রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৩৫+৩৬

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৩৫+৩৬
লেখনীতে: সালসাবিল সারা

–“প্রত্যেকটা কথা স্পষ্ট ভাষায় বলো।আমি ধৈর্য্য নিয়ে দাঁড়ালাম।”
উমাইর কঠোর।তার ভাবভঙ্গি অনড়।সে পূর্বের গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে অটুট ভঙ্গিমায় প্যান্টের পকেটে হাত রাখে।সম্মুখে তাহুরা মেঘলার হাতে হাত চাপে।পায়ের কাছে ছোট্ট লাগেজ।যাওয়ার প্রস্তুতি পূর্ণ।অথচ মেয়েটা কারণ ঠিকভাবে বলছে না।মেঘলাকে ঢাল বানিয়েছে।সুনেরাও চুপচাপ।আগ বাড়িয়ে বলাটা সুন্দর দেখাবে না। তাও চেষ্টা করেছিলো মেঘলার সমেত সে ঘটনার বিস্তৃত কাহিনী জানাতে।শুনেনি উমাইর।তার দাবি সম্পূর্ণ ঘটনা তাহুরা হতে শুনবে সে।অথচ,সেই তাহুরা আতঙ্কে আত্মহারা।যা উমাইকে বিরক্ত করলো বেশ।

উমাইর বুকে দু হাত গুঁজে।গায়ের শার্ট কিছুটা ভিজে।মোটর বাইকে ফেরার পথে ভারী বর্ষণের শিকার হয়।যা এখনো বিদ্যমান।উমাইর নজর ঘুরায়। তাহুরার মাথা নিচু।আতংকে যেনো জর্জরিত।
–“বাবা,আগে শার্টটা চেঞ্জ করো।ভিজে আছে অনেকটা।”
মেঘলা টপিক পরিবর্তনের চেষ্টায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–“মা,তোমার ছোট বৌমাকে কথা বলতে বলো।আর পাঁচ মিনিট দেখবো আমি।এরপর এইভাবে দিয়ে আসবো।সব কথা মুন্সী আঙ্কেল থেকে শুনবো তখন।”
উমাইরের তীক্ষ্ণ সুর।
তাহুরার ভীত দৃষ্টি উমাইরের অবয়বে।লোকটাকে কিভাবে বলবে নিজ চাচা,চাচী এবং চাচাতো ভাইয়ের কুকাজের ব্যাপারে!উমাইর শান্ত থাকলে অবশ্যই বলা যেতো।কিন্তু লোকটা শান্ত থাকবে না।হুংকার ছেড়ে তাকে ভস্ম করবে নাহলে কি করবে তাহুরার বুঝে আসে না।উমাইর তাকে প্রচন্ড চোখে হারায়।তাহুরা নিজেকে শান্ত করে।ইতস্তত ভঙ্গিমায় আওড়ায়,

–“আস..লে বাবা আমাকে দেখতে চাচ্ছে।অনেকদিন ছিলাম তো…”
–“চলো।”
উমাইর অগ্রসর হয়।ঝুঁকে তাহুরার পায়ের কাছ হতে লাগেজ তুলে।ফের তির্যক হাসে,
–“মিথ্যে বলা তুমি মাথামোটা পারবে না।”
তাহুরা আরো চেপে দাঁড়ায় মেঘলার পানে।তার কাঁধে হাত রাখে মেঘলা। উমাইরকে ডাকে।কিন্তু সে শুনলে তো?আধ ভেজা শার্টে দ্রুত কদমে ছুটছে।

–“মা,উনি বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে বাবা যদি রেগে যায়?”
তাহুরা শঙ্কিত।ওড়নার কিনারায় আঁখির জল মুছে।মেঘলা আলগোছে পিছু হাঁটে উমাইরের।ধীর কণ্ঠে বলে,
–“যা ইচ্ছা বলুক।ওদের ব্যাপার।তুমি কিছু করোনি।তাই চুপ থাকো।ছেলেটা আমার তোমার বেলায় কতো রাগ দেখায়।আমার কথাও শুনলো না।তুমি টেনশন নিবে না কোনো।উমাইর সব সামলে নিবে।শান্ত ছেলেটা আমার জেদ দেখানোর বেলায় বড্ড রাগী হয়ে যায়।”

–“তাহু,নো টেনশন।ভাইয়া সামলে নিবে সব।আর বাবাও মেজাজ দেখাবে বলে মনে হয় না।”
সুনেরা শান্তনা দেয় বোনকে।তাহুরা চেয়েও শান্ত হতে পারে না।লোকটা কেমন,সেটা কেবল তার জানা।রাগলে যে কারো কথা কানে নেয় না।শীতলতার সহিত সব দুমড়ে মুচড়ে ফেলবে।তাদের বিয়েটাও তো লোকটার শীতলতার মধ্যখানের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের লাহান।

বাহিরে প্রচন্ড ঝড়। উমাইরকে অদূরে পার্কিংয়ে দেখা যায়।সে ড্রাইভিং সিটে বসেছে।জ্বলে উঠে ব্যাক লাইট।গাড়ি এসে দুয়ারে থামে।তাহুরাকে আগলে নেয় সুনেরা,মেঘলা।কথোপকথন চলে কয়েক মিনিট।দিলরুবা, আফিয়াও কুশল বিনিময় শেষ করে তাহুরার সহিত।সে গাড়ির পানে এগিয়ে যায়।মেঘলা ছেলের নিকট পৌঁছে।জানালার কিনারায় ঝুঁকে দাঁড়ায়,
–“আব্বা গাড়ি সাবধানে চালাবা।মেয়েটাকে গাড়িতে বকবে না।মুন্সী ভাইয়ের সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বলবে।”
–“চিন্তা করো না, আম্মি।মুন্সী আঙ্কেল সিক আমি জানি। মেজাজ ঠান্ডা রেখে কথা বলবো।”

