নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৪

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৪
ইফা আমহৃদ

বাসনা মিটিয়ে আরুকে মা/র/তে ব্যস্ত পারুল। দু-হাত দু-পা মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। ক্রন্দনরত অবস্থায় হাতজোড় করছে আরু। পারুল সেদিকে ভ্রুকুঞ্চন করে তাকাচ্ছে অবধি না। ঈষৎ উষ্ণ অথচ নেভানো চলা কাঠ দিয়ে পে/টা/চ্ছে। সাদা বেনামের চিঠিটা ছুড়ে দিয়ে রূঢ় কণ্ঠে বলে, “সত্যি করে বল ছেলেটা কে? কে তোকে এই চিঠি দিয়েছে? কার সাথে প্রেম চলছে তোর? তোকে স্কুলে পাঠাই এইসব করতে? আজ থেকে তোর স্কুলে যাওয়া বন্ধ। তোর বাবা ফিরুক। ওকে জানাতে হবে, তার মেয়ে এখন প্রেম পিরিতি শিখে গেছে। বিয়ে দিতে হবে।”

“বিশ্বাস করো মা, আমি কোনো ছেলের সাথে কথা বলিনা। তুমি বাবাইকে কিচ্ছু বলো না।” ক্রন্দনধ্বনি শোনা যাচ্ছে কথা বলার সময়।
আরুর ছোট ও একমাত্র ভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আনন্দোচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। বোনকে বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারে না ও। আরুকে হেয় করে বলে, “বুবু আমি নিজে তোর বই থেকে এই কাগজটা পেয়েছি। আমি পড়তে না পারলেও পা ঠিকই পড়তে পারে। তুই মাকে সত্যিটা বলে দে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আরু চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই অয়ন কেঁদে ফেলে, “দেখো মা, বুবু আবার আমাকে চোখ গরম দেখাচ্ছে।”
“অন্যায় করেছি আবার আমার ছেলেকে চোখ রাঙাচ্ছিস। তোকে তো..!” বাক্য শেষ করে আরো কয়েক ঘা দিলেন। অতঃপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘরে চলে গেলেন। শীতের দুপুরের প্রখর রোদে আরু হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রইল।
ফুফুর সাথে দেখা করতে অপূর্ব এসেছে মৃধা বাড়িতে।

উঠোন পেরিয়ে গৃহ প্রবেশ করার পূর্বে শ্রবণ হলো হৃদয়ঙ্গম করা নূপুরের ঝুনঝুন শব্দ। অপূর্ব অভিমুখে তাকাতেই মায়ের লাল শাড়ি পরা একটি মেয়েকে দেখতে পেল। চট করে চিনে ফেলল অপূর্ব। দ্রুতগতির ছুটে গেল আরুর আছে। মাটি থেকে তুলে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে আরু, এভাবে মাটিতে শুয়ে আছিস কেন?”
গলায় কথা দলা পাকিয়ে রয়েছে। হেঁচকি তুলতে তুলতে অপূর্ব-র বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে আরু। অপূর্ব মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলে, “কি হয়েছে আরুপাখি, কাঁদছিস কেন?”

ততক্ষণে উপস্থিত তিয়াস, শেফালী, তুর ও তিস্তা। তিস্তা এগিয়ে গিয়ে বলে, “কী হয়েছে আরু, তোকে হাত পা বেঁধে রেখেছে কে?”

বলতে বলতে বাঁধন খুলে দিল তিস্তা। প্রখর রোদে ফর্সা ধবধবে আরুর শরীর লালচে হয়ে গেছে। আচ্ছা আরুর কি এনিমিয়া আছে? এনিমিয়া ছাড়া এতটা ফর্সা গ্ৰামের মেয়ে, আদৌ সম্ভব! আরুকে জিজ্ঞেস করার স্পৃহা জন্মালো অপূর্ব-র। প্রশ্ন করাটা কি ঠিক হবে? কিছুটা ‘কাই মিল-গায়া’ সিনেমার পরিচালক-কে সাংবাদিকের করা প্রশ্নের মতো মনে হবে। সিনেমা সংক্রান্ত প্রশ্ন না-করে তিনি বোধহয় করেছিল, ‘আপনার ছেলে আপনার মতো টাক হলে কী করবেন।’ তেমন!
পারুল ঘরে থেকে বেরিয়ে এলো। দূর থেকে চিৎকার করে বলে উঠে, “খবরদার ওকে ধরবি না, ওর বাবা এসে ধরবে।”
আরু তখনও অপূর্বর বুকে মাথা রেখে আছে। দ্রুত সে আরুকে কোলে নিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে, “নিজের মেয়েকে কেউ এভাবে মা/রে ফুফি। তোমার সাথে দেখা করতে এসে, যা দেখলাম।”

মেয়ের যাতনায় এতক্ষণ বোধহীন ছিলেন পারুল। অপূর্বকে দেখে কিছুটা প্রশান্তি পেলেন। বিলম্বে তার নিষ্ঠুর ভাব গুছিয়ে অনুদ্ধত ভাব প্রকাশ পেল। হাসি মুখে বলে, “অপু তুই, কেমন আছিস বাবা?”
পারুলকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করে অপূর্ব। বেতের সোফায় আরু-কে বসিয়ে তিস্তাকে আদেশ দিল, “দ্রুত যা, এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়। (তুরকে বলে) তাড়াতাড়ি ফ্যানটা চালু কর।”

