।উমাইর কি বলছে?উনি কি সেইজন,যে ক্লাসে সকলকে নাস্তানাবুদ করে রাখে!অথচ লোকটা দয়ালু,মহান।কিন্তু কাউকে তার এই রূপ দেখায় না কেনো?
–“বলবো,স্যার।”
তাহুরা হাসার চেষ্টা করে।

সেই হাসি বিঁধে উমাইরের মনের ঘরে। ছিন্ন হয় তার অন্তরের প্রত্যেকটা অংশ।গালের দুপাশে সৃষ্ট ছিদ্র উমাইরকে বেসামাল করে।কেশে উঠে উমাইর।ড্রয়ারে দৃষ্টি দেয়।শিট বের করে,
–“নাও।”
পরপর এগিয়ে দেয় সাইন করার জন্যে কাগজটি,–“সাইন হেয়ার।”(এইখানে সাইন করো)।
উবুত হয়ে সাইন করে তাহুরা।শিট হাতে বেরুতে নিলে বেখেয়ালিতে ব্যাগ আটকে যায় তার চেয়ারের সাথে।পা মচকে আধ বসা হয়। উমাইর আতঙ্কে হুট করে চিল্লিয়ে উঠে,

–“আরে দেখে হাঁটবে তো!স্বাভাবিক চলা যায় না?”
কেঁপে উঠে তাহুরার সত্তা।নিজেকে সামলানোর আগে দৌড় দেয়।যেতে যেতে কান্নারত কণ্ঠে আওড়ায়,
–“সরি,স্যার।”
হঠাৎ ধমক আশা করেনি তাহুরা।সরল মেয়েটার গালে অশ্রু ছেপে যায় নিমিষে।তাহুরার মনের ভাবনা,উমাইর এখনো রগচটা।তার মাঝে আন্তরিকতা নেই একদণ্ড।
তাহুরার গাল মুছে কেবিন ত্যাগ করাটাও নজর এড়ায়নি উমাইরের।মন খারাপ হয়নি তার,তুষ্ট সে বৈকি।

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২

উমাইর চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়।আজকের দিনটা তার মনে এমন প্রশান্তি দিবে আশা করেনি মানব। প্রেয়সীর এতসব রূপ উপভোগ করাটা অবিশ্বাস্য ছিলো। উঠে এগিয়ে যায় জানালার পানে। তাহুরা হেঁটে যাচ্ছে সইদের সমেত। চোখ,নাক মুচছে নিশ্চয়।উমাইর নিঃশব্দে হাসে।বুকে হাত রাখে,
–“তোমার প্রত্যেক রূপে আমি বুদ হয়ে রই,তাহু।তোমার হাসির চেয়েও,কান্নাটা বেশি অন্তরে লাগে।আদুরে ছিঁচকাদুনে একটা।”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৪