মেঘলা ছেলের মাথায় দোয়া পড়ে ফুঁক দেয়।উমাইর জানালার কাঁচ তুলে।ঝুম বৃষ্টিতে গাড়ির স্পিড নিয়ন্ত্রণ করে।
বৃষ্টির বেগ ক্রমশ বাড়ছে।চারিদিকে তীব্র যানজট।উমাইর নিশ্চুপ।কেবল আলতো হাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে যাচ্ছে।তাহুরা কিছু বলার ইচ্ছা পোষণ করলেও ভেতরকার সত্তা বলছে, আগুনে ঘি না ঢালতে।অহেতুক যানজটের কারণে উমাইর বিড়বিড় করে কিছু বলছে।তাহুরা আড় দৃষ্টিতে তার প্রিয়তমকে দেখছে।অথচ তার প্রিয়তম কাঠের ন্যায় শক্ত।ফিরে অব্দি তাকালো না পাশে বসা তাহুরাকে। ট্র্যাফিকে আটকে থাকার সময় পার হলো বেশ।এরই মধ্যে মোবাইলে রিং বাজে।তাহুরা ব্যাগ হতে মোবাইল বের করে।বাবার ফোন।দ্রুত রিসিভ করে,

–“হ্যাঁ,বাবা!”
অপর পাশ হতে মুন্সীর কথায় ফের জবাব দেয় সে,
–“জ্যামে।উনি আছেন আমার সাথে।”
বাবার কথা শুনে তাহুরা আবারও বলে উঠে,
–“আচ্ছা।আমি উনাকে বলবো।”
তাহুরা ফোন রাখে।
অবলীলায় উমাইরকে বললো,

–“বাবা বলেছে গাড়ি সাবধানে চালাতে।”
–“আমি সাবধানে চালাতে জানিনা।”
ত্যাড়া উত্তর দেয় উমাইর।জ্যাম ছুটে কিছুটা।সেই সুবাদে গাড়ি কৌশলে আগানোর চেষ্টায় সে।
–“আপনি এমন করছেন কেনো?”
তাহুরা উমাইরের বা বাহুতে আলতো স্পর্শ করে।
–“যেমন করতে বাধ্য করেছো,তেমন করছি।”
বাহু নাড়ায় সে।বুঝিয়ে দেয় তাহুরাকে, সে যেনো হাত সরায়।

অবহেলায় পিষ্ট তাহুরা ফুঁপিয়ে উঠে।তার মনঃক্ষুণ্ণ হয়।লোকটা এইভাবে তার হাত সরিয়ে নিলো?
তাহুরা জানালার কিনারায় ঘেঁষে বসে।আঁখির জল মুছে ওড়নার ধারে।তবে,আবারও জলে আবৃত হচ্ছে গাল খানা।নিজেকে শান্ত করে তাহুরা।ঘোলা দৃষ্টিতে জানালার বাহিরে অবলোকন করে।তীব্র বাতাসে গাছ হেলে যাচ্ছে রাস্তার পাশের।বৃষ্টির প্রকোপে আশেপাশে ঘোলা।হঠাৎ এহেন তুফান কেনো এলো?মুহূর্তে পরিবেশ উত্তাল করে বজ্রপাত।তীব্র শব্দে আলোড়িত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।যানজট নিরসন হলো কিছুটা।তবে,আকাশের পরিস্থিতি ঠিক নয়।যেনো বিশাল তুফান তাণ্ডব চালাবে।

বজ্রপাতের শব্দে তাহুরা এক হাতে কান চাপে।
পরক্ষণে খেয়াল করে তার কোমরে শক্ত হাতের আক্রমণ।কয়েক সেকেন্ডের ব্যাবধানে উমাইর তাকে লেপ্টে ধরে নিজ অবয়বে।তাহুরার বুকের উঠানামার গতির বেগ বাড়ে।অনুভব করে উমাইরের হাতের শীতল স্পর্শ।তাহুরা উমাইরের শার্টের অংশ খিঁচে ধরে।পূর্বের টপিকে কথা বলতে নিলে,উমাইর তাকে ধমক দেয় মৃদু সুরে,

–“চুপ করে বসো।”
তাহুরার অন্তর পুড়ে।মলিন হয়ে আসে ভাষা।মৃদু সুরে আওড়ায়,
–“সরি।”
বজ্রপাতের শব্দের সহিত ফের কাঁপন ধরে তাহুরার তনুয়।আজ বের না হওয়াটা উত্তম ছিলো।এহেন ঝড় এই মুহূর্তে কাম্য নয়।অনেকটা পথ বাকি এখনো।উমাইর শর্টকাট রাস্তার দিকে গাড়ি ফেরায়।মেইন রোডে যাওয়ার সম্ভবনা নেই। শর্ট কাট মূলত আবাসিক এলাকার অলিগলি। সেথায়ও বড্ড ট্র্যাফিক।আচমকা তুফানে সবাই আলোড়িত।এক পর্যায়ে তীব্র যানজটের উত্তোলন।গাড়ি এগোয় না।বৃষ্টি থামে না।

গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে উমাইর।বুকের লেপ্টে থাকা প্রেয়সীর মাথায় হাত বুলায়।মেয়েটা ঘুমিয়ে।ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা।তাহুরার মোবাইল বাজে।উমাইর দ্রুত তার কোল হতে মোবাইল তুলে।মুন্সীর নাম্বার হতে ফোন।লোকটা এতো অস্থির! উমাইরের উপর কি ভরসা নেই?
উমাইর ফোন রিসিভ করে।তার শব্দ শুনে মুন্সী ভরকে যায়।বিনিময়ে উমাইর বলে,

