নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫৯(২)

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫৯(২)
ইফা আমহৃদ

রান্নার কথা আরুর থাকলেও রান্না করছে অপূর্ব। বিদেশে থাকাকালীন রান্না করে খাইয়েছে নিজের নানা নানিকে। স্ত্রী সন্তানকে রান্না করে খাওয়ানো দায়িত্বের মধ্যে পরে। সলা চিংড়ি মাছে হলুদ মরিচ মিশিয়ে গরম তেলে দিয়ে অপূর্ব বলল, “আজ এমন রান্না করব একদম হাত চেটেপুটে খাবি।”

“আগে রান্না করুন, পরে দেখা যাবে।” পাখির বুকে চাপড় মেরে বলে আরু।
“এতটা তাচ্ছিল্য করিস না। অপূর্ব সবদিক থেকে পারফেক্ট। আগে সাঁতার জানতাম না, এখন সেটাও জানি।” আঁচ নামিয়ে লাউ কা/ট/তে বসল অপূর্ব। মনোযোগী হয়ে এক সমান কাটছে সবগুলো। দেখে মনে হয়, প্রতিটা মেপে মেপে সমান করছে। আরু মাথা ঝাঁকিয়ে মনে মনে বাহবা দিল প্রাণনাথকে। মুখে বলল, “কুঁচো চিংড়ি দিয়ে লাউ রান্না করলে মুখে লেগে থাকবে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ডিম নিয়ে এসেছি। ডিম ভেঙে রান্না করব, দেখিস কত মজা লাগে। বনে জঙ্গলে বন্ধুদের নিয়ে আমি অনেকবার ঘুরতে গিয়েছি। এক জায়গায় তিন-চারবার গিয়েছি। ঘুরতে যাওয়ার সময় ব্যাগে করে বিভিন্ন সবজির বীচ নিয়ে যেতাম। জঙ্গলের মাঝে পুঁতে দিতাম। পরেরবার সেখানে গেলে আমাদের আর খাওয়ার জন্য চিন্তা করতে হতো না। ডিম দিয়ে লাউ খাওয়া শিখেছি মূলত সেখান থেকেই। গাছে ধরা লাউ আর ঘুঘু পাখির ডিম।”

“ঘুঘুর পাখির ডিম কোথায় পেলেন?”
“যে গাছে পাখি ছিল তার পাশেই তাবু টানিয়েছি। তাই পাখিরা উড়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে দুটো ডিম নিয়ে লাউ দিয়ে খেয়েছি।”
“না বলে আপনি ওদের ডিম নিয়েছেন?”
“হ্যাঁ!”

“এখন যদি আপনার থেকে ওরা পাখিকে নিয়ে নেয়। তাহলে আপনার কেমন লাগবে?”
“তাহলে আমার ভারি অন্যায় হয়ে গেল। কী করে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি?”
“আর কখনো ওদের ডিম নিবেন না। ঠিক আছে?”

“মহারানির হুকুম বলে কথা। রাখতেই হয়।” মাথা দুলিয়ে অপূর্ব বলে। বিদ্রুপ মনে করে ভেংচি দিল আরু। তখনই তাদের দিকে এগিয়ে এলো তিন জন মানুষ। এক জন কাঙ্ক্ষিত হলেও দুই জন অনাকাঙ্ক্ষিত। আরু ও অপূর্ব নিজেদের মধ্যে দৃষ্টিতে আদানপ্রদান করে উঠে দাঁড়াল। ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে তিন জনে। ইরফান হাসিমুখে বলল, “স্যার, এরা আপনাদের খোঁজ করছিল। তাই নিয়ে এলাম। তাদের চিনেন?”
ইমদাদ হোসেন ও পারুল চেনা হয়েও অপূর্বর কাছে বড্ড অচেনা। দৃষ্টি সরিয়ে বলল, “না। চিনি না। এদেরকে এখানে কেন এনেছ?”