সৌরবিদ্যুচ্চালিত পাখা ঘূর্ণ্যমান হতে যতটুকু সময় লাগে অপূর্ব সেই সামান্য সময় টুকুও অপেক্ষা করল না, টিনের বেড়ার ফাঁকে গেঁথে রাখা হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে শুরু করল। অতঃপর কিছুটা তাচ্ছিল্য করে বলে, “নানিকে কখনো তোমার শরীরে হাত তুলতে দেয়নি বাবা। আর তুমি কি-না তার বোন হয়ে নিজের মেয়েকে উঠানে বেঁধে রেখে এভাবে মা/র/০ছ ফুফি। তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি।”
পারুল বিপরীত সুরে বলে, “তুই জানিস না কী হয়েছে, আরুর বইয়ের মাঝে আমি চিঠি পেয়েছি। এই যেই-সেই চিঠি না, প্রেম পত্র।”

“তো? তাই বলে মেয়েকে মা/র/বে। এমনও তো হতে পারে, ছেলেটা আরুকে পছন্দ করে। কিন্তু আরু করে না। তাই লুকিয়ে বইয়ের ভাঁজে দিয়েছে। তাছাড়াও এটা বয়ঃসন্ধি কাল ফুফু। এই সময়ে মেয়েরা একটু বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আরু যদি প্রেম করত তুমি ওকে বুঝিয়ে বলতে। ও যদি এখন আরেকটু বেপরোয়া হয়ে সেই ছেলেটার সাথে পালিয়ে যায়। তখন কি হবে? সবাই বলবে, মৃধা বাড়ির মেয়ে বা চেয়ারম্যানের ভাগ্নি পালিয়েছে গেছে। তখন শুনতে ভালো লাগবে।”

“ও এমন করবে না।” নতজানু হয়ে বলে পারুল।
“এত বিশ্বাস যখন, তখন আরেকটু বিশ্বাস রাখলে কম পড়তো না। তোমার মা বিশ্বাস বাড়ির মেয়ে কিন্তু, অথচ তার মেয়ের বিশ্বাস নেই।” শেষ বাক্যটা বলতে গিয়ে অপূর্ব একটু হাসল। পারুলের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে অদেখায় নিজের জিন্স পকেটে রেখে দিল।

“আমার ভুল হয়েছে, আর এমন করব না। বস তোরা। প্রথমবার এলি। দেখি কী আছে?” বলেই পারুল তাকের উপর থেকে টিনের জাড় উবুড় করে খই বের করলেন। অতঃপর রান্নাঘরে গেলেন। ধানের ভেতরে সিদ্ধ দিয়ে আমাবলি পিঠা বানিয়েছেন। ট্রে-তে এনে পরিবেশন করলেন তা। আরু তখনও মায়ের ভয়ে জড়সড়ো হয়ে বসে আছে। অপূর্ব একটা পিঠা আরুর হাতে দিয়ে ভাইবোনদের সাথে তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে। আশেপাশে তাকিয়ে বলে, “অয়ন কোথায় ফুফি।”
“খেলতে গেছে।”

মৃধা বাড়ি ফাঁকা। পারুল ব্যতিত সবাই দাওয়াত খেতে গেছে। রাতে ফিরে আসবে, তখন নিজের বাড়িতে যাবে পারুল।
গতকালের সিদ্ধ করা ধান আজ রোদ্দুরে মেলে দিয়েছে পারুল। কাক এসে বসতেই পারুল বলে, “আরু দাঁড়িয়ে না থেকে, ধানে নাড়া দে।”

জড়সড়ো আরু যেন মুক্ত পাখির ন্যায় ছুটে‌ গেল, বিচরণ করল ধানের মাঝে। ছুটে চলার সময় নির্গত হওয়া নূপুরের ঝুনঝুন শব্দে অপূর্ব অস্থির হয়ে উঠে। সৌজন্য হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আমরা আসি। তোমরা তাড়াতাড়ি এসো।”
“আচ্ছা। বিকেলে খেজুরের রস পাড়িয়ে, নিয়ে যাবো।” পারুল বলে। অপূর্ব তিয়াস, তুর, শেফালী ও তিস্তা চলল বাড়ির পথে। ধান মেলার কাজের ইতি করে ,চাল ধুয়ে পুকুর পাড়ে উঠে আরু। অন্তঃকরণে কিছু একটা হানা দিতেই পাতিলটা মাটির উনুনের উপর রেখে দৌড় লাগালো ওদের গমন পথের দিকে।

পায়ে শব্দ শুনে দাঁড়াল সবাই। আরু অতি গোপনে তুরের হাত ধরে কানে-কানে ফিসফিসিয়ে বলে, “প্রয়াস ভাইয়ের চিঠিটা অপূর্ব ভাইয়ের পকেটে। আর হ্যাঁ তোর জন্য মায়ের চলা কাঠের মা/র খেয়েছি। প্রয়াস ভাইকে বলে চানামুঠ খাওয়াস।”
“হু।” বিনা স্বরে।

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৩

“অপূর্ব ‘মেহেরজান’ সিনেমার ক্যাসেড আনতে দিয়েছে। সবাই একসাথে দেখব, চল।” তিস্তা উৎফুল্লতার সাথে বলে।
“না, আমি সিনেমা হলে চার চারবার দেখেছি। তোমরা দেখো। মিঠু ও ‘ওর’ মাকে খড় থেকে ছাড়িয়ে এনেছি ঠিকই কিন্তু ঘাস খেতে দেওয়া হয়নি। ওদের জন্য ঘাস কা/ট/তে যেতে হবে। আমি গেলাম।” আরু আর ফিরে চাইল না। একই গতিতে নূপুরের ছন্দ তুলে এগিয়ে গেছে। অপূর্ব ব্যতিত সবাই গতিশীল হয়েছে। তার কানে এখনো আরুর নূপুরের‌ সেই ঝুনঝুন শব্দ বেজে চলেছে।

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