–“আঙ্কেল,আপনার মেয়ে যেমন আপনার কাছে দামী তেমন আমার কাছে অমূল্য রত্ন।আমি বেঁচে থাকতে ওর ক্ষতি হওয়ার প্রশ্ন আসবে না।পৌঁছে যাবো জ্যাম ছুটলে।চিন্তা করবেন না।”
তাহুরাকে উমাইর তার উরুতে শোয়ায়।ওড়না ছড়িয়ে দেয় দেহের উপরিভাগে।লম্বা হাতে তার পা জোড়া সিটে তুলে দেয়।ঝুঁকে অধরে অধর ছোঁয়ায়,

–“মুন্সী আঙ্কেল এতো বাড়াবাড়ি করলো কেনো?আমার বউকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে আবার।বউ ছাড়া থাকতে কষ্ট হয় মুন্সী আঙ্কেল কেনো বুঝে না!তোমার নাক উচুঁ বাপকে যদি বিয়ের কথাটা বলতে পারতাম এখনই!”
তাহুরা ঘুমের ঘোরে নড়ে।একপাশ ফিরে উমাইরের অবয়বে মুখ গুঁজে।

পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে বহুক্ষণ।বৃষ্টির বেগ বুলেটের গতিতে ছুটছে।গাড়ি তাহুরাদের উঠোনে যখন থামে তখন রাত একটা।চট্টগ্রামের বহু জায়গায় এখন পানিতে টইটুম্বুর।বাতাসের গতি অস্বাভাবিক।তাহুরা সজাগ।উমাইর তাকে ডেকে তুলেছিল গলির মুখে আসার পর।
মুন্সী ছাতা নিয়ে মেয়েকে ভেতরে নেয়।উমাইর বৃষ্টিতেই নেমে পড়ে।মুন্সী ফিরে বলে,

–“আমি আসছিলাম তোমাকে নিতে।”
–“কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ছাতার দরকার নেই আঙ্কেল।”
উমাইর জবাব দেয়।তাহুরার লাগেজ রাখলে মেঝেতে শিউলি এসে নিয়ে যায় আলগোছে।যাওয়া অবস্থায় ভদ্রমহিলা জানায়,

–“বাবা ভেতরে বসো।”
তাহুরা দাঁড়িয়ে।বাবা প্রথমে বাড়ির অভ্যন্তরে যায়।তাহুরা উমাইরকে প্রশ্ন করে,
–“ফ্রেশ হবেন না?”
–“মুন্সী আংকেলের সাথে কথা বলে আমি চলে যাবো।”

বলে উঠে উমাইর।মেয়েটাকে বিদায় দিতে হবে ভাবলে অন্তরে হরতাল নামে। কাঁধে তুলে মেয়েটাকে নিজের রুমে বন্ধী করার ফন্দি আঁটে মন।ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার পর বুকে টেনে শান্তির ঘুমে মগ্ন হতে আহ্বান করে হৃদয়।
তাহুরার জবাবের আশায় না থেকে সে সোজা বসার ঘরে পৌঁছায়।মুন্সী সোফায় বসে অপেক্ষায় ছিলো উমাইরের।প্রাথমিক কুশল বিনিময় শেষে উমাইর সরাসরি মুন্সীকে প্রশ্ন করে,

–“মা খুব করে চাচ্ছিলো তাহুরা আরো কিছুদিন থাকুক। ভাবীও বলছিলো ঘুরতে যাবে কাপ্তাই।এমন সময়ে আপনি ওকে পাঠাতে বললেন,তাও খুব দ্রুত।এর পিছে কারণ আছে নিশ্চয়?”
মুন্সী সোফায় গা হেলিয়ে বসে।মাথার টুপি খুলে টেবিলে রাখে,
–“আসলে কি উমাইর,আমার কিছু আত্মীয় আছে যারা তাহুরার তোমাদের বাড়ি যাওয়া পছন্দ করে না।”
–“আমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে,উনারা তা জানে?”

–“জানে।আজ তোমাদের একসঙ্গে দেখে তারা এইখানে এসে খুব মন্দ কথা শুনিয়েছে।তাই আমি জরুরী তলবে আমার মেয়েকে ডেকে পাঠিয়েছি।ফুলের মতো মেয়ে আমার।কেউ এক অক্ষর বাজে বললে আমার সহ্য হয় না।”
মুন্সী মেয়ের প্রতি নিজের সকল অনুভূতির জানান দেয়।

–“আপনার মেয়েকে কেউ কিছু বললে কি,দেখলেও আমার অশান্তি হয় আঙ্কেল।আপনাকে যখন মানুষগুলো কথা শুনাচ্ছিলো,আমাকে একটা ফোন করতেন।কে কি বললো,তাতে কি যায় আসে আঙ্কেল?মেয়েটা তো বোনের বাড়ি যেতেই পারে। তাই বলে অন্যরা কথা শুনাবে?আঙ্কেল আমার মতে,বিয়ের তারিখ আগানো উচিত।যেহুতু,আমাদের বিয়ে ঠিক করাই আছে,আমি তাহুরাকে দ্রুত আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে চাই আমার বউ হিসেবে।হোক সেটা আগামী মাসে।”