পারুলের মুখ মলিন হয়ে গেল। অপূর্বর এই প্রতুক্তি অপ্রত্যাশিত ছিল। তবে প্রত্যাশা করা দোষের ছিল না। অপূর্ব তো সেদিন সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। পাখির হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে পারুল এগিয়ে যেতেই আরুর কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে নিল অপূর্ব। পারুল চুপসে গেল বেলুনের মতো। অবিকল ছোটো আরু। সৌজন্য হেসে বলল, “সন্তান হারা এক মায়ের আর্তনাদ তোরা বুঝিসনি। তবে এবার বুঝবি! কারণ তোদেরও সন্তান এসেছে।”

“আপনারা কেন এসেছেন?” অপূর্বর প্রশ্নে ইমদাদ হোসেন বলল, “তোরা বাড়ি ছেড়ে চলে এলি না শুধু, তোর বাবার সম্মান নষ্ট করে এলি। এখন কেউ তোর বাবাকে সম্মান করেনা। আজ নামাজ আদায় করে বাড়িতে ফেরার সময় এক বৃদ্ধ, তার ছেলের নামে নালিশ করেছে ভাইজানের কাছে। আরেকজন ব্যঙ্গ করে বলেছে যে নিজেদের বিচার করতে পারেনা, সে কীভাবে অন্যের বিচার করবে? আর সেটা শুনেই তোর বাবার‌ প্রেপার বেড়ে গেছে। বুকেও ব্যথা বেড়েছে। ভাবি তো পারুলের সাথে হিংস্র আচরণও করছে।”

“তাই আমি তোদের ওই বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে এসেছি। তোদের ওই বাড়িতে রেখে আমি নিজের ঠিকানায় চলে যাবে। নিজের সংসার তো শেষ হতে বসেছে। অন্যের সংসার কীভাবে ভাঙি।” পারুল বলে।
“বাবার এই অবস্থার জন্য একটু হলেও আমি দায়ী। তাই আহসান বাড়িতে আমি যাব। কিন্তু থাকব না। বাবা ঠিক হলেই চলে আসব।” কথাটা বলে উনুনের আগুন নিভিয়ে দিল অপূর্ব। রান্নার সরঞ্জামগুলো বয়ে ঘরে রেখে এলো। কড়ায় দুইটা তালা ঝুলিয়ে ফিরে এলো। আরুর থেকে পাখিকে কোলে নিয়ে বলল, “তোদের দুজনকে এখানে রেখে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না। তোরা আমার সাথে যাবি, আবার আমার সাথেই আসবি।”

অপূর্ব ও আরুর পেছনে পেছনে ইমদাদ ও পারুল হাঁটা দিল। ইরফান বিদায় নিয়ে ঘরমুখো হলো। ভরদুপুর ও বন্ধের দিনের কারণে নির্জন পরিবেশ। তবে রাস্তায় উঠতেই দেখা মিলল কয়েকটা রিকশার। অপূর্ব হাতের ইশারায় রিকশাওয়ালাকে বার্তা পাঠাল। দৃষ্টিগোচরে বার্তা পৌঁছাতে হর্ন বাজাতে বাজাতে রিকশা এলো নিকটে। অপূর্ব স্বাভাবিক থেকে বলল, “চেয়ারম্যান বাড়ি যাব।” পরপর শ্বশুর শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনারা এই রিকশায় যান, আমরা আসছি।”

দ্বিরুক্তি না করে দুজনে রিকশায় চড়ল। খচখচে মন নিয়ে রিকশা গতিশীল হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে ইমদাদ হোসেন বলল, “আরু, ওকে একটু আমাদের সাথে নেই?”
চট করে উত্তরের আশায় আরু তাকাল অপূর্বর দিকে। অনুসরণ করে রিকশাওয়ালা সহ তিন জনেই তাকাল সেদিকে। অপূর্ব ইতস্তত নিয়ে বলল, “তোর বাবাকে চাইলে দিতেই পারিস। তার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তবে সে যাতে অন্য কারো কোলে আমার সন্তানকে না দেয়।”

হাসল আরু। বাবার কোলে কাঁথা সহ মেয়েকে তুলে দিয়ে শান্তি পেল। রিকশাওয়ালা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। অপূর্ব আরুকে সাথে নিয়ে অন্য রিকশার হদিস করার ফাঁকে ডায়াল করল হার্ট বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মগবুল আলম ভূঁইয়াকে। অপূর্ব মনের ডাক্তার, বাবার পরীক্ষা করতে পারলেও চিকিৎসা দিতে পারবেনা। তাই ডাক্তার সাথে নিল।
আহসান বাড়িটা শান্ত হয়ে গেছে। এখানে বাচ্চারা আগের মতো ছেলেমানুষি করেনা।