উমাইর ফটাফট নিজের সিদ্ধান্ত জানায়।এমন সিদ্ধান্ত সে গাড়িতে বসে এঁকেছে। বোকা মেয়েটাকে ছাড়া সে অচল।আর এখন মুন্সী হতে ঘটনা শুনে এক মুহূর্ত মেয়েটাকে এই বাড়িতে রাখার ইচ্ছে নেই তার।যদি পারতো সঙ্গে নিয়ে যেতো।
উমাইরের কথাটা মন্দ লাগেনি মুন্সীর।বিয়ে যেহুতু ঠিক করা আছে,তাহলে মেয়েকে উঠিয়ে দেওয়া যায় নিভৃতে। পাছে তখন কেউ মেয়ের ব্যাপারে কিছুটি বলবে না।মুন্সী দাড়িতে হাত ঘষে।মুচকি হেসে জানায়,

–“তোমার মতামত শুনে আমার মেয়ের জন্যে শান্তি পাচ্ছি আমি।ভেবেছিলাম কিভাবে বলি মেয়েকে তোমাদের বাড়ি জলদি তুলে নেওয়ার কথাটা।কিন্তু,তুমি আমার ভাবনা সহজ করলে।তোমার বাড়ির সকলে মানবে?”
–“আঙ্কেল,আপনি কোনো টেনশন করবেন না।আমার বাড়িতে আমি যা বলবো,সেটা মেনে নিবে।তবে অনুরোধ রইলো,খরচের ব্যাপারে ভাববেন না।আমি বিয়ের খরচটা সামলে নিবো।”
উমাইর জানায়।

তবে মুন্সী রাজি নয়।ভদ্রলোক দুই হাত এক করে অসহায় ভঙ্গিমায় উত্তর দেয়,
–“দেখো বাবা,আমার বড় মেয়ের বিয়েতে যা করেছো তোমরা আমি সেটার ঋণ শোধ করতে পারবো না কখনো।জানি সেটা তোমাদের ভালোবাসা তাও আমাকে আর লজ্জিত করো না।তাহুরার বিয়েটা আমি আমার বাড়িতে ছোট পরিসরে করবো।অল্প সংখ্যক আত্মীয় থাকবে।তুমি তোমার অনুষ্ঠান বড় করে করো,তাতে আপত্তি নেই বাবা।আমি যতটুক পারবো তোমাদের অ্যাপায়ন করে নিবো।”

উমাইর দ্রুত উঠে।মুন্সীর হাতের উপর হাত রাখে,
–“আঙ্কেল,বুঝেছি আমি।এইভাবে বলবেন না।হাত জোড় করবেন না আমার সামনে।আপনি আমার বাবার সমতুল্য।আপনার মেয়েকে আমি খুব ভালোবাসি।আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।আমরা ক্লাবে অনুষ্ঠান করলেও আপনার বাড়িতে কেবল কাছের আত্মীয় নিয়ে আসবো,আপনার আদরের মেয়েকে আমার বাড়ি নিয়ে যাবো।এরপর থেকে আপনার মেয়েকে কেউ খারাপ কিছু বলার পূর্বে আমার উপর দিয়ে তাদের যেতে হবে।”

মুচকি হাসে উমাইর।অথচ ভেতরে ক্রোধে উন্মত্ত।তার বউয়ের ব্যাপারে মন্দ কথা তার সহ্যের বাহিরে।বাসায় বলবে অনুষ্ঠান যেনো এই মাসেই করা হয়।দরকার হলে আগামী সপ্তাহে।প্রয়োজন পড়লে আগামী মাসে অনুষ্ঠান না করার জন্যে বাবাকে ঢাকায় পাঠানোর নাটক করবে।আগামী সপ্তাহে বউকে নিজের ঘরে তুলবে উমাইর।
–“তোমাকে বেশ বিশ্বাস করি বাবা।”

মুন্সী খুশি হয়ে বলে।
–“বিশ্বাসটা আমি রক্ষা করবো আঙ্কেল।চিন্তা করবেন না।”
উমাইর বেরুনোর প্রস্তুতি নেয়।বিদায় জানাতে গেলে বিরোধ করে মুন্সী,
–“বাহিরে বেশ ঝড়।এখন যাওয়া নিরাপদ নয়।”
উমাইর জানালার আড়ালে বাহিরে দেখে।তীব্র বাতাসের সাথে ঝড়ের উত্তাল হামলা।বেরুনো এখন ঝুঁকিপূর্ণ।এরমাঝে শিউলি আসে।অনুরোধের সুরে আর্জি জানায়,

–“উমাইর,খেতে আসবে।আসো বাবা।”
–“আন্টি না,খাবো না।আমি কিছুক্ষণ বসি। ঝড় কমলে চলে যাবো।”
উমাইর জানায়।নজর খুঁজে প্রিয়তমাকে।মেয়েটা কোথায়?ফেরার পূর্বে মেয়েটাকে দেখা অনিবার্য।
–“কি বলছো?যাওয়া চলবে না এই ঝড়ে। খাবে আসো।তাহুরা খাবার গরম করছে।”
–“আন্টি বৃষ্টি থামা অব্দি অপেক্ষা করবো আমি।তবে,থাকবো না।”
উমাইর বলে।

–“যেমন সুবিধা হয় তোমার তেমন করো।কিন্তু,বৃষ্টি না কমলে যাবে না দয়া করে।সবার পূর্বে নিজেদের নিরাপত্তা।আমি ঘুমোতে যাচ্ছি।শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।তুমি খেয়ে নিবে।আর দরকার হলে থাকবে এই বাড়িতে।”
মুন্সী নিজ কথা শেষে উঠতে নিলে উমাইর বলে উঠে,
–“আঙ্কেল তাহুরা আমার বাসায় থাকলে সমস্যা হচ্ছে আপনার আত্মীয়দের,আমি এই বাড়িতে থাকলে কি না কি বলে বেড়ায়।আমি আমার নামে অপবাদ সহ্য করলেও আপনার মেয়ের ব্যাপারে কোনো অপবাদ সহ্য করবো না।ভুলে যাবো তখন,উনারা আপনাদের আত্মীয় হয়।”

ক্রোধ কিছুটা প্রকাশ করে উমাইর।
–“আপনি ঘুমাতে যান। তুফানের মাঝে উমাইরকে যেতে দিবো না আমি।আপনার কোন আত্মীয় কি বলে আমার মেয়ের জামাইকে নিয়ে সেটা আমি এখন দেখে নিবো।আমি চুপ থাকবো না আর।”
শিউলি তেতিয়ে উঠে।উদ্দেশ্য উমাইর যেনো কিছুটা শান্ত হয়।মেয়েটা তো তাকে জানিয়েছে উমাইর ঘটনা না জেনেও কেমন ক্ষুব্ধ হয়েছিল।আর এখনের বক্তব্য শুনে শিউলি সব বুঝে। পরিস্থিতি সামলানো তার দায়িত্বে।
মুন্সী আরো কিছু কথা বলে উমাইরের সহিত।অতঃপর ঘুমাতে যায়।

উমাইরের পকেটে ভাইব্রেট হয় মোবাইল।মা ফোন করেছে।সে কথা বলে শিউলিকে দেয় মোবাইল।মা কথা বলবে জানিয়েছে।মেঘলা বেশ অনুরোধ করে এমন ঝড়ে যেনো উমাইরকে না ছাড়ে।শিউলি বুঝে নেয় সব।উমাইর যে কিছুটা জেদী স্বভাবের সেটা আয়ত্বে আসে তার।এই ছেলেকে কেউ আটকাতে না পারলেও তার সরল মেয়ে ঠিক পারবে।শিউলি তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়,এই দুইজনকে একা ছাড়তে হবে।

শিউলি মোবাইল ফেরত দিয়ে অন্য কক্ষে যায়।উমাইর জুতা খুলে বসে।বাহিরে বারংবার দৃষ্টি মেলে, বৃষ্টি কমছে না।মিনিট পাঁচেক পর তাহুরার আগমন।মেয়েটা তার ঘরোয়া কাপড় পড়নে।সুতির কামিজ পড়েছে। চিহ্ন ঢাকতে এখনো ঘোমটা দেওয়ানো।

–“খেতে আসুন।এরপর চা দিবো।মাথা ধরেছে তাই না?চোখ লাল দেখাচ্ছে আপনার।”
–“নাটক করছো কেনো?হ্যাঁ?তোমাকে ঘটনা জিজ্ঞাসা করেছিলাম,তখন কিছু বলোনি।কোন ভাই তোমার?কোন আত্মীয়?তোমার বাবা সংকোচ করে আত্মীয়ের নাম বলেনি।কিন্তু,তুমি বলো।বলো!”
শেষের বাক্যে ধমকে উঠে উমাইর।তাহুরা দু কদম পেছায়।বৃষ্টির শব্দের সহিত উমাইরের শব্দ পাল্লা দেয়।বাহিরে শব্দ পৌঁছায় না।তাহুরা মাথা তুলে তাকায়।সোফায় বসা উমাইর বেশ কঠোর।
দাঁত দ্বারা ঠোঁট কেটে জবাব দেয়,

–“চাচাতো ভাই।”
–“এদেরকে কখনো দেখলাম না।আর এরা কথা রটায়?”
–“সম্পর্ক নেই উনাদের সাথে।তাও..”
–“আমি ফ্রেশ হবো।”
উমাইর তাহুরাকে থামিয়ে দেয়।বাড়তি কাহিনী শোনার ইচ্ছে নেই।তার বউয়ের উপর শেষবার নজর দিয়েছে।পরেরবার এমন কিছু হলে বাড়ি গিয়ে চোখ উপড়ে ফেলবে উমাইর।

খাওয়ার পর্বের মাঝে শিউলি শরীর খারাপের বাহানা দেয়।তাহুরা আলগোছে মাকে শুতে বলে।বাকি সব কাজ সে সারবে জানায়।শিউলি অবশ্য তাহুরাকে কক্ষে ডাকে,জানিয়ে দেয় সে যেনো উমাইরকে বাড়ি ফিরতে বারণ করে ঝড়ের রাতে।মেঘলা বেশ অনুরোধ করে জানিয়েছে।এছাড়াও এমন ঝড়ে বেরুনো বড্ড অনিরাপদ।
মায়ের ইঙ্গিত বুঝতে পেয়ে বিপাকে পড়ে তাহুরা।মা তাকে উমাইরের সাথে থাকার অনুমতি দিচ্ছে অবলীলায়।তবে,বাবা যদি জানে?অনর্থ হয়ে যাবে।মাকে কিছু বললো না তাহুরা।আপাতত ভাবনা তার প্রাণের মানুষটিকে কিভাবে আটকে রাখবে।লোকটা কেমন জেদী হয়ে যায় হুট করে।

খাবার টেবিলের সকল কিছু তাহুরা একা হাতে সামলাতে নিলে দেখে উমাইর প্লেট, বাটি রান্নাঘরে এনে রাখছে।তাহুরা উমাইরের হাত ধরে আটকায়,
–“আল্লাহ্,আপনি করছেন কেনো?আমি কাজ শেষ করতে বেশিক্ষণ লাগবে না।”
–“আমার ইচ্ছা।”
উমাইর হাত ছাড়িয়ে নেয়।
তাহুরা তার পিছু যায়,অনুরোধের সুরে বলে,