সবাই সংসার সামলাতে ব্যস্ত। বাড়ির দোরগোড়ায় রিকশা থামল। ইমদাদ হোসেন পাখিকে কোলে নিয়ে নামল রাস্তায়। পারুল তাকিয়ে আছে ঘুমন্ত পাখির মুখে। এক হাতে নাতনিকে ধরে অন্য হাতে পকেট থেকে টাকা বের করতে বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। নাতনিকে স্পর্শ করার লোভ সামলাতে না পেরে পারুল বলল, “আমার কাছে দিয়ে টাকা বের করো।”

“মাথা খা/রা/প আমার! ওরা পেছনে আসছে। তোমার কোলে পাখিকে দেখলে রেগে যাবে। যদি পারো, পকেট থেকে টাকা বের করে ওনাকে দাও।” ইমদাদ হোসেনের কথা পারুল মানল। ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই হোঁচট খেল কাঠের সাথে।

পরিষ্কার রাস্তায় শুকনো একটা কাঠ দেখাই যাচ্ছিল না। পাখির ঘুম ভাঙল। নিজেকে আগন্তুকের কোলে দেখে কান্না শুরু করল। ইমদাদ হোসেন দোলাতে দোলাতে বলেন, “পাখি, আমি তোমার নানাভাই। কাঁদে না সোনা।”
পাখি কেবল কাঁদছে। উদাসীন হলেন ইমদাদ। দোলাতে দোলাতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভিড় তখনও ছিল মোতাহার আহসানের ঘরে। পাখির কান্নার শব্দে তাকাল সেদিক। অনিতা স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

“বাচ্চাকে কার থেকে ধরে আনলে? কাঁদছে কেন?”
“আরুর থেকে ধরে এনেছি।”
“পাখি?” চট করে বলেই অনিতা এগিয়ে গেল। প্রথমবার দর্শন করল নাতনিকে। চোখ থেকে পানি না পরলেও কাঁদতে কাঁদতে রক্তিম নাকের ডগা। কাঁথা সহ পাখিকে কোলে নিয়ে বলল, “সোনা পাখির কী হয়েছে? এভাবে কাঁদছে কেন?”

‘তুর থেকে বুড়া বাবা’ – কেউ বাদ নেই পাখির কান্না থামাতে। তবুও মেয়েটা কাঁদছে। তিস্তা বলল, “আরু তো ছোটোবেলায় শান্তশিষ্ট ছিল। ওর মেয়ে এমন কাঁদুনে কীভাবে হলো? ফুফা আপনি ভুল করে অন্য কারো বাচ্চা নিয়ে আসেননি তো?”
শেফালী বলে, “দেখতে কিন্তু মা-শা-আল্লাহ।”

সুমি শেফালীর পেটে হালকা স্পর্শ করে বলল, “নয় মাস পর তোমারও হবে।”
মোতাহার আহসান আধশোয়া হয়ে বসে বললেন, “মেয়ে তার বাবার মতো হয়েছে। মা না কাঁদলেও বাবার কান্নায় কেউ ঘুমাতে পারেনি। ওকে আমার কোলে দাও। আমার শ্বশুরের মতো বুদ্ধি প্রয়োগ করে কান্না থামানো যায় কিনা দেখি!”

“ওমা! তুমি না অসুস্থ। উঠলে কেন?”
“নাতনি এসেছে। অসুস্থ থাকি কীভাবে। ওকে এদিকে দাও।” হাত বাড়ালেন মোতাহার আহসান। অনিতা কোলে দিলেও বিরতি দিল না কান্নার। অবশেষে শ্বশুরের বুদ্ধি প্রয়োগ করলেন, “অপূর্বর আরুপাখি কোথায়?”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ৫৯

কান্না থামিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকাল পাখি। উপস্থিত সবাই হতবাক, বিস্মিত, চিন্তিত। এই ডাকেই কীভাবে থামল কান্না? পরক্ষণে পটি করে দিল কোলে। অবশেষে কান্না থামার কারণ খুঁজে পাওয়া গেল।

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে শেষ পর্ব