–“প্লিজ আপনি বসুন।আমি চা দিচ্ছি।এরপর মাথা ম্যাসাজ করে দিবো।খুব ব্যথা করছে?”
–“আমার কেনো মাথা ব্যথা করবে?আমি তোমার মতো দুর্বল?বাসায় আসছো অব্দি কাজ করে যাচ্ছো।তুমি টায়ার্ড,আমি বুঝছি।কথা কম বলো।”
উমাইর আবারও কথা শুনিয়ে দিলো তাহুরাকে।নজর আটকে থাকে তাহুরার প্রিয়তমের পানে।আধ ভেজা শার্ট অনেক আগেই শুকিয়েছে।
দেখা গেলো তাহুরা কেবল প্লেট, বাটি ধুয়েছে আর বাকিটা উমাইর করলো।
কোনো বাক্য বিনিময় ছাড়া উমাইর বসার ঘরে জুতা পড়তে নিলে তাহুরা অবাক হয়।কাছাকাছি গিয়ে শুধায়,

–“তীব্র বৃষ্টিতে কোথায় যাচ্ছেন?আমি যেতে দিবো না আপনাকে।”
–“কি সমস্যা তোমার?সমস্যা কি?চলে এসেছো না আমার বাসা থেকে?আমি তাহলে কেনো থাকবো?”
উমাইরের কঠোরতায় নরম মেয়েটা ফুঁপিয়ে উঠে।
হাঁটু গেড়ে সম্মুখে বসে। উমাইরের গালে হাত রাখে,
–“সরি তো।আপনি জানেন আমি সবকিছু নিয়ে বাড়তি ভেবে ফেলি।তাই তখন বলিনি কিছু।”
–“বাড়তি ভাবতে আমি বলেছি?দেখি সরো। হাত সরাও।”

উমাইর উঠে দাঁড়ায়।যাওয়াটা দরকার। ঝড় হোক,যায় হোক,মেয়েটার সন্নিধ্যে থাকলে অনুভূতিদের সামলানো দায়।
–“আন্টির পাশে গিয়ে চুপচাপ ঘুমাও।আমি বাচ্চা নই যে,এই বৃষ্টিতে যেতে পারবো না।”
মেয়েটার পানে ফিরে উমাইর।মাথার ঘোমটা নেই।চুলগুলো খোঁপা করা।গলায় দৃশ্যমান তার দাঁতের স্পর্শ।নাকটা রক্তিম।অসহায় ভঙ্গিতে চেয়ে রইলো।নিজেকে সামলালো উমাইর।নরম সুরে বলে,
–“কাঁদবে তো,একদম ফোন করবো না।গিয়ে ঘুমাও।”

উমাইর শার্টে টান অনুভব করে।অতঃপর পেছনে লেপ্টে থাকা প্রেয়সীর অবয়বে দিশেহারা হয় সে।তাহুরা পেছন হতে জড়িয়ে ধরে তাকে।এলোমেলো বাক্যে আর্জি জানায়,
–“যাবেন না প্লিজ।খুব রিস্ক, এমন ঝড়ে বেরুনো।শুনুন না…”
–“জান,হয়েছে তো।থামো।আচ্ছা যাচ্ছি না।দেখি।এই মেয়ে।”
উমাইর তাহুরাকে জড়িয়ে ধরে।মিশিয়ে নেয় নিজ বক্ষ পিঞ্জিরায়।

–“সরি,উমাইর।আমি এরপর থেকে সবসময়…আপনাকে সব জানা…জানাবো।”
–“আচ্ছা,জান। কাঁদে না।”
উমাইর তার মাথার তালুতে অধর স্পর্শ করে।
তাহুরা রুমের সবকিছু ঠিক করে।উমাইর তার শার্ট খুলে।কারেন্ট নেই বেশ কিছুক্ষণ হলো।ঝড়ের মাঝেও ভ্যাপসা গরম।বাহির হতে বাতাসের,ঝড়ের শব্দ স্পষ্ট।চার্জ লাইটের আলো নিভু নিভু।মা হয়তো চার্জ দিতে ভুলেছে।উমাইর মেঝেতে বসে অপলক চেয়ে রয় তাহুরার পানে।মেয়েটা বিছানায় নতুন চাদর বিছিয়েছে।বালিশে কভার দিচ্ছে নতুন।চুলে এখন লম্বাটে বেণী করেছে সে।যা একবার একপাশ,তো আরেকবার অপর পাশে হেলে দুলে খেলছে।

–“এই যে,আসুন।বিছানা রেডি।”
অমায়িক হাসে তাহুরা।
উমাইর উঠে।কাছাকাছি গিয়ে থেমে যায়।নজরে আটকে যায় নিষিদ্ধ অবয়ব।গরমের চেয়েও প্রেমের উত্তাপে উত্তাল সে।
তাহুরা ওড়না নেয়। উমাইরের শরীর মুছে বলে,
–“খুব গরম তাই না?আমি বাতাস করছি।”
তাহুরা নামতে গেলে উমাইর বাঁধ সাধে।কাছে টেনে নেয় মেয়েটাকে,
–“তুমি কাছে থাকলে, এসিতেও আমার গরম লাগে জান।”

উমাইর অধর বসায় বুকের মধ্যিখানে।তাহুরা ঘাবড়ে । উমাইরের ঘাড়ে হাত রাখলে,উমাইর নেশাক্ত সুরে আওড়ায়,
–“আমাকে থাকতে বলে,নিজের কষ্ট বাড়িয়েছো জান।”
অতঃপর উমাইরের হাতের স্পর্শে কাবু হয় তাহুরা। বক্ষদেশের পীড়ায় আর্তনাদ করে মৃদু। উমাইরের চুলের গভীরতায় আঙুল বুলায়,
–“এই যে,শুনুন।একটু শান্ত হোন।”
–“এখন শান্ত হলে আমি শেষ হয়ে যাবো জান।আই ওয়ান্ট ইউ।”
উমাইর তাহুরার দৃষ্টির গভীরতায় হারায়।অধরের ছোঁয়ায় কাবু করে তাহুরাকে।আলগোছে বউকে জানায়,
–“ভালোবাসি,বউ।”

কয়েকদিনে বৃষ্টির প্রকোপ কমলে উমাইরের পরিকল্পনা অনুযায়ী জয় জানালো তার আগামী মাসে ঢাকায় যেতে হবে।অতঃপর দুই পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়,আগামী সপ্তাহে উমাইর,তাহুরার বিয়ের অনুষ্ঠান করা হবে।তাহুরা যানপরনাই অবাক।লোকটা তাকে বললো না কিছু।অথচ সেদিন কিনা বিয়ের কথা বলে গেলো।সেই যে বৃষ্টির রাতে দেখা মিলেছিলো লোকটার আর খবর নেই।কেবল ফোনে কথা বলে রাতে।কলেজে ব্যস্ত থাকে বেশ।
বহুদিন পর তাহুরা আজ কলেজ যাবে।উমাইর বিকাশে টাকা পাঠিয়েছে।এও জানিয়েছে ক্লাস শেষে অফিসে তার সহিত দেখা করতে।

ফুরফুরে মেজাজে তাহুরা তৈরি হয়ে কলেজে যায়।চারিদিকে ছিপছিপে ভাব।বৃষ্টি কমলেও কাদা কমেনি অনেকটা।পরিবেশ বেশ সতেজ।সিএনজি দ্বারা দ্রুত পৌঁছায় সে কলেজে।ক্লাসে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর পিয়ন এসে বলে তাহুরার নাম। ডাক পড়ে তার ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকার নিকট।

তাহুরা চিন্তিত।সে কোনো স্যা র কিংবা ম্যামের সাথে অতটা সখ্যতা দেখায় না।তাহলে তাকে ডাকার কারণ?ধীর পায়ে সে এক তলায় পৌঁছে।ম্যামের নাম দেখে দরজায় টোকা দেয়।ম্যাম অনুমতি দিলে ভেতরে যায় সে।
মহিলা যেনো পূর্ব হতে ক্ষেপে ছিলো।তাহুরা ঢুকলে তাকে ধমকে উঠে,

–“উমাইরের বিয়ে ঠিক করা আছে,এটা তুমি জানো?তুমি উনার রিলেটিভ,অবশ্যই জানার কথা।”
–“জ্বী,ম্যাম।”
তাহুরা ফটাফট জবাব দেয়।
ম্যাডামের এমন রণমূর্তি দেখে সে নিজের ভাষা হারাচ্ছে।কেনো এমন রেগে ম্যাডাম?
–“নাম কি মেয়ের?কি করে?”
ম্যাডাম বেশ তেড়ে উঠে।
তাহুরা উমাইরের বলা পূর্বের কথা ভেবে সাহস করে কিছুটা।ভাঙ্গা গলায় বলে,

–“আমি।”
–“ওহ মাই গড! ওহ মাই গড!তুমি? উমাইরের ফিয়ন্সি তুমি?”
ম্যাডাম উঠে চেয়ার হতে।তাহুরা হাতে হাত ঘষে।ক্রোধে ফুঁসতে থাকা মহিলা তাহুরার হিজাব টেনে ধরে,
–“রূপের বাহানে ফাঁসিয়েছো তাই না?সেজন্যে উমাইর আমাকে ইগনোর করে,বলেছে তার বিয়ে সামনে।তুমি এই বিয়েতে মানা করে দিবে।নাহলে এমন অপবাদ লাগাবো তোমার নামে,উমাইর তোমার চেহারা দেখতেও ঘৃণা করবে।”

–“ম্যাম…ম্যাম আপনি…”
তাহুরার গাল চেপে ধরে ম্যাডাম,
–“বিয়েতে মানা করবি নাহলে তোর ইজ্জত আমি শেষ করবো।”
কি জঘন্য ভাবনা।কলেজের শিক্ষিকা হয়ে ক্রোধের কাছে হার মানলো?ছাত্রীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হারিয়েছে ক্রোধের কারণে।ম্যাডাম চলে যায় কক্ষ হতে।তাহুরা হিজাব টানে।ভাবছে কি থেকে কি হলো?ম্যাডাম যা বলছে সেটা বিষাক্ত।উমাইর কেনো তাকে কিছু বলে না?আগে থেকে জানলে এই ম্যাডামের সাথে দেখা করার জন্যে ভুলেও আসতো না।

তাহুরা উমাইরকে ফোন করে।কেবিনে চেক করেছিলো কিন্তু সে নেই।মাথায় তার হাজারো চিন্তা।ম্যাডাম বলেছে তাকে অপবাদ দিবে যেনো উমাইর তার চেহারাও না দেখে!এমন হলে তাহুরা বাঁচবে না।লোকটা যে তার দুনিয়া।তাহুরা কেঁদে অস্থির।উমাইর ফোন তুলছে না।তাহুরা নিজের কান্নামুখ লুকানোর চেষ্টায়।দ্রুত ছুটে লেডিস কমন রুমের পানে।পথিমধ্যে দেখা হয় উমাইরের সহিত।

আশেপাশে বেশ ছেলে মেয়ে।উমাইর তাকে দেখে থমকে যায়।মাত্রই তাহুরাকে ফোন করতে নিচ্ছিলো সে।
তাহুরা তাকে উপেক্ষা করে সম্মুখে ছুটে।ছাত্রছাত্রীরা দেখলে আবার কি না কি রটায়?তাহুরাকে উমাইর ডাকবে এর পূর্বেই মেয়েটা দৌড়িয়ে চলে যাচ্ছে।বুকে অস্থিরতা তার।তাহুরার এই আঁখির পানি বিষ হতেও বিষাক্ত।উমাইর তার কেবিনে যায়।তার ক্লাস আজ বারোটা হতে।তবে, পূর্বে আসার কারণ হলো প্রশ্ন প্রিন্টের কাজ বাকি।
তাহুরার ফোন বাজছে।মেয়েটা রিসিভ করছে না।অস্থিরতা বাড়ে উমাইরের।প্রশ্ন প্রিন্টের কাজ স্টাফকে বুঝিয়ে দেয় সে।
আবারো ফোন করলে তাহুরা ফোন রিসিভ করে।মুহূর্তে উমাইর চিন্তিত ভঙ্গিতে আওড়ায়,

–“জান?কি হয়েছে তোমার?ঠিক আছো?”
–“আমি কেবিনে আসি?”
তাহুরা চোখ মুছে।সে কেনো কাদঁছে?কোথাকার কোন ম্যাম?উমাইর তার জন্যে সব উজাড় করবে যদি তাহুরার কিচ্ছুটি হয়!
–“হ্যাঁ আসো,জান।দৌড়াবে না।আমি কলে থাকি ততক্ষণ।”
তাহুরা মুখে পানি ছিটিয়ে ফের উমাইরের কক্ষের পানে হাঁটে।ভীত দৃষ্টিতে সেই ম্যামকে খুঁজে।পায়নি তাহুরা। উমাইরের কেবিনের সম্মুখে আসলে বুকটা হালকা হয় তার।দরজায় নক না করেই ভেতরে যায়।উমাইর তারই অপেক্ষায়।বসা হতে উঠে দ্রুত।আগলে নেয় প্রেয়সীকে,

–“কি হয়েছে?”
–“একজন ম্যাম বলেছেন আমি যেনো বিয়েটা ভেঙে দিই।নাহলে আমার নামে অপবাদ করবে।আমি আপনাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো?উমাইর আমার ভয় করছে।”
তাহুরা একদমে সব উগলে দেয়।উমাইরের বুঝতে দেরী হয়নি এর পেছনে দায়ী কে।উমাইর মাথায় হাত বুলায় তাহুরার,
–“থাকতে হবে না আমাকে ছাড়া।আমি সারাজীবনের জন্যে তোমার,জান।”
–“উমাইর স্যার….”

ম্যামের কণ্ঠ বুঝে তাহুরার বেগ পেতে হলো না কে এসেছে।সে ছুটতে চাইলে উমাইরের বাঁধন হতে, উমাইর তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
–“ছি,বিয়ের আগে এমন জড়াজড়ি।এই মেয়ের চরিত্রে সমস্যা আছে স্যার।”
–“আমার বউ আমাকে যতক্ষণ ইচ্ছা জড়িয়ে ধরতে পারবে।আপনি ম্যানারলেস, নাহলে নক না করে কারো কেবিনে ঢুকতেন না।”
উমাইর শক্ত ভাষায় জবাব দেয়।

–“বউ মানে?”
ম্যাম বিশ্বাস করতে অপরাগ।
–“আমার বউ,তাহুরা।সে আপনার স্টুডেন্ট না,আপনার কলিগের ওয়াইফ।তার সাথে ভালো ব্যবহার করবেন।ইনফ্যাক্ট কোনো ব্যবহার করার দরকার নেই।”
উমাইরের কণ্ঠে ক্রোধ।তাহুরা উমাইরের হাত ধরে।তাকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানায়।ম্যাম চলে যেতে নিলে উমাইর তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠে,

–“আমার বউকে অপবাদ দেওয়ার আগে নিজের চরিত্র ঠিক করবেন।পরবর্তীতে আমার বউয়ের ব্যাপারে বা তাকে কিছু বলেছেন শুনলে হ্যারাসমেন্টের কেস ঠুকে দিবো।”
–“না না,স্যার আমার ভুল হয়েছে।”
ম্যাম বেশ বিচলিত।
–“ভুলগুলো যেনো আজ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে।পরেরবার আমি ক্ষমা করবো না।”
হুমকি দেয় উমাইর।
ম্যাম অপমানিত মুখে বেরোয়।দরজা অটো বন্ধ হয়।
উমাইর তাহুরার পানে ঝুঁকে। গম্ভীরতা ভর করে তার মুখশ্রীতে,

–“না কেঁদে কিছু করা বা বলা যায় না?”
–“এসে যায় কান্না।সরি।”
তাহুরা নাক মুছে।
–“বারবার বলি তুমি মাথামোটা শুধু আমার কথায় কাঁদবে।তোমাকে কান্না করানোর অধিকার কেবল আমার।”
উমাইর মাথায় টোকা দেয় তাহুরার।

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৩৪

–“হুহ,বুঝেছি।”
উমাইর হাসে।জড়িয়ে ধরে মেয়েটাকে।চুমুতে ভরিয়ে দেয় গাল,
–“ঘুম হয়না জান তোমাকে ছাড়া।আর কিছুদিন,এরপর থেকে রোজ রাতে আমি তোমার বুকে ঘুমাবো।শান্তির ঘুম হবে আমার।”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় শেষ পর্ব